E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ১৯শ সংখ্যা / ২৫ ডিসেম্বর ২০২০ / ৯ পৌষ ১৪২৭

ইস্পাত দৃঢ়-স্তালিন

নির্মলকান্তি দাস


ডাক নাম ‘শোশো’। জন্ম আজ থেকে ১৪১ বছর আগে অর্থাৎ ১৮৭৯ সালের ২১ ডিসেম্বর রাশিয়ায় তিফলিস প্রদেশের গোরি শহরে। পুরো নাম জোসেফ ভিসারিওনোভিচ স্তালিন। ওদেশে ইস্পাত-কে স্তালিন বলা হয়। পিতা ভিসারিওনোভিচ জুগাশভিলি, তিনি ছিলেন জুতো কারখানার শ্রমিক। আর মা একাতারিনা জুগাশভিলি, ধোপানির কাজ করতেন। অর্থাৎ হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান ছিলেন তিনি। কিন্তু, শত অভাবের মধ্যেও আদরের শোশোকে তাঁর মা-বাবা লেখাপড়া শেখাতে কোনো কার্পণ্য করেন নি। অসাধারণ মেধা, ক্ষুরধারবুদ্ধি, চারিত্রিক দৃঢ়তা সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করত। পাদরিদের স্কুল থেকে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে গ্র্যাজুয়েট হয়ে উচ্চতর শিক্ষার জন্য তিফলিসে জিওলজিক্যাল সেমিনারিতে ভর্তি হন- সেটা ১৮৯৪ সাল। ছাত্র থাকাকালীন পাঠ্যবই ছাড়াও ইতিহাস, শিল্প, সাহিত্য, কবিতা, বিজ্ঞান, রাজনীতি ইত্যাদির যেকোনো বই পেলেই পড়ে ফেলতেন। কলেজে ছাত্র থাকাকালীন অতিগোপনে কমিউনিস্ট ইশ্‌তিহার সহ মার্কস, এঙ্গেলসের সমস্ত রচনাবলি তাঁর পড়া হয়ে যায়। তাঁর উদ্যোগে ১৮৯৮ সালে তিফলিসে রেলশ্রমিকদের নিয়ে এক পাঠচক্র গড়ে ওঠে। পরবর্তীতে, এক স্মৃতিকথায় এই রেলশ্রমিকরাই যে তাঁর প্রথম শিক্ষক ছিলেন সে কথা উল্লেখ করেন। ক্রমশ বৃহত্তর জীবনের পরিসরে শুরু হলো কমরেড স্তালিনের সর্বক্ষণের বৈপ্লবিক জীবন। শ্রমিকদের সামনে বক্তব্য রাখার সময় সর্বদা তিনি ভালোভাবে প্রস্তুতি নিয়ে আসতেন। স্তালিনকে সর্বদা রাশিয়ার স্বৈরশাসক জারের পুলিশ নজরে রাখত। ওদের চোখে ধুলো দিয়ে বিভিন্ন কলকারখানায় আইনি ও আইন বহির্ভূত সংগঠন গড়তে লাগলেন। প্রথম থেকেই ব্যাপক শ্রমিকদের কাছে অতি দ্রুত মার্কসবাদী বক্তব্য পৌঁছনোর পথ খোঁজা শুরু হলো। সেই অবস্থায় ১৯০১ সালে প্রথম বেআইনি মুখপত্র ‘বর্দজোলা’-র আত্মপ্রকাশ এবং ১৯০২ সালে গোপন ছাপাখানা বাটুম-এর স্থাপন। ১৯০৫ সালের ডিসেম্বর মাসে ফিনল্যান্ডে বলশেভিক পার্টির সন্মেলনে ভি আই লেনিনের সাথে স্তালিনের প্রথম সাক্ষাৎ হয়। তারপর থেকে যে যতদুরেই থাকুক না কেন উভয়েই নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলতেন। চিন্তা চেতনায় ছিলেন একে অপরের পরিপূরক। এদিকে সারা রাশিয়ায় স্তালিন অগ্রণী শ্রমিক-কৃষকদের নিয়ে মার্কসবাদী চিন্তা চেতনায় ছোটো ছোটো টিমে সংগঠিত করতে থাকেন। কেউ কেউ বিপ্লবী কাজকে পিছনে চালনা করতে চাইতেন। এদের (সংখ্যালঘু হওয়ায় মেনশেভিক বলা হতো) বিরুদ্ধে লেনিন এবং স্তালিন জীবনের শেষদিন পর্যন্ত অবিরাম সংগ্রাম করে সংখ্যাগরিষ্ঠ (বলশেভিক) মতবাদকে প্রতিষ্ঠিত করতে হয়েছিল। একনায়কতন্ত্রী জারের শ্যেন দৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়ে বিভিন্ন প্রদেশে অসংখ্য আইনি, বেআইনি পত্রপত্রিকা প্রকাশ করতে হয়েছে।

আমাদের দেশের মতো জাতিসমস্যা সারা রাশিয়ায় প্রকটভাবে ছিল। আন্দোলন চলাকালে স্তালিন বুঝলেন রাশিয়ায় জাতিসমস্যার সমাধান না করে শ্রমিক, কৃষককে সংগঠিত করা যাবে না। ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে দীর্ঘ ২০ বছর (এমনকি বিপ্লব সমাধার পরেও) যাবত সমগ্র পার্টিকে নিয়ে লেনিন ও স্তালিন এই সমস্যার নিরসন করেন।

১৯০১ সালের ২১ মার্চ থেকে ১৯১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের বিপ্লব পর্যন্ত দীর্ঘ ১৬ বছর স্তালিনকে আত্মগোপনে থেকেই বিপ্লব সংগঠিত করতে হয়। রাজনৈতিক দুঃখকষ্ট হাসি মুখে বরণ করে নিয়ে মহান নেতা স্তালিন, মার্কস-লেনিনের চিন্তাধারাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেন। দেশকে স্বৈরশাসকদের হাত থেকে মুক্ত করতে স্তালিনকে কখনও গ্রেপ্তারি, কখনও জেল- সেখান থেকে পলায়ন, কখনও নির্বাসনে কাটাতে হয়েছে। এদিকে জারের অত্যাচারে সাধারণ মানুষ নিষ্পেষিত, আর্থিক দুর্দশা, খাদ্য সংকট চরমে। শিল্প উৎপাদনের গতি শ্লথ। অনেক বুদ্ধিজীবী শিল্পী, সাহিত্যিক এই ঝড়ো হাওয়ার দিনগুলিতে হতবুদ্ধি হয়ে পড়লেন। সারা রাশিয়ার চোখের মণি লেনিন এবং স্তালিনের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় কমিটিতে সশস্ত্র সংগ্রামের সিদ্ধান্ত হলো (সেটা ১০ অক্টোবর, ১৯১৭ সাল)।ন্যস্ত দায়িত্ব পালনে বলশেভিক নেতৃত্ব দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ল। কেরেনস্কি সরকার ২৪ অক্টোবর (নতুন ক্যালেন্ডার হিসেবে ৬ নভেম্বর, ১৯১৭) দেশের মানুষের উপর প্রথম সশস্ত্র আক্রমণ শুরু করে। সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে শ্রমিক-কৃষকরাও অমিতবিক্রমে নিজেদের অধিকার বুঝে নিতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ওই বছরে ৭-১৭ নভেম্বর সারা দেশে তীব্র লড়াই হয়। এই লড়াই ‘দুনিয়া কাঁপানো দশদিন’ নামে খ্যাত - যাঁর নেতৃত্বে লেনিন এবং সুযোগ্য সহকারী স্তালিন।

১৯২৪ সালের ২৯ জানুয়ারি মাত্র ৫৪ বছর বয়সে মহামতি লেনিনের মৃত্যু ঘটে। সামনে তাঁর দীক্ষাগুরু নেই তাই অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার গুরুদায়িত্ব স্তালিন নিজের কাঁধে তুলে নিলেন। লেনিন নেই, এই সুযোগে পার্টির মধ্যেই কেউ কেউ অপ্রতিরোধ্য শ্রমিক, কৃষকদের দুর্জয়গতিকে রোধ করতে উঠে পড়ে লাগল। কিন্তু ওরা জানত না সমস্ত পার্টিকে সংঘবদ্ধ করে এই অনৈক্য সৃষ্টিকারীদের বানচাল করতে প্রাজ্ঞ লেনিন যোগ্য উত্তরাধিকার রেখে গেছেন - তিনি কমরেড স্তালিন। সমগ্র পার্টিতে লেনিনের পরেই স্তালিনের নেতৃত্ব যে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছিল তার যথার্থ প্রমাণ পাওয়া গেলো যখন একাদশ পার্টি কংগ্রেস স্তালিনকে সিপিএসইউ(বি) কেন্দ্রীয় কমিটি’র সাধারণ সম্পাদক নির্ধারিত করে।

নতুন মন্ত্রীসভা গঠিত হলো, প্রধানমন্ত্রী হলেন ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন। ওই বছরের ডিসেম্বর মাসে বলশেভিক পার্টির প্রধান কর্মকাণ্ড হয় লালফৌজ গড়ে তোলা। সামনে দেশগঠনে বিরাট কর্মযজ্ঞ। বলশেভিক পার্টি নেতৃত্বের সুযোগ্য পরিচালনায় দেশের অর্থনীতি অতি দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে লাগল। এই সময়েই ১৯২৪ সালের ২৯ জানুয়ারি মাত্র ৫৪ বছর বয়সে মহামতি লেনিনের মৃত্যু ঘটে। সামনে তাঁর দীক্ষাগুরু নেই তাই অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার গুরুদায়িত্ব স্তালিন নিজের কাঁধে তুলে নিলেন। লেনিন নেই, এই সুযোগে পার্টির মধ্যেই কেউ কেউ অপ্রতিরোধ্য শ্রমিক, কৃষকদের দুর্জয়গতিকে রোধ করতে উঠে পড়ে লাগল।

কিন্তু ওরা জানত না সমস্ত পার্টিকে সংঘবদ্ধ করে এই অনৈক্য সৃষ্টিকারীদের বানচাল করতে প্রাজ্ঞ লেনিন যোগ্য উত্তরাধিকার রেখে গেছেন- তিনি কমরেড স্তালিন। সমগ্র পার্টিতে লেনিনের পরেই স্তালিনের নেতৃত্ব যে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছিল তার যথার্থ প্রমাণ পাওয়া গেলো যখন একাদশ পার্টি কংগ্রেস স্তালিনকে সিপিএসইউ(বি) কেন্দ্রীয় কমিটি’র সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করে।

তখন মূলত পুঁজিবাদী দেশের প্রতিক্রিয়ার চক্রান্ত থেকে নবগঠিত সমাজতান্ত্রিক দেশ ও বিপ্লবী সাফল্যকে রক্ষা করার জন্য স্তালিনকে বাধ্য হয়ে কিছু কঠোর ব্যবস্থা নিতে হয়েছিল। এই সময়ে সরকারের ও পার্টির কাজ অনেকগুণ বেড়ে গেলো। রাশিয়ার বুকে সাম্রাজ্যবাদী জারের পতনের পর সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে ওঠায় ধনতান্ত্রিক দেশগুলির অস্বস্তি শুরু হলো। অতি দ্রুত সারা পৃথিবী দুটি শিবিরে বিভক্ত হয়ে যায়। ওদিকে জার্মানির হিটলার এবং ইতালির মুসোলিনি ফ্যাসিবাদ কায়েম করতে সচেষ্ট হলো। সোভিয়েত রাশিয়াতেও অন্তর্ঘাতমুলক কাজ ধরা পড়ে গেলো। স্তালিন ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রনায়ক হিটলারের সাথে কৌশলগত কারণে অনাক্রমণ চুক্তি করতে বাধ্য হলেন। সেই সুযোগে দূরদর্শী নেতা অনিবার্য যুদ্ধের জন্য নিজের পিতৃভূমিকে অভূতপূর্ব প্রস্তুত করতে লাগলেন। আসন্ন যুদ্ধ বিশ্ব ইতিহাসে ভয়াবহ রূপ নিতে চলেছে একথা বুঝে সিপিএসইউ(বি) স্তালিনকে রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী পদে বৃত করলেন। ১৯৪১ সালের ২২ জুন ভোরবেলায় সমস্ত অনাক্রমণ চুক্তি ছিঁড়ে ফেলে সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর হিটলার জল, স্থল এবং আকাশপথে একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়ল। পার্টির অনুপ্রেরণায় পিতৃভূমি বাঁচাতে অগ্রবর্তী বাহিনী লালফৌজের নেতৃত্বে সমগ্র সোভিয়েত ইউনিয়ন রুখে দাঁড়াল। সারা দেশে এমন একটি পরিবারও ছিল না যেখানকার কেউ না কেউ লালফৌজে নিজেকে অন্তর্ভুক্ত করেনি। সদ্যগঠিত সোভিয়েতকে ‘ছোটো’ করে দেখার ফলে হিটলারের ধারণা ছিল অচিরেই ওদের গুঁড়িয়ে দেওয়া যাবে। যদিও অতিদ্রুত এই ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো। কূটনীতি এবং সমরবিদ্যায় পারদর্শী স্তালিনের দূরদর্শিতায় যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী রূপ পেলো। ইতিমধ্যে, লাগাতার চেষ্টায় ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং আমেরিকা ১৯৪৪ সালের জুনে একজোট হয়। এই তিন দেশ সম্মিলিতভাবে ফ্যাসিস্ত শক্তিকে পরাস্ত করতে দ্বিতীয় ফ্রন্টে লড়াই শুরু করে। এই অবস্থায় হিটলার প্রমাদ গোনে, বাধ্য হয় তার সমস্ত সেনাবাহিনীকে একের পরিবর্তে দুই রণাঙ্গনে পাঠাতে। স্তালিন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন, বুঝলেন ফ্যাসিবাদের পরাজয় এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। অবশেষে, ৮ মে, ১৯৪৫ জার্মানির হাইকমান্ড লালফৌজের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। সিপিএসইউ-এর নেতৃত্বে রাশিয়াজুড়ে সাধারণ মানুষ বিজয় উৎসবে মেতে উঠল। শুধু রাশিয়াই বা কেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে খুব দ্রুত কমিউনিস্ট পার্টির প্রসার ঘটতে লাগল। এইসবই হতে থাকল কমরেড স্তালিনের সুপরামর্শে। এমনকি, আমাদের দেশেও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির তদানীন্তন নেতৃত্ব (এসএডাঙ্গে, সি রাজেশ্বর রাও, অজয় ঘোষ, বাসবপুন্নাইয়া প্রমুখ) ১৯৫০ সালে রাশিয়ায় যান এবং আমাদের পার্টির গতিপ্রকৃতি অবস্থান, সংগঠন, কংগ্রেস পার্টির ভূমিকা ইতাদি বিষয়ে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের অন্যতম পুরোধা কমরেড স্তালিনের সাথে সুদীর্ঘ আলোচনা করেন। ওই সময়ে বিভিন্ন দেশ পরাধীনতার নাগপাশ থেকে দ্রুত বেরিয়ে এলো।

একটা হিসাবে জানা যায়, ৫ বছর ধরে চলা এই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে শুধুমাত্র সোভিয়েত ইউনিয়নেই সৈন্যবাহিনী সহ ১ কোটি ৯০ লক্ষাধিক লোক মারা যায়। বিরাট ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে দিয়ে যুদ্ধ তো শেষ, এখন সেই ধ্বংসস্তুপের উপরে দেশ পুনর্গঠনের পালা। সেই স্তালিনের নেতৃত্বে স্বনির্ভরতার লক্ষ্যে প্রতেকেই স্ব স্ব দায়িত্ব পালনে এগিয়ে গেলেন।

অবশেষে এলো সেই দুর্যোগের দিন। ১৯৫৩ সালের ৫ মার্চ, ৭৩ বছর বয়সে ইস্পাতদৃঢ় জে ভি স্তালিন চলে যান। পিছনে রয়ে গেলো শুধু সোভিয়েত ইউনিয়নের জনগণ নয়, বিশ্বের সমগ্র শ্রমিকশ্রেণি যাঁরা আগামীদিনে এই প্রিয়নেতার স্বপ্নকে সার্থক করার লক্ষ্যে বিপ্লবী আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাবেন।।