E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ৭ সংখ্যা / ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২১ / ৭ আশ্বিন, ১৪২৮

ডিওয়াইএফআই জেলা সম্মেলনগুলির আহ্বান -

বিস্তার করো সংগঠন রুখে দাও দক্ষিণপন্থার বিপদ...

দৃঢ় হোক সম্প্রীতি গণতন্ত্র ও কাজের লড়াই...


জেলা সম্মেলন শুরুর আগে যুবদের মিছিল ঝালদা শহরে।

নিজস্ব সংবাদদাতাঃ এ রাজ্যে, এ দেশে ভুলিয়ে দেবার, গুলিয়ে দেবার চেষ্টা হচ্ছে রুটি-রুজির লড়াইকে। গত এক দশকে বাংলায় কোনো শিল্প গড়ে ওঠেনি। স্কুল সার্ভিস কমিশন, টেট সহ রাজ্য সরকারের সমস্ত দপ্তরে নিয়োগ বন্ধ। দুর্নীতির দায়ে বিচারালয়ে নিয়মিত দোষী সাব্যস্ত হচ্ছে তৃণমূল সরকার। আর সাত বছর ধরে ক্ষমতাসীন বিজেপি’র নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় সরকার হাঁটছে বেলাগাম বেসরকারিকরণের পথে। প্রায় প্রতিদিনই বেচে দিচ্ছে একটা করে রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানা। সঙ্কুচিত হচ্ছে কাজের সুযোগ। যুবমানসকে বিপথে চালিত করতে, তাঁদের নজর ঘোরাতে সাম্প্রদায়িকতা, ধর্ম, ভাষা আর পরিচিতিসত্তার নানা দক্ষিণপন্থী ঝোঁকে বিভাজিত করার চেষ্টা হচ্ছে। বদলে দেবার চেষ্টা হচ্ছে দেশের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের কাঠামোকে। রুখতে হবে দক্ষিণপন্থার বিপদকে। বামপন্থী যুব আন্দোলন তথা দেশের বৃহত্তম যুব সংগঠন ডিওয়াইএফআই এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। কারণ বামপন্থীদের রাজনীতি মানে সামাজিক দায়বদ্ধতা। কাজের দাবিতে লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে, গণআন্দোলনে শামিল হয়ে সরকারকে বাধ্য করতে হবে রুজির দাবি পূরণ করতে। আগামী ২ থেকে ৪ অক্টোবর রায়গঞ্জে অনুষ্ঠিতব্য ডিওয়াইএফআই’র রাজ্য ১৯তম সম্মেলনকে সামনে রেখে রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় ডিওয়াইএফআই’র সম্মেলনগুলি থেকে উঠে আসছে এমনই নানা ইতিবাচক বার্তা। উচ্চারিত হচ্ছে জানকবুল লড়াইয়ের শপথ।

এ পর্যন্ত রাজ্যে ডিওয়াইএফআই’র মোট ৬টি জেলা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। আলিপুরদুয়ার, পুরুলিয়া, কোচবিহার, পশ্চিম মেদিনীপুর, কলকাতা এবং পূর্ব মেদিনীপুর - প্রতিটি জেলায় সম্মেলন উপলক্ষে অভূতপূর্ব উদ্দীপনা দেখা গেছে। স্থানীয় ইস্যু থেকে জাতীয় স্তরে কর্মসংস্থানের প্রতিকূলতার প্রশ্নে সোচ্চার থেকেছেন সম্মেলনে আগত প্রতিনিধিরা। প্রতিটি জেলা সম্মেলন থেকেই দিল্লির কৃষক আন্দোলনের প্রতি সংহতি এবং ২৭ সেপ্টেম্বরের সংযুক্ত কিষান মোর্চার ডাকে ধর্মঘটে যুব সমাজকে শামিল হবার আহ্বান জানানো হয়। শ্রমিক কৃষক মহিলা ছাত্র ও শিক্ষক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ সম্মেলনগুলিতে উপস্থিত থেকে অভিনন্দন ও সংহতি জানান।

বেকারদের স্বার্থে অবিলম্বে জেলা জুড়ে শিল্পায়ন প্রক্রিয়ার দাবি জানিয়ে পুরুলিয়া কুড়িতম জেলা সম্মেলন শুরু হয় ১১ সেপ্টেম্বর। শেষ হয় ১২সেপ্টেম্বর। ১১তারিখ একটি সুবিশাল মিছিল ঝালদা শহর পরিক্রমা করে। এই মিছিলে উপস্থিত ছিলেন সংগঠনের সর্বভারতীয় সম্পাদক অভয় মুখার্জি, রাজ্য সভানেত্রী মীনাক্ষী মুখার্জি প্রমুখ। কমরেড মইদুল ইসলাম নগরে (ঝালদার সত্যভামা বিদ্যাপীঠ) এবং কমরেড নরেন মুখার্জি-কমরেড পিন্টু মাহাতো মঞ্চে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ২০০-র বেশি প্রতিনিধি। সম্মেলনের উদ্বোধন করেন অভয় মুখার্জি। সম্মেলনের উদ্বোধন করে তিনি বলেন, পুঁজিবাদের স্বার্থেই এ দেশের সরকারের নীতি পরিচালিত হয়। পুঁজিবাদ কখনো শেষ কথা বলতে পারেনা। রাজ্যজুড়ে এখন এক ভয়ানক অস্থির অবস্থা। সব ধরনের চাকরি বন্ধ। শিল্পায়ন নেই। উচ্চশিক্ষিত বেকার ঘরে ঘরে বসে আছেন। তিনি দাবি করেন অবিলম্বে জেলা জুড়ে শিল্পায়নের পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। সম্পাদকীয় প্রতিবেদন পেশ করেন বিদায়ী সম্পাদক শ্যামল মাহাতো।

প্রতিনিধিদের আলোচনায় উঠে আসে পরিযায়ী শ্রমিক প্রসঙ্গ। উঠে আসে বামফ্রন্ট সরকারের কথা। লক্ষাধিক মানুষ এই জেলা থেকে ভিন্‌ রাজ্যে কাজের খোঁজে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। করোনা পর্বে তারা ফিরে এসেছেন। বহু মানুষ কাজ হারিয়েছেন। বাম আমলে পুরুলিয়া জেলা জুড়ে শিল্পায়নের একটা বাতাবরণ তৈরি হয়েছিল। সর্বশেষ শিল্প বলতে বাম আমলে তৈরি রঘুনাথপুর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। শিল্পহীন জেলায় তৃণমূল শাসনের গত ১০ বছর ধরে শিল্পায়নের নামে চলছে ভাঁওতা।

১৮ ও ১৯ সেপ্টেম্বর ডিওয়াইএফআই’র ২৩ তম কলকাতা জেলা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে শহিদ কমরেড মইদুল ইসলাম মিদ্যার নামাঙ্কিত মঞ্চে (নিরঞ্জন সদন) ও কমরেড পরিমল বিশ্বাস নগরে (যাদবপুর)। সম্মেলন থেকে ৬৩ জনের নতুন জেলা কমিটি ও ২৬ জনের সম্পাদকমণ্ডলী গঠিত হয়েছে। সভাপতি পদে বিকাশ ঝা এবং সম্পাদক পদে পৌলবী মজুমদার নির্বাচিত হয়েছেন।

সম্মেলন শেষে ১৯ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় যাদবপুর ৮বি বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন এলাকায় প্রকাশ্য সমাবেশে বক্তব্য রেখেছেন সিপিআই(এম) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী, পার্টি নেতা সুশান্ত ঘোষ, রূপা বাগচী সহ নেতৃবৃন্দ। সমাবেশ পরিচালনা করেন বিকাশ ঝা। সম্মেলনে উপস্থিত হয়েছিলেন ডিওয়াইএফআই’র প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক মহম্মদ সেলিমসহ সুশান্ত ঘোষ, রূপা বাগচী, সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির কলকাতা জেলার সভানেত্রী শমিতা হর চৌধুরী, জেলা সম্পাদিকা দীপু দাস, এসএফআই’র কলকাতা জেলার সভাপতি দেবাঞ্জন দে প্রমুখ নেতৃবৃন্দ।

কলকাতা জেলা সম্মেলনের প্রকাশ্য সমাবেশে সুজন চক্রবর্তী বলেছেন, মূল্যবোধহীন রাজনীতি চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে তৃণমূল এবং বিজেপি। এর বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে একমাত্র বামপন্থীরাই। রেড ভলান্টিয়ারদের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি বলেন, মহামারী পরিস্থিতিতে মানুষ যখন বিপন্ন, তখন বামপন্থী ছাত্র যুবরাই মানুষের পাশে থেকেছেন। রাজনীতি মানে প্রতারণা নয়, পানশালা খোলা অথচ পাঠশালা বন্ধ করে রাখা হয়েছে পশ্চিমবাংলাতে। দেশের মানুষের করের টাকায় ২১ দিন ধরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর জন্মদিন পালন হচ্ছে এবং তাঁর জন্মদিনে ২ কোটি টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে আগে থেকেই টিকাদান কমিয়ে দিয়ে মানুষকে বিপদে ফেলা হয়েছে।

সবার জন্য শিক্ষা ও কাজের দাবিতে এবং সম্প্রীতি ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামের লক্ষ্যে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার কুড়িতম সম্মেলন শুরু হয় ১৯ সেপ্টেম্বর। সম্মেলন শুরুর আগে নন্দকুমার বাজারে প্রকাশ্য সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে বক্তব্য রাখেন মীনাক্ষী মুখার্জি, ইব্রাহিম আলি, পরিতোষ পট্টনায়েক প্রমুখ। সভাপতিত্ব করেন নাজির হোসেন। মীনাক্ষী মুখার্জি বলেন, সরকারের জনবিরোধী নীতিগুলির প্রতিবাদে রাস্তায় থেকে লড়াই করতে হবে। সাংগঠনিক ত্রুটি দুর্বলতাকে ১০০ শতাংশ কাটিয়ে উঠতে না পারলে বৃহত্তর আন্দোলনের ক্ষেত্রে বাধাপ্রাপ্ত হতে হবে। যত কঠিন পরিস্থিতি আসুক না কেন বামপন্থী ছাত্র যুবরা লড়াই করবে রাস্তায় নেমেই।

সম্মেলনের উদ্বোধন করেন চলচ্চিত্র শিল্পী বাদশা মৈত্র। বাদশা মৈত্র বলেন, সারাদেশ ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে চলছে। তার থেকে মুক্তির উপায় কেবলমাত্র বামপন্থা। কমরেড নির্মল জানা ও অপূর্ব জানা নগর (নন্দকুমার) এবং শহিদ কমরেড মহিদুল ইসলাম মিদ্যা মঞ্চে (কুহেলি সভা কক্ষে) সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রকাশ্য সমাবেশ থেকে বর্ণাঢ্য মিছিলের মাধ্যমে প্রতিনিধিসহ কয়েকশো মানুষ সম্মেলন মঞ্চে উপস্থিত হন। সম্পাদকীয় প্রতিবেদনের উপর ৩১৭ জন প্রতিনিধিদের মধ্যে ৩৩ জন আলোচনা করেন। সম্মেলন থেকে মোট ২১ টি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। জবাবি ভাষণ দেন বিদায়ী জেলা সম্পাদক পরিতোষ পট্টনায়েক। সম্মেলন থেকে সর্বসম্মতিক্রমে ইব্রাহিম আলী সম্পাদক, সুকুমার মৈশালকে সভাপতি নির্বাচিত করে ৬১ জনের জেলা কমিটি ও কুড়ি জনের সম্পাদকমণ্ডলী গঠিত হয়েছে।

বিস্তার করো সংগঠন, দৃঢ় হোক প্রসারিত যুবশক্তি - এই স্লোগানকে সামনে রেখে শুরু হয় পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ২০ তম যুব সম্মেলন। শহিদ কমরেড জিতেন নন্দী নগর (গড়বেতা) শহিদ কমরেড মইদুল ইসলাম মঞ্চে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। খড়গপুর শহর থেকে ১৯ তম সম্মেলনের মশাল নিয়ে বাইক মিছিল পৌঁছায় গড়বেতার লড়াকু মাটিতে। ২২০ জন প্রতিনিধি এই সম্মেলনে অংশ নিয়েছেন। জেলা সম্পাদক সুমিত অধিকারী প্রতিবেদন পেশ করেন। প্রতিনিধি সম্মেলনে যুবনেত্রী মীনাক্ষী মুখার্জি বলেন, বাধা-বিপত্তি-আক্রমণ যত বাড়বে ইস্পাত দৃঢ় চেতনায় আরো সামনে দাঁড়িয়ে এরাজ্য সহ সারাদেশে দক্ষিণপন্থার বিপদ থেকে যুবসমাজকে রক্ষা করবে সংগঠন। শোষণ-বৈষম্যের বিরুদ্ধে সমাজ পরিবর্তনের জন্য দক্ষিণপন্থার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ভারসাম্যের পরিবর্তন ঘটাতে হবে। কর্মসূচির বিস্তার ঘটাতে হবে।

প্রতিনিধিদের বক্তব্যে উঠে আসে জেলার শিল্পের বেহাল দশার কথা, জমি নিয়ে তা কাজে না লাগাতে পারার রাজ্য সরকারের ব্যর্থতার কথা। তাঁরা উল্লেখ করেন, গোয়ালতোড়ের দুর্গাবাঁধ মৌজায় ১২ হাজার হেক্টর জমি অধিগ্রহণ করে গত আট বছর ধরে পতিত জমিতে পরিণত করা হয়েছে। শালবনিতে জিন্দালদের ইস্পাত নগরী প্রকল্প বন্ধ। জমিদাতা পরিবারের মাত্র ৭৬ জন সিমেন্ট প্রজেক্টে কাজ পেয়েছে। বিদ্যাসাগর শিল্প তালুকের অধিগৃহীত জমিতে গত ১০ বছরের নতুন করে কোনো শিল্প কারখানা গড়ে ওঠেনি। সেই জায়গায় শিল্পের পরিবর্তে স্টেডিয়াম তৈরি হয়েছে। সম্মেলন থেকে দাবি ওঠে সরকারের সমস্ত শূন্যপদ অবিলম্বে পূরণ করার। সম্মেলন থেকে সভাপতি ও সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন যথাক্রমে শুভজিত সেন এবং সুমিত অধিকারী।

১৯ সেপ্টেম্বর মাথাভাঙা নজরুল সদনে ভারতের গণতান্ত্রিক যুব ফেডারেশন কোচবিহার জেলা ১৯তম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন যুব ফেডারেশনের রাজ্য কমিটির সম্পাদক সায়নদীপ মিত্র। প্রতিনিধিরা উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন পরিচিতিসত্তার আন্দোলনের বিপদ, উদ্‌বাস্তু মানুষকে ভিটেছাড়া করার চক্রান্ত ও আদিবাসী মানুষের জমি কেড়ে নেওয়া, দক্ষিণপন্থার বিভাজনের রাজনীতি, চাকরির নামে শাসকদলের প্রতারণার বিভিন্ন দিক তুলে ধরে ঐক্যবদ্ধ যুব আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন।

সম্মেলনের উদ্বোধন করেন সংগঠনের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য অয়নাংশু সরকার। সম্পাদকীয় প্রতিবেদন পেশ করেন বিদায়ী সম্পাদক শম্ভু চৌধুরী। ৫৪ জনকে নিয়ে জেলা কমিটি গঠন করা হয়।

ফেব্রুয়ারি মাসে কামাখ্যাগুড়িতে কমরেড নিরঞ্জন মাহাতো মঞ্চে কমরেড মানবেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী ও কমরেড বরেন রায় নগরে আলিপুরদুয়ার জেলার তৃতীয় যুব সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনের উদ্বোধন করেন রাজ্য সম্পাদক সায়নদীপ মিত্র। এই সম্মেলন থেকে সম্পাদক নির্বাচিত হন রাজু ব্যানার্জি এবং সভাপতি তপন গোপ। এই সম্মেলন থেকে বস্তিবাসীদের সামাজিক সুরক্ষা, সহজ জীবন জীবিকার স্বার্থে কৃষিপণ্যের লাভজনক দাম এবং ডুয়ার্সের পর্যটন বিকাশের লক্ষ্যে কর্মসংস্থানের বিষয়ে আলোচনা এবং বিভিন্ন প্রস্তাব নেওয়া হয়। আগামী ২৯ সেপ্টেম্বর জেলায় যুব কনভেনশন অনুষ্ঠিত হবে।