৫৮ বর্ষ ১৯শ সংখ্যা / ২৫ ডিসেম্বর ২০২০ / ৯ পৌষ ১৪২৭
জম্মু ও কাশ্মীরের জেলা উন্নয়ন পরিষদের নির্বাচনে অধিকাংশ আসনে জয়ী বিজেপি বিরোধী জোট পিএজিডি
সাংবাদিক সম্মেলনে পিএজিডি নেতৃবৃন্দ।
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ জম্মু ও কাশ্মীরের জেলা উন্নয়ন কাউন্সিল (ডিডিসি) নির্বাচনে বিজেপি বিরোধী দলগুলির জোট পিপলস অ্যালায়েন্স অব গুপকর ডিক্লারেশন বা পিএজিডি জয় পেল অধিকাংশ আসনে। মোট ২৮৮ টি আসনের মধ্যে আসন প্রাপ্তির হিসেবে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে বিজেপি। এককভাবে লড়াই করে কংগ্রেস তৃতীয় স্থানে রয়েছে। ব্যালটে নির্বাচন হবার প্রেক্ষিতে এই ফলাফলকে তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে।
এই নির্বাচনে বিজেপি ৭৪টি আসন পেয়েছে। জম্মু কাশ্মীর ন্যাশনাল কনফারেন্স ৬৭টি, নির্দল প্রার্থীরা জিতেছেন ৪৯টি আসনে, পিডিপি ২৭টি আসনে, জাতীয় কংগ্রেস ২৬টি আসনে, জেকেএপি ১২টি, জেকেপিসি ৮টি আসনে, সিপিআই(এম) ৫টি আসনে, জেকেপিএম ৩টি, পিডিএফ দু’টি, জেকে ন্যাশন্যাল প্যানথার পার্টি দু’টি আসনে এবং বহুজন সমাজ পার্টি ১টি আসনে জয়ী হয়েছে।
গত বছর ৫ আগস্ট জম্মু-কাশ্মীরকে অবরুদ্ধ করে সংবিধানের ৩৭০ধারা কার্যত বাতিল করে কেন্দ্রের মোদী সরকার। রাজ্যকে ভেঙে দু’টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করে। দীর্ঘ কয়েকমাস জম্মু-কাশ্মীরকে বাকি দুনিয়ার থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়। বিশেষ করে কাশ্মীরে ভয়ঙ্কর দমনপীড়ন চলতে থাকে। নাগরিকদের মৌলিক অধিকারগুলি কার্যত সবই ছিনিয়ে নেওয়া হয়। বিজেপি ব্যতীত অন্য সব রাজনৈতিক দলের নেতাদের এবং সমাজকর্মীকে আগেই গ্রেপ্তার বা আটক করা হয়। ইন্টারনেট, মোবাইল পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থা পুরো ভেঙে পড়ে।
জেলবন্দি, গৃহবন্দি বিরোধী নেতারা মুক্তি পাওয়ার পরে একসঙ্গে বসে পিপলস অ্যালায়েন্স অব গুপকর ডিক্লারেশন গ্রহণ করেন। যাতে ৩৭০ ধারা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার পাশাপাশি কাশ্মীরে জনতার লুণ্ঠিত অধিকারগুলি ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত হয়। ন্যাশনাল কনফারেন্স নেতা ফারুক আবদুল্লার গুপকর রোডের বাসভবনে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ডিডিসি তড়িঘড়ি নির্বাচন ঘোষণা করে দেওয়ায় এই বিরোধী জোট ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এদের মধ্যে ন্যাশনাল কনফারেন্স, পিডিপি, সিপিআই (এম), জেকেপিসি প্রমুখ দল রয়েছে। কংগ্রেস গুপকর ঘোষণার সঙ্গে সহমত জানালেও নির্বাচনে জোটের সঙ্গে থেকে না লড়ে পৃথকভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। ২৮ নভেম্বর থেকে শুরু হয়ে ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত বহু পর্যায়ে এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
ওই অচলাবস্থার সময় সংবাদমাধ্যমে পুরোপুরি সেন্সরশিপ চালানো হয়। বিধিনিষেধ ধাপে ধাপে শিথিল করার পরেও সংবাদমাধ্যমকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য মিডিয়া নীতি এনেছে কেন্দ্রীয় সরকার। বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের উপরে নজরদারি চলছে। কোনও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড করতে দেওয়া হয়নি। এইরকম দমবন্ধ করা পরিস্থিতির মধ্যে সরকার আচমকা জেলা উন্নয়ন কাউন্সিলের ভোট ঘোষণা করে দেয়।
জম্মু-কাশ্মীরে বিজেপি-বিরোধী পিএজিডি জোটের জয়ী প্রার্থীর উচ্ছ্বাস।
বিজেপি এই নির্বাচনকে পাখির চোখ করেছিল। প্রচারে আক্রমণের কেন্দ্রে ছিল বিরোধী জোট। তাদের ‘গুপকর গ্যাং’ বলে দেগে দেওয়া হয় এবং দেশবিরোধী, পাকিস্তানপন্থী তকমা লাগানো হয়। এই পরিস্থিতিতে ন্যাশনাল কনফারেন্স নেতা ফারুক আবদুল্লাকে বারবার ইডি ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ চালায়। পরিবারতন্ত্র, দুর্নীতি ইত্যাদির অভিযোগ তুলে কাশ্মীরের বর্তমান রাজনৈতিক নেতাদের বাতিল করার আহ্বান জানায় বিজেপি। কাশ্মীরের জনগণকেও মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলির থেকে নানাভাবে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করে। তারপরেও বিরোধী দলগুলির নেতৃবৃন্দ, প্রার্থীদের প্রচার করতে দেওয়া হয়নি। নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়নি। আবার নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়েই বিরোধী প্রার্থীদের ঘর থেকে বেরতে দেওয়া হয়নি।
জম্মু-কাশ্মীরের মানুষকে অভিনন্দন জানিয়ে সিপিআই(এম)’র বিবৃতি
একটি পৃথক বিবৃতিতে জম্মু-কাশ্মীরের মানুষকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার জন্য সিপিআই(এম)’র পক্ষ থেকে অভিনন্দন জানিয়ে বলা হয়েছে, বিজয়ী প্রার্থীরা মানুষের অধিকারের জন্য প্রতিটি মঞ্চ থেকে লড়াই চালিয়ে যাবে।
২৩ ডিসেম্বর প্রকাশিত ওই বিবৃতির শীর্ষক পিএজিডি’র সাফল্য জম্মু-কাশ্মীরের মানুষ কি চান তার স্পষ্ট উত্তর দিচ্ছে।
জম্মু-কাশ্মীরের জেলা উন্নয়ন কাউন্সিলের নির্বাচনের ভোট গণনা চলছে।
জম্মু-কাশ্মীরের নির্বাচনে মানুষের ব্যাপক সংখ্যায় অংশগ্রহণ পরিষ্কার ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, তাঁরা তাঁদের কেড়ে নেওয়া সাংবিধানিক অধিকার ফিরে পেতে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই লড়াই করতে চান। গত আগস্ট মাস থেকে বিজেপি সরকার প্রচার চালিয়ে এসেছে যে, জম্মু-কাশ্মীরের জনগণ ৩৭০ ধারায় প্রদত্ত রাজ্যের বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহারের একতরফা এবং অসাংবিধানিক সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছেন। এই নির্বাচনের ফল বিজেপি সরকারের চোখ খুলে দেবে। বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে, আরও চেষ্টা হয়েছে, নির্বাচনী ফলের মেরুকরণ ঘটাবার উদ্দেশ্যে জম্মুতে বিজেপি বড়ো জয় পেয়েছে বলে যে প্রচার চালাবার চেষ্টা হচ্ছে সেটাও সত্যি নয়। যদি আমরা নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করি তাহলে পরিষ্কার দেখা যাবে যে, জম্মুর সর্বত্রই বিজেপি জিতেছে, তা নয়। পিএজিডি, কংগ্রেস, প্যান্থার পার্টি, বিএসপি এবং অন্যান্য নির্দল প্রার্থীরা ভালো সংখ্যায় সেখানে জিতেছে এবং তাদের পাওয়া ভোটের শতাংশ তাৎপর্যপূর্ণ। এই ফলাফল দেখিয়ে দিচ্ছে যে, জম্মু ও কাশ্মীরের জনাদেশ মেরুকরণের ভিত্তিতে হয়নি।
পিএজিডি কাশ্মীর এবং জম্মু দু’জায়গাতেই বেশি আসনে জিততে পারতো যদি প্রস্তুতির জন্য বেশি সময় পেত। সরকারের পক্ষ থেকে তড়িঘড়ি নির্বাচন ঘোষণা করা হয়েছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বেশ কিছু জায়গায় ঐক্যবদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গির অভাব ছিল পিএজিডি’র শরিকদের মধ্যে যা এড়ানো যেত। জম্মু এবং কাশ্মীরের মানুষের পক্ষ থেকে পিএজিডি’র পক্ষে এই জনাদেশ কিন্তু পরিষ্কার ইঙ্গিত যে, তাঁরা তাঁদের গত আগস্ট মাস থেকে লুণ্ঠিত অধিকার ফিরে পেতে চান।
এটা প্রশংসার যোগ্য যে, ডিডিসি নির্বাচন মোটামুটি শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই জনাদেশকে প্রত্যেকেরই শ্রদ্ধা জানানো কর্তব্য। জনগণের স্বার্থ জড়িত রাজনৈতিক বা উন্নয়নমূলক প্রত্যেকটি ব্যাপারকেই যত্নের সঙ্গে দেখা অবশ্য কর্তব্য। জম্মু ও কাশ্মীর যাতে একসাথে অগ্রসর হতে পারে সেটাই এখন দেখতে হবে।