৫৮ বর্ষ ১৯শ সংখ্যা / ২৫ ডিসেম্বর ২০২০ / ৯ পৌষ ১৪২৭
আরও প্রসারিত, আরও দৃঢ়মূল হয়ে উঠছে কৃষক আন্দোলন
নয়া-কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে জানকবুল লড়াই
নাসিক-দিল্লি জাঠার যাত্রাপথে কৃষক সমাবেশ।
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ ২০১৮ সালের ঐতিহাসিক লঙ মার্চের অভিজ্ঞতাকে সম্বল করে আবারও এক দীর্ঘ লঙ মার্চে শামিল হয়েছেন মহারাষ্ট্রের লড়াকু কৃষকরা। কেন্দ্রের সর্বনাশা তিন কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে সারা ভারত কৃষক সভার ডাকে ২১ ডিসেম্বর নাসিক থেকে দিল্লি কয়েক হাজার লড়াকু কৃষক রওনা হয়েছেন দিল্লি অভিমুখে। দিল্লির বুকে এবং দিল্লির সমস্ত সীমান্ত অঞ্চলে যে কয়েক লক্ষ কৃষকের দুর্নিবার লড়াই চলছে, সেই লড়াইয়ে অংশ নিতে মহারাষ্ট্রের কৃষকদের এই দীর্ঘ অভিযান। সেবারে ছিল কৃষকদের জাতীয় কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী ফসলের ন্যায্য দাম, কৃষকের ঋণ মকুব ইত্যাদি দাবিতে নাসিক থেকে মুম্বাই প্রায় ২০০ কিলোমিটার কৃষকদের মিছিল। এবারে লঙমার্চের আঙ্গিকটা ভিন্ন। প্রায় ১৩০০ কিলোমিটার পথ কৃষকেরা অতিক্রম করবেন বিভিন্ন যানবাহনের সাহায্যে। তীব্র লড়াইয়ের সঙ্কল্প নিয়ে এবারের এই সংগ্রামী অভিযাত্রায় কৃষকেরা সঙ্গে নিয়েছেন প্রয়োজনীয় খাবারদাবার ও অন্যান্য রসদ।
২১ ডিসেম্বর নাসিকের ইদগা ময়দানের সুবিশাল সমাবেশের শেষে প্রায় ২৫০ যানবাহনের কনভয় যাত্রা শুরু করে। এই অভিযানের সূচনায় ছিলেন নাসিক, থানে, পালঘর, আহমেদনগর, শোলাপুরের সংগ্রামী কৃষকরা। ধীরে ধীরে এই অভিযানে মহারাষ্ট্রের ২১টি রাজ্যের কৃষক প্রতিনিধিরাও অংশ নেবেন। চলার পথে রাতে বিভিন্ন স্থানে থাকা-খাওয়া ও বিশ্রাম, সকালে আবারও যাত্রা। এভাবে যাত্রাপথে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আরও লড়াকু কৃষক যোগ দেবেন এই যাত্রায়। বাড়তে থাকবে বিভিন্ন যানবাহনের সংখ্যা। এই অভিযানের সূচনায় নেতৃবৃন্দ দৃঢ়তার সঙ্গেই ঘোষণা করেছেন, কেন্দ্রের কৃষি আইন বাতিল না হওয়া পর্যন্ত আমরা ফিরব না। নাসিকের ইদগা ময়দানে ৫ হাজারেরও বেশি কৃষকের সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন সারা ভারত কৃষক সভার সভাপতি অশোক ধাওয়ালে, সিপিআই(এম) সাংসদ কে কে রাগেশ সহ জে পি গাভিট, মরিয়াম ধাওয়ালে প্রমুখ। সমাবেশে কৃষকদের পাশাপাশি উপস্থিত ছিলেন শ্রমিক, ছাত্র, যুব, মহিলা প্রভৃতি নানা অংশের মানুষ। সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, কৃষিমন্ত্রীর কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়। চলার পথে বিভিন্ন স্থানে কৃষক অভিযাত্রীরা কেন্দ্রের তিন কৃষি আইন বাতিলের দাবি সহ জনস্বার্থবিরোধী বিদ্যুৎ বিল বাতিল, কৃষকের ফসলের ন্যায্য দাম, কৃষিঋণ মকুব প্রভৃতি বিভিন্ন দাবি তুলে ধরছেন। লক্ষণীয় বিষয় হলো, কৃষকদের এই দিল্লি অভিযানে বিভিন্ন সাহায্য নিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছে শ্রমিক সংগঠন সিআইটিইউ। ২০১৮ সালে নাসিক থেকে মুম্বাই পদযাত্রায় অগণিত মানুষ, বিভিন্ন সংগঠন, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা কৃষকদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। এবারে সেই সাহায্য সূচনা থেকেই ব্যাপক আকারে লক্ষ করা যাচ্ছে। কৃষকদের এই অভিযান মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান হয়ে ২৪ ডিসেম্বর পৌঁছবে দিল্লি সীমান্তের কৃষকদের বিক্ষোভ সমাবেশে। এভাবেই নাসিক থেকে দিল্লি পর্যন্ত কৃষকদের এই লঙমার্চ লক্ষ লক্ষ কৃষকের আন্দোলনে শামিল হয়ে আবারও এক ঐতিহাসিক অধ্যায় সৃষ্টি করতে চলেছে।
শহিদ দিবস পালন
কেন্দ্রের কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে ২৬ নভেম্বর থেকে দিল্লিতে যে কৃষক আন্দোলনের সূচনা হয়েছে, তারপর থেকে এপর্যন্ত ৩০ জনেরও বেশি সংগ্রামী সাথির মৃত্যু হয়েছে। সারা ভারত কৃষক সংগ্রাম সমন্বয় সমিতি (এআইকেএসসিসি)-র ডাকে তাঁদের স্মরণে ২০ ডিসেম্বর দেশব্যাপী শহিদ দিবস পালিত হয়েছে। এই কর্মসূচি উপলক্ষে এদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে শ্রদ্ধাঞ্জলি কর্মসূচি পালনের পাশাপাশি কৃষকেরা শপথ নিয়েছেনঃ কেন্দ্রের তিন কৃষি আইন প্রত্যাহার না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন জারি থাকবে।
গাজিপুরে কৃষক জমায়েত।
এদিন পাঞ্জাব ও হরিয়ানার বিভিন্ন স্থানে শহিদ স্মরণ অনুষ্ঠান হয়েছে। কোথাও কোথাও প্রার্থনা সভাও অনুষ্ঠিত হয়েছে। হয়েছে স্মরণসভা, মিছিল ইত্যাদি। হরিয়ানায় বিজেপি নেতা ও প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বীরেন্দ্র সিং এমনই একটি সভায় যোগ দেন। ছত্তিশগড়ে সরজা, সুরজপুর, কোরবা, মরওয়াহি, রাজনন্দগাঁও সহ ১৫ জেলায় শহিদ স্মরণে কর্মসূচি হয়েছে। কৃষকসভা ছাড়াও আদিবাসী একতা মহাসভা, অরণ্য বাঁচাও সংঘর্ষ সমিতি, কিষান সঙ্ঘ সহ বিভিন্ন সংগঠন এই কর্মসূচিতে অংশ নেয়। রায়পুর, বিলাসপুর, দুর্গ, রায়গড় প্রভৃতি শহরে শ্রমিক সংগঠনের উদ্যোগে এই কর্মসূচি পালিত হয়েছে। উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন জেলায় এদিন কৃষকরা শহিদ স্মরণ অনুষ্ঠান পালন করেন। ত্রিপুরায় বিভিন্ন স্থানে এই দিনটি পালিত হয়েছে। খয়েরপুরে এমনই একটি স্মরণ কর্মসূচি পালনের সময়ে বিজেপি কর্মীরা হামলা চালায়। তারপর প্রতিরোধ গড়ে তুললে দুষ্কৃতীরা পালিয়ে যায়।
কেন্দ্রের কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে আন্দোলনে অংশ নেওয়া সংগ্রামী কৃষকদের স্মরণে দেশের অন্যান্য রাজ্যের পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গেও জেলায় জেলায় দিনটি পালিত হয়েছে। এই উপলক্ষে শহিদ বেদিতে মাল্যদান, সংহতি মিছিল, মোমবাতি মিছিল, সভা ইত্যাদি সংগঠিত হয়েছে। এদিন কলকাতায় জোড়াসাঁকোতে সিপিআই(এম)’র উদ্যোগে মিছিল হয়েছে। এদিন শ্রমিক-কৃষকদের যৌথ বিক্ষোভ আন্দোলনে উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় উত্তর দিনাজপুরের ডালখোলায় জাতীয় সড়কের টোল প্লাজা। এসএফআই বর্ধমান সদর ২ লোকাল কমিটির উদ্যোগে দিল্লির কৃষক আন্দোলনের শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে শক্তিগড়ে মোমবাতি মিছিল ও সভা হয়েছে। পূর্ব বর্ধমানের গুসকরা সহ বিভিন্ন স্থানে মোমবাতি মিছিল, পূর্বস্থলীতে মিছিল হয়েছে। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় ৩৭টি স্থানে কৃষকদের আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়ে এবং শহিদ স্মরণে কর্মসূচি পালিত হয়েছে। দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার বারুইপুরে কৃষকসভার দপ্তরে শহিদ দিবস পালিত হয়েছে। দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার বালুরঘাটে শ্রমিক-কৃষক ভবনে শহিদ বেদিতে মাল্যদান করা হয়েছে। হরিরামপুরে মিছিল হয়েছে। বীরভূমের নলহাটিতে কৃষক-খেতমজুরদের একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। কৃষি আইন প্রত্যাহার ও প্রয়াত আন্দোলনকারীদের স্মরণে মাল্যদান, মিছিল পথসভা হয়েছে জেলার সাঁইথিয়া, তিলপাড়া, মুরারই, পাইকর, পাথর চাপুড়ি প্রভৃতি স্থানে। হুগলি জেলার কামারপুকুর চটি, পুড়শুড়া, ব্যান্ডেল, বৈকুণ্ঠপুর, হরিপাল প্রভৃতি জায়গায় শহিদদের স্মরণ করা হয়েছে। জলপাইগুড়ি শহরের শিরিষতলায় কৃষক সংগঠনগুলির যৌথমঞ্চের পক্ষ থেকে শহিদ দিবস পালিত হয়েছে। এছাড়াও জেলার বিভিন্ন স্থানে কর্মসূচি পালিত হয়। এদিন সিপিআই(এম) পূর্ব মেদিনীপুর জেলা কেন্দ্রে শহিদ বেদিতে মাল্যদান করে শ্রদ্ধা জানান নেতৃবৃন্দ। খেজুরির হেঁড়িয়াতে শহিদ বেদিতে মাল্যদান করা হয়। উত্তরবঙ্গের ফাঁসিদেওয়া এলাকায় কৃষকসভার ডাকে গ্রামে গ্রামে জাঠা মিছিল হয়েছে। জাঠা হয়েছে মালবাজার মহকুমায়। ওদলাবাড়ি, বাতাবাড়ি প্রভৃতি জায়গাতেও কর্মসূচি হয়েছে। উত্তর ২৪ পরগনা জেলায় নিউবারাকপুর বিলকান্দা এরিয়া কমিটির ডাকে পথসভা হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে কৃষকদের জন্য অর্থ সংগৃহীত হয়েছে। বাঁকুড়ার বরজোড়ার জামবেদিয়া ও ওন্দার পুনিশোল অঞ্চলের নতুনগ্রামে মিছিল ও সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
কৃষকদের রিলে অনশনঃ অন্যান্য কর্মসূচি
সারা ভারত কৃষক সংঘর্ষ সমন্বয় সমিতির আহ্বানে কেন্দ্রের নীতি পরিবর্তনের দাবিতে ২১ ডিসেম্বর থেকে রিলে অনশন শুরু হয়েছে। সিঙ্ঘু, টিকরি, গাজিপুর, শাহজানপুর ছাড়াও দেশের নানা প্রান্তেই কৃষকেরা এই রিলে অনশনে অংশ নেন। লাগাতার এই অনশন আন্দোলনে ১১ জন করে কৃষক অংশ নেবেন।
এছাড়া কৃষক আন্দোলনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২৩ ডিসেম্বর কৃষক দিবস পালনের উদ্দেশে একবেলার অরন্ধন কর্মসূচি, ২৫ থেকে ২৭ ডিসেম্বর হরিয়ানার সমস্ত টোল প্লাজায় টোল নেওয়া বন্ধ করা এবং ২৭ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর ‘মন কি বাত’ কর্মসূচির দিন থালা বাজিয়ে প্রতিবাদের সিদ্ধান্ত নেন কৃষকরা।
কৃষক আন্দোলনে শহিদ
● ভীম সিং
● জয় সিং
● কুলবিন্দর সিং
● সন্ত বাবা রামসিং
● গুরপ্রীত সিং
● লাভ সিং
● দীপ সিং
● সুখদেব সিং
● গুরমিত সিং
● মাক্ষণ সিং
● পালা সিং
● কিতাব সিং
● গুরভাষ সিং
● ভাগ সিং
● কাহান সিং
● ধান্না সিং
● গজ্জন সিং
● জনকরাজ সিং
● গুরদেব সিং
● গুর্জন্ত সিং
● গুরবচ্চন সিং সিবিয়া
● বালজিন্দার সিং
● লখবীর সিং
● কর্নেল সিং
● রাজিন্দার সিং
● গুরমেল কাউর
● মেওয়া সিং
● অজয় কুমার
● লখবীর সিং