E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬১ বর্ষ ৩ সংখ্যা / ২৫ আগস্ট, ২০২৩ / ৭ ভাদ্র, ১৪৩০

মূল্যস্ফীতির খাঁড়ার ঘা

বাদল দত্ত


‘অমৃতকালে’ কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থা ন্যাশনাল স্ট্যাটিস্টিক্যাল অফিস (এনএসও)-র কাছ থেকে আমরা ১৪ আগস্ট, ২০২৩ একটি ‘অমৃত বার্তা’ পেয়েছিঃ দেশে খুচরো মূল্যস্ফীতির হার জুলাইয়ে বেড়ে হয়েছে ৭.৪৪ শতাংশ। এটি ১৫ মাসে সর্বোচ্চ। ভারতের রিজার্ভ ব্যাঙ্কের বেঁধে দেওয়া সহনসীমা সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ অতিক্রম করেছে। এখানে সহনসীমা মানে সাধারণ মানুষের সহনসীমার কথা বলা হচ্ছে না। সাধারণ মানুষের সহনসীমা বহু আগেই অতিক্রান্ত। এই সহনসীমা ভারতের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি বজায় রাখতে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের আর্থিক নীতির ক্ষেত্রে নির্ধারিত একটি মাপকাঠি। অতি সম্প্রতি, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সুদের হার অপরিবর্তিত রাখার কথা ঘোষণা করেছে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ধারণা ছিল চলতি আর্থিক বছরের শেষে দেশের মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়াবে ৫.৪ শতাংশ। ব্যাঙ্কের সুদের হার বাড়িয়ে বাজারে টাকার জোগান কমিয়ে মূল্যস্ফীতিকে বাগে আনার চিরাচরিত আর্থিক দাওয়াই বিশেষ কাজ করছে না।

খুচরো মূল্যস্ফীতির হিসাবে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব (৪৫.৮৬শতাংশ) খাদ্য ও পানীয় পণ্যের। এই ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে হয়েছে ১০.৫৭ শতাংশ। খাদ্য ও পানীয়’র মধ্যে যে পণ্যগুলির দাম সবচেয়ে বেশি বেড়েছে, সেগুলি হচ্ছে তরিতরকারি (৩৭.৩৪ শতাংশ), মশলা (২১.৬৩ শতাংশ), ডাল জাতীয় পণ্য (১৩.২৭ শতাংশ), দানাশস্য (১৩.৪ শতাংশ), দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য (৮.৩৪ শতাংশ)। আবার তরিতরকারির মধ্যে দাম বেশি বেড়েছে টম্যাটো (২০১.৫৪ শতাংশ), আদা (১৭৭. ১১ শতাংশ), রসুন (৭০.০৯ শতাংশ), কাঁচালঙ্কা (৫০. ৪২ শতাংশ)। আলু, বাঁধাকপি, লেবু, মটরশুঁটি এই ক’টি পণ্য বাদ দিলে তালিকাভূক্ত অন্যসমস্ত তরিতরকারির দাম ১০ শতাংশের উপর বেড়েছে। এসব ভারত সরকারের তথ্য ও কর্মসূচি রূপায়ণ মন্ত্রকের তথ্য। সিএমআইই-র তথ্য অনুযায়ী তরিতরকারির দাম গত পাঁচ বছরে সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছেছে। ভারত সরকারের ক্রেতা সম্পর্কিত দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, প্রোটিন-সমৃদ্ধ খাদ্যের দাম গত বছর স্বাধীনতা দিবসের দিন ছিল কেজি প্রতি ৩১ টাকা ৬৬ পয়সা। এ বছর তা তিনগুণ বেড়ে হয়েছে ১০৭ টাকা ৮৭ পয়সা।

নজিরবিহীন বেকারত্বের সঙ্গে পেট্রোল, ডিজেল, কেরোসিন, রান্নার গ্যাস, বিদ্যুৎ সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের ধারাবাহিক দামবৃদ্ধি সাধারণ মানুষের জীবনযাপনকে অসহনীয় করে তুলেছে বহুদিন ধরেই। রান্নার গ্যাসের সিলিন্ডারের দাম ২০১৪ সালে ছিল ৪১০ টাকা, ২০২৩-এ তা বেড়ে হয়েছে ১১০০ টাকা। পেট্রোলের লিটার প্রতি দাম ২০১৪ সালে ছিল ৭১ টাকা। ২০২৩-এ তা বেড়ে হয়েছে ৯৫-১০০ টাকা। ডিজেল ২০১৪ সালে ছিল ৫৫ টাকা। ২০২৩-এ তা বেড়ে হয়েছে ৮৩-৯৮ টাকা। এটা সবার জানা, পেট্রোল, ডিজেলের দাম বাড়লে নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রতিটি জিনিসের দাম বাড়ে। পাল্লা দিয়ে কমছে টাকার দাম। টাকায় ডলারের বিনিময়মূল্য ২০১৪ সালে ছিল ৬২ টাকা। এখন সেটা ৮৩.৫ টাকা, সর্বকালীন রেকর্ড।

সাম্প্রতিক মূল্যস্ফীতি মরার উপরে খাঁড়ার ঘা। সাধারণ মানুষের আয় বাড়ছে না। জিনিসের দাম বেড়েই চলেছে। ফলে সাধারণ মানুষের জীবনযাপন অসহনীয় হয়ে উঠেছে।

তরিতরকারি সহ খাদ্যপণ্যের দাম বেলাগাম বাড়লেও কৃষকের আয় বাড়ছে না। এই দামবৃদ্ধির প্রধান কারণ খাদ্যপণ্যের যথেচ্ছ মজুতদারি। মজুতদারির মাধ্যমে খোলাবাজারে চড়াহারে দাম বাড়িয়ে একতরফা মুনাফার ব্যবস্থা করছে করপোরেট মজুতদারেরা। করপোরেটের স্বার্থে ২০২০ সালে কেন্দ্র সরকার যে তিনটি কৃষি আইন তৈরি করেছিল, তার একটি ছিল পুরনো অত্যাবশ্যক পণ্য আইনের পরিবর্তে কৃষি পণ্যের অবাধ মজুতদারির সপক্ষে নতুন আইন। কৃষক আন্দোলনের চাপে এই আইন তুলে নিলেও পুরনো অত্যাবশ্যক পণ্য আইনের বিধি-নিষেধগুলি অকার্যকর করে রাখা হয়েছে। ফলে খাদ্যপণ্যের মজুতদারি চলছে অবাধে।

সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ সালের প্রথম ত্রৈমাসিকে কৃষি কারবারে করপোরেট আদানির মুনাফা বেড়েছে ৮৬০ কোটি টাকা। গত বছরের তুলনায় ৬৬ শতাংশ বৃদ্ধি। করপোরেট আইটিসি’র মুনাফা বেড়েছে ৩০০ কোটি টাকা। বৃদ্ধির হার ২৫.৯ শতাংশ। ইউনাইটেড ফসফরাসের মুনাফা বৃদ্ধির হার ১৬ শতাংশ। অন্যদিকে কৃষকের প্রকৃত আয় কমেই চলেছে। মূল্যস্ফীতির খাঁড়ার ঘা বিপুল সংখ্যক কৃষকের জীবনকে ভয়াবহভাবে বিপর্যস্ত করে তুলেছে।

জনগণের মাথাপিছু ক্যালরি ও প্রোটিন গ্রহণের পরিমাণ কমছে। প্রোটিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎস খাদ্যশস্য। দানাশস্য ও ডাল গ্রামের মানুষের গড় প্রোটিন গ্রহণের দুই-তৃতীয়াংশ। নয়া উদারনীতির তিন দশকে মাথাপিছু দানাশস্য গ্রহণ কমেছে। খাদ্যে মাথাপিছু প্রকৃত ব্যয় কমেছে। রাষ্ট্রসঙ্ঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা-র ২০১৯-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতে খাদ্যে দানাশস্য গ্রহণ মাথাপিছু ১৭১ কিলোগ্রাম। বিশ্ব গড় ৩০৪ কিলোগ্রাম। আমেরিকার ৫৯০ কিলোগ্রাম। বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ভারত ১২১ টি দেশের মধ্যে ১০৭। একেবারে নিচের দিকে। দামবৃদ্ধি প্রতিদিন সমস্যাকে তীব্রতর করে তুলছে।

ভারত সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রকের অধীন ‘ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর পপুলার সায়েন্সেস’-এর পঞ্চম জাতীয় পরিবার সমীক্ষা ২০১৯-২১-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, শিশু ও প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে উঁচুহারে থাকা রক্তাল্পতা বেড়ে গেছে। ৬ থেকে ৫৯ মাস বয়সি শিশুদের মধ্যে রক্তাল্পতায় ভোগা শিশু ২০১৫-১৬ সালের তুলনায় ৫৯ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৬৭ শতাংশ। প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে বিশেষত মহিলাদের মধ্যে রক্তাল্পতার বৃদ্ধি ঘটেছে। গ্রামীণ শিশু ও প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে রক্তাল্পতা তুলনামূলকভাবে বেশি। এইসব তথ্যে ক্ষুব্ধ কেন্দ্রের সরকার ‘ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর পপুলেশন সায়েন্সেস’-এর অধিকর্তা কে এস জেমসকে সাসপেন্ড করেছে।

১৮৭২ থেকে চালু হওয়া দশসালা জাতীয় জনগণনা (আদমশুমারি) ২০২১-এ সম্পন্ন হওয়ার কথা। করোনা পরিস্থিতি সত্ত্বেও বাংলাদেশ, নেপাল সহ এশিয়ার ১২টি দেশ ২০২১-২২ এ দশসালা জনগণনা সম্পন্ন করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৪১ সালেও ভারতে দশসালা জনগণনা স্থগিত হয়নি। কিন্তু ‘দশসালা জনগণনা ২০২১’ আজও হলো না। গোটা দেশ বঞ্চিত বহু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও পরিসংখ্যান থেকে।

কেন্দ্র সরকার প্রকৃত তথ্যকে লুকোবার চেষ্টা করছে

২০১১-১২-র পর থেকে আমাদের ভোগব্যয়ের কোনো সরকারি তথ্য নেই। ২০১৭-১৮-র তথ্য সরকারিভাবে প্রকাশিত হয়নি। মূল্যবৃদ্ধি, বেকারি সংক্রান্ত ‘ন্যাশনাল স্যাম্পেল সার্ভে অফিস’ (এনএসএসও) দ্বারা পরিচালিত ‘কনজিউমার এক্সপেন্ডিচার সার্ভে ২০১৭-১৮’ সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। ২০১১-১২ সালে এনএসএসও-র হাউসহোল্ড কনজিউমার এক্সপেন্ডিচারের বৃহৎ নমুনা সমীক্ষায় সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে দারিদ্র্যসীমা ঠিক করা হয়েছিল মাসিক মাথাপিছু ব্যয়ের ভিত্তিতে। তখন তা ছিল গ্রামে ৮১৬ টাকা। শহরে ১০০০ টাকা। তখন দেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে মানুষের সংখ্যা ছিল ২৭ কোটি। তারপর দেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে কত মানুষ আছেন সরকারের জানা নেই। সরকার কোনো সমীক্ষা করেনি। সরকারের কোনো নতুন মাপকাঠিও নেই। রঙ্গরাজন কমিটি, তেন্ডুলকর কমিটি, এনএসএস-এর ভোগব্যয় নির্ভর দারিদ্র্যের পরিমাপ পদ্ধতির পরিবর্তে বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচক চালু করার চেষ্টা করছে। সিএমআইই কিংবা পিএলএফএস-এর তথ্যকে সরকার গ্রহণ করছে না। ন্যাশনাল স্যাম্পেল সার্ভে (এনএসএস) ও ন্যাশনাল অ্যাকাউন্ট স্ট্যাটিস্টিকস-এর তথ্যের মধ্যে ফারাক হচ্ছে। এই ফারাক দূর করতে ন্যাশনাল স্ট্যাটিস্টিক্যাল অফিস (এনএসও)-এর কোনো উদ্যোগ নেই।

খুচরো মূল্য সূচকের এই উল্লম্ফনের ফলে সাধারণ মানুষের জীবনে যে গুরুতর বিপর্যয় নেমে আসছে কোনো সরকারি তথ্যে তা যাতে ধরা না পড়ে, তার জন্য কেন্দ্র সরকার সুপরিকল্পিতভাবে তথ্যকে আড়াল করার চেষ্টা করছে।

বাস্তব অভিজ্ঞতা বড়ো নির্মম। শত চেষ্টাতেও সত্যকে লুকানো সম্ভব নয়। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো (এনসিআরবি)-র রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৪ সালে ১৫,৭৩৫ জন দিনমজুর আত্মহত্যা করেছেন। ২০২১ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৪২,০০৪ জন। ২০২১ সালে প্রতিদিন গড়ে ১১৫ জন দিনমজুর আত্মহত্যা করেছেন। কর্মহীনতা, স্বল্প অথবা অনিয়মিত আয়, ধারাবাহিক দামবৃদ্ধির কশাঘাত, ঋণগ্রস্ততা, অসুস্থতা, সামাজিক লজ্জা কীভাবে এত মানুষের জীবন কেড়ে নেয় সরকার কোনোদিন তা ভেবে দেখেনি। তা যদি হতো কেন্দ্র সরকার ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পে বরাদ্দ কমানোর পরিবর্তে বাড়ানোর কথা ভাবত। মজুরি বৃদ্ধির হারের চেয়ে অনেক বেশি দ্রুত হারে বাড়ছে মূল্যস্ফীতির হার। এই সংকট প্রতিদিন শতাধিক দিনমজুরকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এই সংখ্যা আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। সরকারের কোনো হুঁশ নেই।

বিশ্বজুড়ে চলছে মন্দা। ভারতেও তা ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। বাজারের অভাবে বহু কলকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে বেকারত্ব বেড়ে চলেছে। শিল্প-শহরে বেকারত্ব বাড়ছে অনেক বেশি হারে। পরিযায়ী শ্রমিকদের শহরমুখী স্রোত কমেছে। দরিদ্র মানুষের হাতে টাকা নেই। বাজারে ভোগ্যপণ্যের চাহিদা কমছে। তার সঙ্গে জুড়েছে বিপুল পরিমাণ মূল্যস্ফীতি।

অক্সফাম ইন্ডিয়া’র রিপোর্ট অনুযায়ী দেশের সবচেয়ে ধনী ১ শতাংশের হাতে মোট সম্পদের ৪১ শতাংশ। নিচের তলার ৫০ শতাংশের হাতে মোট সম্পদের মাত্র ৩ শতাংশ। ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান বাড়ছে কুৎসিতভাবে। দলিত, জনজাতি, মুসলিম, মহিলা এবং অসংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মীরা ক্রমাগত কোণঠাসা হচ্ছেন। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমছে। ফলে দেশ আজ চরম চাহিদার অভাব সংকটে ভুগছে। মূল্যস্ফীতি এই সংকটকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেবে।