E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ৭ সংখ্যা / ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২১ / ৭ আশ্বিন, ১৪২৮

বিজ্ঞান আলোচনা


আইনস্টাইনের নোবেল প্রাপ্তির শতবর্ষ স্মরণে

(আর্য ফিজিক্স থেকে গোরুর প্রশ্বাসে অক্সিজেন)

তপন মিশ্র


আইনস্টাইনের নোবেল প্রাপ্তির শতবর্ষ পূর্তি পৃথিবীর ইতিহাসে এক স্মরণীয় ঘটনা। মৌলবাদ বিভিন্ন রূপে বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদকে বারবার আক্রমণ করেছে। আইনস্টাইনের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ছিল না। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব মৌলবাদের দর্শনের উপর এক বড়ো আঘাত হানে। আজকের দিনে আমাদের দেশে এই মৌলবাদী ধারণার দ্বারা তাড়িত হয়ে গোরুর প্রশ্বাসে অক্সিজেনের অলীক অবৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ধ্বনিত হয় দেশের বিচারব্যবস্থার মধ্যেও - “বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন যে, গোরু একমাত্র প্রাণী যা শ্বাস-প্রশ্বাসে শুধু অক্সিজেনই ত্যাগ করে” - এই উক্তি মৌলবাদের কণ্ঠস্বর ছাড়া আর কী বা হতে পারে? আইনস্টাইনের গবেষণার উপর আক্রমণকে ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সায়েন্টিফিক আমেরিকান পত্রিকায় লেখা হয় “The simple fact was that Einstein was a prominent Jew, and his thoughts therefore fit for the bonfire. But Einstein’s theory was attacked on racial grounds”। গোরুর প্রশ্বাসে অক্সিজেনের অলীক ধারণাও সেই জাতীয় যুক্তিহীন চিন্তা।

১৯০৫ সালে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদের উপর ‘Special Theory of Relativity’ প্রকাশিত হয়। ১৯১৬ সালে প্রকাশিত হয় ‘General Theory of Relativity’। ১৯২০ সাল নাগাদ আইনস্টাইন তাঁর এই দুই তত্ত্বের জন্য বিশ্বব্যাপী খ্যতির শীর্ষে। তখনও তিনি নোবেল পুরস্কার পাননি। অবশ্য তিনি ১৯২১ সালে নোবেল পুরস্কার পান থিওরিটিক্যাল ফিজিক্সের ‘Law of the photoelectric effect’ আবিষ্কারের জন্য। এ বছর সেই নোবেল প্রাপ্তির শতবর্ষ।

১৯০৯ সালে তিনি জুরিখে এক্সট্রাঅর্ডিনারি অধ্যাপক হিসাবে নিযুক্ত হন, ১৯১১ সালে প্রাগ (চেক রিপাবলিক)-এর তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক, পরের বছর একই ধরনের পদে আবার সুইৎজারলান্ডের জুরিখে ফিরে আসেন। ১৯১৪ সালে তিনি বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘কায়জার উইলহেলম ফিজিক্যাল ইনস্টিটিউটে’র পরিচালক এবং বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক নিযুক্ত হন। জার্মানির উলম শহরে জন্ম (১৪ মার্চ, ১৮৭৯ সাল) হলেও অন্য দুটি দেশ ঘোরার পর বার্লিনে ফিরে এসে তিনি ১৯১৪ সালে আবার জার্মান নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত তিনি বার্লিনে ছিলেন। নাজিদের উত্থানের পর রাজনৈতিক কারণে তিনি জার্মান নাগরিকত্ব ত্যাগ করেতে বাধ্য হন এবং সালে আমেরিকার প্রিন্সটনে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপকের পদ গ্রহণ করেন। ১৯৪০ সালে আমেরিকার নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন।

খ্যাতির বিড়ম্বনা এবং আক্রমণ

১৯২০ সালের আগস্ট মাসে, বার্লিন ফিলহারমোনিকের সভা কক্ষে, একটি বক্তৃতার সিরিজ সংগঠিত করার ব্যবস্থা করা হয়। সেখানে আইনস্টাইনকে একজন ধাপ্পাবাজ এবং মিথ্যার প্রচারক হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। সভার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল, আপেক্ষিকতার তত্ত্ব (থিওরি অফ রিলেটিভিটি)-কে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে আইনস্টাইনকে নিন্দা করা। আইনস্টাইনের এই তত্ত্ব বিজ্ঞানের শুদ্ধতাকে নষ্ট করেছে - এটাই ছিল অভিযোগ। সভার সংগঠক ছিল “Arbeitsgemeinschaft deutscher Naturforscher” (“Working Society of German Scientists”) নামে একটি সংস্থা। ২৭ আগস্ট, ১৯২০ এক বহুল প্রচারিত দৈনিক ‘Berliner Tageblatt’-এ আইনস্টাইনের প্রতিবাদ প্রকাশিত হয়। তিনি বলেন “a variegated society has assembled whose provisional purpose of existence seems to be to degrade, in the eyes of non-scientists, the theory of relativity, as well as me as its originator... I have good reason to believe that motives other than the striving for truth are at the bottom of this business. (If I were a German nationalist with or without a swastika instead of a Jew with liberal international views, then...)। - একটি বিচিত্র এবং অস্থায়ী সংগঠন এবং অধপতনবাদীদের দৃষ্টিতে, আপেক্ষিকতার তত্ত্ব, এবং সেই সাথে তাকে তার প্রবর্তক হিসাবে অপদস্ত করতে চাইছে। তাঁর বিশ্বাস ছিল যে, এই প্রয়াস সত্য প্রতিষ্ঠার পরিপন্থী। (যদি আমি উদার আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন একজন ইহুদির পরিবর্তে স্বস্তিকার সাথে বা ছাড়া জার্মান জাতীয়তাবাদী হতাম, তাহলে...)। এই সভা-সংগঠকদের মধ্যে একজন ছিলেন ১৯০৫ সালের নোবেল জয়ী জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী ফিলিপ লেনার্ড (Philipp Eduard Anton von Lenard)। এই সভায় আইনস্টাইনকে একজন ইহুদি, গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী এবং ওয়াইমার প্রজাতন্ত্রের (Weimar Republic) একজন দালাল হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। উল্লেখ্য, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানির থুরিঙ্গেন রাজ্যের ওয়াইমারে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং যুদ্ধের বিরোধিতা করে এক স্বাধীন সরকার গঠিত হয় (১৯১৯-১৯৩৩)। হিটলারের নেতৃত্বে নাজিরা ক্ষমতায় আসার পর এই সরকারকে ভেঙে দেওয়া হয়।

তৎকালীন জার্মানির একজন ইহুদি বিরোধী নেতা পল ওয়ালান্ড, ৬ আগস্ট, ১৯২০-তে Tägliche Rundschau নামে বার্লিনের একটি দৈনিক কাগজে একটি প্রবন্ধ লেখেন এবং আইনস্টাইনকে বিভিন্নভাবে অপদস্ত করেন। এমনকী একটি আইনস্টাইন-বিরোধী গোষ্ঠী তৈরির কথা ঘোষণা করেন। তাঁর অভিযোগ ছিল যে, আইনস্টাইন একটি ইহুদিদের গোষ্ঠী তৈরি করেছেন এবং তাঁর আত্মপ্রচারের জন্য ব্যবহার করছেন। অবশ্য এর একটা কারণ ছিল। ১৯১৯ সালে যে পূর্ণ সূর্যগ্রহণ হয় তাকে ব্যবহার করে আইনস্টাইনের ১৯০৫ সালের আপেক্ষিকতাতত্ত্ব প্রমাণিত হয়। এই সফল পরীক্ষায় প্রমাণিত হয় যে, নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ সম্পর্কিত ‘Law of Universal Gravitation’ সংশোধনের প্রয়োজন। এর পরই Berliner Tageblatt দৈনিকে (এই দৈনিকের প্রকাশক Rudolph Mosse ছিলেন একজন ইহুদি) আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব সম্পর্কে লেখা হয় “a highest truth, beyond Galileo and Newton, beyond Kant”।

সেই বছর সেপ্টেম্বর মাসে জার্মানির বাড নওহাইম (Bad Nauheim) শহরে জার্মানির বিজ্ঞানী ও চিকিৎসকদের এক সংগঠনের (Gesellschaft Deutscher Naturforscher und Arzte) একটি সভায়, আইনস্টাইন তাঁর আপেক্ষিকতার তত্ত্ব নিয়ে লেনার্ডের সাথে একটি তীব্র বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। এখানেও আইনস্টাইনকে অপদস্ত করা হয়।

আর্য ফিজিক্স (ডয়েস ফিজিক)-এর কথা

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে ১৯১৪ সালের আগস্ট মাসে জার্মান সেনা বেলজিয়াম আক্রমণ করে এবং ক্যাথলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি পুড়িয়ে দেয়। এই কুকর্মের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকজন প্রখ্যাত ইংরেজ বিজ্ঞানী প্রতিবাদ করেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন আলেকজান্ডার ফ্লেমিং, উইলিয়াম ক্রুক্স, উইলিয়াম রামসে, জে জে থমসন প্রমুখ। এরই প্রতিক্রিয়া হিসাবে ১৬ জন জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী এক যৌথ বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন। এখানে জার্মান জাতকে অপমানিত করা হয়েছে বলে বলা হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে ভার্সাই চুক্তির মাধ্যমে জার্মানিকে হেয় প্রতিপন্ন করায়, জার্মান জাতীয়তাবাদ ভ্রান্ত দেশপ্রেমের চেহারা নেয়। এরপরই দুই নোবেল জয়ী বিজ্ঞানী থিওডর লেনার্ড এবং স্টার্ক (Johannes Stark)-এর নেতৃত্বে ডয়েচ ফিজিক (Deutsche Physik) বা আর্য ফিজিক্স (Arische Physik)-এর কর্মকাণ্ড শুরু হয়। লেনার্ড একদিকে ছিলেন আর্য ফিজিক্সের কর্তা এবং অন্যদিকে অ্যাডলফ হিটলারের পরামর্শদাতা। তাঁর এবং তাঁদের সংগঠনের মত ছিলঃ ‘ইংলিশ ফিজিক্স’ জার্মানদের জ্ঞান চুরি করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং ‘জিউইস ফিজিক্স’ ভ্রান্ত ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত। ১৯৩৩ সালে ইংরেজিতে লেনার্ডের প্রথম প্রকাশিত বই ‘Great Men in Science, A History of Scientific Progress’-এর মাধ্যমে কিছু বিজ্ঞানী সম্পর্কে লেনার্ডের মতামত প্রকাশিত হয়। অত্যন্ত দৃষ্টিকটুভাবে বইটিতে আইনস্টাইন, মাদাম ক্যুরির কথা উল্লেখ করা হয়নি।

আর্য ফিজিক্সের ঘৃণা এতটাই তীব্র ছিল যে, নাজিবিরোধী বিজ্ঞানীদের নোবেল পদক নষ্ট করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। নাজিদের কবল থেকে নোবেল পদক সুরক্ষিত রাখার জন্য ১৯১৪ সালের ফিজিক্সের নোবেল বিজেতা জার্মান বিজ্ঞানী ম্যাক্স ফন লওয়ে (Max Theodor Felix von Laue) এবং ১৯২৫ সালের ফিজিক্সের নোবেল বিজেতা জার্মান বিজ্ঞানী জেমস ফ্রাঙ্ক (James Franck) তাঁদের পদক ডেনমার্কের প্রখ্যাত নোবেল জয়ী বিজ্ঞানী নিলস বোর (Niels Bohr)-এর কাছে জমা রাখেন। বোর ছিলেন একজন নাজিবিরোধী এবং বেশ কয়েকজন নাজি বিরোধীদের আশ্রয়দাতা। নাজিদের হাতে ধরা পড়ে যাওয়ার ঠিক আগে তিনি প্রথমে সুইডেন এবং পরে ব্রিটেনে চলে যেতে বাধ্য হন। লওয়ে ছিলেন ‘ডয়েচ ফিজিক’-এর বিরুদ্ধে এবং তাঁর বক্তব্য ছিল ‘‘science has no race or religion’’। অনেক নাজিবিরোধী বিজ্ঞানীকে বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া এবং তাঁদের গবেষণা যাতে বিঘ্নিত না হয় তার দেখভাল করার কাজ তিনি করেন। জেমস ফ্রাঙ্ক হলেন সেই বিখ্যাত বিজ্ঞানী যিনি ১৯৪৫ সালে ফ্রাঙ্ক রিপোর্ট তৈরি করেন। এই রিপোর্টের মধ্যদিয়ে আমেরিকার রাষ্ট্রপতির কাছে জাপানের বিরুদ্ধে পরমাণু বোমা ব্যবহার না করার জন্য দাবি করা হয়। এই রিপোর্ট ছিল অনেক পরমাণু বিজ্ঞানীর স্বাক্ষরিত। ১৯৪০ সালে যখন হিটলার ডেনমার্ক আক্রমণ করে তখন এই পদকগুলি জর্জ হেভেসে (George de Hevesy) নামে একজন নোবেল জয়ী রসায়ন বিজ্ঞানী তাঁর গবেষণাগারে লোকচক্ষুর আড়ালে ‘অ্যাকুয়া রিজিয়া’ দ্রবণে প্রায় ১০ বছর লুকিয়ে রাখেন। পরে তা উদ্ধার করা হয়।

আঁতে আঘাত

আইনস্টাইনের শান্তি আন্দোলন এবং সমাজতন্ত্রবাদীদের সঙ্গে যোগাযোগ মার্কিন সরকারের চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছিল। এমনকী তৎকালীন মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই’র প্রধান এডগার হুভার তাঁকে আমেরিকা থেকে বহিষ্কারের সুপারিশ করেন। কিন্তু তা হয়নি।

বিজ্ঞান এবং যুক্তিবাদের অগ্রগতিতে মৌলবাদীদের আঁতে আঘাত লাগছে। আমাদের মনে আছে যে, যেমন জার্মানিতে নাজিবাদের উত্থান একদিনে হয়নি, তেমনই এদেশে হিন্দুত্ব-মৌলবাদের ধারা দির্ঘদিন ধরে লালিত হচ্ছে। মৌলবাদী দর্শনের গোড়ার কথা হলো ভগবানই সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা এবং তা ধ্রুব বা অপরিবর্তনীয়। যুক্তিবাদের মূল কথা হলো, প্রকৃতি পরিবর্তনশীল এবং তাই আমাদের চারপাশে যা কিছু সবই পরিবর্তনশীল। এরই হাত ধরে আইনস্টাইন বলতে চাইলেন যে, এই মহাবিশ্বে সমস্ত কিছুই আপেক্ষিক এবং পরিবর্তনশীল। প্রকৃতির নিয়মই আপেক্ষিকতা। আইনস্টাইন বললেন, তত্ত্ব যদি প্রমাণ নির্ভর না হয় তবে তা অলীক। ১৯১৯ সালে তাঁর তত্ত্ব প্রমাণিত হওয়ার পর তিনি বিশ্ববিখ্যাত হন। গোরুর রচনায় অক্সিজেনের তত্ত্ব বিজ্ঞানের কোনো পরীক্ষাতেই প্রমাণিত নয় বরং প্রত্যাখ্যাত। এই অজ্ঞতা দেশের সাংবিধানিক কাঠামোর সব থেকে ভরসার জায়গায় শিকড় গেড়ে বসেছে এটাই আশঙ্কার এবং প্রতিবাদের বিষয়।