৬১ বর্ষ ৩ সংখ্যা / ২৫ আগস্ট, ২০২৩ / ৭ ভাদ্র, ১৪৩০
হাম দেখেঙ্গে
সুশোভন
স্যাকরার ঠুক-ঠাক,
কামারের এক ঘা।
চন্দ্রযান-৩-এর সফল সফট ল্যান্ডিং-এ অবশ্যই কৃতিত্ব আছে মোদির।
এতে প্রধানমন্ত্রী কি করলেন, কারও কৃতিত্ব থাকলে সেটা ইসরোর, সেটা বিজ্ঞানীদের, বিজ্ঞানের।
আজকে মর্নিং ওয়াকের গ্যাং-এ জোর লড়াই! বিষয় চন্দ্রযান-৩ কৃতিত্ব কার? মর্নিং ওয়াকে খেয়াল করে দেখবেন বিভিন্ন গ্যাং থাকে। গ্যাং মানে ছোটো ছোটো ৪-৫ জনের টিম। একসাথে বেশ গল্প করতে করতে হাঁটেন। গল্প করতে করতে চর্বি গলানোর পাঁয়তারা কতটা কাজে লাগে সে কথা ডায়েটিশিয়ানরা ভালো বলতে পারবেন, তবে সমাজ, রাজনীতি, বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে এমন কিছু তথ্য আপনি এঁদের সান্নিধ্যে জানতে পারবেন যেগুলো বেসিক্যালি হোয়াটস অ্যাপ ইউনিভার্সিটির সার্টিফায়েড কোর্স ওয়ার্ক। কৃতিত্বের ভাগাভাগি নিয়ে লড়াই যখন তুঙ্গে, তখন গ্যাং-র ফোড়ন মাস্টার সদস্য সব কিছু নস্যাৎ করে দিয়ে বললেন, “জানিস ২০০০ কোটি টাকা অ্যালট করেছিলেন মোদি। কৃতিত্ব নেই বললেই হবে?” এমনিতে সাধারণ মানুষের ট্যাক্সের টাকা ভক্তদের আবদারে কবে যে মোদির টাকা হয়ে যাবে আপনি ধরতে পারবেন না, তার উপর যে চন্দ্রযান-৩-র বাজেট যেখানে সব মিলিয়ে ৬১৫ কোটি সেখানে কেনই বা কেউ ২০০০ কোটি টাকা অ্যালট করবেন সে অঙ্কও আপনি মেলাতে পারবেন না। বরং ইন্টারনেট খুঁজে দেখলে আপনি ইসরোর যে সমস্ত বিজ্ঞানী চন্দ্রযান-৩-র লঞ্চ প্যাড বানিয়েছিলেন তাঁদের ১৭ মাস বেতন না পাবার খবর দেখবেন। যাকগে, মাস্টার স্ট্রোকটা দিল গ্যাং-র মিনমিনে সদস্য। গলা নামিয়ে ধীরে সুস্থে বললেন “তা ঠিক ৪ লক্ষ কিলোমিটার দূরে চন্দ্রযানের সফট ল্যান্ডিং মোদির কৃতিত্ব আর ৪০০ মিটার দূরে সবজি বাজারে যে টমেটো ৩০০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে সেটা নেহেরুর দোষ।” চন্দ্রযান-৩ নিয়ে হোয়াটস অ্যাপ ইউনিভার্সিটির মর্নিং আড্ডা ওখানেই ইতিগজ। কে জানে কত ক্যালোরি খরচা হলো আর কতই বা বেঁচে গেল! কথায় বলে “স্যাকরার ঠুক-ঠাক, কামারের এক ঘা”।
উদ্দেশ্য এবং বিধেয়
অবশ্য কামারের এক ঘা কাল দিদিমণিই দিয়ে দিয়েছেন। উনি এই নিয়ে দ্বিতীয় বারের জন্য রাকেশ রোশনকে চাঁদে পাঠিয়ে দিয়েছেন। সেই নিয়ে টুইটারে তুমুল হাসির রোল উঠেছে। রাকেশ শর্মা কোন যাদুবলে রাকেশ রোশন হয়ে যাচ্ছেন সেই নিয়ে মিমের বন্যা বয়েছে। অবশ্য মুখ্যমন্ত্রীর লুজ টক নতুন কিছু না। কোনোদিন উনি হুল দিবসে সিধু-কানুর সাথে ‘ডহর’ বাবু কে খুঁজে পেয়েছেন। কোনোদিন ‘সিপিএম’ ওনার মাথায় গুলি করেছিল বলে দাবি করেছেন। কোনোদিন উনি বাংলার বিধানসভায় রাজা রামমোহন রায়কে বসিয়ে দিয়েছেন, কোনোদিন উনি সরস্বতী বন্দনার মন্ত্র অন মাইক ভুল পড়েছেন। আজ ডিজি-কে উত্তমকুমারের মতো দেখতে লাগে বলছেন, কাল অমানুষ সিনেমাতে উত্তমকুমারকে অমিতাভ বানিয়ে অভিনয় করিয়ে দিচ্ছেন, আর পরশু প্রয়াত লতা তাঁকে কত্ত স্নেহ করতেন সেই ফান্ডা দিচ্ছেন!
লোকে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে নিয়ে হাসাহাসি করছেন, ব্যঙ্গ করছেন, বিদ্রূপ করছেন। আর ওদিকে মুখ্যমন্ত্রী ‘ডোন্ট কেয়ার’ অ্যাটিটিউড নিয়ে আবার পরের দিন ভাষণ দিতে গিয়ে ভূগোল, ইতিহাস, সাহিত্য, শিল্প, কৃষ্টি সংস্কৃতির চৌদ্দ গুষ্ঠি উদ্ধার করে দিচ্ছেন! আপনার মনে হচ্ছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কি এগুলো দেখেন না? নিজের এই অকারণ মিথ্যে বাচালতাতে উনি লজ্জা পান না? আপনি হয়ত ভাবছেন একটু তো বুঝে বলতে পারেন, জানা না থাকলে জেনে নিয়ে বলতে পারেন! যেমনই হোক রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, প্রশাসনিক প্রধান; এরকম আলটপকা মন্তব্য তো উনি না করলেই পারেন!
ঠিকই, আপনি ভাবছেন, আমরা ভাবছি, রাজ্যের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ ভাবছেন – সবই ঠিক আছে। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী ভাবছেন না। ভাবার প্রয়োজনও বোধ করছেন না। কারণ এই হালকা মন্তব্যগুলো নিয়ে মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়াতে যত হইচই হচ্ছে তার চোটে আড়াল হয়ে যাচ্ছে মুখ্যমন্ত্রীর অনেক বিষাক্ত রাজনৈতিক মন্তব্য এবং কাজ। ঠিক যেমন এবার আড়াল হয়ে যাচ্ছে মুখ্যমন্ত্রীর পূজা অনুদানের ঘোষণার নোংরা রাজনীতিটা। এটাই লুজ টকের আসল উদ্দেশ্য এবং বিধেয়।
ডাল মে কুছ কালা হ্যায়
পূজা কমিটিতে অনুদান শুরু হয়েছে ২০১৮-তে। ১০ হাজার টাকা দিয়ে। ২০১৯-এ বেড়ে দাঁড়ায় ২৫ হাজার। ২০২০ এবং ২০২১, কোভিডের সময়ে এই অনুদান ছিল ৫০ হাজার করে। ২০২২-এ ৬০ আর এবার ২০২৩-এ সেটা বেড়ে দাড়াল ৭০ হাজার। এছাড়াও পূজা কমিটিগুলির বিদ্যুৎ বিলে ৩/৪ অংশ ছাড়, সবধরনের করে ছাড়, দমকল অনুমতি বাবদ ফি মকুব এসব তো আছেই আই অন দি টপের মতো। সহজ হিসেবে এই সংখ্যাগুলো একটু সাজিয়ে গুছিয়ে নিলে কেমন লাগবে?
২০২২-এ ৪০,০২৮ ক্লাবকে ৬০ হাজার টাকা করে অনুদান দিতে মোট খরচা হয়েছিল ২৪০ কোটি। এবার সেটা বেড়ে দাঁড়াতে পারে ২৮০ কোটি। অবশ্য ক্লাবের সংখ্যা যদি একই থাকে তবেই। ক্লাবের সংখ্যা বাড়লে এই অঙ্ক বাড়বে। গড়পরতা একটা হিসেব বলছে, ২০১৮-২০২৩ পূজা কমিটিতে অনুদান দিতে রাজ্য সরকারের মোট খরচা আনুমানিক ১১০০ কোটি। আচ্ছা বাস্তবে এই ১১০০ কোটি টাকাটা বুঝতে কেমন? এই ১১০০ কোটিতে ৫ বছর বেতন দেওয়া যেত ৯,১৬৬ সাধারণ কর্মীকে, ৬,১১১ প্রাথমিক শিক্ষককে, ৪,০৭৪ উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষককে।
এই সংখ্যাগুলোকে অনুধাবন করতে হবে এই আঙ্গিকে যে, বাংলার স্কুলে ভয়ঙ্কর বেড়েছে ড্রপ আউট। বন্ধ হতে চলেছে ৮.২০৭টি স্কুল। শিক্ষক ছাত্র অনুপাত, যা থাকার কথা ১:৩০ বর্তমানে সেটা ১:৭৩। যোগ্য প্রার্থীরা রাস্তায় বসে আন্দোলন করছেন আর প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী সহ পুরো শিক্ষা দপ্তর জেলের ঘানি টানছে।
এই সংখ্যাগুলোকে অনুধাবন করতে হবে এই আঙ্গিকে যে, ২০১৮ থেকে ২০২৩ রাজ্য সরকারের তরফ থেকে পূজায় অনুদান বেড়েছে ৬০০ শতাংশ আর রাজ্য সরকারের কর্মচারীদের বকেয়া মহার্ঘ ভাতা ৩৬ শতাংশ। মিড ডে মিলে প্রতিটি বাচ্চাদের জন্য রাজ্য সরকার খরচা করে প্রাথমিকে ২ টাকা ১৮ পয়সা আর উচ্চ প্রাথমিক ৩ টাকা ২৭ পয়সা। যে মুখ্যমন্ত্রী মহার্ঘ ভাতা চাইলে সরকারি কর্মচারীদের আর্থিক সংকটের কথা বলেন, তিনি এই পূজা কমিটির অনুদানে এতো মুক্ত হস্ত হলেন কী করে? জরুর ডাল মে কুছ কালা হ্যায়!
হাম দেখেঙ্গে
খুব ইন্টারেস্টিংলি মুখ্যমন্ত্রী নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে অনুদান ঘোষণা করার সময় পূজা কমিটিগুলির উদ্যোক্তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, “আমরা অনুদান বাড়িয়ে দিলাম। আপনারা একটু ভালো করে সরকারের কাজের প্রচার করে দেবেন।” ফলত এই অনুদানের উদ্দেশ্য এক কথায় পূজা কমিটিগুলির আনুগত্য কিনে সরকারি প্রচার। তাই খালি চোখে এটা পূজা কমিটিগুলিকে অনুদান মনে হলেও আসলে এটা সরকারি বিজ্ঞাপনী প্রচার বাবদ ধরলে রাজনীতিটা পরিষ্কার হবে।
তৃণমূল কংগ্রেস আসার আগে এ রাজ্যে ধুমধাম করে দুর্গাপূজা যে হতো না তেমন তো নয়। কিন্তু ধর্মনিরেপক্ষতার যে বোঝাপড়া বামফ্রন্টের সময় ছিল তার গোড়ার কথাই হলো, রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্ম পালনের দূরত্ব। ধর্ম পালনে যেমন রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করবে না, তেমনই রাষ্ট্রের কাজে ধর্মের কোনো প্রভাব থাকবে না। তাতে এ রাজ্যের দুর্গাপূজার গরিমাতে কোনো কলঙ্ক লাগেনি। দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে তৃণমূলের বাহুবলী নেতা মন্ত্রীদের বদান্যতায় এই বৈভবের বিস্ফোরণ অভূতপূর্ব এবং ন্যক্কারজনক। সাম্প্রাদায়িক রাজনীতির যে জমিতে বিজেপি লাঙল চালাচ্ছে সেই জমির প্রস্তুতকারক তৃণমূল।
এখন রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হলো পি আর। গোদা বাংলায় যাকে বলে নিজের ঢাক নিজে পেটানো। সেই আঙ্গিকে পূজা কমিটিগুলোকে অনুদান দিয়ে সরকারি কাজের প্রচার কিংবা চন্দ্রযান-৩-র সাফল্যর দাবি করে মোদির মুখ দেখানো ভাষণ আসলে দুটো একই গোয়ালের গোরু। অবশ্য গোয়ালের পরিধিটা আরেকটু বড়ো যে কোনো স্বৈরতান্ত্রিক কিংবা ফ্যাসিস্ট নেতার ধর্মই হলো আত্মপ্রচার। ইতিহাসের পাতায় লেখা আছে যে হিটলার, মুসোলিনি কিংবা ফ্রাঙ্কো, সাম্প্রতিক সময়ে ট্রাম্প, বোলসোনারো সবাই এক গোয়ালের সদস্য। সবাই আত্মপ্রচারে, মিথ্যে প্রোপাগান্ডায় মগজ ধোলাইয়ের সমস্ত টেকনিকই এরা ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ব্যবহার করেছেন। মুশকিল হলো অন্য জায়গায়, ইতিহাসের পাতায় এটাও লেখা আছে যে, আত্মপ্রচারে কিংবা মিথ্যে প্রোপাগান্ডা এদের ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে পারেনি। শেষ কথা বলেছেন মানুষ। মেহনতি মানুষ। এবারও তার অন্যথা হবে না। হাম দেখেঙ্গে।