৫৯ বর্ষ ৭ সংখ্যা / ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২১ / ৭ আশ্বিন, ১৪২৮
২৭ সেপ্টেম্বর ভারত বনধের ডাক
দেশজুড়ে ব্যাপক সাড়া
ধর্মতলায় লেনিন মূর্তির সামনে পথসভা করে ২৭ সেপ্টেম্বরের সাধারণ ধর্মঘটে শামিল হওয়ার জন্য শ্রমজীবী মানুষের কাছে
আবেদন জানালেন ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দ।
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ আগামী ২৭ সেপ্টেম্বর সংযুক্ত কিষান মোর্চার ডাকে ধর্মঘটে অচল হবে গোটা দেশ। কেন্দ্রের সর্বনাশা তিন কৃষি আইন বাতিল, ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের দাবি সহ বিদ্যুৎ বিল এবং শ্রমিক স্বার্থবিরোধী চারটি শ্রমকোড প্রত্যাহার ইত্যাদি নানা গুরুত্বপূর্ণ দাবিতে এদিন বন্ধে স্তব্ধ হবে দেশের প্রতিটি প্রান্ত। কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন ও বিভিন্ন গণসংগঠনও এই বন্ধকে সমর্থন জানিয়েছে। এছাড়া সিপিআই(এম) এবং অন্যান্য বামপন্থী দল সহ দেশের প্রায় সমস্ত বিরোধী রাজনৈতিক দল এই বন্ধকে সমর্থন জানিয়ে সফল করার আহ্বান জানিয়েছে।
১১ সেপ্টেম্বর সিআইটিইউ কলকাতা জেলা সম্মেলন উদ্বোধন করে সংগঠনের সর্বভারতীয় সভানেত্রী কে হেমলতা প্রতিটি কর্মীকে রাস্তায় নেমে ধর্মঘট সফল করার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ২৭ সেপ্টেম্বর ভারত বন্ধ সফল করে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারকে ফের একবার ধাক্কা দিতে হবে।
প্রসঙ্গত, সংযুক্ত কিষান মোর্চা ২৭-এর দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট আচমকা ডাকেনি। দীর্ঘ প্রায় ১০ মাস ধারাবাহিকভাবে ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলন পরিচালনার পর গত ৫ সেপ্টেম্বর মুজফ্ফরনগরে ১০ লক্ষ কৃষকের মহাপঞ্চায়েত থেকে এই ধর্মঘটের আহ্বান জানানো হয়েছিল। এই মহাপঞ্চায়েতের আগে ২৬ ও ২৭ আগস্ট সিঙ্ঘু সীমান্তে সংযুক্ত কিষান মোর্চার আহ্বানে একটি জাতীয় কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়। ওই কনভেনশনে কৃষকদের সমস্যার পাশাপাশি ট্রেড ইউনিয়নগুলি ৪টি শ্রমকোড সহ সারের মূল্যবৃদ্ধি, পেট্রোল, ডিজেল ও রান্নার গ্যাসের দামবৃদ্ধি, জনস্বার্থবিরোধী বিদ্যুৎ বিল এবং কৃষিক্ষেত্রকে কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেবার বিরুদ্ধে আলোচনা হয়। সেখানে ছাত্র, যুব, মহিলা সহ অন্যান্য গণসংগঠনের প্রতিনিধিরাও উপস্থিত থেকে তাঁদের মতামত স্পষ্টভাবে তুলে ধরেন। এছাড়াও উল্লেখযোগ্য দিক হলো, এই কনভেনশনে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে প্রস্তাব সহ কেন্দ্রীয় সরকারের বেসরকারিকরণ নীতির বিরুদ্ধে প্রস্তাব গ্রহণ করে দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে তোলার ডাক দেওয়া হয়। এই কনভেনশন থেকে তিন কৃষি আইন বাতিল সহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দাবিতে দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল।
নরেন্দ্র মোদী সরকার দেশের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবার পর থেকে দেশের অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো কৃষিতেও ভয়ঙ্কর আঘাত নেমে এসেছে। এই সরকার দেশের কৃষি ও কৃষকের স্বার্থের দিকে না তাকিয়ে সার্বিক কৃষি ব্যবস্থাকেই ক্রমশ বেসরকারি মালিক ও কর্পোরেটদের হাতে তুলে দিতে উদ্যত হয়েছে। তাদের স্বার্থ পূরণের লক্ষ্যেই সংসদীয় বিধি-ব্যবস্থাকে তোয়াক্কা না করে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে কৃষক স্বার্থ বিরোধী তিনটি কৃষি আইন লাগু করার উদ্যোগ নিয়েছে। এই তিনটি আইনের মধ্য দিয়ে ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ব্যবস্থা তুলে দিতে চাইছে কেন্দ্র। এছাড়া সরকারি সংগ্রহ ব্যবস্থা এবং গণবণ্টন ব্যবস্থা বিপর্যস্ত করে দিতে চাইছে। এই তিন কৃষি আইন শুধু কৃষক স্বার্থ বিরোধী নয়, মৌলিক অর্থেই জনবিরোধী।
তাই ৫০০-র বেশি কৃষক সংগঠনের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা আন্দোলনের মঞ্চ সংযুক্ত কিষান মোর্চা কেন্দ্রের তিন কৃষি আইন বাতিলের দাবি সর্বাগ্রে তুলে ধরেছে। এছাড়াও দাবি তোলা হয়েছে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের নিশ্চয়তা দিতে কেন্দ্রীয় আইন প্রণয়ন করতে হবে।। স্বামীনাথন কমিশনের সূত্র অনুযায়ী সামগ্রিক উৎপাদন খরচের দেড়গুণ ন্যূনতম সহায়ক মূল্য দেবার দাবি জানানো হয়েছে। এছাড়া দাবি উঠেছে, বিদ্যুৎ সংশোধনী বিল প্রত্যাহার করতে হবে। এই দাবিগুলির পাশাপাশি কৃষক আন্দোলন থেকে দাবি উঠেছে পেট্রোল-ডিজেলের আকাশছোঁয়া দাম কমাতে হবে। কৃষক -খেতমজুরদের সমস্ত ঋণ মকুব করতে হবে। সর্বোপরি কর্পোরেটদের হাত থেকে কৃষিকে রক্ষায় আন্দোলন জারি রেখেছে সংযুক্ত কিষান মোর্চা।
এই দাবিগুলি নিয়েই সংযুক্ত কিষান মোর্চা দিল্লি সীমান্তে যে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ-আন্দোলন শুরু করেছিল তা গত ২১ সেপ্টেম্বর ৩০০ দিন অতিক্রম করেছে। এই আন্দোলন দিল্লির সীমানা ছাড়িয়ে পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ সহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে। এই সময়কালের মধ্যে কৃষক নেতৃত্ব কেন্দ্রের কাছে বার বার দাবি জানিয়েছে কৃষক স্বার্থ বিরোধী আইন ও পদক্ষেপগুলি তুলে দেবার জন্য। কিন্তু কয়েক দফায় কেন্দ্রের সরকার কৃষক নেতৃত্বের সাথে আলোচনায় বসলেও কৃষকদের দাবি পূরণে কোনো সদর্থক পদক্ষেপ নেয়নি। এদিকে প্রবল শীত, প্রচণ্ড দাবদাহ, অবিশ্রান্ত বর্ষণের মধ্যেও হাজার হাজার কৃষক দাবি আদায়ে অনড় থেকে তাঁদের আন্দোলন জারি রেখেছেন। এই আন্দোলনকে কালিমালিপ্ত করতে নানা অপপ্রচার চালানো হয়েছে। এই আন্দোলনকে ভাঙতে কেন্দ্রের পাশাপাশি হরিয়ানা ও উত্তর প্রদেশের বিজেপি সরকারের পুলিশ আন্দোলনরত কৃষকদের উপর নির্মম আক্রমণ নামিয়ে আনলেও কৃষকদের প্রতিহত করা যায়নি। এদিকে এই দুর্বার কৃষক আন্দোলনে অংশ নিয়ে প্রায় পাঁচ শতাধিক কৃষক শহিদ হয়েছেন। তবু্ও এতটুকু শ্লথ হয়নি এই আন্দোলন। উলটে এই আন্দোলনের তীব্রতা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে।
লক্ষণীয় ঘটনা হলো, এই ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের রেশ দেশের সীমানা অতিক্রম করে বিদেশেও পৌঁছেছে। লন্ডন, কানাডা প্রভৃতি জায়গায় ইতিমধ্যে ভারতের কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে বিক্ষোভ সমাবেশ সংগঠিত হয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটেই আগামী ২৭ সেপ্টেম্বর সংযুক্ত কিষান মোর্চার ডাকে দেশব্যাপী বন্ধ হতে যাচ্ছে। এই বন্ধকে সফল করতে রাজ্যে রাজ্যে প্রচার কর্মসূচি সংগঠিত হচ্ছে। হয়েছে সভা, মিছিল, কনভেনশন। ‘অন্নদাতা’ কৃষকদের ন্যায্য দাবিতে প্রচারে ব্যাপক সাড়া লক্ষ করা যাচ্ছে। কেবল কৃষক পরিবারের সদস্যরাই নন, আন্দোলনকারীদের বক্তব্যের সমর্থনে পাশে দাঁড়াচ্ছেন শ্রমিক, কর্মচারী, ব্যবসায়ী, মহিলা, যুবক, ছাত্র সহ সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষ। সব মিলিয়ে ২৭ সেপ্টেম্বর দেশজুড়ে নজিরসৃষ্টিকারী বন্ধেরই ইঙ্গিত মিলছে।
পশ্চিমবঙ্গেও কৃষক সংগঠনগুলির পাশাপাশি শ্রমিক, খেত মজুর সহ বিভিন্ন গণসংঠনের পক্ষ থেকে বন্ধকে সফল করতে জোরালো প্রচার সংগঠিত হচ্ছে। ইতিমধ্যে সংযুক্ত কিষান মোর্চার ডাকে বিভিন্ন ইস্যুতে এ রাজ্যের কৃষক-খেত মজুররাও সভা,সমাবেশ, মিছিল সহ রাস্তা রোকো, রেল রোকো ইত্যাদি বিভিন্ন কর্মসূচিতে কয়েক হাজার কৃষক অংশগ্রহণ করেছেন। এবারেও ২৭-এর বন্ধকে সফল করতে নানা প্রচার আন্দোলনে শামিল হয়েছেন রাজ্যের সবক'টি জেলার কৃষক-খেত মজুররা। শ্রমিক সহ অন্যান্য গণসংগঠনের কর্মীরাও এই প্রচারে শামিল হয়ে বন্ধকে সফল করতে উদ্যোগী হয়েছেন।
অতীতে কেন্দ্রের জনবিরোধী-সাম্প্রদায়িক ও দেশ বিরোধী নীতির বিরুদ্ধে যতগুলি সাধারণ ধর্মঘট হয়েছে, সবগুলোর ক্ষেত্রেই এ রাজ্যের তৃণমূল সরকার ও শাসক দল ধর্মঘটীদের বিরুদ্ধে যথেচ্ছ দমন-পীড়ন চালিয়েছে। ধর্মঘটে অংশগ্রহণকারী সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে। যদিও সেই সমস্ত ধর্মঘটের মূল দাবিগুলি ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে। অথচ এ রাজ্যে কেন্দ্রের সরকারের তল্পিবাহক হিসেবে তৃণমূল সরকার বাড়তি উদ্যোগী হয়ে ধর্মঘটের বিরোধিতা করেছে, পুলিশকে এমনকী কোথাও কোথাও শাসকদলের দুর্বৃত্তদেরও লেলিয়ে দিয়েছে। তবুও আন্দোলনকারীদের ধর্মঘটের পথ থেকে টলাতে পারেনি।
উল্লেখ করা যেতে পারে, তৃণমূল নেত্রী তথা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বিভিন্ন সময়ে অবস্থার চাপে কৃষক আন্দোলনকে সমর্থনের কথা বলে প্রচারের আলোয় আসার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তাঁর সরকারই কৃষকস্বার্থ বিরোধী নানা পদক্ষেপ নিয়ে কৃষকদের দুর্বিষহ যন্ত্রণার আবর্তে ঠেলে দিয়েছে। তার পরিণতিতে তিন শতাধিক কৃষক এরাজ্যে ফসলের দাম না পেয়ে, ঋণে জর্জরিত হয়ে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন। তিনি কিষান মান্ডি নিয়ে অনেক বাগাড়ম্বর করলেও তাতে কৃষকদের কোনো সুরাহা হয়নি, সরকারের উদ্যোগে ন্যায্য দামে ধান কেনার উদ্যোগ প্রায় নেই বললেই চলে। কৃষকদের স্বার্থে উদ্যোগ নেওয়া তো দূরের কথা, রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে দলীয় দুষ্কৃতীদের দিয়ে বর্গাদার-পাট্টাদারদের জমি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। এদিকে কৃষকরা যখন নিদারুণ যন্ত্রণা থেকে পরিত্রাণ পেতে ন্যায্য দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলনে অগ্রসর হয়েছে, তখন তাদের উপর আক্রমণ নামিয়ে এনেছে এই সরকার। শান্তিপূর্ণভাবে বিভিন্ন দাবিতে স্মারকলিপি দেবার সময়েও বাধা দেওয়া হয়েছে। তৃণমূলী আমলে এই দৃশ্য বারবার দেখা গেছে। এই অবস্থা সত্ত্বেও মুখ্যমন্ত্রীর দাবি এ রাজ্যে নাকি কৃষকদের আয় বেড়েছে!
এই অবস্থায় সংযুক্ত কিষান মোর্চার ডাকে ২৭ সেপ্টেম্বর দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট হতে যাচ্ছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে সিপিআই(এম)'র রাজ্য সম্পাদক সূর্য মিশ্র দৃঢতার সঙ্গে বলেছেন, ২৭ সেপ্টেম্বর ধর্মঘট হবেই। এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী কখনো কৃষক আন্দোলনকে সমর্থন করেন, আবার কখনো ধর্মঘটের বিরোধিতায় বামপন্থীদের বিরুদ্ধে পুলিশ পাঠিয়ে গ্রেপ্তার করান। ধর্মঘটের দিন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী কী করবেন, কোথায় থাকবেন তা তাঁকেই ঠিক করতে হবে। তিনি স্পষ্টতই জানান, ধর্মঘটের দিন বামপন্থীরা রাস্তায় নেমেই ধর্মঘটকে সফল করবেন।