E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬১ বর্ষ ১৫ সংখ্যা / ২৪ নভেম্বর, ২০২৩ / ৭ অগ্রহায়ণ, ১৪৩০

ভারতীয় ক্রীড়ার অবহেলিত রূপ প্রদীপের নিচে অন্ধকার

সুমিত গঙ্গোপাধ্যায়


খেলা নিয়ে জনসাধারণের মনোভাব যাই হোক, কবিরা কিন্তু বেশ ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করতেন। জসীম উদ্দীন বলেছিলেন - ‘খেলা মোদের গান গাওয়া ভাই খেলা লাঙ্গল চষা/ সারাটা দিন খেলতে পারি জানি নেকো বসা’ - আবার রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন ‘আজ খেলা ভাঙার খেলা’।

যাই হোক, জসীম উদ্দীন দৈনন্দিন কাজের মধ্যে যতই খেলা খুঁজে পান, আমাদের সময়ের করপোরেট শক্তি খেলার মধ্যে বিপুল বাজার খুঁজে পেয়েছে। ফলত এই সমাজে খেলা বিষয়টি সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গেছে।

প্রাচীনকাল থেকে পৃথিবীতে খেলা ছিল সময় কাটানোর বস্তু। মধ্যযুগ থেকে খেলা সংক্রান্ত বিষয় বদলাতে শুরু করে। সামগ্রিকভাবে খেলা ছিল সেই সময় সিংহভাগ শিশুদের সময় কাটানোর বিষয়। বড়ো কোনো ঘটনা বা বিষয় উদ্‌যাপন উপলক্ষ্যে প্রাপ্ত বয়স্করা খেলায় অংশগ্রহণ করতেন। সেই সময় খেলার শ্রেণি ও বর্ণ বিভাগও ছিল। সেসব নিয়ে ভবিষ্যতে কখনো আলোচনা হবে।

বর্তমান যুগের যে ক্রীড়া ব্যবস্থা আমরা বাংলা বা ভারত জুড়ে দেখতে পাই, তার সূত্রপাত হলো উনিশ শতকের মধ্যভাগে। প্রাক্-মহাবিদ্রোহ যুগে যে পাশ্চাত্য ক্রীড়ায় ভারতীয় বা বাঙালির কোনো ভূমিকা ছিল না তা নয়, কিন্তু তা এতটাই অকিঞ্চিৎকর যে, সেই বিষয় নিয়ে এখানে বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন নেই। কিন্তু উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে বিষয়টা গেল বদলে।

ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ভারতে প্রবেশ করেছিল (বা বলা ভালো ভিত-শক্ত করেছিল) ভিক্টোরিয়ো যুগের উদারনীতি,যার সঙ্গে পাশ্চাত্য ক্রীড়ার সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে। ফলে নব্যশিক্ষিত পাশ্চাত্যপন্থী বাঙালিসমাজ এই খেলাগুলিকে গ্রহণ করে। একই সঙ্গে ছিল হিন্দু সমাজ যার একটি অংশ যাঁরা তখন ক্ষয়িষ্ণু সামন্ত্রতন্ত্র-র কবলে পড়তে শুরু করেছে। এই দুই ধারার বাঙালিরাই পাশ্চাত্য ক্রীড়ায় অংশগ্রহণ করেন ও তাঁদের চিন্তাভাবনার প্রভাব এই ক্রীড়া ও ক্রীড়া সংগঠনে পড়তে শুরু করে।

একটু অন্যভাবে ভেবে দেখলে একথা অনায়াসে বলা চলে ‘ভদ্রলোক’ সমাজের শিক্ষিতদের কাছে পাশ্চাত্য ক্রীড়া গ্রহণ করা ও ছড়িয়ে দেওয়ার পেছনে কতকগুলি কারণ ছিল। বোরিয়া মজুমদারের (Cricket in colonial India, Routledge, 2008) মতে এই সব খেলাগুলো ছিল শিক্ষিত ভদ্রলোকদের কাছে অহিংস পদ্ধতিতে ব্রিটিশরাজের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামা - সেই সময়ে যখন মূলত ১৮৫৭ সালের পরবর্তী সময় সশস্ত্র আন্দোলনকে আর ছড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছিল না। তাছাড়া ১৮৫০-৭০-এর সময়ে শরীরচর্চা জাতীয় দেশি খেলাগুলিকে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ মার খাওয়ায় ক্রিকেট ও ফুটবলের মতো ইয়োরোপীয় খেলাগুলির প্রতি নজর দেওয়া ছাড়া অন্য কোনো গত্যন্তর ছিল না। এই কারণে বাঙালি ভদ্রলোক সমাজ-মুখাপেক্ষী হয়ে পড়ে দেশি রাজাদের।

তবে মনে রাখতে হবে ভারতে পাশ্চাত্য ক্রীড়া ছড়িয়ে দেওয়ার পিছনে বিদেশি ঔপনিবেশিক শাসকেরও নিজস্ব লক্ষ্য ছিল। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র হাতছাড়া হওয়া (১৭৭৩), উনিশ শতকের প্রথম দিকের চার্টিস্ট আন্দোলনের ফলে বিলেতের শ্রমজীবীদের জীবনযাত্রায় উন্নতি (অতি সামান্য) তাঁদের বাধ্য করেছিল উপনিবেশগুলিতে আরও শোষণ চালাতে। তাছাড়া এই কাজের জন্য কোম্পানিকে (ইস্ট ইন্ডিয়া) উপযুক্ত মনে না করায় ব্রিটিশ রাজতন্ত্র নিজের হাতে ক্ষমতা তুলে নেয় (মহারানির ঘোষণাপত্র ১৮৫৮), ফলে ব্যাপকভাবে পূর্বতন দেশীয় শাসকদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য পাশ্চাত্য ক্রীড়া সেতু হিসেবে পরিগণিত হয়।

এই প্রেক্ষাপটেই কেটে যায় পরবর্তী বেশ কয়েক দশক। সেই যুগের সংবাদপত্রগুলি নজর করলে দেখা যাবে সেখানে সর্বপ্রকার খেলার খবর অত্যন্ত যত্ন করে ও গুরুত্ব সহকারে ছাপানো হতো। এই ধারা বজায় ছিল ১৯৭০-এর দশক অবধি। এরপরেই প্রবল দ্বন্দ্ব শুরু হয় বড়ো ক্রীড়া সংস্থাগুলির মধ্যে। ঠিক যেভাবে প্রচলিত উৎপাদন ব্যবস্থা, উৎপাদনের উদ্দেশ্য ও শাসক শ্রেণি রাষ্ট্রের শ্রেণি চরিত্র নির্ধারণ করে, তেমনই ঘটনা ঘটলো ক্রীড়া জগতের ক্ষেত্রে। জনমানসে গণক্রীড়া (মাস স্পোর্টস)-য় পরিণত হওয়া খেলা বা খেলার মধ্যকার স্তরগুলি পৃষ্ঠপোষকতা পেলো, বাকিগুলো ক্রমাগত অবহেলিত ক্রীড়ায় পর্যবসিত হলো।

প্রকৃতপক্ষে, বর্তমান ভারতে দুই ধরনের খেলা হলো অবহেলিত। প্রথম ধরন হলো দেশীয় খেলা; যার একটি বড়ো অংশই হলো আন্তর্জাতিক ক্রীড়া জগৎ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন অথবা তার আন্তর্জাতিক চরিত্র খুবই দুর্বল বা সীমিত। এর মধ্যে যেগুলি ইনডোর গেমস (যেমন- লুডো, পাশা, বাঘবন্দি) তার মধ্যে কোনো কোনোটা বর্তমানে একপ্রকার ইন্টারনেটের মাধ্যমে জুয়া খেলার মাধ্যম হয়েছে। কোনো কোনো ইনডোর বেশ জনপ্রিয় যেমন দাবা। দাবা মোটেই অবহেলিত নয় এবং এর আন্তর্জাতিক মহল খুবই শক্তিশালী।

দেশীয় খেলার একটা বড়ো অংশই বর্তমানে বিলুপ্ত। বিশেষ করে নব্বইয়ের দশক থেকে ক্রমাগত প্রান্তিক ক্রীড়ায় পরিণত হয়েছে। অথচ, এক দীর্ঘ সময় যাবত এই উপমহাদেশের জনগণের শৈশব ও প্রাক্ কৈশোর অবধি ব্যাপক জনপ্রিয় ও প্রাথমিক শারীরিক সক্ষমতা তৈরিতে এই খেলাগুলির বড়ো ভূমিকা ছিল। যেমন, সাতচারা, গাই গোদানি, লাল লাঠি, দাঁড়িয়া বাঁধা, কানামাছি, গোল্লাচ্ছুট, বিভিন্ন প্রকারের কিতকিত ও গুলি বা মার্বেল খেলা। এদের কোনো কোনোটা বর্তমানে ব্যাপক পাশ্চাত্য প্রভাবিত (যেমন সাত চারা বা পিটটু; এখানে ওয়াইড, নো বল, ওভার প্রভৃতি প্রায় ৩০ বছর যাবত যুক্ত হয়েছে)।

মূলত মুক্ত বাজারের ফলে আধুনিক শরীর চর্চা, পাশ্চাত্য ক্রীড়া পেশাদারি হয়ে যাবার কারণে এই খেলাগুলি থেকে আকর্ষণ চলে গেছে। তাছাড়া মাঠের অপ্রতুলতা, মেয়েদের ক্রমাগত পাশ্চাত্য ক্রীড়ায় অংশগ্রহণ (যার ফলে কড়ি ও কিতকিত বিলুপ্ত) খেলাগুলো অবহেলিত হতে হতে মুছে আসছে। শুধু স্মৃতিচারণামূলক গানে এক্কা দোক্কা খেলার কথা ফিরে আসে।

ভারতে প্রচলিত পাশ্চাত্য ক্রীড়ার মধ্যে তিনটি স্তর দেখা যায়। প্রথম স্তরের অন্তর্গত হলো সেই সব খেলা যা সম্পূর্ণভাবে অবহেলিত। দ্বিতীয় স্তরের অন্তর্গত হলো সেই সব খেলা যা জনপ্রিয়তায় পিছিয়ে, কিন্তু অর্থ ও ভারতীয়দের সাফল্যের দিক থেকে মোটেই পিছিয়ে নেই। তৃতীয় স্তরে আছে সেই সব খেলা যা সর্বাধিক জনপ্রিয়, কিন্তু খেলাটির শুধু ওপরের স্তরটি ব্যাপক সমৃদ্ধ। নিচু ও মাঝারি রীতিমতো সংকটের মধ্য দিয়ে চলে বা লিঙ্গভিত্তিক জনপ্রিয়তায় পুরুষরা এগিয়ে, মহিলাদের শুধু অবহেলা নয়, রীতিমতো অবজ্ঞা করা হয়।

এক্ষেত্রে প্রথমেই মনে আসে হকির কথা। একসময় ভারত হকিতে সেরা ছিল। ১৯২৮ থেকে ১৯৫৬ অবধি টানা অলিম্পিক হকিতে সোনা পাওয়া ভারত প্রথম রূপো পায় ১৯৬০-এ। ১৯৬৪-তে আবার সোনা পেলেও এরপরেই ভারতে হকির পতন শুরু। ১৯৮০ সালে শেষবার সোনা পায় ভারত; তাও বহু দেশ সেই অলিম্পিকে খেলেনি। এরপর টানা সাতবার গ্রুপেই বিদায় নেয় ভারতীয় দল। অবশেষে ২০২২-এ ব্রোঞ্জ পেয়ে কিছুটা আশার সঞ্চার করেছে। দুটি বিষয় ভারতীয় হকির সমস্যা সৃষ্টি করে। এক, সবুজ বিপ্লবের ফলে উত্তর ভারতের বড়ো চাষি পরিবারের সন্তানরা হকির বদলে ক্রিকেটে আগ্রহী হয়; দুই,বিদেশি দলগুলি প্রাক্তন ভারতীয়দের কোচ করলে ভারতীয় স্কিলের সঙ্গে গতি মিশে অন্য দেশগুলি উন্নত হয়ে যায়। এর চূড়ান্ত ফল হলো হকির পতন। এরমধ্যে বিক্ষিপ্ত কিছু ক্ষেত্রে যেমন একবার বিশ্বকাপ (১৯৭৫), তিনবার এশিয়ান গেমস (১৯৬৬, ১৯৯৮, ২০১৪) ও তিনবার এশিয়া কাপ (২০০৩, ২০০৭, ২০১৭) জিতেছে ভারত। এছাড়াও তিনবার এশিয়ান চ্যাম্পিয়নস ট্রফি, পাঁচবার আজলান শাহ্, একবার করে দক্ষিণ এশীয় গেমস, অ্যাফ্রো-এশিয়ান গেমস, হকি সিরিজ, চ্যাম্পিয়নশিপ চ্যালেঞ্জ ও ওয়েস্টার্ন এশিয়াটিক গেমস জিতেছে।

হকিতে সাফল্য থাকলেও একসময়ের ভারতীয় ক্রীড়ার চোখের মণি হকি আজ ক্রিকেট ও ফুটবলের জনপ্রিয়তার কাছে ম্লান। প্রো হকি লিগ চালু করলেও খেলোয়াড়দের অবস্থা ভালো নয়। চাকুরি, জীবন জীবিকা তাঁদের খেলায় চরম প্রভাব ফেলেছে। তার ওপর হকির বোর্ড-এ কার প্রাধান্য থাকবে তাই নিয়ে সমস্যা বড়ো আকারে চলে। প্রাচীন বেটন কাপ আজ প্রায় লোকচক্ষুর আড়ালে চলে গেছে। কলকাতার ময়দানের বড়ো ক্লাবগুলির হকির আকর্ষণ কমিয়েছে। তবে আশার কথা তিন প্রধান আবার আগ্রহ দেখিয়েছে। কিন্তু ভবিষ্যৎ এখনও খুব উজ্জ্বল নয়। না হলে ধনরাজ পিল্লাইয়ের মতো সারাজীবন হকিকে দেওয়া খেলোয়াড় প্রকাশ্যে বলতে পারেন - ‘হকিকে আমি সর্বস্ব দিয়েছি, হকি আমাকে কিছুই দেয়নি।’

সবাই তো কপিল এবং শচীনের নাম জানি, কিন্তু ধ্যানচাঁদ এবং পৃথ্বীপাল সিং সম্পর্কে জানি না। ভাবাই যায়না যে, ভারত ২০০৮ সালে অলিম্পিকের জন্য যোগ্যতা অর্জন করতে ব্যর্থ হয় এবং ২০১২ সালে দ্বাদশ স্থান পায়! কিন্তু কেন?

১৯৭০-এর দশকের গোড়ার দিকে বিশ্বব্যাপী হকি খেলা হতো ঘাসে। পাঞ্জাব, কেরালা এবং গোয়ার মাঠে ভারতীয় খেলোয়াড়রা অপরাজেয় ছিল। শুধুমাত্র পাকিস্তান ছিল বড়ো প্রতিদ্বন্দ্বী। তারপর আন্তর্জাতিক হকি ফেডারেশন আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টের জন্য সিন্থেটিক অ্যাস্ট্রোটার্ফকে বাধ্যতামূলক করে।

১৯৭৬ সালের মন্ট্রিল অলিম্পিক ছিল প্রথম গেম যেখানে অ্যাস্ট্রোটার্ফ হকিতে ব্যবহার করা হয়। প্রথমবারের মতো ব্রোঞ্জ পদকও জিততে পারেনি ভারত। ভারতীয় হকি ফেডারেশনের আপত্তি করা উচিত ছিল, কিন্তু করেনি। এখন সমস্ত অলিম্পিক গেমস অ্যাস্ট্রোটার্ফে খেলা হয়। একে তো দেশে অ্যাস্ট্রোটার্ফ কম, তায় ভারত হকি ঘাসের উপর আন্তর্জাতিকভাবে এক শতাব্দী ধরে খেলে দক্ষ। মূলত ড্রিবল এবং পাসের মাধ্যমে খেলে। অ্যাস্ট্রোটার্ফের প্রযুক্তিগত দক্ষতার ফলে ইয়োরোপীয় এবং অস্ট্রেলিয়ান হকি খেলোয়াড়দের সুবিধা হয়, ফলে অস্ট্রেলিয়া এবং জার্মানি ১৯৮০-এর দশকের পরে এই খেলায় আধিপত্য বিস্তার করে।

তবে অ্যাস্ট্রোটার্ফ শুধু কারণ নয়। কারণ হলো টাকা। ৭০ মিনিটের একটি খেলা যা বুলেট ট্রেনের মতো খুব নিবিড়ভাবে এবং ভয়ঙ্করভাবে দ্রুতগতিতে চলে, সেখানে বিরতি এবং বিজ্ঞাপনের জন্য কোনো সময় নেই বলে প্রচার এবং সংস্থার সঙ্গে তহবিলের অভাব হয়।

শেষ এবং গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো গণমাধ্যম যার মধ্যে ভারতীয় জনগণকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু নিউজ চ্যানেলে খুব কমই হকি খেলার ফলাফল দেখানো হয়। ২০০৯ সালে, ভারত যখন এশিয়া কাপ জিতেছিল এবং পরের দিন খেলার পৃষ্ঠায় গৌতম গম্ভীরের একটি বিশাল ছবি ছাপা হয়, যিনি কেবল হাফ সেঞ্চুরি করেন, অথচ, ২০১৩ সালে হকি ইন্ডিয়া শুরু করে পেশাদার হকি টুর্নামেন্ট। তার প্রচার কোথায়?

এরকমই একটি চরম সংকটে থাকা খেলা হলো হলো সাঁতার। দেশে সুইমিং ক্লাবের কমতি নেই, কিন্তু সাঁতার, ডাইভিং ও পোলো মিলিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রীড়ায় ভারতের মোট মেডেল ১৮। তাতে সোনা চারটে। অথচ নদীমাতৃক দেশ ভারত। শুধু তাই নয় ষাট জনের বেশি ইংলিশ চ্যানেল পেরোলেও আজও ভারতে সাঁতার শুধু স্বাস্থ্য চর্চা ও বুর্জোয়া/পেটি বুর্জোয়া সমাজের বড়ো বড়ো ক্লাবের শোভা বর্ধনকারী অংশ মাত্র।

এমনি একটি অবহেলিত খেলা হলো তীরন্দাজি। যতই পুরান, উপকথা ও মহাকাব্যে অনবদ্য তীরন্দাজদের বর্ণনা থাক, আজ অবধি অলিম্পিকে কোনো পদক নেই। এশিয়ান গেমসে একটি, কমনওয়েলথ গেমসে তিনটি, বিশ্বকাপ ফাইনালে একটি ও বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে তিনটি সোনা পেয়েছে ভারত। দীপিকা কুমারীর ২০২১-এ মেয়েদের মধ্যে বিশ্বে এক নম্বর ও অতনু দাসের ষষ্ঠ স্থানে যাওয়া ছাড়া বলার কিছুই নেই। কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে তীরন্দাজি ভারতের শক্তি হওয়া উচিত ছিল।

যতই মিলখা সিং বা পি টি উষার কথা আসুক, ডোপিং ও অন্যন্য বিতর্কে জড়িয়ে ভারতের ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডের রেকর্ড খুবই দুর্বল। নীরজ চোপড়ার আগে এইক্ষেত্রে এমন অসামান্য দক্ষতা কেউই দেখাননি। কিন্তু অর্থাভাব, উপদলীয় কোন্দল, অনৈতিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা ভারতীয় অ্যাথলেটিকসকে যোজন দূরে ঠেলে দিয়েছে।

নদীমাতৃক দেশ, নৌ পরিবহণের সুদীর্ঘ ইতিহাস সত্ত্বেও রোয়িং ভারতের ক্রীড়া জগতের আরেক দুয়োরানি। আজ অবধি এশিয়ান গেমসে ২টো সোনা, ৫টা রূপো ও ১৬টা ব্রোঞ্জ আছে কেবল ভারতের তালিকায়। অলিম্পিকে প্রথম সুযোগই পেল ২০১২ সালে। অথচ ক্যালকাটা রোয়িং ক্লাবের বয়স ১৬৫ বছর। জাতীয় সংস্থাটি অবশ্য ১৯৭৬ সালে তৈরি।

২০১৮ সালে আন্তর্জাতিক খো খো ফেডারেশন তৈরি হলেও মূলত ভারত, বাংলাদেশে প্রবল জনপ্রিয় খো খো খেলায় ভারতের প্রাধান্য রয়েছে কাবাডির মতই। কাবাডিতেও ভারতের প্রাধান্য। একবার মাত্র এশিয়ান গেমসে সোনা পায়নি ভারত। বাকি সব সময় এই খেলায় ভারতের সোনা বাঁধা। কাবাডি বিশ্বকাপেও ভারত সেরা। প্রো কাবাডি লিগও চালু হয়েছে ভারতে। কিন্তু এই দুটি খেলাই ভারতীয় বুর্জোয়াদের পৃষ্ঠপোষকতার ক্ষেত্রে কম গুরুত্ব পায়।

সাম্প্রতিক সময়ে এশিয়ান, কমনওয়েলথ ও অলিম্পিকে ভারতের হয়ে প্রচুর মেডেল জিতেছেন কুস্তিগিররা। জনপ্রিয় বায়োপিক তৈরি হয়েছে। কিন্তু যৌন অত্যাচার সংক্রান্ত অভিযোগে অভিযুক্তকে অপসারণের দাবিতে কুস্তিগিররা আন্দোলনে নামলে পুলিশি আক্রমণ নেমে আসে। বুটের আঘাত নেমে আসে আন্তর্জাতিক মঞ্চ আলোকিত করা ক্রীড়াবিদদের মুখে। অবশেষে অভিযুক্ত ব্যক্তির নামে চার্জশিট দেওয়া হলে যখন আন্দোলন সামান্য থমকে যায় তখন কুস্তিগিরদের বোর্ড দখল করতে উদ্যত হয় সংশ্লিষ্ট অভিযুক্তের ঘনিষ্ঠরা। দীর্ঘদিন সিদ্ধান্ত না আসায় আন্তর্জাতিক মঞ্চ ভারতকে সাবধান করে। ক্ষমতার দাম্ভিকতা তা কানে তোলেনি। ফলে ভারত সাসপেন্ড ও অলিম্পিক খেলা আপাতত বিশ বাঁও জলে।

ভারতীয় পুরুষদের ফুটবল দল যতই পিছিয়ে থাক, তাদের প্রতি তবুও জনসাধারণের আগ্রহ আছে। কিন্তু মহিলা ফুটবল দলের প্রতি? নৈব নৈব চ। অথচ এই মুহূর্তে ভারতের মহিলা ফুটবল দল ৬১ র‌াঙ্কে আছে, যেখানে পুরুষরা কখনো সখনো ৯০-এর ঘরে উঠে আসে। ২০১৪ সালে মহিলারা ৪৯ তম স্থানে ছিল, যেটা পুরুষদের স্বপ্নের অগোচর। এশিয়ায় বর্তমানে দশম স্থানে থাকা ভারতীয় মহিলা ফুটবল দল তবুও আজও অলিম্পিক বা বিশ্বকাপ খেলেনি। এশিয়ান গেমসেই কয়েকবার খেলেছে। পর্যাপ্ত বিদেশ সফর ও ম্যাচ প্র্যাকটিসের অভাবে তাঁরা সর্বদাই বড়ো প্রতিযোগিতায় ব্যর্থ হয়। ১৯৭৫-৯১ দারুণ খেললেও, শুধু পরিকল্পনার অভাবে ২০০৯ অবধি চূড়ান্ত খারাপ পর্যায়ে পৌঁছে যায় তাঁরা। পারিবারিক বাধা, পর্যাপ্ত প্র্যাকটিস, স্পন্সর, ট্রেনিং ও অর্থের অভাবে ধুঁকছে ভারতের অন্যতম সেরা খেলার মহিলাদের অংশ। এই অবস্থা চরম লজ্জার বলেই মনে হয়।

টেবল টেনিসে ভারত বহু বড়ো খেলোয়াড়দের পেয়েছে। কী পুরুষ, কী মহিলা। একেকজন ২০ বছর পেরোনোর আগে বিশ্বের বহু দেশ ঘুরে ফেলেছেন। সাফল্যও এসেছে। কিন্তু অব্যবস্থা, দুর্নীতির অভিযোগ, স্পন্সর না পাওয়া ও একটা গোটা গোল্ডেন জেনারেশনে বিদায় বিষয়টিকে প্রবল জটিলতায় ফেলে দিয়েছে।

বেশ কিছু আন্তর্জাতিক খেলা আছে, যেগুলো ভারতে একেবারেই জনপ্রিয় নয়। কারণ হয় সেগুলো ধনীদের খেলা (গলফ) অথবা বেশিরভাগ লোকে নিয়ম বোঝে না (বেসবল বা সফট বল)। ফলে এই খেলাগুলিকে নিয়ে তেমন আলোচনার কিছুই নেই। কিন্তু রাগবির মতো কিছু খেলা আছে যা মাঠের অভাবে ধুঁকছে, আছে মেয়েদের হকি - যেখানে পুরুষদের হকির অবস্থাই সঙ্গীন, সেখানে মেয়েদের হকির কথা বলাই বাহুল্য। আবার বাস্কেট বলে দৈহিক কারণেই দুর্বল ভারত। বক্সিং-এ অবশ্য সাফল্য প্রায়ই আসে, কিন্তু সব কিছুর সংকটের বা অবহেলার মূলে হলো নয়া উদারবাদী অর্থনীতি ও তার ধ্বজাধারী ভারতীয় করপোরেট।

যেখানে ক্রিকেটের সর্বনিম্ন স্তরে অর্থের জোগান প্রায় শূন্য, ফলে বাকিদের অবস্থা বোঝাই যায়। প্রতি বছর পুরুষ ক্রিকেটে ৬০,০০০ ক্রিকেটার রেজিস্ট্রেশন করে ভারতে। তার মধ্যে খুব বেশি হলে ১১৪০ জন রাজ্য দলের সিনিয়র টিমে সুযোগ পায়, যাদের মধ্যে ৫৫০/৬০০ জন ন্যূনতম একটা ম্যাচ খেলে। ফলে ৫৮,০০০ এর বেশি ক্রিকেটারের স্বীকৃত (বোর্ড বা তার স্বীকৃত রাজ্য বোর্ড কর্তৃক) ক্রিকেট খেলে বার্ষিক এক লক্ষ টাকাও আয় করতে পারেন না। বাকি ১১৪০ জনের মধ্যে মেরেকেটে ৪০০/৫০০ জনের আয় বছরে চার লাখের বেশি (সমগ্র দেশে, ব্যক্তি স্পন্সর ধরে)। অথচ ক্রিকেটে একজন খেলোয়াড় বছরে খরচ করেন (পশ্চিমবঙ্গের মতো কম খরচের রাজ্যে) ৪/৫ লাখ টাকা (ন্যূনতম; এটা লাগবেই)। এক বিপুল অংশের ক্রিকেটার অস্বীকৃত ক্রিকেট থেকে আয় করেন, যা তাঁদের জীবনীশক্তি ছিবড়ে করে দেয়, কেরিয়ারে তালা ঝোলাতে হয় ৩৫ এর মধ্যে (মাত্র তিন দশক আগেও এটা ছিল অফিস টুর্নামেন্ট ধরে ৪৫)। এদিকে সিনিয়র মহিলা দলের ম্যাচ ফি পুরুষদের সমান হলেও সর্বোচ্চ গ্রেডের মহিলা ক্রিকেটার সর্বনিম্ন গ্রেডের পুরুষ ক্রিকেটারের থেকে অনেক কম টাকা পান। ক্রিকেটের এই হাল হলে বাকিদের অবস্থা না বললেও চলবে।

করপোরেটদের সব খেলার প্রতি সমদৃষ্টি দিতে বাধ্য করা, পরিবহণ, ক্রীড়া স্বাস্থ্য ও ফেলোশিপের সুব্যবস্থা, ক্রীড়া ম্যানেজমেন্ট ও গবেষণার সংস্থা বানানো ও সর্বোপরি দেশ ও রাজ্যভিত্তিক সরকারি যুব নীতি ও তার অংশ হিসেবে ক্রীড়া নীতি প্রণয়ন আজ প্রগতিশীল গণ-আন্দোলনের লক্ষ্য হওয়া উচিত; যাতে কোনো ক্রীড়াই আর ধুঁকতে না পারে।