৬১ বর্ষ ৩ সংখ্যা / ২৫ আগস্ট, ২০২৩ / ৭ ভাদ্র, ১৪৩০
মোদি সরকার নারীবিরোধী সরকার
ঈশিতা মুখার্জি
মোদি সরকারের নীতির বিরুদ্ধে দিল্লিতে সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির কনভেনশন।
বিশ্বে যখন এই সত্য প্রতিষ্ঠিত যে, নারী পুরুষ বৈষম্য না কমিয়ে, নারীদের সমান অধিকার না দিয়ে কোনো দেশ সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক কোনো আঙ্গিকেই এগোতে পারে না, যে সময়ে বিশ্ব পুঁজিবাদের ভরকেন্দ্র বিশ্ব ব্যাঙ্ক পর্যন্ত ভারতের লিঙ্গ বৈষম্য নিয়ে কটাক্ষ করে, সেই ২০২৩ সালে সংসদে নারী উন্নয়ন নিয়ে বলতে দেশের প্রধানমন্ত্রী কয়েকটি প্রকল্পের কথা শুধু বলেন। দেশের সংবিধানের তোয়াক্কা না করে বিজেপি-আরএসএস’র সৈনিকেরা যখন ধর্ম, জাতপাতে দেশভাগ করে, দেশজুড়ে ঘৃণা বিদ্বেষ ছড়ায়, তখন তাদের প্রধান তীর থাকে মহিলাদের প্রতি। মনুস্মৃতির উপর দাঁড়িয়ে যে ধারণা, সেই ধারণাকে প্রগতিশীল কেন, উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলিও সমালোচনা করে। ২০১৪ সালের পর মোদি সরকারের আমলে যেভাবে নারীর প্রতি হিংসা বেড়ে গেছে, তা এই শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে অকল্পনীয়। মণিপুরে জাতি দাঙ্গায় নারীর প্রতি অমানবীয় নির্যাতন দেশের নারীসমাজের প্রতি অপরাধের তালিকা দীর্ঘ করেছে শুধু নয়, এই বর্বরতা সভ্য জগতে গ্রাহ্য নয়। ঘটনা ঘটেছে একের পর এক দেশের নানা প্রান্তে, কিন্তু কোনো ক্ষেত্রেই প্রধানমন্ত্রীর কোনো তাপ-উত্তাপ আমরা দেখিনি। প্রধানমন্ত্রীর সর্বশেষ সংসদের ভাষণেও মণিপুরের ঘটনা কম গুরুত্ব পেয়েছে।
মোদি সরকারের কোন নীতি দেশের লিঙ্গ বৈষম্য কমানোর চেষ্টা করেছে? দেখা যাক দেশের নীতির ফলে কীভাবে নারীরা প্রতি পদক্ষেপে আক্রান্ত হচ্ছেন। প্রথম আক্রমণ খাদ্য নিরাপত্তার উপর আক্রমণ। রেশন ব্যবস্থা ধসে পড়েছে। সরকার ঘোষণা করেছে যে, গরিব পরিবারে চাল সরবরাহ করা হবে যার মধ্যে রক্তাল্পতা কমানো এবং অপুষ্টি কমানোর উপাদান থাকবে। শুনতে ভালো লাগলেও আসলে জানা যায় যে, ডাচ স্টেট মাইনস নামে একটি বিদেশি কোম্পানি এর ফলে তার খাদ্যপণ্য ব্যবসা বাড়াতে পারবে বলে সরকার এই নীতি নিয়েছে। খবরে প্রকাশ যে, এই প্রকল্প অর্থাৎ এই পুষ্টি যুক্ত চাল সরবরাহের প্রকল্প দেশে চালু করার আগে এ বিষয়ে কোনো আগাম প্রস্তুতি নেওয়া হয়নি। এই নতুন ধরনের চালের খরচ বছরে ২৭০০ কোটি টাকা। এই প্রকল্প চলবে ২০২৪ পর্যন্ত। ডাচ কোম্পানি ছাড়াও আরও পাঁচটি কোম্পানি এই চাল সরবরাহ করে ১৮০০ কোটি টাকার ব্যবসা করে নেবে। এই ব্যবসায় মুনাফা নিশ্চিত। যা সম্পুর্ণ অনিশ্চিত তা হলো এর ফলে আদৌ রক্তাল্পতা এবং অপুষ্টি হ্রাস করবে কীনা, কারণ এ বিষয়ে যথোচিত বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষা হয় নি।আমাদের দেশের মহিলারা সবচেয়ে বেশি ভোগেন রক্তাল্পতায়। তাই এই নীতি নিশ্চিতভাবে মহিলাদের স্বাস্থ্যের উন্নতির সাথে যুক্ত। কিন্তু মহিলাদের স্বাস্থ্যের চেয়েও মোদি সরকারের নজর ছিল কয়েকটি কোম্পানির মুনাফা বাড়ানো। এই কোম্পানির প্রধানেরা মোদি সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়েছে। কিন্তু এই চাল দিয়ে ভাত রান্না করে তা খেলে আদৌ অপুষ্টি এবং রক্তাল্পতা কমাবে কি না তা তো নিশ্চিতভাবে জানা যায় নি, তাই জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা থেকে মহিলাদের রক্তাল্পতার সম্পর্কে প্রশ্নটাই বাদ দিয়ে দিল মোদি সরকার। এরকমভাবে সত্যকে জানা নির্মূল কোনো সরকার আজ পর্যন্ত করেনি। জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষার পঞ্চম রাউন্ডের তথ্য জানায় যে, দেশে মহিলাদের মধ্যে ৫৭শতাংশ এবং শিশুদের মধ্যে ৬৭ শতাংশ রক্তাল্পতায় ভোগে। এই রক্তাল্পতার জন্যই মাতৃত্বকালীন মৃত্যু ঘটে এবং শিশুদের স্বাস্থ্যহানি ঘটে। আমাদের দেশে রক্তাল্পতা মহিলাদের মধ্যে ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা তার ষষ্ঠ রাউন্ডে এ সম্পর্কে তথ্য জানার কোনো সম্ভাবনা রাখেনি। কেন তা রাখেনি তা কি স্পষ্ট নয়? মোদি সরকারের কাছে বেসরকারি কোম্পানির নিশ্চিত মুনাফা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ দেশের মহিলা ও শিশুর স্বাস্থ্যের চেয়ে। তাই প্রধানমন্ত্রী সংসদে নাকি নারীদের উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে বলতে গিয়ে আবেগমথিত হয়ে পড়েছিলেন। একেই বলে কুম্ভীরাশ্রু।
দেশে গ্রামে মহিলাদের একমাত্র ভরসার জায়গা যে প্রকল্প তা হলো মনরেগা। এই প্রকল্পের গলা টিপে মেড়ে ফেলছে মোদি সরকার। ২০১৪ সাল থেকে ক্ষমতায় আসীন মোদি সরকার। এই প্রকল্প ইউপিএ ১ সরকারের সময়ে সাধারণ ন্যূনতম কর্মসূচির অন্তর্গত। নিশ্চিত ১০০ দিনের কাজের এই প্রকল্পখাতে মোদি সরকার প্রতি বছর বাজেটে বরাদ্দ ছাঁটাই করেছে। ২০২১-২২ সালে এই প্রকল্পে ব্যয় করা হয়েছিল ৯৮৪৬৭.৮৫ কোটি টাকা। ২০২২-২৩ সালে তা ১০ শতাংশ কমিয়ে ব্যয় করা হয়েছে ৮৯,৪০০কোটি টাকা। চলতি বছরে অর্থাৎ ২০২৩-২৪ সালে বরাদ্দ হয়েছে মাত্র ৬০,০০০ কোটি টাকা যা গতবছরের চেয়ে ৩৩ শতাংশ কম। দেশে বেকারি সর্বকালীন রেকর্ড। মনরেগা প্রকল্পের আওতায় বাধ্যতামূলকভাবে ৩০ শতাংশ মহিলা থাকতে হবে। তাই বেকার পুরুষ শ্রমিকের পরিবারেও মহিলাদের এই প্রকল্পের চাহিদা আছে, আর সংসার চালাতে না পেরে অনেক নিম্ন আয়ের পরিবারের মহিলাদেরও এই প্রকল্পের চাহিদা আছে। কিন্তু এই প্রকল্পে কাজের সুযোগ কোথায় যদি বাজেট বরাদ্দই না থাকে? সম্প্রতি এই প্রকল্পে টাকা আসছে না বলেই কাজ পাচ্ছেন না বহু মহিলা। এছাড়াও এই প্রকল্প রূপায়ণে জটিলতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই প্রকল্পে যারা কাজ করছেন তাদের একটি মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে উপস্থিতি জানান দিতে হবে, তবেই তিনি মজুরি পাবেন। আবারও স্মার্ট ফোন এবং বেসরকারি ইন্টারনেট পরিষেবা। সেই বেসরকারি ব্যবসার রমরমা বাড়ছে কিন্তু গ্রামে গ্রামে শ্রমিকরা উপস্থিতি জানান দিতে নাজেহাল হয়ে পড়ছেন। এক্ষেত্রেও মজুরি পাওয়া কঠিন হয়ে উঠছে। মোদি সরকারের নিজের দেওয়া হিসেব জানাচ্ছে যে, চলতি বছরে মাত্র ৩৬৩০ কোটি টাকা মজুরি পেয়েছেন শ্রমিকেরা ১৫ দিন পিছিয়ে এবং এখনো পর্যন্ত ১০১০ কোটি টাকা মজুরি শ্রমিকদের বকেয়া আছে। এই শ্রমিকদের বেশিরভাগ মহিলা। এভাবে প্রকল্প রূপায়িত হলে বৈষম্য কমবে কীভাবে এ দেশে? রিজার্ভ ব্যাঙ্কের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী একজন পুরুষ কৃষি শ্রমিকের মজুরি দৈনিক ৩৪৯.৭৭ টাকা। কিন্তু মনরেগা শ্রমিকের দৈনিক মজুরি ২০২২-২৩ সালে ছিল ২১৭.৮৭ কোটি টাকা। বেকারি বাড়ছে, নারী শ্রমিকদের মজুরি কমছে। স্বল্প বেতনে কাজ করিয়ে নেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে মালিকপক্ষের থেকে। এখানেও মহিলাদের স্বার্থ না দেখে মোদি সরকার বেসরকারি কোম্পানির মুনাফা দেখছে।
আলোচনা করি বন সংরক্ষণ আইনের প্রসঙ্গ। এই আইন সংশোধন করে এরকম করা হলো যে, বনের অধিকার আর বনের অধিবাসী বা ঐতিহাসিকভাবে পিছিয়ে-পড়া জনগোষ্ঠীর হাতে থাকল না। বনজমি সহজে তুলে দেওয়া যাবে বেসরকারি মালিকের হাতে। আদিবাসীদের অধিকার এইভাবে কেড়ে নেওয়া হলো আর এই ব্যবস্থায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলো আদিবাসী মহিলারা।
২০১৪ সাল থেকে লাগাতারভাবে নারীর প্রতি হিংসা বেড়ে গেছে। ২০১৯ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে জাতীয় ক্রাইম রিসার্চ ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী নারীর প্রতি হিংসার ঘটনা ৪২.৯৬ শতাংশ বেড়ে গেছে। এই ঘটনাগুলি শুধুমাত্র সেইগুলি যা নথিভুক্ত হয়েছে। নথিভুক্ত হয়নি এরকম ঘটনার সংখ্যা অনেক বেশি। মহিলা কুস্তিগিরদের হেনস্থার ঘটনা সকলে জানে। কিন্তু যে ব্যক্তি ব্রিজভূষণ এই অভিযোগে অভিযুক্ত সেই বিজেপি মন্ত্রী শাস্তি পান না। দিল্লির রাজপথে পুলিশি হেনস্থার বলি হয় দেশের নাম উজ্জ্বল করা মহিলা কুস্তিগিরেরা। সম্মানের জন্য হত্যা, “লাভ জেহাদ” নামে ভিন্ন ধর্মে বিয়ে আটকানো, এ সব কিছুই মোদি সরকারের সময়ের ঘটনা। ভিন্ন ধর্ম, জাতপাতের মধ্যে বিয়ে হয়েছে এমন দম্পতিদের হেনস্থা, তাদের উপর হিন্দুত্ববাদীদের আক্রমণের বহু ঘটনা ঘটেছে এ দেশে মোদি সরকারের সময়কালে। মহিলাদের সম্মানরক্ষা এবং অধিকার রক্ষার কথা বলেছে আমাদের দেশের সংবিধান। সেই সংবিধানের তোয়াক্কা না করে আসলে চালু করছে মনুসংহিতার কথাই। তা না হলে একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা ঘটে চলেছে বিজেপি শাসিত উত্তর প্রদেশে, কিন্তু সরকারের হেলদোল নেই। তীব্র নারীবিরোধী এই মোদি সরকার - এই ঘটনাগুলিই তার প্রমাণ।
বহু প্রকল্প আনলেও এই নারী বিরোধী রূপ ঢাকা কঠিন মোদি সরকারের। আসলে এই প্রতিটি প্রকল্পই সরকারি বরাদ্দের বেসরকারিকরণ পিছনের দরজা দিয়ে। এই সত্য ঢাকার জন্যই প্রকল্পের ওই যৎসামান্য বরাদের সিংহভাগই খরচ করা হয় সরকারের বিজ্ঞাপনে যেমন ঘটেছে বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও প্রকল্পের ক্ষেত্রে।এইভাবেই মোদি সরকার নারীবিরোধী রূপ ঢেকে রাখে। কিন্তু লিঙ্গ বৈষম্যের আন্তর্জাতিক সমস্ত রিপোর্টে, আন্তর্জাতিক আলোচনায়, মানবাধিকার প্রসঙ্গে বারেবারেই ভারতের অবস্থান অসন্তোষজনক বলে জানা যাচ্ছে। মোদি সরকার এবং বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী সে বিষয়ে কোনো তোয়াক্কা করেন না। তাই সংসদে তার মেকি উদ্বেগ প্রকৃত তথ্য আড়াল করতে পারছে না।