৫৮ বর্ষ ১৯শ সংখ্যা / ২৫ ডিসেম্বর ২০২০ / ৯ পৌষ ১৪২৭
সৌমিত্র স্মরণ সন্ধ্যা
শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়
‘...প্রগলভ রাত্রির বন্যা দিয়েছে যে নক্ষত্রকে ঢেকে
নেই কোন সান্ত্বনা রাত্রির অন্ধকার ব্যতিরেকে
সম্মুখে প্রশস্ত পথ ভঙ্গুর ক্লেদজ মরুভূমি
এই দুঃখের দিনে ছায়াময় বৃক্ষের মত স্মরণে আস তুমি।’
বটবৃক্ষ (বাবাকে মনে রেখে), সৌগত চট্টোপাধ্যায়
______________________________
মৃত্যু একটা মুহূর্ত মাত্র। তাঁর জীবনটা দীর্ঘ। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আক্ষরিক অর্থেই মতাদর্শে স্থিত এক মহাজীবনের উজ্জ্বল পরিসর। তাঁর মননে বামপন্থার শিকড়। রেনেসাঁর উত্তরাধিকার তাঁকে অবিরত সৃষ্টিশীল রেখেছে। তাঁর সৃষ্টিশীলতার পরিধি তাঁর সাফল্যকে বটের ঝুরির মতো বিস্তৃতি দিয়েছে। অভিনেতৃ সংঘ থেকে পেশাদার রঙ্গালয়, পত্রিকা সম্পাদনা থেকে কখনও শুটিংয়ের বিপদসঙ্কুলতায় কমরেডদের পাশে তাঁর নিরুদ্বিগ্ন উপস্থিতি বামপন্থার প্রতি তাঁর প্রত্যয় থেকেই। যা তাঁকে করে তুলেছে প্রকৃত সহযোদ্ধা - টিম ম্যান। তাঁর কর্মচঞ্চল জীবন থেকেই শিক্ষা নেওয়া দরকার। ২০ ডিসেম্বর কলকাতার জ্ঞান মঞ্চে আয়োজিত সৌমিত্র স্মরণ সন্ধ্যায় বহুমাত্রিক প্রদর্শন থেকে কথনের মধ্য দিয়ে উঠে এলো এমন সামগ্রিক অনুভব।
ভারতীয় গণনাট্য সংঘ, পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘ, জনবাদী লেখক সংঘ (পশ্চিমবঙ্গ), পশ্চিমবঙ্গ আদিবাসী লোকশিল্পী সঙ্ঘ সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের সংস্কৃতিজনেরা ছিলেন এদিনের অনুষ্ঠানের যৌথ আয়োজক।
এই উদ্যাপনের প্রস্তুতি কমিটির কার্যকরী সভাপতি পবিত্র সরকার এদিন তাঁর কথনে তুলে ধরেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সৃষ্টিশীল প্রাণচঞ্চলতার উৎস সহ বিভিন্ন দিকের কথা। তিনি বলেন, সবসময় একটা কিছু করার তাড়না তাঁর নিজের মধ্যে ছিল, সেই তাড়না তিনি সকলের মধ্যে চারিয়ে দিতেন। নিজের সম্ভাবনাকে কত রকমভাবে খতিয়ে দেখা - নিজেকে নানাভাবে প্রকাশ করার একটা চেষ্টা এটা রেনেসাঁর মানুষের একটা লক্ষণ। তারই একটা দিক অভিনয়ের চূড়ান্তে অবস্থান। মঞ্চটা অসম্ভব ভালো বুঝতেন। তার সঙ্গে পত্রিকা সম্পাদনা, ছবি আঁকা। বেশ ভালো গানের গলা ছিল। এত গুণ একটা মানুষের মধ্যে, যেটা রেনেসাঁর গুণ। একটা কথা আমাদের সবার মনে রাখা দরকার এই এত ব্যস্ততার মধ্যেও মাটির সঙ্গে, মানুষের সঙ্গে দায়িত্বের সঙ্গে একটা যোগ সৌমিত্রদা সবসময় রেখে গেছেন। তিনি মনে করতেন, আমি যা কিছু করি তার শেষ পর্যন্ত একটা অর্থ দাঁড়াবে - যদি মানুষের পাশে আমি থাকতে পারি। সেজন্য একেবারে ছাত্রজীবন থেকে মানুষের পাশে, সংগ্রামের পাশে - সে শিক্ষক আন্দোলন, খাদ্য আন্দোলন থেকে আরম্ভ করে শেষ পর্যন্ত বলে গেছেন, হ্যাঁ, বামপন্থা যা মানুষের জন্য সার্বিকভাবে কল্যাণকর।
তিনি বলেন, এই ব্যক্তিগত বিকাশের নানানরকম প্রয়াস এবং ব্যক্তির উৎকর্ষের এবং সিদ্ধিতে পৌঁছবার পর আবার সমস্ত আবরণ, ঝলকানি ছেড়ে দিয়ে মানুষের পাশে থাকা - এই যে একটা সামগ্রিক জীবন-সন্ধান এটা সৌমিত্রদার কাছ থেকে সব প্রজন্মের শিক্ষণীয়। সব প্রজন্মের কাছে এটাও শেখার যে, কীভাবে নিজেকে সন্ধান করতে করতে বৃহত্তর মানুষের কাছে কীভাবে পৌঁছতে হয়।
স্মরণ অনুষ্ঠান মঞ্চের ব্যাকড্রপে ছিল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অভিনীত সিনেমার চরিত্রগুলির কোলাজ। অপরাজিত সৌমিত্র এবং ‘অ্যান ইভিনিং উইথ সৌমিত্র - দ্য ডেথলেস ওয়ান’ শীর্ষক এই সন্ধ্যার আয়োজনে মূলত দৃশ্য-শ্রাব্য মাধ্যমে উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করা হয়। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অভিনীত বিভিন্ন ছবির ক্লিপিংস সহ তাঁর সাক্ষাৎকার এদিনের অনুষ্ঠানের বাড়তি পাওয়া।
পরান বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে মমতা শংকর, গৌতম ঘোষ, বিপ্লব চট্টোপাধ্যায়, বিভাস চক্রবর্তী, রাজা মিত্র, ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, মেঘনাদ ভট্টাচার্য প্রমুখ - এবং ইচ্ছা থাকলেও যাঁরা এই দুঃসহ পরিস্থিতি এবং অন্যত্র ব্যস্ততার জন্য এই স্মরণ অনুষ্ঠানে আসতে পারেননি, তাঁরা ভিডিয়ো বার্তায় বলেছেন তাঁদের মুগ্ধতার কথা। আলো-আঁধারির মায়াজগৎ পেরোনো বাস্তব জগতের সাথি-সহযোদ্ধা হিসেবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের দীর্ঘ উপস্থিতি যা সর্বঅর্থেই দীর্ঘতর হয়েছে আজীবন - সেসব উঠে এসেছে স্মৃতিচারণে।
অনুষ্ঠানের যুগ্ম-আহ্বায়ক বিশিষ্ট পরিচালক তরুণ মজুমদার স্মরণ সন্ধ্যায় তুলে ধরেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর কাজ করার বিভিন্ন অন্তরঙ্গ মুহূর্তের কথা। তাঁর স্মৃতিচারণা থেকে জানা গেল, কীভাবে প্রাণের আশঙ্কাকে তুচ্ছ করে নকশাল উৎপাতকে অগ্রাহ্য করে বীরভূমের প্রত্যন্ত অঞ্চলে 'গণদেবতা' ছবির নির্মাণের কাজে যুক্ত সহকর্মীদের কাছে সৌমিত্র পৌঁছে গিয়েছিলেন স্টার সুলভ গ্ল্যামারকে পেছনে ফেলে। মেতে উঠেছিলেন গল্পে-গানে প্রকৃত সহযোদ্ধার মতই।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন বাদশা মৈত্র, সেঁজুতি মুখার্জি এবং বিমল চক্রবর্তী। স্মৃতিচারণ করেন শিল্পী বিশ্বনাথ দাস।
সৌমিত্র কন্যা পৌলমী বসুর স্মৃতিচারণায় উঠে আসে বাবার দেখানো পথে হাঁটার দৃঢ় প্রত্যয়। যেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন পারফেকশনিস্ট সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের আকুতির কথা। তিনি বলেন, ব্যক্তিগত সম্পর্কের ওঠানামা নিয়ে কখনো বিরক্তি প্রকাশ করেননি বাবা। শুধুমাত্র শিল্পের প্রশ্নে কেউ আপস করলে বকুনি অনিবার্য ছিল। সৌমিত্র পুত্র কবি সৌগত চট্টোপাধ্যায়ের নিবেদনে এদিন ছিল বাবাকে নিয়ে তাঁর লেখা দু’টি কবিতার পাঠ। এছাড়াও ব্যক্তিগত সান্নিধ্যের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন আলোক শিল্পী বাদল দাস। শিল্পী হিরণ মিত্রর আঁকা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের একটি প্রতিকৃতি উপহার হিসেবে শিল্পী পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হয় আয়োজকদের পক্ষ থেকে।
পরিচালক অনীক দত্ত তাঁর স্মৃতিচারণে তুলে ধরেন তাঁর পরিচালিত ছবি ‘ভবিষ্যতের ভূত’ প্রদর্শন সম্পর্কে রাজ্য সরকার এবং শাসকদলের ও তৃণমূল সরকারের রোষের কথা। প্রতিবাদে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কীভাবে এগিয়ে এসেছিলেন? প্রথমে প্রতিবাদ পত্র লিখে, পরে বিক্ষোভ সভায় উপস্থিত হয়ে। অনীক দত্ত বলেন, তিনি প্রশ্ন করেছিলেন আর কবে প্রতিবাদ করবে তোমরা? এখন না বেরিয়ে এলে তো মুশকিল। অনীক দত্ত এ প্রসঙ্গে আরও বলেন, "আগে ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে যা হয়েছে (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রতি) সে সম্পর্কে মুখ খোলা উচিত ছিল। সেটা করিনি বলে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। এইটুকু আজ বলছি যে প্রতিবাদ আমরা করব।"
এই স্মরণসভার সাংগঠনিক প্রস্তুতি কমিটির সভাপতি কবি শঙ্খ ঘোষ এবং আহ্বায়ক তরুণ মজুমদার, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত প্রমুখ ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন অরুণ মুখোপাধ্যায়, ওয়াসিম কাপুর, হিরণ্ময় ঘোষাল, রজত বন্দ্যোপাধ্যায়, সব্যসাচী চক্রবর্তী, সৌগত চট্টোপাধ্যায় এবং পৌলমী বসু।
দর্শকাসনে ছিলেন সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরোর প্রবীণ নেতা বিমান বসু, রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র, মহম্মদ সেলিম, সুজন চক্রবর্তী, শমীক লাহিড়ী, রবীন দেব, আরএসপি নেতা মনোজ ভট্টাচার্য প্রমুখ সহ বিশিষ্ট ব্যক্তি, শিল্পী ও কলাকুশলীবৃন্দ।
স্মরণসন্ধ্যার অন্তিম পর্বে ছিল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অভিনীত ছবিগুলির আবহসংগীত ও গান নিয়ে অনুষ্ঠান ‘গানের সরণি’। সঙ্গীত পরিচালক দেবজ্যোতি মিশ্রের পরিচালনায় এই পর্বে সঙ্গীতাংশে অংশ নিয়েছেন রূপঙ্কর বাগচী, ইমন চক্রবর্তী, দুর্নিবার এবং সহশিল্পীবৃন্দ। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অভিনীত সত্যজিৎ রায়ের সিনেমায় ব্যবহৃত দু’টি রবীন্দ্রসঙ্গীত এবং ছায়াছবির গানও এদিনের অনুষ্ঠানে পরিবেশিত হয়। তবে পথের পাঁচালী থেকে সোনার কেল্লা ছবির থিম মিউজিকের অভিনব অনুরণন শুরুতেই অনুষ্ঠানটিকে ভিন্ন মাত্রায় উন্নীত করে। গণসংগীত সম্পর্কে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের আগ্রহের সূত্র ধরে এদিনের অনুষ্ঠান শেষ হয় ‘আলোর পথযাত্রী’ গানের মধ্য দিয়ে। আলোর পথযাত্রী গানে দর্শকদের অংশগ্রহণ সন্ধ্যার উপস্থাপনাটিকে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অবিনাশী সৃষ্টিধারাকে প্রতিধ্বনিত করে বার্তা দেয়, বিপন্নতাকে জয় করে কীভাবে বলতে হয় অন্ধকারের সঙ্গে কোনো সমঝোতায় পৌঁছতে আমি আর রাজি নই!