৫৯ বর্ষ ৭ সংখ্যা / ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২১ / ৭ আশ্বিন, ১৪২৮
সামসেরগঞ্জ ও জঙ্গিপুর কেন্দ্রে বামফ্রন্টের প্রচারে উঠে আসছে বিড়ি শ্রমিকদের সমস্যা ও নদী ভাঙনের যন্ত্রণা
অনির্বাণ দে
প্রচারে সামসেরগঞ্জ কেন্দ্রের সিপিআই(এম) প্রার্থী মোদাসসার হোসেন।
বিড়ির মজুরি কেন বাড়েনা? প্রশ্নের উত্তর জানে সামসেরগঞ্জ, জঙ্গিপুরের বিড়ি মহল্লা। ৩০ সেপ্টেম্বর নির্বাচন সামসেরগঞ্জ এবং জঙ্গিপুর এই দুই আসনে। জঙ্গিপুর মহকুমার এই দুই আসন আক্ষরিক অর্থেই বিড়ি শ্রমিক নিবিড়। আড়াই লক্ষেরও বেশি বিড়ি শ্রমিক বসবাস করেন এই দুই বিধানসভা কেন্দ্রে ।
তৃণমূল কংগ্রেসের আমলে দুর্গতির শেষ নেই বিড়ি শ্রমিকদের। দীর্ঘদিন বন্ধ সরকারি বিভিন্ন সুবিধা। তার উপর বিড়ি শ্রমিকদের মজুরি নিয়ে সরকারের উদাসীনতা শ্রমিকদের দুর্গতি আরও বাড়িয়েছে।
২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে বিড়ি মালিক এবং শ্রমিক সংগঠনগুলির মধ্যে বৈঠকে মজুরি বেড়েছে শ্রমিকদের। ২০১৭’র ডিসেম্বরে বিড়ি শ্রমিকদের মজুরি ঠিক হয় হাজার বিড়ি পিছু ১৫২ টাকা। ২০১৮’র জানুয়ারি থেকে মজুরি কার্যকর হওয়ার কথা থাকলেও সব মালিক এই মজুরি চালু করেনি। লকডাউন-পরবর্তীকালে কাজে, মজুরিতে আরো সংকট নেমে এসেছে।
জঙ্গিপুর, সামসেরগঞ্জের বিড়ি শ্রমিকরা এখন হাজার বিড়ি বেঁধে ১২০ থেকে ১৪০ টাকা মজুরি পাচ্ছেন। তাও সপ্তাহে তিনদিন। বাকি চারদিন ১০০ টাকাও দিতে চাইছে না বিড়ি শ্রমিকদের।
সরকার নিজে মিনিমাম ওয়েজ তালিকায় ফলাও করে ঘোষণা করেছে, হাজার বিড়ি বেঁধে একজন শ্রমিক পাবেন ২৭৬ টাকা। এই ন্যূনতম মজুরি কার্যকর করার দিকে নজর নেই রাজ্য সরকারের। শ্রমিক আন্দোলনের চাপে নির্বাচনের মুখে মজুরি নিয়ে বিড়ি মালিকদের সংগঠন ও শ্রমিক সংগঠনের মধ্যে বৈঠক হয়েছে। তবে সরকারি ন্যূনতম মজুরি দিতে নারাজ মালিকরা। রাজ্য সরকারের শ্রম দপ্তরের দায়িত্ব মজুরি সংক্রান্ত বিষয় দেখভালের। তবে বিড়ি শ্রমিকদের মজুরি নিয়ে মিটিংও ডাকতে নারাজ সরকার কেন? এই প্রশ্নের উত্তর উঠে আসছে নির্বাচনের প্রচারে।
জঙ্গিপুর কেন্দ্রের এই বারের তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী জাকির হোসেন নিজেই ‘শিব বিড়ি’ নামের বিড়ি কোম্পানির মালিক। ২০১৬ থেকে ২০২১ তৃণমূল কংগ্রেসের সরকারের শ্রম দপ্তরের মন্ত্রী ছিলেন বিড়ি মালিক জাকির হোসেন।
২০১৮ সালে লোকসভা নির্বাচনে জঙ্গিপুর কেন্দ্র থেকে জয়ী হয়েছেন তৃণমূল কংগ্রেস নেতা খলিলুর রহমান। খলিলুর রহমান বর্তমানে তৃণমূল কংগ্রেসের জঙ্গিপুর সাংগঠনিক জেলার সভাপতি। সকলেই জানেন, জঙ্গিপুরের অন্যতম বড়ো বিড়ি কোম্পানি নুর বিড়ির মালিক খলিলুর। আরেক বিড়ি মালিক ইমানি বিশ্বাস বর্তমানে সুতির বিধায়ক। দেখা যাচ্ছে বিড়ি মালিকরাই বসে রাজ্যের শাসকদলের মাথায়। তাদের নির্দেশেই চলছে সরকার। তাই, শ্রমিকদের মজুরি নিয়ে ভাবার সময় নেই সরকারের।
লাগাতার বিড়ি শ্রমিকদের মজুরির লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন বামপন্থীরা।
নির্বাচনে সামসেরগঞ্জ কেন্দ্রের সিপিআই(এম) প্রার্থী মোদাসসার হোসেন নিজেই বিড়ি শ্রমিক পরিবারের ছেলে। ছাত্র নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর বর্তমানে ডিওয়াইএফআই’র জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য। বিড়ি শ্রমিকদের মজুরির প্রশ্ন উঠে আসছে মোদাসসারের প্রচারে। পায়ে হেঁটে বাড়ি বাড়ি যাচ্ছেন প্রার্থী।
প্রচারে জঙ্গিপুর কেন্দ্রে আরএসপি প্রার্থী জানে আলম মিঞা।
প্রচারে বিড়ি শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে সরব হচ্ছেন জঙ্গিপুর কেন্দ্রে আরএসপি প্রার্থী জানে আলম মিঞাও।
নদী ভাঙনের কথাও উঠে আসছে নির্বাচনে। ২০২০ সালের নদী ভাঙনে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে সামসেরগঞ্জের ধানঘড়া গ্রামের অর্ধেকটা। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি আবার শুরু হয়েছে ভাঙন।
ভাঙনে সামসেরগঞ্জের কামালপুর, নতুন শিবপুরের বহু মানুষ সর্বস্বান্ত হয়েছেন। কেউ আশ্রয় নিয়েছেন স্কুল বাড়িতে, কেউ আত্মীয়দের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। তৃণমূল নেতারা জানাচ্ছেন সরকারের পক্ষ থেকে জমির পাট্টা দেওয়া হয়েছে ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে। তবে কারা পাট্টা পেয়েছেন সেই তালিকা প্রকাশ করেনি প্রশাসন। উঠছে অস্বচ্ছতার অভিযোগ।
নদী ভাঙন নিয়ে প্রচারে নীরব তৃণমূল কংগ্রেস, বিজেপি। প্রশ্ন উঠলে তৃণমূল নেতারা বলছেন, বালির বস্তা ফেলা হয়েছে ভাঙন মোকাবিলায়। গঙ্গা ভাঙন রোধের নামে বালির বস্তা ফেলে আসলে কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে, বলছেন সামসেরগঞ্জের বামফ্রন্ট প্রার্থী মোদাসসার হোসেন।
বালির বস্তা ফেলে নয়, স্থায়ী স্পার নির্মাণ করেই ভাঙন রোধ সম্ভব। কিন্তু সেইদিকে নজর নেই সরকারের।
মানুষের চোখে ধুলো দিতে মরিয়া শাসকদল। একাধিকবার বিক্ষোভ দেখিয়েছেন গ্রামের মানুষ, সমাধান নয় - জুটেছে পুলিশি হয়রানি। জলের গর্ভে বালির বস্তা ফেলা নয়, স্থায়ী সমাধানের দাবিতে সরব হয়েছেন এলাকার মানুষ। একাধিকবার এলাকায় ঘুরে গিয়েছেন মন্ত্রীও। কার্যত ভাঙন ট্যুরিজম হয়েছে, মানুষের কোনো লাভ হয়নি, জানাচ্ছেন স্থানীয়রা। ভাঙনে দুর্গত মানুষের কান্না উঠে আসছে বামফ্রন্ট প্রার্থীর প্রচারে।
ভাঙন নিয়ে মানুষের কথা শুনতে গ্রামে এসেছেন রাজ্যসভায় সিপিআই(এম) সাংসদ বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্য, সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিম এবং সংযুক্ত মোর্চার আইএসএফ বিধায়ক নওসাদ সিদ্দিকি সহ বামফ্রন্ট নেতৃবৃন্দ। ভাঙনরোধ নিয়ে প্রশাসনের দ্বারস্থ হয়েছেন মালদহ এবং মুর্শিদাবাদ জেলার বামফ্রন্ট নেতৃত্ব। কিন্তু হেলদোল নেই সরকারের।
বিড়ি শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির পাশাপাশি এলাকার ভাঙন সমস্যার সমাধানের দাবি জোরালোভাবে বিধানসভায় পৌঁছে দিতে চাইছেন বামফ্রন্ট প্রার্থীরা।
মুর্শিদাবাদের দুই কেন্দ্রের ভোটে বামফ্রন্ট প্রার্থীর প্রচারে সামনে আসছে জেলার পরিযায়ী শ্রমিকদের কথাও।
পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে কোনো সরকারি পরিসংখ্যান নেই প্রশাসনের কাছে। ভিন্রাজ্যে একের পর এক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছেন শ্রমিকরা। সামসেরগঞ্জ, জঙ্গিপুরের যুবকরাও রাজ্যে কাজের অভাবে প্রতিদিন পাড়ি দিছেন ভিন্ রাজ্যে, ঝুঁকি নিয়েই।
একশো দিনের কাজে দুর্নীতির কারণে কাজ পাচ্ছেন না গ্রামের মানুষও।
অপরিকল্পিত লকডাউন-পরবর্তী পরিস্থিতিতে কমেছে গ্রামের মানুষের আয়। বেড়েছে দুর্দশা। গ্রামীণ অর্থনীতির এই অবস্থা কেন? প্রশ্ন তুলছেন বামফ্রন্টের প্রার্থীরা।
সামসেরগঞ্জ আসনে কংগ্রেস প্রার্থীর অবস্থান নিয়ে এখনও ধোঁয়াশা রয়েছে। এই কেন্দ্রের কংগ্রেস প্রার্থী জৈদুর রহমান জানিয়েছিলেন, ভোটে লড়তে চান না তিনি। যদিও পরে কংগ্রেস নেতাদের মধ্যস্থতায় সুর নরম করেন তিনি। ঘোষণা করেছেন নির্বাচনে লড়বেন। তবে এখনও প্রচারে নামেননি প্রার্থী নিজে।
জঙ্গিপুর কেন্দ্রে তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী রাজ্যের শ্রম দপ্তরের প্রাক্তন মন্ত্রী জাকির হোসেন, বিজেপি প্রার্থী সুজিত দাস। এছাড়াও জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির প্রার্থী আবু সালেম, এসইউসিআই প্রার্থী মীর্জা নাসিরুদ্দিন, বহুজন মহা পার্টির মইনুল হক নির্বাচনে লড়ছেন। নির্দল প্রার্থী হিসেবে নমিনেশন জমা দিয়েছেন তিন জন। বিগত লোকসভা নির্বাচনে সামসেরগঞ্জ কেন্দ্রে ভোটের নিরিখে এগিয়ে ছিল জোট। সামসেরগঞ্জে তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী করেছে আমিরুল ইসলামকে। বিজেপি’র প্রার্থী হয়েছেন মিলন ঘোষ।
একদিকে কেন্দ্রের সরকারের গরিব বিরোধী নীতি, অন্যদিকে পঞ্চায়েত পৌরসভায় সীমাহীন দুর্নীতি, গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ। বিড়ি মহল্লায় কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে এই সময়ে নতুন করে দেনায় জড়িয়ে পরেছেন অনেকে। স্থানীয় মহাজন থেকে বন্ধন ব্যাঙ্কের মতো মাইক্রোফিনান্স কোম্পানি। সুযোগ বুঝে চড়া সুদে ঋণ দিয়েছে অনেকে। সেই ঋণ শোধ করাই এখন বড়ো চ্যালেঞ্জ গ্রামের মানুষের কাছে। প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা থেকে মানুষ বলছেন, প্রতিদিন দুর্বিষহ হয়ে উঠছে জীবন। উলটোদিকে লড়াইয়ের সন্ধান দিচ্ছে বামফ্রন্ট প্রার্থীদের প্রচার।
সামসেরগঞ্জ ও জঙ্গিপুর - এই দুই কেন্দ্রে বামফ্রন্ট প্রার্থী যথাক্রমে সিপিআই(এম)-র মোদাসসার হোসেন এবং আরএসপি’র জানে আলম মিঞা’কে জয়ী করার আহ্বান জানিয়েছেন মুর্শিদাবাদ জেলা বামফ্রন্টের আহ্বায়ক নৃপেন চৌধুরী। তিনি বলেছেন, “আমরা সমস্ত মানুষের কাছে আবেদন করতে চাই, অনুরোধ করতে চাই, আজকের পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে সামসেরগঞ্জে সিপিআই(এম)-র প্রার্থীকে এবং জঙ্গিপুরে আরএসপি প্রার্থীকে জয়যুক্ত করে, তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপি’কে পরাজিত করে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করুন। আমরা আশাবাদী, এলাকার মানুষ বিধানসভায় বামফ্রন্ট প্রার্থীদের নির্বাচিত করে পাঠাবেন এবং সাধারণ মানুষের স্বার্থে কথা বলার সুযোগ করে দেবেন’’।