৬১ বর্ষ ৩ সংখ্যা / ২৫ আগস্ট, ২০২৩ / ৭ ভাদ্র, ১৪৩০
৩১ আগস্ট - গণআন্দোলনের শহিদ দিবস ও বর্তমান সময়
সন্দীপ দে
৩১ আগস্ট - পশ্চিমবঙ্গের গণআন্দোলনের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। এই দিনটি সংগ্রাম-বিদ্রোহের চেতনায় প্রেরণার উৎস হিসাবে রাজ্যের সুদীর্ঘ গণআন্দোলনের ইতিহাসে সমুজ্জ্বল হয়ে আছে। ১৯৫৯ সালের ৩১ আগস্ট কলকাতায় খাদ্যের দাবি জানাতে এসে গ্রামাঞ্চলের গরিব বুভুক্ষু শতাধিক মানুষ তৎকালীন স্বৈরাচারী কংগ্রেস শাসকদের বর্বরোচিত আক্রমণে শহিদের মৃত্যুবরণ করেছিলেন। সেদিন স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের পুলিশ ঠান্ডা মাথায় লাঠিপেটা করে নিরীহ-নিরন্ন ৮০ জন মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। এই ঘটনায় সেদিন গর্জে উঠেছিল বাংলা।
এই ঘটনার পর থেকে প্রতিবছর এই দিনটিতে সেই সময়ের রক্তাক্ত ইতিহাসকে স্মরণ করে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়। ১৯৭৭ সালে রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠার পর, ১৯৭৮ সাল থেকে এই দিনটি গণআন্দোলনের শহিদ দিবস হিসাবে পালিত হয়ে আসছে।
এবারে স্বাধীনতার ৭৭তম এবং সেই ঐতিহাসিক আন্দোলনের ৬৪তম বর্ষে দেশ এবং রাজ্যের এক বিশের অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতিতে দিনটি রাজ্য বামফ্রন্টের উদ্যোগে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হবে রাজ্যে। এদিন সকালে কলকাতায় সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারে শহিদ স্মারক স্তম্ভে মাল্যদানের পাশাপাশি রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে নানা কর্মসূচির মাধ্যমে দিনটি পালিত হবে। কলকাতার ধর্মতলায় বেলা ২টায় হবে বিশাল সমাবেশ। বর্তমানে দেশজুড়ে ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধি, বেকারি, টাকার মূল্যের অধোগতি, সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা-হিংস্রতা সহ রাজ্যে তৃণমূলের অপশাসন, নৈরাজ্য, দুর্নীতি ইত্যাদিতে সাধারণ মানুষের যে জীবন-যন্ত্রণা তীব্র হয়েছে, তারা ক্রমশ সংকটের আবহে জড়িয়ে যাচ্ছেন, এই পরিপ্রেক্ষিতকে সামনে রেখে চলছে নিবিড় প্রচার। আগামী দিনের বৃহত্তর লড়াইয়ের প্রস্তুতিতে ৩১ আগস্টের সমাবেশকে বিশাল সমাবেশে রূপদানের প্রস্তুতি নিচ্ছেন বামফ্রন্টের কর্মীরা। কলকাতার সমাবেশের পাশাপাশি এদিন উত্তরবঙ্গের জেলাগুলির সমাবেশ হবে জলপাইগুড়ি শহরে।
৩১ আগস্ট ’৫৯ পুলিশের হিংস্র বর্বরতার নমুনা।
কংগ্রেসী দুঃশাসনে খাদ্যের হাহাকার
প্রতিবাদ-আন্দোলন
স্বাধীনতার পর থেকেই রাজ্য সরকারের ভূমিনীতি, কৃষিনীতি ও খাদ্যনীতির ফলে খাদ্য সংকট ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। ১৯৫৬ সালে পশ্চিমবাংলায় ভয়াবহ বন্যায় ব্যাপক মানুষের ক্ষতি হয়। ১৯৫৭ সাল থেকেই খাদ্য সংকটের তীব্রতা মারাত্মক আকার নিতে থাকে। ১৯৫৯ সালে বিধানচন্দ্র রায়ের নেতৃত্বাধীন তৎকালীন কংগ্রেস সরকারের অপশাসনে চরম খাদ্য সংকট দেখা দেয়। গ্রামাঞ্চলে দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতিও তৈরি হয়। এই সংকট সমাধানের দাবিতে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে ধারাবাহিক আন্দোলন গড়ে ওঠে। এই পরিস্থিতিতে কংগ্রেস সরকারের মজুতদার-তোষণকারী খাদ্য নীতির ফলে কৃত্রিমভাবে তৈরি হওয়া শোচনীয় খাদ্যাবস্থার প্রতিকার এবং গরিব মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে খাদ্য পাবার দাবিতে গড়ে ওঠা ‘পশ্চিমবঙ্গ মূল্যবৃদ্ধি ও দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ কমিটি’র নেতৃত্বে আন্দোলন শুরু হয়। ১৪ জুলাই থেকে ২০ আগস্ট পর্যন্ত ছিল এই আন্দোলনের প্রথম পর্যায়। ১৪ জুলাই বিভিন্ন জেলা আদালত ও স্থানীয় সরকারি দপ্তরগুলির সামনে আইন অমান্যের মধ্য দিয়ে আন্দোলনের সূচনা হয়। এই পর্যায়ে জেলায় জেলায় আইন অমান্যকারী ১৬৩১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
২০ আগস্ট থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়ে কলকাতা মহানগরী সহ সমস্ত জেলায় আইন অমান্য আন্দোলন সম্প্রসারিত হয়। ৩১ আগস্ট কলকাতা সহ সমস্ত জেলা সদরে অবিরাম কেন্দ্রীয় গণঅভিযান, জেলাগুলির সদর আদালতে গণ আইন অমান্য কর্মসূচি পালিত হয়। কলকাতায় রাজ্য সরকারের দপ্তর অভিমুখে গণমিছিল এবং কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে আইন অমান্য কর্মসূচি নেওয়া হয়। এই পর্যায়ের শেষে ৩ সেপ্টেম্বর রাজ্যব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট ও হরতালের ডাক দেওয়া হয়েছিল।
৩১ আগস্ট গ্রাম-গ্রামান্তরের দুর্ভিক্ষ-পীড়িত নিরন্ন বুভুক্ষু মানুষ ‘খাদ্য চাই, খাদ্য দাও’ আওয়াজ তুলে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য কলকাতার রাজপথে মিছিলে পা মিলিয়েছিলেন। কিন্তু সেদিন খাদ্যের বদলে তাঁদের জুটেছিল বিধান রায় সরকারের পুলিশের নির্মম নৃশংস লাঠির আঘাত। অথচ সেই নিরীহ বিপন্ন মানুষরা কোথাও কোনো বিশৃঙ্খলা বা আইন ভেঙে সংঘাত তৈরি করেনি। তবুও পুলিশের নির্মম নৃশংস আক্রমণে মহানগরীর রাজপথ সেদিন শত শত গরিব, ক্ষুধার্ত মানুষের তাজা রক্তে সিক্ত হয়েছিল। ওইদিন শুধুমাত্র পুলিশের লাঠির আঘাতেই প্রাণ হারাতে হয়েছিল ৮০ জন ক্ষুধার্ত মানুষকে। আহত হয়েছিলেন শত শত। গ্রেপ্তার করা হয়েছিল কয়েক হাজার বিপন্ন-নিরন্ন মানুষকে।
ওইদিন কলকাতার মনুমেন্ট ময়দানে (বর্তমানের শহিদ মিনার) বিশাল সমাবেশ হয়েছিল। সমাবেশে বিপুল সংখ্যায় ছিলেন মহিলারা। সভা শেষে লক্ষাধিক নরনারীর সম্পূর্ণ নিরস্ত্র, শান্তিপূর্ণ মিছিল যখন রাজভবনের সামনের পথ ধরে এগিয়ে যেতে থাকে, তখনই সেই মিছিলের ওপর অতর্কিতে নেমে আসে কংগ্রেস সরকারের বর্বর আক্রমণ। কংগ্রেস সরকারের হিংস্র-স্বৈরতান্ত্রিক আক্রমণে নিরন্ন মানুষের রক্ত-বন্যায় ভেসে যায় মহানগরীর রাজপথ।
সেদিনের এই নৃশংস বর্বরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে গর্জে উঠেছিল কলকাতা ও শহরতলী। মানুষের দৃপ্ত প্রতিবাদ সেদিন কলকাতা মহানগরীর সীমানা অতিক্রম করে বিস্তৃত হয়েছিল সংলগ্ন বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। সেই প্রতিবাদকে স্তব্ধ করতে আরও কয়েকদিন কলকাতা ও শহরতলীতে চলেছিল শুধু লাঠি বা কাঁদানে গ্যাস নয়, চলেছিল পুলিশের বেপরোয়া গুলিবর্ষণ। ফলে শহিদ হতে হয়েছিল আরও বেশ কয়েকজনকে।
এই আন্দোলনে জেলায় জেলায় অংশগ্রহণ করেন হাজার হাজার মানুষ। এই প্রতিবাদ-কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে কয়েক হাজার মানুষ গ্রেপ্তার বরণ করেন। ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আইন অমান্যের জন্য গ্রেপ্তার হন ১৪,২৩২ জন।
প্রসঙ্গত, আন্দোলনের সূচনাতেই তৎকালীন কুখ্যাত নিবর্তনমূলক আটক আইন প্রয়োগ করে দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ কমিটির সদস্য-সংগঠক সহ বামপন্থী দলগুলির নেতৃবৃন্দকে নির্বিচারে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। আন্দোলনকে নেতৃত্বহীন করে দিয়ে আন্দোলনকে স্তিমিত ও দিশাহীন করে দেওয়াই ছিল সরকারের লক্ষ্য। কিন্তু কংগ্রেস সরকারের সেই লক্ষ্য ব্যর্থ হয়েছিল। আন্দোলনের সূচনাপর্ব থেকে প্রতিটি জেলায় নির্দিষ্ট কর্মসূচি অনুযায়ী শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খল কর্মসূচি পালিত হয়েছিল। সাধারণ মানুষও আইন অমান্যের নতুন নতুন কর্মসূচি গ্রহণ করে আন্দোলনকে ক্রমশ ব্যাপক ও দুর্বার করে তোলেন। প্রাথমিক পরাজয়ে ক্ষিপ্ত সরকার পরাজয়ের গ্লানি ঢাকতে চেয়েছিল রক্তাক্ত প্রতিশোধের মাধ্যমে। তাই তারা ৩১ আগস্ট ও তার পরের দিনগুলিতে যে হিংস্র উন্মত্ত অভিযান চালিয়েছিল, তা ‘রক্তে লেখা দিন’ হিসাবেই চিহ্নিত হয়ে আছে।
৩১ আগস্ট থেকে ৩ সেপ্টেম্বর - এই চারদিনের মধ্যে কলকাতা ও হাওড়ায় প্রাণ হারিয়েছিলেন শতাধিক মানুষ। হিংসার এই উন্মত্ত বীভৎস রূপ দেখে স্তম্ভিত হয়েছিল সারাদেশ। তীব্র প্রতিবাদে গর্জে উঠেছিল বাংলার ছাত্রসমাজ। তাই ৮ সেপ্টেম্বর স্কুল-কলেজে উদ্যাপিত হয়েছিল শহিদ দিবস। ১০ সেপ্টেম্বর বিভিন্ন কল-কারখানায়, অফিসে শহিদ দিবস পালন করেন শ্রমিক-কর্মচারীরা। সেদিন কলকাতা মহানগরী প্রত্যক্ষ করেছিল অভাবনীয় মৌন মিছিলে বিপুল জনস্রোত। মহাসমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের মতো সেই মৌনমুখর মিছিলের সামনে সেদিন বিশালাকার পোস্টারে লেখা হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের কবিতার সেই বিখ্যাত পঙ্ক্তি -
‘‘বীরের এ রক্তস্রোত
মাতার এ অশ্রুধারা
এর যত মূল্য সে কি
ধরার ধূলায় হবে হারা?’’
এই ঐতিহাসিক আন্দোলন পরবর্তীকালে আরও অজস্র গণ-আন্দোলনের উত্তাল তরঙ্গে এসে মিলেছে এবং পশ্চিমবাংলার আন্দোলন-সংগ্রামে দুর্বার নবতরঙ্গ সঞ্চার করেছে।
আজকের সময়
এই সময়ে দেশে বিজেপি এবং রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেসের দুঃশাসনে সাধারণ মানুষ দুর্বিষহ সংকটের আবর্তে জড়িয়ে পড়েছেন। বিশেষ করে কৃষিতে ভয়াবহ সংকটের পরিণতিতে গরিব শ্রমজীবী মানুষের সামনে মারাত্মক খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের করপোরেট তোষণ নীতি ও সরকারি ব্যবস্থা ধ্বংস করে দেবার পরিণতিতে এই সংকটের তীব্রতা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। তাই ভিন্ন প্রেক্ষিত সমস্যা-সংকটের পার্থক্য থাকলেও বর্তমান সময়ে তৈরি হওয়া কৃষি ও খাদ্য সংকট ’৫৯-এর খাদ্য আন্দোলনের সেই দুঃসহ কালপর্বকেই যেন আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে।
মোদি ও মমতা সরকারের নীতিতে কৃষি ও কৃষকের সংকট আজ তীব্র হয়েছে। চাষের উপকরণ সহ আনুষঙ্গিক চাষের খরচ কৃষকের হাতের নাগালের বাইরে। তার উপর ফসল ফলিয়েও কৃষকেরা ফসলের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না। এদিকে গরিব-প্রান্তিক কৃষকরা একদিকে যেমন বিমার সুযোগের নামে প্রতারিত হচ্ছেন, অন্যদিকে জেরবার হচ্ছেন মহাজনি ঋণের জালে। গণবণ্টন ব্যবস্থা ক্রমশ ভেঙে দেওয়া হচ্ছে। খাদ্য নিরাপত্তা বিপন্ন। ফলে অনাহারে থাকা মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। এসবেরই পরিণতিতে কৃষকদের আত্মহত্যার ঘটনা ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে। পুষ্টির অভাবে শিশুরা ধুঁকছে। বাস্তবে গ্রাম ভারত-গ্রামবাংলার যখন এই বিপন্ন অবস্থা, তখন কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের বিজ্ঞাপনী দামামায় নিজেদের কৃষি ও কৃষকের স্বার্থবাহী বন্ধু রূপে জাহির করার ব্যাপক আয়োজন চোখে পড়ছে। তাদের প্রচারে মনে হচ্ছে যেন কোনো সংকটই স্পর্শ করতে পারেনি কৃষি ও কৃষককে।
দেশের মানুষের অভিজ্ঞতায় রয়েছে, প্রতিটি বাজেটেই কৃষি ও কৃষক স্বার্থের কথা বলে মোদি সরকার এমন সব পদক্ষেপ নিয়েছে যা আসলে তাদের করপোরেট বন্ধুদের মুনাফার সুবিধা হয়। নয়াউদারনীতির পথ ধরে কৃষিক্ষেত্রে সর্বনাশ করা হয়েছে। চূড়ান্তভাবে অবহেলিত হয়েছে কৃষি ও কৃষক। বিশ্বব্যাঙ্ক, বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার নির্দেশ অনুসরণ করে স্বাধীন সার্বভৌম দেশের সরকার কৃষিতে ধারাবাহিকভাবে ভরতুকি প্রত্যাহার করে চলেছে। ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য প্রদান ও ফসল সংগ্রহ ব্যবস্থা থেকে হাত গুটিয়ে নিয়েছে। উলটো দিকে করপোরেট ও বহুজাতিক সংস্থাগুলিকে কৃষিক্ষেত্রে অবাধ অনুপ্রবেশের পথ তৈরি করে দিয়েছে। আজকে মুক্ত বাণিজ্য ও কাঠামোগত সংস্কারের নামে কৃষকের উপর বাড়তি বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। জমির ঊর্ধ্বসীমা তুলে দেওয়া, সেচ-বিদ্যুৎ-ঋণ ইত্যাদির উপর ভরতুকি তুলে দেওয়া, খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা বানচাল করা, আগাম বাণিজ্যের উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া ইত্যাদি পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে কৃষককে মেরে ফেলার সবরকম বন্দোবস্ত করা হয়েছে। চুক্তিচাষ, গোষ্ঠীচাষ ইত্যাদির নামে বিপুল পরিমাণ জমি হস্তান্তর করা হচ্ছে করপোরেটদের হাতে। কৃষক জমিচ্যুত হচ্ছেন। দেশের গ্রামাঞ্চলে বাড়ছে ভূমিহীন মানুষের সংখ্যা।
সম্প্রতি সংবাদ সংস্থা ‘দ্য রিপোটার্স কালেকটিভ’ জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী মোদি কৃষকের আয় দ্বিগুণ করার যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে কৃষি আইনের যে বদল এনেছিল, তা আসলে করা হয়েছিল কৃষিপণ্য ব্যবসায় আদানিদের বর্ধিত মুনাফা নিশ্চিত করার লক্ষ্যেই। সরকারি তথ্যেই জানা যাচ্ছে, ২০২২-২৩ সালের প্রথম ত্রৈমাসিকে কৃষি ব্যবসায়ী করপোরেট আদানির মুনাফা বেড়ে হয়েছে ৮৬০ কোটি টাকা, গত বছরের তুলনায় যা ৬৬ শতাংশ হারে বৃদ্ধি হয়েছে। এছাড়া করপোরেট আইটিসি’র মুনাফা হয়েছে ৩০০ কোটি টাকা। অথচ আশ্চর্যের বিষয়, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সাম্প্রতিক এক তথ্যে জানা যাচ্ছে - মোদি জমানায় গত দশ বছরে করপোরেটদের অনাদায়ী ঋণ মকুব হয়েছে ১৫ লক্ষ কোটি টাকা! অন্যদিকে কৃষকের প্রকৃত আয় কমেই চলেছে।
এদিকে দেশে মুদ্রাস্ফীতির হার জুনের ৪.৮৭ শতাংশ থেকে জুলাইয়ে পৌঁছে গিয়েছে ৭.৪৪ শতাংশে। দেশে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম ক্রমাগত বাড়ছে। গত এক বছরে তরিতরকারির দাম বেড়েছে ৩৭ শতাংশ। কিন্তু কৃষকের আয় বাড়ছে না। এর অন্যতম কারণ খাদ্যপণ্যের যথেচ্ছ মজুতদারি। এই অবস্থার পরিণতিতে তীব্র সংকটে জর্জরিত হয়ে ক্রমশ নিঃস্ব হয়ে যাওয়া গরিব কৃষক, দিনমজুররা বাধ্য হচ্ছেন আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে। আজ দেশের স্বাধীনতার ৭৭তম বর্ষেও সরকারের নীতিতে খাদ্য সংকট তীব্র আকার নিচ্ছে। বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ২০২২ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১২১ টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১০৭-এ। তবুও নির্লজ্জ প্রধানমন্ত্রী এবারের স্বাধীনতা দিবসের লালকেল্লা থেকে ভাষণে বাণী দিয়েছেন, আগামী ২০২৪-এ তিনি লোকসভা নির্বাচনে জিতে আসবেন এবং তাঁর তৃতীয় দফার প্রধানমন্ত্রীত্বে ভারত নাকি বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হয়ে উঠবে।
দেশের এই ভয়ঙ্কর অবস্থার মধ্যে বাংলার অবস্থাও ভয়াবহ। ‘পরিবর্তনের’ বাংলায় ফসলের দাম নেই। অতিরিক্ত দামে বীজ, সার কিনে মহাজনের কাছ থেকে চড়া হারে ঋণ নিয়ে ফসল ফলিয়ে কৃষকরা সফলের ন্যূনতম দামটুকুও পাচ্ছেন না। সরকারের ফাঁকা ঘোষণা থাকলেও সরকারি উদ্যোগে ফসল কেনার উদ্যোগ সেভাবে নেই। এই সুযোগে ফড়ে, মজুতদাররা গ্রামে গ্রামে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। অন্যদিকে অভাবী বিক্রি বেড়েই চলেছে। গ্রামের মানুষের আয়ের পথ ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে। কেন্দ্রের সরকার একদিকে একশো দিনের কাজে অর্থবরাদ্দ কমাচ্ছে, অন্যদিকে রাজ্যে একশো দিনের কাজে শাসকদলের ব্যাপক দুর্নীতি চলছে।
বাম আমলে ভূমিসংস্কার কর্মসূচির মধ্য দিয়ে উপকৃত হয়েছিলেন অগণিত গ্রামীণ মানুষ। তখন ভূমিহীনদের হাতে জমি গিয়েছিল। কৃষকেরা জমির অধিকার ফিরে পেয়েছিলেন। মানুষের আয় বেড়েছিল, খাদ্য নিরাপত্তা সুনিশ্চিত হয়েছিল। তৃণমূল সরকারে এসেই এর উলটো পথে চলতে শুরু করে। নির্বিচারে বর্গাদার, পাট্টাদারদের জমি কেড়ে নেওয়া, কৃষকদের জমি থেকে উচ্ছেদ, ফসল লুট চালাতে থাকে শাসকদলের দুর্বৃত্তরা। ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থা আজ তৃণমূলী জমানায় সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত। ‘মা মাটি মানুষ’-এর সরকারের আমলে আজ গ্রামীণ মানুষ নানাভাবে আক্রান্ত। মানুষের আয়ের সংস্থান ক্রয়ক্ষমতা দিনে দিনে কমছে। জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধিতে খাদ্যসামগ্রী নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। গ্রামে কাজ নেই। যুবকরা ছুটছেন ভবিষ্যতের আশায় ভিন্রাজ্যে। বাম আমলে গড়ে-ওঠা খাদ্য নিরাপত্তার বদলে আজ ক্ষুধা বাড়ছে। এদিকে রাজ্যেও কৃষিতে ব্যক্তিগত পুঁজির অনুপ্রবেশ ঘটছে। সরকারের খাদ্যনীতি ক্রমশ বাজার-নির্ভর হয়ে পড়ছে। কেন্দ্র ও রাজ্যের নীতির ফলে খাদ্য ও জীবিকার অনিশ্চয়তা ক্রমশ যেন প্রকট হয়ে গেছে।
এমনই এক চরম সংকটময় পরিস্থিতিতে ৩১ আগস্ট ও পরবর্তী আন্দোলন মুখর সেই দিনগুলি স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে - এই অবস্থার মোকাবিলায় আরও দুর্বার লড়াই ছাড়া বিকল্প পথ নেই।