৫৮ বর্ষ ১৯শ সংখ্যা / ২৫ ডিসেম্বর ২০২০ / ৯ পৌষ ১৪২৭
প্রতিবাদ ওই গরজে
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ এক সময়ে মাওবাদী-তৃণমূলের খুন সন্ত্রাসের প্রকাশ্য মুখ জনসাধারণের কমিটির নেতা, শতাধিক সিপিআই(এম) কর্মী-সমর্থককে খুনের অন্যতম অভিযুক্ত, এখনও ধরমপুরে সিপিআই(এম) কর্মী প্রবীর মাহাতোর নৃশংস হত্যায় যার বিরুদ্ধে এনআইএ তদন্ত চলছে এবং বর্তমানে কপট রাজনীতির স্বার্থে জেলখাটা একদা খুনী-সন্ত্রাসী, যাকে এখন মুখ্যমন্ত্রী দলের অন্যতম রাজ্য সম্পাদক পদে বসিয়েছেন - সেই ছত্রধর মাহাতো আজ জঙ্গলমহলের মানুষের প্রবল ক্ষোভ ও প্রতিরোধের মুখে। কী অদ্ভুত সমাপতন!
এক সময়ে মাওবাদী-তৃণমূলের মদতে সন্ত্রাসের পথ ধরে জঙ্গলমহলে যার ছিল প্রায় একচ্ছত্র আধিপত্য, লালঝান্ডার অগ্রগতি রুখতে যার হাত একের পর এক সিপিআই(এম) কর্মীর রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল - সে এখন শাসক দলের নেতা হয়ে পুলিশি নিরাপত্তার মধ্যেও জনরোষের কবলে পড়ছে! এই ঘটনা প্রমাণ করছে তৃণমূলের শাসনক্ষমতা থাকলেও জঙ্গলমহলের মানুষ আর নির্বিবাদে মুখ বুজে খুন-সন্ত্রাস আর লুঠের রাজত্ব মেনে নেবেন না। তাঁরা একদিকে যেমন স্বজন হারানোর বেদনা নিয়েও সেদিনের খুন-সন্ত্রাসের উপযুক্ত প্রতিবিধান চাইছেন, তেমনি বর্তমান সরকার ও শাসকদলের অপশাসন, অন্যায়, অবিচারের প্রতিকার চাইতে প্রতিরোধে শামিল হয়েছেন। তাঁরা আজ সমস্ত ভয়-সন্ত্রাসের আবহকে মুছে দিয়ে হারানো অধিকার ফিরে পেতে এবং লুঠেরাদের রাজত্বের অবসান ঘটাতে ক্রমশ সংঘবদ্ধ হচ্ছেন রক্তপতাকার নিচে। বর্তমানে ঝাড়গ্রাম বিশেষত জঙ্গলমহলের বাস্তবচিত্র এটাই।
মাওবাদী-জনসাধারণের কমিটি আর তৃণমূলের যৌথ সন্ত্রাস-খুন-অত্যাচার ও লুঠতরাজের পর্ব পেরিয়ে এখন ধীরে ধীরে জেগে উঠছে ঝাড়গ্রাম। লালঝান্ডাকে রুখতে একসময় যারা অস্ত্র হাতে নিয়ে রক্ত ঝরিয়েছিল লাল পাহাড়ের বুকে, তারা ২০১১ সালে রাজ্যের পালা বদলের পর সদলবলে ভিড় জমিয়েছে শাসক শিবিরে। তার প্রতিদানস্বরূপ মিলেছে সরকারি বদান্যতা, নানা সুযোগ-সুবিধা, পরিবারের সদস্য বা নিজেদের চাকরি, নিরাপত্তা, গাড়ি, টাকা পয়সা আরও কত কিছু। শুধু তাই নয়, এরাই জঙ্গলমহলে হয়ে উঠেছে শাসকদলের স্থানীয় নেতা-মাতব্বর, কেষ্টবিষ্টু। মিলছে অবাধ লুঠের সুযোগ, গরিব মানুষকে নানাভাবে সর্বস্বান্ত করার অবাধ ছাড়পত্র। এসবের পরিণতিতে ফুলেফেঁপে উঠেছে স্থানীয় তৃণমূলী দুর্বৃত্তরা। অন্যদিকে সবদিক দিয়ে বঞ্চিত হয়েছেন সাধারণ মানুষ। পঞ্চায়েতের বরাদ্দের টাকার ভাগ-বাঁটোয়ারা হয়ে পৌঁছে যাচ্ছে শাসকদলের নেতা, অনুগত, মাতব্বরদের পকেটে। যার বখরা নিয়মিত পৌঁছে যাচ্ছে কলকাতায় বিশেষ জায়গায় বিশেষ বিশেষ নেতার হাতে।
বামফ্রন্ট সরকারের আমলে প্রত্যন্ত অঞ্চলের গরিব মানুষ, বয়স্ক, বিধবাদের জন্য যে ভাতা চালু হয়েছিল তার প্রায় সবই বন্ধ হয়ে গেছে। ১০০ দিনের কাজ নেই, যেটুকু হয়েছে তারও মজুরি মিলছে না। পঞ্চায়েতের কাজ স্তব্ধ হয়ে গেছে। রাস্তাঘাট তৈরি হচ্ছে না। পানীয় জল, স্বাস্থ্য পরিষেবার কোনো সুযোগই মিলছে না জেলার প্রত্যন্তে। এসবের ফলে ক্ষোভ বাড়ছে মানুষের। শাসকদলের অপদার্থতা, সরকারের ব্যর্থতায় গরিব মানুষদের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ-বিক্ষোভকে সুযোগ বুঝে কাজে লাগাতে চাইছে বিজেপি। তারা সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনীতিকে ছড়িয়ে দিতে দেদার অর্থ বিলি করছে। তৃণমূল ও মাওবাদী সংসর্গ ছেড়ে আসা নব্য সংগঠকদের বাইক, তেল, মোবাইল ফোন ও নানা সামগ্রীর অঢেল বন্দোবস্ত করে গোটা জঙ্গলমহলকে কব্জা করতে চাইছে বিজেপি।
এমনই একটা অবস্থার মধ্যে মানুষের রুটিরুজি-জীবনসংগ্রাম, ন্যায্য দাবিদাওয়া নিয়ে লালঝান্ডার নেতৃত্বে আন্দোলন ক্রমশ সংহত হচ্ছে। একদিকে কেন্দ্রের সাম্প্রদায়িক-দেশবিরোধী পদক্ষেপ, অন্যদিকে রাজ্য সরকারের অগণতান্ত্রিক, জনবিরোধী কার্যকলাপ ও লুঠের কারবারের বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন করে আন্দোলন গড়ে তুলতে গরিব মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছেন সিপিআই(এম) কর্মীরা। কেন্দ্রের সর্বনাশা তিন কৃষি আইন বাতিলের দাবিসহ বিভিন্ন দাবিতে মিছিল-সভায় মানুষের উপস্থিতি ক্রমশ বাড়ছে। গত ২৬ নভেম্বর দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট ও ৮ ডিসেম্বর গ্রাম বন্ধ কর্মসূচিতে বিপুল সাড়া মিলেছে এখানে। ‘বাংলার গর্ব মমতা’ আর ‘দুয়ারে সরকার’-এর বিজ্ঞাপনী চমক দিয়ে জঙ্গলমহলের মানুষকে আর বোকা বানানো যে যাচ্ছে না, তার আভাস মিলছে লালঝান্ডার বিভিন্ন কর্মসূচিতে।
প্রকৃত অর্থেই ঝাড়গ্রাম জেলা বিশেষ করে জঙ্গলমহলের মানুষ আজ সন্ত্রাস-খুন-অত্যাচারের বিহ্বলতা কাটিয়ে ধীরে ধীরে জেগে উঠছেন। রাজ্যের ক্ষমতা দখলের নেশায় তৃণমূলের কুৎসিত রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন এখানকার মানুষ। এদের প্রত্যক্ষ মদতে মাওবাদী আর জনসাধারণের কমিটির খুনে বাহিনীর হাতে জঙ্গলমহলে খুন হতে হয়েছে ২৭২ জন সিপিআই(এম) কর্মীকে। মাওবাদী-তৃণমূলের নৈরাজ্যে এখনও নিখোঁজ ১০১ জন। অসংখ্য পরিবার এদের হিংস্র দুর্বৃত্তপনায় কার্যত নিঃস্ব হয়ে গেছে। মুখ্যমন্ত্রী এখানে এসে বিপুল অর্থ খরচ করে প্রশাসনিক সভার নামে বিভিন্ন সময়ে অজস্র প্রতিশ্রুতি বিলিয়ে গেছেন। তিনি শহিদ হওয়া এবং নিখোঁজ হওয়া পরিবারগুলোকে কয়েকবারই সরকারি সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু তার ছিঁটেফোঁটাও মেলেনি আজও। তাই বিক্ষুব্ধ মানুষ আজ সমস্ত ভয়-ভীতিকে দূরে ঠেলে লালঝান্ডার আন্দোলনে শামিল হচ্ছেন। প্রকাশ্যে প্রতিবাদ-ক্ষোভ ব্যক্ত করছেন।
গ্রামবাসীদের সেই প্রতিবাদ আর ক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ দেখা যায় গত ২১ ডিসেম্বর। ঝাড়গ্রামের পাটাশিমূল গ্রামে এদিন মাওবাদী-তৃণমূলী দুর্বৃত্তদের হাতে খুন হওয়া শহিদ কমরেড অভিজিৎ মাহাতোর মা, শহিদ কমরেড গুরুচরণ মাহাতোর স্ত্রী, শহিদ কমরেড নিলাদ্রি মাহাতোর মা-বাবা, শহিদ শিক্ষক নেতা অনিল মাহাতো সহ পার্টিকর্মী-সমর্থক বাবলু মাহাতো, টোটন পরিযারি, কেশব মাহাতো, কানাই রায় সহ ১৩ জন শহিদ পরিবারের সদস্য সহ গ্রামবাসীদের প্রবল বিক্ষোভের মুখে পড়েন একদা মাওবাদী ঘনিষ্ঠ জনসাধারণের কমিটির নেতা, তৃণমূল নেত্রীর স্নেহধন্য, বর্তমানে তৃণমূলের অন্যতম রাজ্য সম্পাদক ছত্রধর মাহাতো। বিশাল গাড়ির কনভয় হাঁকিয়ে এদিন পাটাশিমূল গ্রামে ‘দুয়ারে সরকার’ কর্মসূচির প্রচারে এসে গ্রামবাসীদের দ্বারা ঘেরাও হন। শহিদ কমরেড অভিজিৎ মাহাতোর মা, শহিদ কমরেড গুরুচরণ মাহাতোর স্ত্রী ছত্রধরের গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলেন, ‘‘আমাদের স্বামী-সন্তানকে আগে ফেরত দিন, তারপর গাড়ি নিয়ে ঘুরবেন। মাওবাদীদের সঙ্গে নিয়ে স্বামীকে খুন করলেন। এখন গাড়ি করে পুলিশ নিয়ে ঘুরছেন। আর আমরা যন্ত্রণা নিয়ে রোজ মরছি।’’ পুলিশের সামনে বিশাল কনভয় নিয়ে প্রায় চার ঘণ্টারও বেশি সময় ছত্রধরকে আটকে রেখে গ্রামবাসীরা স্লোগান দিলেন - ‘খুনি ছত্রধর দূর হটো’। শহিদ পরিবারের সদস্য ও গ্রামবাসীদের দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ ও প্রতিরোধের দুরন্ত মেজাজ দেখে শেষ পর্যন্ত রণেভঙ্গ দিতে বাধ্য হন এক সময়ে জঙ্গলমহলে তৃণমূলী মদতে খুন-সন্ত্রাসের অন্যতম কাণ্ডারি ছত্রধর মাহাতো। গ্রামবাসীরা দৃপ্ত স্বরে জানিয়ে দেন, খুনিদের আর গ্রামে ঢুকতে দেওয়া হবে না। তাঁরা প্রতিবাদী কণ্ঠে ঘোষণা করেন শহিদ পরিবারগুলির ক্ষতিপূরণ সহ তাঁদের পরিবারের সদস্যদের চাকরির দাবিতে প্রশাসনিক দপ্তর অচল করে দেওয়া হবে যতদিন না পর্যন্ত দাবি আদায় হয়। একই সঙ্গে চলবে অন্যান্য দাবি-দাওয়া নিয়ে লড়াই-আন্দোলন।