৬১ বর্ষ ৩ সংখ্যা / ২৫ আগস্ট, ২০২৩ / ৭ ভাদ্র, ১৪৩০
ভারতীয় দর্শন প্রসঙ্গে (পঁচিশ)
শ্রীদীপ ভট্টাচার্য
● একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে আজ আমরা ভারতে একদিকে ধর্মীয় মৌলবাদের বাড়বাড়ন্ত, কুসংস্কারের চর্চা, কূপমণ্ডূকতা ও ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং অপরদিকে বর্ণবাদী ব্যবস্থার বিষময় প্রভাব, পিতৃতান্ত্রিক ধারণার ব্যাপক প্রসার প্রত্যক্ষ করছি, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অভাবনীয় অগ্রগতির যুগে শিক্ষা-সংস্কৃতির বিকাশ সত্ত্বেও দেশের জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ভয়াবহ পশ্চাৎপদ ধারণায় আকণ্ঠ ডুবে রয়েছে।
● নয়া-উদারনীতির অবধারিত পরিণতি হলো দুইটি পরস্পর-বিরোধী প্রবণতার তীব্র বৃদ্ধি। একদিকে তথ্য-প্রযুক্তির বিপ্লব সহ নতুন নতুন প্রযুক্তির ঢেউ সমগ্র বিশ্ববাসীকে চমকিত করছে, অন্যদিকে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ, যুক্তিহীনতা ও যুক্তিহীন বিশ্বাস ও আচরণ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ধর্মীয় আচরণ-সর্বস্বতা বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সমীক্ষা অনুযায়ী ভারতীয়দের মধ্যে ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা বেড়েছে এবং এই বৃদ্ধি গ্রামাঞ্চলের থেকে শহরাঞ্চলে বেশি। ধর্মীয় উপাসনাকেন্দ্র বিগত চার দশকে বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে, ভারতে সরকারি-বেসরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্র, হাসপাতাল এবং বিদ্যালয়ের মোট সংখ্যার তুলনায় উপাসনাকেন্দ্রের সংখ্যা বহুগুণ বেশি। ভারতে পর্যটনকেন্দ্রের অর্ধেকের বেশি ধর্মস্থান। পুঁজিবাদের বর্তমান রূপ নয়া-উদারবাদ ধর্মীয় বিশ্বাসকে এক বৃহৎ বাজারে পরিণত করেছে। ধর্মীয় বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে মুনাফা অর্জনের কার্যধারা পরিচালিত হচ্ছে। এখানে ভোগবাদী দর্শনকে উৎসাহিত করা হয় মুনাফার নতুন বাজার গড়ে তোলার জন্য, আবার আধ্যাত্মিকতা, ধর্মীয় উগ্রতা-গোঁড়ামি, নিরাপত্তাহীনতা, অলীক জাতীয়তাবাদ এবং এই অলীক জাতীয়তাবাদকে ঘিরে নানা ধরনের ক্রিয়াকলাপ, তাও গড়ে তুলছে নতুন নতুন পণ্যের বাজার, মুনাফা অর্জনের জন্য। বর্তমান ভারতে লক্ষিত হচ্ছে নতুন নতুন যজ্ঞানুষ্ঠান, নানা ধরনের ধর্মীয় উৎসব (যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে) ও ঐতিহ্য রক্ষার নামে নতুন নতুন অনুষ্ঠান। অক্ষয় তৃতীয়া এমন একদিন, যেদিন সোনা কিনলে সৌভাগ্য একেবারে নিশ্চিত। ধনতেরাষ এই ধরনের এক অনুষ্ঠান। এই দিনগুলিতে আমাদের ভারতে বহু পরিমাণে (পরিমাণটা বিশাল), সোনা ও রত্নালঙ্কার বিক্রয় হয়। ভারতে টিভি সহ সমস্ত প্রচারমাধ্যমে প্রচারিত প্রতিনিয়ত কতরকমের পশ্চাৎপদ, অবৈজ্ঞানিক ধারণা কোটি কোটি ভারতবাসীকে প্রভাবিত করছে। এই দেশে ঈশ্বরের নামে যে বাজার, তাকে ব্যবহার করার জন্য হরেকরকমের দেবতা ও নানা ধরনের আচার-অনুষ্ঠান, যা এই বাজারকে আরও শক্তি জোগাচ্ছে। শুধুমাত্র হিন্দুদের একচেটিয়া এই বাজার নয়, সব ধর্মের মানুষকে নিয়েই এই ব্যবসা চলছে। ভারতে বিস্মকরভাবে সমস্ত ধর্মীয় নেতা-মহিষীদের সম্পত্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে। শুধুমাত্র রামদেব বাবার সম্পত্তি আট হাজার কোটি টাকাও ছাড়িয়ে গেছে। শুধুমাত্র বাবা রামদেবই, অন্যান্য বাবা মহর্ষীরাও পিছিয়ে নেই। এই বাবা-মহর্ষীদের প্রভাব ও সম্পদ বৃদ্ধির পিছনে কাজ করছে করপোরেট হাউসগুলি। এরাই তো মহর্ষী-বাবাদের স্পনসর করছে। এরাই নিজেদের কর্মীসহ জনগণকে অনুপ্রাণিত করছে এই বাবা-মহর্ষীরূপী ধর্মকে পণ্য করে যারা ব্যবসা করছে, তাদের কাছে যেতে। আমাদের দেশে হস্তরেখা বিচার, রত্নধারণ করে আসন্ন বিপদ থেকে উদ্ধার, গুরুদীক্ষা, জ্যোতিষচর্চা প্রভৃতি এখন লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। আধুনিকতার এক ছদ্মবেশ ধারণ করেই এই কূপমন্ডূকতা, পশ্চাৎপদ চিন্তার প্রসার ঘটেছে। আধুনিকতার দদ্মবেশে আধ্যাত্মিকতা ও কুসংস্কার চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে।
● বর্তমান সময়ে বিশ্ব পুঁজিবাদের দর্শন হলো উত্তর আধুনিকতা (Past Modernism)। উত্তর-আধুনিকতার দর্শন শ্রেণিদৃষ্টিভঙ্গি ও দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদকে অস্বীকার করে। প্রসঙ্গত এটা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি (যার মূল কথা হলো, বস্তুই আদি, মুখ্য ও সত্য এবং বিকাশের ধারায় বস্তুকে আশ্রয় করেই চেতনা গড়ে ওঠে) এবং দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি (যার মূল কথা হলো, কোনোকিছুই স্থির নয়, সমস্ত কিছুই গতির মধ্যে, গতির মধ্য দিয়েই পরিবর্তন ও বিকাশ এবং সমস্ত কিছুর মধ্যে বিরাজমান দ্বন্দ্বই [Contradiction] গতির সঞ্চার করে), এই দুইয়ের সমন্বয় দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দর্শনের প্রতিষ্ঠা করেছে। কর্ল মার্কস তাঁর সহযোগী ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসকে নিয়ে এই দর্শনের প্রতিষ্ঠা করেছেন বলেই একে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ বা মার্কসীয় দর্শন হিসাবে অভিহিত করা হয়। এই দর্শনের শক্তি ও শ্রেষ্ঠত্বের অন্যতম উৎস হলো বিজ্ঞানের ও কাল অর্থাৎ সময়ের অগ্রগতির সাথে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দর্শন ক্রমান্বয়ে সমৃদ্ধ হয়ে চলেছে। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দর্শন বর্তমান যুগের একমাত্র বিপ্লবী শ্রেণি, শ্রমিকশ্রেণির দর্শন। যেহেতু কারণ সমস্ত শ্রেণিশোষণ ব্যবস্থা তথা সমস্ত ধরনের শোষণব্যবস্থার অবসানের দার্শনিক ভিত্তি প্রস্তুত করেছে, তাই বিশ্ব পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদকে শুধুমাত্র অস্বীকার করা নয়, একে ধ্বংস করতে চায়। উত্তর-আধুনিকতার দর্শনকে বিশ্ব পুঁজিবাদ দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ ও শ্রেণিদৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে মতাদর্শগত হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে। উত্তর-আধুনিকতা হলো ‘বিলম্বিত পুঁজিবাদের মতাদর্শ’ (Ideology of the late capitalism)। এই দর্শন শ্রেণি-সংগ্রামের তত্ত্বকে শুধু খারিজই করে না, শ্রেণির বিভাজন তত্ত্বকে স্বীকার করে না। বর্ণ, জাত, ভাষা, লিঙ্গের ভিত্তিতে মানুষের মূল পরিচয়কে চিহ্নিত করার নামে মানব সমাজের ঐক্যবদ্ধ অস্তিত্বকে দুর্বল করার জন্য পরিচিতি সত্তার রাজনীতি (Identity Politics) আধুনিকতার দর্শনকে অবলম্বন করে গড়ে উঠেছে। বিগত শতাব্দীর আটের দশকের শেষ ও নয়ের দশকের শুরুতে কয়েকটি দেশে সমাজতন্ত্রের পতন উত্তর-আধুনিকতার দর্শনের প্রসারের সুযোগ করে দিয়েছে। এই দর্শনকে অবলম্বন করে পরিচিতি সত্তার রাজনীতি ব্যাপকতা পেয়েছে। বৃদ্ধি পাচ্ছে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদ, স্বার্থ সর্বস্বতা ও নিরাপত্তাহীনতা। এই ধরনের পরিস্থিতি হিন্দুত্ববাদী ও তারই সাথে সাথে অন্য মৌলবাদী শক্তিগুলির পরিপুষ্ঠি ঘটাচ্ছে এবং স্বাভাবিকভাবেই মানুষের মনে গভীর প্রভাব ফেলতে পারছে।
● ভারত সহ পুঁজিবাদী দেশগুলিতে নয়া-উদারনীতির সংকট তীব্রতর হচ্ছে। এই উদারনীতির সংকট প্রতিফলিত হচ্ছে সমাজের সমস্ত অংশের মানুষের জীবনে। তরুণ সমাজের মধ্যে তৈরি হওয়া দ্বিধা ও সংশয় এই সংকটের প্রতিফলন। শিক্ষায় যে মূল্যবোধ গড়ে উঠছে, তার সাথে কর্মজীবনের মূল লক্ষ্যর এক তীব্র বৈপরীত্য প্রত্যক্ষ করছে তরুণ প্রজন্ম। বর্তমানে আমাদের দেশে অত্যন্ত তীব্র (কেন্দ্রের সরকারের প্রত্যক্ষ মদত রয়েছে এর পিছনে) রূপে হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শ দেশের সমগ্র যুবসমাজকে এক জঙ্গি সাম্প্রদায়িক দেশাত্মবোধে মগ্ন করতে অত্যন্ত তৎপর। এই পরিস্থিতির সঠিক মোকাবিলা করতে না পারলে ভয়াবহ বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী।
● কমিউনিস্টরা দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ নামক সর্বাপেক্ষা অগ্রসর বৈজ্ঞানিক মতাদর্শের ধারক ও বাহক। বর্তমানের সংকটের বিরুদ্ধে তীব্র, অতি-তীব্র মতাদর্শগত সংগ্রাম কমিউনিস্টদেরই পরিচালনা করতে হবে। নতুন প্রজন্ম সহ ভারতীয় জনগণকে বর্তমান সংকটের একমাত্র বিকল্প সমাজতন্ত্রের দিকে নিয়ে যেতে হবে।
যে সমস্ত গ্রন্থ ও রচনার সাহায্য গ্রহণ করা হয়েছে -
(১) ভারতীয় দর্শনে বস্তুবাদ - ডঃ দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়।
(২) Lokayata - Debiprasad Chattopadhyaya.
(৩) What is Living and What is Dead in Indian Philosophy - Debiprasad Chattopadhyaya.
(৪) A History of Indian Philosophy, 5th Volumes - Surendranath Dasgupta.
(৫) চার্বাক চর্চা - রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য।
(৬) চার্বাকের খোঁজে ভারতীয় দর্শন - রণদীপম বসু।
(৭) মহাত্মা এবং মতাদর্শ - ই. এম. এস. নাম্বুদিরিপাদ।
(৮) Party Education Note on Indian Philosophy - CPI(M) Central Committee Publication.
(সমাপ্ত)