৫৯ বর্ষ ৭ সংখ্যা / ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২১ / ৭ আশ্বিন, ১৪২৮
কমরেড সুকুমার সেনগুপ্ত স্মরণে
সুধাংশু দাশগুপ্ত
কমরেড সুকুমার সেনগুপ্ত’র মৃত্যুর পর ১৯৯৩ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর দেশহিতৈষী’তে স্বাধীনতা সংগ্রামী, বিপ্লবী কমিউনিস্ট নেতা, দেশহিতৈষী’র সে সময়ের সম্পাদক কমরেড সুধাংশু দাশগুপ্ত তাঁর বিপ্লবী সহকর্মীর স্মরণে এটি লিখেছিলেন।
গত ১৬ই সেপ্টেম্বর কমরেড সুকুমার সেনগুপ্ত’র প্রয়াণ দিবসে যে আবক্ষমূর্তি উন্মোচিত হয়েছে তাকে উপলক্ষ্য করেই এই স্মৃতিচারণাটি প্রকাশ করা হলো। কমরেড সুকুমার সেনগুপ্ত’র প্রতি এটাই আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।
একে একে নিভিছে দেউটি! পুরানো দিনের সাথীরা একে একে চলে যাচ্ছেন। সুকুমার সেনগুপ্তও চলে গেলেন (১৬ই সেপ্টেম্বর) দু’দিন আগেও দেশহিতৈষী পত্রিকার সম্পাদকীয় দপ্তরে বসে তাঁর সঙ্গে কথা হচ্ছিল দেশহিতৈষী’র ত্রিশ বছর পূর্ণ হওয়ার ইতিহাস সম্পর্কে। তিনি এসেছিলেন ব্রিটিশ আমলে বন্দিশিবিরে বিনাবিচারে আটক বন্দিদের একটা তালিকা নিয়ে। সেই তালিকা থেকে সশস্ত্রবিপ্লবীদের নেতৃস্থানীয়দের একটা তালিকা তৈরি করে দেবার অনুরোধ নিয়েই তিনি সেদিন আমার কাছে এসেছিলেন। বললেনঃ ‘‘এটা আপনি ছাড়া আর কেউ করতে পারবে না, শৈলেনবাবু তাই বলেছেন!’’ তাঁর হাত থেকে তালিকাটা নিলাম, বললাম কাল পাবেন। পরের দিন অফিসে যাওয়ার পরই তাঁর ফোন এলো মুজফ্ফর আহ্মদ ভবনের যে ঘরে তিনি থাকতেন সেই ঘর থেকে। বললেনঃ ‘‘শরীরটা ভালো না, তালিকাটা তৈরি হয়ে থাকলে অশোক মারফত পাঠিয়ে দেবেন!’’ তক্ষুণি অশোক তাঁর কাছে তালিকাটি দিয়ে এলো। পরের দিন অফিসে গিয়েই শুনলাম তাঁর শরীরের অবস্থা খুবই খারাপ, ডাক্তার এসেছে, অ্যাম্বুলেন্স এসেছে। কিন্তু অ্যাম্বুলেন্স কোনো কাজে লাগল না। পার্টি অফিসেই পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী কমরেড সুকুমার সেনগুপ্ত’র জীবন প্রদীপ নিভে গেলো।
কমরেড মুজফ্ফর আহ্মদ, আব্দুল হালিম, সোমনাথ লাহিড়ীরা অবিভক্ত বাংলাদেশে কমিউনিস্ট পার্টির ছোট্ট কোটারি গড়েছিলেন বৃহত্তর কলকাতাকে ঘিরে। সারা বাংলাদেশব্যাপী পার্টি গড়তে তখন তাঁরা পারেননি। কথাটা অপ্রিয় শোনালেও সত্য। সারা বাংলাদেশব্যাপী কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে উঠতে আরম্ভ করল তখনি যখন আন্দামানের সেলুলার জেল থেকে দেউলি, বক্সা, হিজলি, বহরমপুর বন্দিনিবাস থেকে সশস্ত্র বিপ্লবীরা পুরানো পথ পরিত্যাগ করে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে কারাপ্রাচীর থেকে মুক্ত হয়ে নীল আকাশের নিচে এসে দাঁড়ালেন। শৃঙ্খলাবদ্ধ সৈনিকের মতো তাঁরা কমরেড মুজফ্ফর আহ্মদের কাছে রিপোর্ট করে পার্টি কাজের নির্দেশ চাইলেন। কমরেড মুজফ্ফর আহ্মদ তাঁদের নিজ নিজ জেলায় কৃষক আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তোলার নির্দেশ দিলেন। সেই নির্দেশ নিয়ে মুক্ত বিপ্লবীরা নিজ নিজ জেলায় চলে গেলেন এবং কৃষক আন্দোলন ও শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করলেন। এদেরই প্রচেষ্টায় সারা বাংলাদেশব্যাপী বিস্তৃত হলো কমিউনিস্ট পার্টি। এই মুক্ত বিপ্লবীদের একজন হলেন কমরেড সুকুমার সেনগুপ্ত। যাঁর কর্মোদ্যোগে, অক্লান্ত পরিশ্রমে মেদিনীপুর হয়ে উঠেছে সিপিআই(এম)-র এক দুর্জয় ঘাঁটি।
মেদিনীপুরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বার্জ হত্যা মামলায় সুকুমার সেনগুপ্ত যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়ে যখন আন্দামান সেলুলার জেলে নির্বাসিত হন, তখন বিংশ শতাব্দীর বাস্তিল আন্দামান সেলুলার জেল কমরেড নারায়ণ রায়ের নেতৃত্বে রূপান্তরিত হয়েছে এক কমিউনিস্ট বিদ্যায়তনে। অনেক আত্মজিজ্ঞাসা, অনেক আত্মানুসন্ধানের পর সুকুমার সেনগুপ্ত যোগ দিলেন সেই বিদ্যায়তনে এবং সেই বিদ্যায়তন থেকে তিনি আদর্শ বিপ্লবী হিসাবে ইস্পাতের মতন দৃঢ় হয়ে বেরিয়ে এলেন। তারই প্রমাণ তিনি রেখে গেছেন মেদিনীপুর জেলায় সিপিআই(এম)-এর শক্ত ঘাঁটি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে।
স্বাধীনতা আন্দোলনে মেদিনীপুর ছিল কংগ্রেসের এক দুর্জয় ঘাঁটি। সুকুমার সেনগুপ্ত মুক্ত হবার আগেই কিন্তু বিপ্লবীরা মুক্ত হয়ে এসে মেদিনীপুরে কমিউনিস্ট পার্টির গোড়াপত্তন করেন। দেশবিভাগের পর দেখা যায় যে, পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুরেই কমিউনিস্ট পার্টি অন্যান্য জেলার চেয়ে বেশি শক্তিশালী। ১৯৬৪ সালের কলকাতায় অনুষ্ঠিত সপ্তম কংগ্রেসে পার্টি যখন বিভক্ত হয়ে গেলো এবং সিপিআই(এম) (নাম যদিও পরে দেওয়া) গঠিত হলো তখন অল্পসংখ্যক পার্টি সদস্য নিয়ে কমরেড সুকুমার সেনগুপ্ত মেদিনীপুরে সিপিআই(এম)-এর ঘাঁটি গড়ে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। সে সময়ে মেদিনীপুরে একদিকে যেমন কংগ্রেস শক্তিশালী অন্যদিকে তেমনি সিপিআই(এম)-এর তুলনায় দক্ষিণপন্থী সিপিআই অনেক বেশি শক্তিশালী।
সেই মেদিনীপুর কালক্রমে হয়ে উঠল সিপিআই(এম)-এর শক্তিশালী বড়ো ঘাঁটি। কংগ্রেস, সিপিআই সবাই পিছনে পড়ে রইলো! এর মূলে ছিল কমরেড সুকুমার সেনগুপ্ত’র অসাধারণ সাংগঠনিক শক্তি। পার্টিকে সম্প্রসারিত করতে হলে পার্টি শিক্ষাও যে সঙ্গে সঙ্গে চালাতে হবে সেটা তিনি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিলেন। প্রতি বছরের শারদ সংখ্যা দেশহিতৈষী’কে তিনি পার্টিশিক্ষার বাহন করে তুলেছিলেন। যখনই দেখা হতো তখনি আমাকে তিনি বলতেনঃ ‘‘আমি হচ্ছি আপনার বড় খদ্দের!’’ সত্যি, তাই প্রতি বছর মেদিনীপুরে যত কপি শারদ সংখ্যা বিক্রি হয় অন্য কোনো জেলায় অতো শারদ সংখ্যা দেশহিতৈষী বিক্রি হয় না। তিনি এটা বুঝেছিলেন যে, পার্টি পত্রিকা হচ্ছে পার্টি শিক্ষার বাহন। তাই জেলা সম্পাদক হিসাবে দৈনিক গণশক্তি, সাপ্তাহিক দেশহিতৈষী’র প্রচারে তিনি বিশেষ জোর দিতেন।
যেখানে পারতেন সেখানেই পার্টি স্কুল সংগঠিত করতেন। শিক্ষক হিসাবে কলকাতার কাউকে না পেলে নিজেরাই স্কুল পরিচালনা করতেন। আমাকে একবার তিনি বলেছিলেন যে, তিনি নিজেই ছ’ঘণ্টার একটা শর্ট কোর্স তৈরি করেছেন।
১৯৮২ সালের জুলাইতে বাঁকুড়া, বীরভূম, পুরুলিয়া, বর্ধমান, হুগলি আর মেদিনীপুর জেলার বাছাই করা কমরেডদের নিয়ে আমরা মেদিনীপুরের হলদিয়ায় ছ’দিনের একটি পার্টি স্কুল করেছিলাম। এই স্কুল হয়েছিল হলদিয়া ভবনে। এই স্কুল পরিচালনার সব ব্যবস্থাই কমরেড সুকুমার সেনগুপ্ত করেছিলেন। সেই স্কুলের উদ্বোধনী ভাষণে পার্টি শিক্ষার উপর জোর দিয়ে তিনি বলেছিলেন যে, পার্টিশিক্ষা ছাড়া পার্টি বাড়তে পারে না, বাঁচতে পারে না। হলদিয়ার সেই স্কুলের কথা আজও অনেকে আমায় বলে থাকেন।
কমরেড সুকুমার সেনগুপ্ত’র অনুরোধে মেদিনীপুরের অনেক জায়গায় আমি পার্টি-কর্মসূচি ও রাষ্ট্র বিপ্লব সম্বন্ধে ক্লাস করেছি। হঠাৎ একবার তিনি আমায় বললেন যে, পার্টি সভ্যদের কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোর মূল কথাটা বুঝিয়ে দেওয়া দরকার, আপনাকে তমলুকে পুরো একটা দিন কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো সম্বন্ধে বলতে হবে। তাঁর অনুরোধে তমলুকে গেলাম এবং কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোর মূলকথা সম্বন্ধে বক্তব্য রাখলাম। তিনি উপস্থিত কমরেডদের বললেনঃ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য থাকবে, অথচ কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো সম্বন্ধে কিছু জানবে না, এটাতো চলতে পারে না।
পার্টি-শিক্ষা সম্বন্ধে এই ছিল তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি।
পার্টি সংগঠনের একটা স্তম্ভ হচ্ছে চেক-আপ। চেক-আপের মধ্যদিয়ে ধরা পড়ে পার্টির সিদ্ধান্তটা জনগণের পক্ষে গ্রহণযোগ্য কিনা, আর ধরা পড়ে পার্টি-কমরেডরা সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে কতটা সিরিয়াস। এই চেক-আপের একটা অভিনব পন্থা বের করেছিলেন কমরেড সুকুমার সেনগুপ্ত।
১৯৮৩ সালের ঘটনা। কমরেড সুকুমার সেনগুপ্ত কলকাতায় এসে আমাকে বললেনঃ মেদিনীপুরের কয়েকটা জায়গার লোকাল কনফারেন্সে আপনাকে যেতে হবে। আমি বললামঃ এখন লোকাল কনফারেন্স হয় কী করে, কবে পার্টি কংগ্রেস তো হয়ে গেছে, সেই কংগ্রেসের সিদ্ধান্তই তো এখন কার্যকর করতে হবে। তিনি বললেনঃ ‘‘সেই জন্যই তো লোকালগুলোর এই কনফারেন্স, যেখানে কোনো নির্বাচন হবে না। শুধু আলোচনা হবে লোকালের কাজকর্ম কীভাবে চলছে, কীভাবে পার্টি সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হচ্ছে এবং সেই সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে গিয়ে লোকালের কমরেডরা কীরকম বাধার সম্মুখীন হয়েছে এবং তার সমাধান কীভাবে করতে হবে। লোকালের কমরেডরাই রিপোর্ট রাখবেন। সেই রিপোর্টের ভিত্তিতে আপনাকে বলতে হবে।’’
কমরেড সুকুমার সেনগুপ্ত’র কথা শুনে বুঝলাম চেক-আপের এ এক অভিনব পদ্ধতি। এ পদ্ধতি কমরেড সুকুমার সেনগুপ্তই আবিষ্কার করেছিলেন। এরকম চারটি লোকাল কনফারেন্সে - ঘাটাল, ডেবরা, নারায়ণপুর, কেশপুর - আমি গেলাম, ভাষণ দিলাম এবং মুগ্ধ হলাম কমরেড সুকুমার সেনগুপ্ত’র সাংগঠনিক শক্তি দেখে।
এ সময় আমাকে থাকতে হয়েছিল মেদিনীপুরের নতুন পার্টি অফিসে। সেখানেই কমরেড সুকুমার সেনগুপ্ত পার্টি শিক্ষার জন্য যে লাইব্রেরি করেছেন সেটা দেখালেন, তাঁর নিজের সংগৃহীত সব বই এই লাইব্রেরিতে তিনি দিয়ে দিয়েছেন, আমাকে কিছু বই দিতে অনুরোধ করলেন। তাঁর সেই অনুরোধ আমি রেখেছিলাম।
আজ মেদিনীপুরের দিকে তাকালেই বোঝা যায় কতবড়ো পার্টি সংগঠক ছিলেন কমরেড সুকুমার সেনগুপ্ত।
কমরেড সুকুমার সেনগুপ্ত’র জীবনের বিভিন্ন দিক সম্বন্ধে তাঁর মেদিনীপুরের সাথিদের অভিজ্ঞতা অনেক বেশি। আশা করব সেই অভিজ্ঞতা দিয়ে তাঁরা কমরেড সুকুমার সেনগুপ্ত’র জীবন কাহিনি রচনা করবেন - সেই জীবন কাহিনিই হবে নতুন প্রজন্মের কাছে আদর্শের নতুন দীপশিখা।
কমরেড সুকুমার সেনগুপ্ত’র স্মৃতির উদ্দেশে তোলা রইলো আমার সশ্রদ্ধ অভিবাদন।
- ১৮ই সেপ্টেম্বর