E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ১৯শ সংখ্যা / ২৫ ডিসেম্বর ২০২০ / ৯ পৌষ ১৪২৭

কৃ‍‌ষি ও কৃষক - বামফ্রন্ট সরকার বনাম তৃণমূল সরকার

সুপ্রতীপ রা‌য়


কৃষক আন্দোলনে উত্তাল দেশ। ১৬ ডিসেম্বর কলকাতার রাজপথ কাঁ‍‌পিয়ে বাংলার কৃষকরা জানান দিয়েছেন - কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারকে কৃষক বিরোধী নীতি থেকে সরে আসতে হবে। যদিও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বলে চলেছেন - এ রাজ্যের কৃষকদের নাকি তৃণমূল জমানায় ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। তিনি এও বলছেন - তৃণমূল সাম্প্রতিক লাগু হওয়া কৃষির তিনটি আইনের বিরুদ্ধে। যদিও বিরোধিতার কোনো নমুনা রাজ্যবাসী দেখতে পাচ্ছেন না। নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে ততই প্রকল্প ঘোষণার তালিকা দীর্ঘতর হচ্ছে।

তৃণমূলেশ্বরী যতই চিৎকার করুন না কেন, আসলে কৃষি ও কৃষকের উন্নতি হয়েছিল ৩৪ বছরের বাম আমলে। ২০১১-তে পরিবর্তনের পর কৃষি ও কৃষক বিপন্ন। ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকার গঠনের পর কৃষি ও কৃষকের অবস্থার পরিবর্তন হয়। বামফ্রন্ট সরকার স্থায়ী উন্নয়ন করতে চেয়েছিল। আর তৃণমূল সরকারের কাজে চমক ছাড়া কিছুই নেই। বামফ্রন্ট সরকার সিলিঙের অতিরিক্ত যে জমি ন্যস্ত হয়েছিল - সেই ন্যস্ত জমি ভূমিহীন ও নিতান্ত দরিদ্র কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করার দিকে জোর দিয়েছিল। ১৯৭৭ সা‍‌লের জুন মাসে বামফ্রন্ট সরকার গঠিত হওয়ার পর‍‌ সিলিঙের উদ্বৃত্ত জমি অধিগ্রহণ করে ও বিতরণ করে। ১৯৭৮-৮১ সালের মধ্যে মোট ১,৯২,০০০ একর জমি অধিগৃহীত হয়।

সিলিং আইনের নানা ত্রুটি থাকার ফলে উদ্বৃত্ত জমি অধিগ্রহণে প্রতিবন্ধকতা দেখা দেয়। এই ত্রুটিগুলি সংশোধনের জন্য দ্বিতীয় ভূমিসংস্কার আইন আনা হয়। ১৯৮১ সা‍‌লে এটি বিধানসভায় পাশ হলেও রাষ্ট্রপতির সম্মতির জন্য দীর্ঘ পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে হয়। ১৯৮৬ সা‍‌লের মার্চ মাসে সম্মতি পাওয়া যায়। সম্মতি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তৃতীয় সংশোধনী বিল বিধানসভায় পাশ করানো হয়। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি সম্ম‍‌তি প্রদানে বিলম্ব ঘটান। প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে জমি বণ্টন করা হয়।

আমাদের রাজ্যে বামফ্রন্ট আমলে ভূমিহীন, প্রান্তিক চাষিদের হাতেই বে‍‌শিরভাগ জমি গেছে। জমিতে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে তাঁরা নিজেদের জমিতেই ফসল, সবজি চাষ করেছেন অনেক দরদ দিয়ে। ফলে উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছিল। জমি বিলির সঙ্গে সঙ্গে বামফ্রন্ট সরকারের আমলে সেচ, বিশেষত ক্ষুদ্র সেচ সম্প্রসারিত হওয়ার ফলে কৃষির উৎপাদন বেড়েছিল। বৃদ্ধি পেয়েছিল কৃষির নিবিড়তা।

অর্থনৈতিক উন্নতি, গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নতি ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করতে গেলে আমূল ভূমিসংস্কার প্রয়োজন। প্রয়োজন জমির উপর গ্রামের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও উৎপাদনের সঙ্গে সমস্ত মানুষকে যুক্ত করা। কৃষি উপকরণ সরবরাহ, পুঁজির জোগান ও বিপণনের সুযোগ বাড়ালে উৎপাদন বাড়বে। উৎপাদন হয় দীর্ঘস্থায়ী। উৎপাদন বৃদ্ধির হাত ধরে গ্রামীণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে, বাড়ে সঞ্চয় ক্ষমতা। এর ফলে নতুন নতুন শিল্প পণ্য তারা বেশি বেশি করে কিনবেন। বিরাট বাজার সৃষ্টি হবে। বাজারের চাহিদা পূরণে বিকাশ হবে শিল্পের। এই কাজটিই করেছিল বামফ্রন্ট সরকার। দেশের সংবিধান ও আইন ভূমিসংস্কারের যেটুকু সুযোগ দিয়েছিল বামফ্রন্ট সরকার সেটুকুকেই ব্যবহার করেছে।

জ‍‌মি বণ্টনের সঙ্গে সঙ্গে কৃষকদের মধ্যে কৃষি ঋণ, বীজ, সার, সেচের জল, সস্তায় বিদ্যুৎ প্রভৃতি বামফ্রন্ট সরকার সরবরাহ করেছিল। উৎপাদিত ফসল বিপণনের ব্যবস্থা করেছিল। কৃষি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নজর দিয়ে বামফ্রন্ট সরকার গ্রামীণ মানুষের আয় বৃদ্ধির বিকল্প পথের সন্ধান দিয়েছিল।

ভূমিসংস্কারের মাধ্যমে ভূমিহীন কৃষকদের বিনামূল্যে জমির পাট্টা বিলির কাজ হয়েছে বাম আমলে। কৃষি নির্ভর মানুষের স্বার্থে দেশের মধ্যে সেরা কাজ করেছিল বামফ্রন্ট সরকার। বামফ্রন্ট সরকারের নীতির ফলে পশ্চিমবঙ্গে ৩০ লক্ষাধিক কৃষক ১১ লক্ষ ২৭ হাজার একরেরও বেশি জমি পেয়েছেন বিনামূল্যে। পাট্টা প্রাপকদের প্রায়‌ ৩৭ শতাংশ তপশিলি জাতিভুক্ত, প্রায় ১৮ শতাংশ আদিবাসী, প্রায় ১৮ শতাংশ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের।

বামফ্রন্ট সরকারের নীতির ফলে পশ্চিমবাংলার কৃষক পরিবারের মা-বোনেরাও পাট্টা পেয়ে জমির মালিক হয়েছেন। রাজ্যে ভূমিসংস্কারের মাধ্যমে নারী-পুরুষ যৌথ পাট্টা ৬ লক্ষ ১৮ হাজারেরও বেশি। মহিলাদের পাট্টা ১ লক্ষ ৬১ হাজারেরও বেশি। বামফ্রন্ট সরকারের ভূমিসংস্কারের ফলে রাজ্যে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকেরা ৮৪ শতাংশ কৃষি জমির মালিক হয়েছেন। বর্গা উচ্ছেদ আটকাতে ১৯৭৭ সালের সেপ্টেম্বরেই ভূমিসংস্কার আইনের সংশোধন করেছিল রাজ্য সরকার। সপ্তম বামফ্রন্ট সরকার ২০০৬-২০১০ সালের মধ্যে ১৬ হাজার ৭০০ একর জমি বিলি করেছে। ভূমিসংস্কারের কাজ আরও সংহত করতে ‘চাষ ও বসবাসের ভূমিদান প্রকল্প’ কার্যকর করেছে সপ্তম বামফ্রন্ট সরকার।

তৃণমূলের আমলে কৃষি বিপন্ন। আক্রান্ত কৃষক। নতুন করে জমি বিলি হয়নি। শুধু তাই নয় জমির প্রমোটারচক্র কম মূল্যে জমি হাতিয়ে নিচ্ছে। চাষযোগ্য জমিতে মদের দোকান গড়ে উঠছে। কৃষি ফসল বিপণনের সরকারি ব্যবস্থা ধ্বংস করা হয়েছে। চাষি ধান, আলুর দাম পাচ্ছেন না। তৃণমূলের আমলে কৃষক ধানের দাম পাননি। কৃষক বিপর্যস্ত। নেমে এসেছে চরম হতাশা। অভাবী কৃষকের কাছ থেকে সরকার ধান কেনে না। কৃষক বাধ্য হচ্ছেন ফড়ে দালাল বা মহাজনদের কাছে কম দামে ধান বিক্রি করতে। তৃণমূলের আমলে ধান ফড়েদের দখলে। চাষিদের নাম করে আসলে ফড়েদের কাছ থেকে ধান কেনে তৃণমূল সরকার।

‘মা-মাটি-মানুষে’র সরকারের আমলে ধান, আলু, পাটের দর নেমেই চলেছে। এই তিন ফসলে গত নয় বছরে দাম পাননি বাংলার কৃষক। এমনকি কেন্দ্রীয় সরকারের বেঁধে দেওয়া ন্যূনতম সহায়কমূল্যও কৃষকের মেলেনি। পাটের দাম না পাওয়ার ফলে কৃষক বারে বারে পাট পুড়িয়ে বিক্ষোভও দেখিয়েছেন। চাষ করার খরচটুকুও কৃষকের উঠছে না। বিগত বছরগুলিতে অভাবী বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন কৃষক। সরকারের বেধে দেওয়া দরের নিচেও নেমে গেছে ধানের দর। ধান কাটার পর অভাবী কৃষক মহাজন আর রাইসমিল মালিকদের কাছে কম দামে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন।

পশ্চিমবাংলার কৃষকদের অন্যতম অর্থকরী ফসল আলু। তৃণমূল সরকারের সৌজন্যে সর্বনাশের কিনারায় দাঁড়িয়েছেন আলুচাষিরা। বামফ্রন্ট সরকার আলুচাষিদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। ২০১০ সালে ব্যাপক আলু উৎপাদন হয় পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশে। ফলে বাংলার আলুচাষিরা বিপদে পড়েন। বামফ্রন্ট সরকার আলুচাষিদের বাঁচাতে ৫০ কেজির বস্তা আলু ২৭৫ টাকা দরে কিনে নিয়েছিল। এজন্য সরকার খরচ করেছিল ৬০০ কোটি টাকা। অন্য রাজ্যে পশ্চিমবঙ্গের আলুর বাজার বাড়াতে বামফ্রন্ট সরকার গ্রহণ করেছিল নানা উদ্যোগ। জাহাজে করে বিদেশেও আলু পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছিল বামফ্রন্ট সরকার।

২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের ইশ্‌তিহারের ১৫ পাতায় লেখা হয়েছিলঃ ‘‘প্রতি মহকুমাতে পাঁচ বছরে অন্তত পাঁচটি করে হিমঘর তৈরি করা হবে। তাহলে আলু, পটল, কপি, বেগুন, টমেটো, আম, কাঁঠাল, আনারস, পেয়ারা চাষ করে চাষিরা লাভবান হবে। বিপন্ন বিক্রি অতীতের বিষয় হবে।’’ ওই পাতাতেই লেখা হয়েছিলঃ ‘‘দেখতে হবে ধান ও আলুর মজুত বৃদ্ধি পায়। কৃষক তার ন্যায্য পাওনা পায়। তা হলে কৃষকদের অভাবের তাড়নায় আর আত্মহত্যা ঘটবে না।’’

অভিজ্ঞতা কি? কোথায় হিমঘর। ২০১১ সালের ৫ নভেম্বর বাংলা আকাদেমিতে ধান সংগ্রহ নিয়ে সভা করেছিল নবগঠিত তৃণমূল সরকার। ওই সভাতেই কৃষক বিরোধী প্রথম সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে রাজ্য সরকার। ২০১১-১২ সালের ধান সংগ্রহের জন্য ওই বছর ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ছিল কুইন্টাল পিছু ১০৮০ টাকা। তৃণমূল সরকার কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্তকে বহাল রাখে। অর্থাৎ বামফ্রন্ট সরকারের শেষ বছরের থেকে কুইন্টালে ২০ টাকা কম দাম দিয়ে ধান বিক্রি করতে হয়েছিল রাজ্যের কৃষককে।

২০১১-র মে মাসের পর এমন কোনো কৃষি পণ্য নেই যার লাভজনক দাম পেয়েছে বাংলার কৃষক। তৃণমূলের আমলে বাংলার মাঠ যেন মারণখেত। কৃষকের আত্মহত্যার মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। অভাবী বিক্রির কবলে পড়ে দেনাগ্রস্ত কৃষক আত্মহত্যা করছেন। একদিকে ফসলের দাম নেই। বিদ্যুতের গতিতে বাড়ছে চাষের খরচ। কৃষি উৎপাদনের সব উপকরণের দাম বেড়েছে। যদিও ২০১১-তে নির্বাচনী ইশ্‌তিহারে তৃণমূল (১৮নং পাতায়) বলেছিলঃ ‘‘সরকার সারে ভরতুকি দেবে। এতে কৃষি উৎপাদন বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে। কৃষকদের আয় বৃদ্ধি পাবে।’’

কিন্তু কোথায় গেল সেই প্রতিশ্রুতি। কৃষি ও কৃষকদের বিন্দুমাত্র আর্থিক সহায়তা তৃণমূল সরকার করেনি। মেলা-খেলা-উৎসবে বিপুল টাকা খরচ করা হয়েছে। ক্লাবে ক্লাবে বিলি করা হয়েছে টাকা। যদিও সরকারের টাকা নেই কৃষকের জন্য। প্রতি বছর মাটি উৎসবে আড়ম্বর, এলাহি খানাপিনা সব হয়েছে কিন্তু উৎসবের আঙিনা থেকে বাদ গেছেন কৃষক।

তৃণমূলের আমলে করুণ অবস্থায় কৃষক, গ্রামের মানুষ। কৃষকের জীবনধারণের মান দ্রুত নিচে নেমেছে। ছোটো চাষি থেকে বর্গাদার, বড়ো চাষি এখন সবাই দেনায় ডুবে আছে। ১৯৭৭ সালে পশ্চিমবঙ্গ ছিল খাদ্যে ঘাটতি রাজ্য। ১৯৭৬-৭৭ সালে রাজ্যে খাদ্যশস্য উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৭৪ লক্ষ মেট্রিক টন। ৩৪ বছরে তা ১৭০ লক্ষ মেট্রিক টনে নিয়ে যায় বামফ্রন্ট সরকার। আর তৃণমূল সরকার কোনো মরশুমেই লক্ষ্যমাত্রার ধারে কাছে পৌঁছতে পারেনি। কৃষি উন্নয়নের অন্যতম মাপকাঠি একটি জমিতে কতবার চাষ হচ্ছে। শস্যনিবিড়তার মাপকাঠিতে পশ্চিমবঙ্গের হার ছিল ১৯২শতাংশ। এখন রাজ্যের কৃষক কৃষি থেকে মুখ ফেরাচ্ছে।

তৃণমূলের আমলে বাংলার কৃষকের শুধুই হতাশা।