৫৮ বর্ষ ১৯শ সংখ্যা / ২৫ ডিসেম্বর ২০২০ / ৯ পৌষ ১৪২৭
কৃষিক্ষেত্র ও মুক্তবাজার
প্রভাত পট্টনায়েক
মোদী সরকারের তিনটি কৃষিবিল বাতিলের দাবিতে দেশজুড়ে যে কৃষক আন্দোলন চলছে, তার প্রেক্ষিতে যত মানুষ বক্তব্য রাখছেন, তাঁদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই কৃষকদের দৃষ্টিভঙ্গির পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। অন্যদিকে, একদল মুষ্টিমেয় মানুষ প্রশ্ন তুলেছে, মুক্তবাজার ব্যবস্থায় কৃষি কেন কাজ করতে পারবে না? তবে এটা ধরে নেওয়া উচিত হবে না যে, তাঁরা প্রত্যেকেই আবশ্যিকভাবে মোদীর সাথে সহমত পোষণ করেন। তবুও তাঁদের উত্থাপিত প্রশ্নটি জবাব পাওয়ার যোগ্য। এই জবাব অত্যন্ত সুপরিচিত ও এক্ষেত্রে তার পুনরাবৃত্তি ঘটবে। তথাপি সেই পুনরুক্তি এক্ষেত্রে করা যায়।
কেইনস যেভাবে সামগ্রিকতায় বিষয়টি দেখিয়েছেন, মুক্তবাজারের মাধ্যমে কোনো কিছুর সমাধান করা অবশ্যই অর্থনীতির পক্ষে সর্বাপেক্ষা সন্তোষজনক বিধি বন্দোবস্তের থেকে সন্দেহাতীতভাবে বেশ কিছুটা কমতি উপায়। তথাপি কেইনসীয় যুক্তিকে আপাতত দূরে সরিয়ে রাখা যাক। তাহলেও, কৃষির ক্ষেত্রে বাজার ব্যবস্থার মাধ্যমে কোনো কিছুর সুরাহা করার বিষয়টি দু’টি সুস্পষ্ট কারণে সর্বাপেক্ষা কাম্য-বন্দোবস্তের থেকে বেশ কিছুটা কমতি উপায়। কৃষিজ উৎপন্নের ক্ষেত্রে মুক্তবাজারে যে দামস্তর আধিপত্য বিস্তার করবে, তা সামাজিকভাবে সর্বাপেক্ষা কাম্য হবে না - সমাজের পক্ষে সর্বনাশ হবে। আবার সেই দামস্তরে বিভিন্ন ধরনের কৃষিজ পণ্য যে পরিমাণ উৎপাদিত হবে, অথবা অন্যকথায় মুক্তবাজার ব্যবস্থার হাতে কৃষিকে ছেড়ে দিলে জমির যে ব্যবহার হবে, সেটাও সমাজের পক্ষে সর্বনাশা।
আলোচনাটিকে আরও স্পষ্ট করে তুলে ধরার জন্য এই দু’টি বিষয়কে আলাদা করে সরিয়ে রেখে এটা ধরে নিয়ে আমরা শুরু করতে পারি যে, কৃষিক্ষেত্রে একটিমাত্র উৎপন্নই উৎপাদিত হয়; সেটা হলো খাদ্যশস্য। এক্ষণে খাদ্যশস্যের চাহিদা দামস্তরের ওঠানামার সাথে সাথে খুব একটা পরিবর্তিত হয় না (দাম অস্থিতিস্থাপক) অন্যদিকে আরও অনেক কিছুর সাথে প্রাকৃতিক কারণেই কৃষি উৎপাদনের পরিমাণ বিরাটমাত্রায় ওঠানামা করে। (কৃষির এই বৈশিষ্ট্যটি সামগ্রিকভাবে সমস্ত উৎপন্নের ক্ষেত্রেই সত্য)। অতএব স্বাভাবিক অবস্থাতেই কৃষি উৎপন্নের চাহিদা ও জোগানের সমতা বিধানের জন্য তার দামস্তর ব্যাপকমাত্রায় ওঠানামা করে। দাম যদি নিদারুণভাবে কমে যায়, তাহলে কৃষকরা দেনার দায়ে জড়িয়ে পড়ে, যে বোঝা তাঁদের কাঁধে চিরকালের জন্য চেপে বসে। আবার দাম যদি মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পায়, তবে অনেক উপভোক্তা (সাধারণ মানুষ) বাজার থেকে ছিটকে যায় এবং খাদ্যশস্যের মতো পণ্যের ক্ষেত্রে এই ঘটনা চূড়ান্তভাবে সর্বনাশা।
এই ধরনের চরম ঘটনার দু’টি উদাহরণ হলো, ‘মহামন্দার’র সময়ে দাম পড়ে যাওয়ার কারণে কৃষকরা ব্যাপক দেনায় ডুবে গিয়েছিল, এবং ১৯৪৩ সালে বাংলায় ‘মহাদুর্ভিক্ষে’র সময়ে ত্রিশ লক্ষ মানুষ (দামের অত্যধিক বৃদ্ধির কারণে) কেবলমাত্র অনাহারে মারা গিয়েছিল। এই দুই ঘটনার কোনোটাই জোগানের দিক থেকে আনা প্রচণ্ড ধাক্কার কারণে ঘটেনি - কৃষিজ উৎপন্নের ব্যাপক উৎপাদন বা প্রায় একেবারেই উৎপাদন না হওয়ার কারণে ঘটেনি। তবে এই ঘটনা দু’টি আমি তুলে ধরলাম এটা বেঝাতে যে, খাদ্যের দাম ব্যাপক ওঠানামার কারণে কী বিপর্যয় ঘটতে পারে। আর একটা বিষয় হলোঃ ১৯৩০ সালে দাম পড়ে যাওয়ায় খাদ্যের উপভোক্তারাও উপকৃত হয়েছিল, অথবা বাংলার দুর্ভিক্ষের সময়ে উৎপাদকরা উপকৃত হয়েছিল - এমনটা কিছুই ঘটেনি। উভয় ঘটনাই ছিল কেবলমাত্র দ্ব্যর্থহীন সামাজিক বিপর্যয়।
মুক্তবাজার কিভাবে কাজ করে, তা নিয়ে বিদ্যমান মূলধারার তত্ত্বগুলি এই ধরনের সম্ভাবনার কথা কোনোভাবেই দেখতে পায়নি। একটি অর্থপূর্ণ মুক্তবাজারের (চাহিদা ও জোগানের মধ্যে) ভারসাম্যের স্বার্থে প্রচলিত তত্ত্বগুলি আগেই অনুমান করে নেয় যে, সমস্ত পণ্যই ‘সামগ্রিকভাবে একে অপরের বিকল্প পণ্য’; অর্থাৎ বাকি পণ্যগুলির দাম অপরিবর্তিত থাকা অবস্থায় কোনো একটি পণ্যের দাম বৃদ্ধি পেলে বাকি সমস্ত পণ্যের চাহিদা হয় বৃদ্ধি পাবে, অথবা অপরিবর্তিত থাকবে। খাদ্যশস্যের মতো একটি পণ্যের অস্তিত্ব এই পূর্বানুমানের মধ্যে বিধিবদ্ধভাবে ধরা যায় না। খাদ্যশস্যের দাম বৃদ্ধি পেলে অন্যান্য পণ্যের চাহিদা কমে যাচ্ছে, তার কারণ, খাদ্যশস্য কেনার জন্য উপভোক্তারা তাঁদের অন্যান্য কেনাকাটা কমাতে বাধ্য হন। এককথায়, অন্যান্য পণ্যগুলি খাদ্যশস্যের বিকল্প হিসাবে কাজ করতে অক্ষম; অথচ অর্থপূর্ণ একটি মুক্তবাজারে কার্যকরভাবে ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য যে বিকল্পের প্রয়োজন জরুরি। সুতরাং খাদ্যশস্যের দাম খুব বেশি ওঠানামা না করার বিষয়টি নিশ্চিত করা অত্যন্ত আবশ্যিক হয়ে ওঠে; আর সেইজন্যই এক্ষত্রে মুক্তবাজারব্যবস্থা অধিকতর প্রভাবশালী হয়ে ওঠা ঠেকাতে সরকার হস্তক্ষেপ করে। অতএব যে গুটিকয়েক মানুষ যুক্তি দিচ্ছেন যে, (সরকারি) হস্তক্ষেপের ওপরে মুক্তবাজার ব্যবস্থা থাকা উচিত, তাঁদের বক্তব্য সম্পূর্ণত পঙ্গু।
এবার উৎপাদনের পরিমাণের বিষয়টিতে যাওয়া যাক; নির্দিষ্টভাবে বললে, মুক্তবাজারব্যবস্থা জমি ব্যবহারের বিষয়টিতে যে ফলাফলের জন্ম দেবে, সেই বিষয়টিতে। যে কোনো অপ্রতুল সম্পদের ক্ষেত্রেই যেটা ঘটে, তা হলো - সেই সম্পদ কী কাজে ব্যবহৃত হবে, সেটা নির্ভর করে তার বিভিন্ন সম্ভাব্য ক্রেতার তুলনামূলক ক্রয়ক্ষমতার পরিমাণের ওপরে। মুক্তবাজারের হাতে কৃষিক্ষেত্রকে ছেড়ে দিলে তার একটি অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হবে খাদ্যশস্যের জমি পশ্চিমী দুনিয়ায় চাহিদা থাকা ফসলের জমিতে পরিণত হওয়ার দিকে এগোবে, অথবা সমাজের অধিকতর প্রভাবশালী মানুষজনের চাহিদা পরিতৃপ্তির কাজে জমি ব্যবহৃত হওয়ার দিকে সরে যাবে। অন্যকথায়, দেশ-বিদেশের ক্ষমতাবান উপভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতা খাদ্যশস্য উৎপাদনের কাজ থেকে জমিয়ে ছিনিয়ে নেবে। এমনকি বিদেশের এগিয়ে থাকা দেশগুলি থেকে খাদ্যশস্য আমদানি করার কারণে যদি তার দাম নাও বৃদ্ধি পায়, তাহলেও দু’টি জিনিস ঘটবে - প্রথমত, বছরের পর বছর ধরে চেষ্টার পরে দেশ নিজেকে যে (খাদ্যশস্যে) আত্মনির্ভর করে তুলেছে, তা ধ্বংস হবে এবং আমাদেরকে খাদ্য আমদানির ওপরে নির্ভর করে তুলবে; দ্বিতীয়ত, গণহারে ক্ষুধার বৃদ্ধি ঘটবে।
দ্বিতীয় পরিণতিটিকে প্রথমে আলোচনা করা যাক। একখণ্ড জমি যদি প্রাথমিকভাবে খাদ্যশস্য উৎপাদনে ব্যবহৃত হতো, যেখানে ১০ জন লোক কাজ করত এবং সেটাই এখন যদি অন্য কোনো ফসল, যেমন ফল উৎপাদনের কাজে ব্যবহৃত হয় যেখানে পাঁচজন লোক কাজ করবে, তাহলে খাদ্যশস্য থেকে ফল উৎপাদনের কাজে জমির ব্যবহারের পরিবর্তন পাঁচজনকে কর্মচ্যুত করে দেবে। খাদ্যশস্যের চাহিদার পক্ষেও এই পাঁচজনের কোনো ক্রয়ক্ষমতা থাকবে না। ফলে চলতি আন্তর্জাতিক দামে খাদ্যশস্য আমদানি করার সুযোগ যদি থেকেও থাকে, এবং খাদ্যশস্য আমদানি করার মতো বৈদেশিক মুদ্রা যদি দেশের হাতে থাকেও - তাহলে ক্ষুধা বৃদ্ধি পাবে। তার কারণ, খাদ্য কেনার মতো প্রয়োজনীয় ক্রয়ক্ষমতাও মানুষের হাতে থাকবে না।
খাদ্যশস্য উৎপাদনের থেকে সরে গিয়ে একক পরিমাণ জমি-প্রতি কম লোক কাজ করে এমন অন্য কোনো ফসল উৎপাদনে জমি ব্যবহৃত হবে - এই আলোচনাতে এ কথাটি অবশ্যই ধরে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু (এটাও ঠিক) শহুরে চাহিদা বা সমাজের ক্ষমতাশালী অংশের চাহিদার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যে সমস্ত ফসলের উৎপাদন হয়, গড়পড়তায় সেই উৎপাদনের কাজ কম নিযুক্তি-নিবিড়। আর ফসল উৎপাদনের বদলে রিয়েল এস্টেট বা গলফ কোর্ট গড়ে তোলার কাজে জমি ব্যবহৃত হতে থাকলে একক প্রতি জমিতে নিযুক্তির সংখ্যা আরও কমে যাবে, ফলে বেকারি ও গণহারে ক্ষুধার সৃষ্টি হবে। মূলধারার অর্থনীতি এই সহজ সাধারণ বিষয়টিকে স্বীকৃতি দেয় না। তার কারণ, সে ধরে নেয় সব সময়েই পূর্ণ নিয়োগ দশা থাকে এবং এটাও ধরে নেয় যে, মুক্তবাজার ব্যবস্থার এই পূর্ণ নিয়োগ-ভারসাম্যে প্রত্যেকেই টিকে থাকতে পারবে।
এবার প্রথম পরিণতিটিতে আসা যাক; নির্দিষ্টভাবে খাদ্যশস্যে আত্মনির্ভরতা ধ্বংসের প্রসঙ্গে। ধরা যাক, দেশের জন্য যে খাদ্যশস্যের প্রয়োজন তা এখন আর দেশে উৎপাদিত হবে না বরং তার জন্য আমদানি-নির্ভর হয়ে থাকতে হবে। সেক্ষেত্রে দু’টি নিশ্চিত সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে। প্রথমত, দেশে যখনই খাদ্যশস্যের প্রয়োজন হবে, তখন তো যথেষ্ট পরিমাণে বিশ্ববাজারে পাওয়া যাবে, এমনটা সর্বদা নাও ঘটতে পারে। একটি বৃহৎ দেশের ক্ষেত্রে এটা গুরুত্বপূর্ণ, কেননা এক্ষেত্রে তার প্রয়োজনীয় আমদানির পরিমাণও বেশ বড়োমাপের হবে। এই সমস্যার আর একটি দিক হলো - ভারতের মতো একটি বৃহৎ দেশ আমদানির জন্য বিশ্ববাজারে দ্বারস্থ হলেই (খাদ্যশস্যের) আন্তর্জাতিক দাম নিজে থেকেই বৃদ্ধি পাবে।
দ্বিতীয় সমস্যাটি হলো, বাস্তবের বিশ্ববাজার পাঠ্যপুস্তকে বর্ণিত একটি বাজারের থেকে বহুলাংশে আলাদা। পাঠ্যপুস্তকের বাজারে বিপুল সংখ্যক ক্রেতা ও বিক্রেতা থাকে, যাদের মধ্যে কোনো ব্যক্তিগত সম্পর্ক নেই। কিন্তু বাস্তবের বিশ্ববাজারে কোনো একটি দেশ তার প্রয়োজনের সময়ে খাদ্য পাবে কিনা, তা নির্ভর করে আমেরিকা ও ইয়োরোপীয় সরকারগুলির সদিচ্ছার ওপরে। তারা নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারে, তাদের বিদেশনীতির পদাঙ্ক অনুসরণে বাধ্য করার জন্য আমদানিকারী দেশের হাত মুচকিয়ে ধরতে পারে; অথবা তাদের কোম্পানিগুলিকে বিশেষ কিছু ছাড় দেওয়ার দাবি জানিয়ে একটা পারিতোষিক চাইতে পারে। অতএব, কোনো একটি দেশের হাতে যদি খাদ্যশস্য কেনার মতো বিদেশি মুদ্রা থেকেও থাকে, এবং তার চাহিদা পূরণের উপযুক্ত পরিমাণ যদি বিশ্ববাজারে থাকেও, তাহলেও সেই খাদ্যশস্য পাওয়ার জন্য সেই দেশকে অর্থের বাইরে অন্য কিছুর মাধ্যমে দাম চোকাতে হতে পারে।
এই সমস্ত কারণেই একটি বৃহৎ দেশকে যদি খাদ্যে আত্মনির্ভরতা নিশ্চিত করতে হয়, তাহলে তাকে নিজের প্রয়োজনীয় খাদ্য নিজেকেই উৎপাদন করতে হবে। কোন্ ফসল ফলানো হবে, অর্থাৎ জমির ব্যবহার কেমন ধারার হবে, তা মুক্তবাজারের হাতে ছেড়ে রাখা যায় না। সামাজিক বাস্তবতা দাবি করে, কোন্ ধরনের ফসল ফলানো হবে, তা নির্ধারণের জন্য সরকারি হস্তক্ষেপ লাগবেই। আর এর একটি নিশ্চিত পন্থা হলো, বাজার-নির্ধারিত দামব্যবস্থার বিপরীতে হেঁটে সরকার-নির্ধারিত দামস্তরগুলিকে বাজারের ওপরে কর্তৃত্ব করার বন্দোবস্ত করা।
ভাষান্তরঃ জয়দীপ ভট্টাচার্য