E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ২৮ সংখ্যা / ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ / ১২ ফাল্গুন, ১৪২৮

আনিস হত্যার প্রতিবাদী মিছিলের অবিরাম ঢেউ রাজপথে


২১ ফেব্রুয়ারির ভাষা দিবসের বিকেলে আনিস খানের হত্যার প্রতিবাদে কলকাতার রাস্তায় মিছিল।

নিজস্ব প্রতিনিধিঃ আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা আনিস খানের হত্যার প্রতিবাদে ছাত্রছাত্রীদের মিছিলের অবিরাম ঢেউ প্রতিদিন রাজপথে সুনামির মতো আছড়ে পড়ে প্রতিস্পর্ধার নতুন ইতিহাস লিখছে কলকাতাসহ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে। প্রতিবাদের নয়া লব্জকে হাতিয়ার করে মুখ্যমন্ত্রীর পুলিশকে বিঁধে স্লোগান উঠছে, ‘আনিস খান কে মারলো কারা, মইদুল কে মারলো যারা! মইদুল কে মারলো কারা? সুদীপ্তকে মারল যারা! সুদীপ্ত কে মারল কারা? আনিস খান কে মারল যারা’। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বলি আনিস খানের বলা কথা, ‘পোস্টারে স্লোগান লেখার রঙ যদি কম পড়ে তবে আমার রক্তে লিখো স্লোগান!’ ফুটে উঠছে মিছিলের গান থেকে কবিতায়। স্পেনের প্রতিবাদের সুর বেলাচাও গানে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ঘৃণার অক্ষর বসিয়ে আরএসএস’র দুর্গা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিকে এবং তাঁর পোষা ‘দিদি মিডিয়া’ এবং প্রশাসনকে বলা হচ্ছে ‘ওয়াপস যাও, যাও, যাও’। আনিসের বাবার কাছে দাগী মিডিয়া ব্যবসায়ীর প্রলোভনের প্রস্তাবককে ব্যঙ্গ করে বলা হচ্ছে আমরা মিডিয়ার দালালি সহ্য করব না। রাজনীতির ঝান্ডাবিহীন মহামিছিলের তারুণ্য আর মেজাজের উত্তাপে রাজ্যের শাসকদলের মেকি দরদের মুখোশ খসে পড়ছে ধীরে ধীরে।

২১ ফেব্রুয়ারির ভাষা দিবসের বিকেলে কলকাতার রাস্তায় মিছিল করে হাজার হাজার ছাত্র-যুব-মহিলা এবং সহনাগরিকরা আনিস খানকে খুনের ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টার প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন। যে কলকাতার রাস্তায় এনআরসি, তৃণমূলের তোলাবাজি, আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে দুর্নীতি ইত্যাদির প্রতিবাদে বারে বারে স্লোগান তুলে হেঁটেছেন আনিস খান, সেই কলকাতা এদিন সোচ্চার হয়েছে তাঁরই হত্যাকারীদের শাস্তির দাবিতে। বহু প্রতিবাদী শিল্পী, বুদ্ধিজীবীও পা মিলিয়েছেন এই মিছিলে। আর রাস্তার দু’ধারের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে মিছিলকারীদের প্রতি সমর্থন করে বলেছেন, ‘বাড়িতে পুলিশ ঢুকিয়ে ছাত্রকে খুন করেছে, প্রতিবাদ তো হবেই।’ অধ্যাপক, চিকিৎসক, শিল্পী, ছাত্র-ছাত্রী বহু মানুষ চলতি মি‍‌ছিলে যোগ দিয়ে পা মেলালেন ধর্মতলা থেকে মহাজাতি সদন পর্যন্ত এই নাগরিক পদচারণায়।

মিছিলে হাঁটতে হাটতে অনেকেই বলেছেন তাঁদের উপলব্ধির কথা, জীবন দিয়ে আনিস প্রতিবাদের সাহস দাবানলের মতো ছড়িয়ে দিয়ে গিয়েছে। আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আনিসের সহপাঠীদের অনেকের চোখে জল চলে আসছিল তাঁর কথা বলতে গেলেই। শোক নিমেষেই ঘৃণা আর ক্ষোভে বদলে সেই চোখ থেকেই ঝরে পড়ছিল আগুন। সবার মুখে স্লোগান, ‘আনিস খানের খুনের বিচার চাই।’ আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম মুখ তারিকুল আনোয়ার বলেন, ‘আনিসের বাকি থাকা কাজ আমরা শেষ করবই।’ কেন তৃণমূল বিরোধীদের ভোট বেড়েছে তা নিয়ে হেনস্তার মুখে পড়তে হয়েছে, কেন ‍চিঠি দিয়ে নিরাপত্তা চেয়েও পাননি পুলিশের কাছে তাঁর জবাব চেয়ে বার বার ফুঁসে উঠেছে প্রতিবাদী স্লোগান মুখর মিছিল।

মিছিলে পিছনে হাঁটা বেনিয়াপুকুরের বাসিন্দা আক্রমের কথায়, ‘আনিস যেহেতু সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলেছিল তাই ওঁকে মেরে দেওয়া হলো। এই রাজ্যে যে সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলবে তাঁরই জীবনের আশঙ্কা তৈরি হয়।’ সত্যিই, শুধু আনিস না, এর আগে শাসকের বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য প্রাণ গিয়েছে সুদীপ্ত গুপ্ত, স্বপন কোলে, মইদুল ইসলাম মিদ্দা সহ এরকমই অনেক তরতাজা যুবকের। তালিকাটা দীর্ঘ। কিন্তু এখনও পর্যন্ত তাঁদের হত্যার কোনও ন্যায়বিচার হয়নি। মিছিল প্রশ্ন তুলেছে গঠিত সিটের প্রধানের নিরপেক্ষতা নিয়েও।

২১ ফেব্রুয়ারির মিছিলে অংশ নেন রাজ্যসভার সাংসদ বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, ‘আনিস একজন শিক্ষিত প্রতিবাদী মুখ ছিলেন। তাই তাঁকে পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয়েছে।’ বিশিষ্ট চিকিৎসক ফুয়াদ হালিম বলেন, ‘আনিস থ্যালাসেমিয়া রোগীদের রক্ত জোগাড় করার জন্য সব সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতেন। নিজের এলাকায় থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশুদের জন্য রক্তদান শিবির করতে গিয়ে তাঁকে তৃণমূলের রোষের মুখে পড়তে হয়েছিল। কিন্তু তাতেও তাঁকে থামানো যায়নি।’ মিছিলে হাঁটতে হাঁটতে অধ্যাপক শ্যামল চক্রবর্তী বলেন, ‘এমন নৃশংসভাবে কোনও ছাত্রের হত্যাকাণ্ড কেউ মেনে নিতে পারবেন না। প্রতিবাদ হবেই।’

মিছিলে এদিন উপস্থিত ছিলেন চিত্র পরিচালক অনীক দত্ত, অভিনেতা বাদশা মৈত্র, দেবদূত ঘোষ, ছাত্রনেতা ময়ূখ বিশ্বাস, দীপ্সিতা ধর, সৃজন ভট্টাচার্য, প্রতীক উর রহমান, গায়ক সৌমিক দাস, দিপালি ভট্টাচার্য, অম্বিকেশ মহাপাত্র প্রমুখ। মিছিল শেষে মহাজাতি সদনের সামনের সংক্ষিপ্ত সভায় বক্তব্য রাখেন বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্য, অনীক দত্ত, বাদশা মৈত্র, দীপ্সিতা ধর, সৃজন ভট্টাচার্য এবং সৌমিক দাস। প্রত্যেকেরই বক্তব্যে উঠে আসে প্রশাসনের ভূমিকার কড়া সমালোচনা। তারা দাবি করেন অবিলম্বে দোষীদের শাস্তি দিতে হবে, অন্যথায় আইনি পথের সঙ্গেই রাজপথে থেকে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। ‘স্টুডেন্টস এগেনস্ট ফ্যাসিজম’র ব্যানারে এই মিছিল হয়। এদিন ওই সভাস্থলে মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশ মন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি’র কুশপুতুল দাহ করেন এসএফআই কর্মীরা।

২২ ফেব্রুয়ারি আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আনিস খানের খুনের বিচার চাইতে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মহাকরণ অবধি মিছিলের ডাক দিয়েছিলেন পড়ুয়ারা। কলেজ স্ট্রিট মোড়ে সেই মিছিল আটকায় পুলিশ। চলে তাণ্ডব। আটক করা হয় ৫৯জন পড়ুয়াকে। যদিও পরবর্তীকালে তাঁদের প্রত্যেককে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হয় পুলিশ। গ্রেপ্তার হওয়া পড়ুয়াদের একজন রুশীয়।

আনিস খানের খুনের প্রতিবাদে ক্ষোভে ফুঁসছে গোটা আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। ডিপার্টমেন্ট ধরে ধরে, নিজেদের উদ্যোগে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ খুলে মঙ্গলবারের মিছিলের জমায়েত করেন সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা। তাঁদের দাবি ৭২ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও তাঁদের সহপাঠী আনিস খানের খুনিদের গ্রেপ্তার করতে পারেনি রাজ্য পুলিশ। সভ্য দেশে এটা মেনে নেওয়া যায় না। তাঁরা ঠিক করেন সংখ্যালঘু উন্নয়ন মন্ত্রকের সদর দপ্তর মহাকরণ অবধি প্রতিবাদ মিছিল হবে। তারপর মন্ত্রীকে দেওয়া হবে দাবিসনদ।

সেই মিছিল আটকাতে মরিয়া হয়ে ওঠে পুলিশ। এদিন সকাল থেকেই পুলিশ দিয়ে মিছিলের প্রস্তাবিত গোটা পথকে মুড়ে ফেলা হয়। ধাতব লোহার ব্যারিকেড সাজিয়ে ডোরিনা ক্রসিংকেও কার্যত দুর্গে পরিণত করে পুলিশ। আলিয়ার পড়ুয়ারা প্রথমেই পার্কসার্কাস সেভেন পয়েন্ট ক্রসিং ঘিরে ফেলে অবরুদ্ধ করে দেন। হাজারের কাছে পড়ুয়ার স্লোগানে উত্তাল হয়ে ওঠে পার্কসার্কাস। পার্কসার্কাস থেকে মিছিল এগিয়ে চলে মল্লিকবাজার হয়ে মৌলালির দিকে। পথে উড়ে যায় মল্লিকবাজারের ব্যারিকেড। স্লোগান ওঠে, ‘‘আমরা সবাই আনিস খান!’’

মৌলালি পৌঁছে মিছিল চলতে শুরু করে এনআরএস হাসপাতালের দিকে। তারপর শিয়ালদহ ব্রিজ পেরিয়ে মহাত্মা গান্ধী রোড এবং কলেজ স্ট্রিট মোড়ের দিকে এগোতে থাকে মিছিল। হাতে পায়ে ধরার মতো করে ছাত্র-ছাত্রীদের পিছনে ছুটতে দেখা যায় কলকাতা পুলিশের আধিকারিক থেকে সাধারণ কনস্টেবলদের।

আলিয়ার পড়ুয়াদের সংহতি জানিয়ে মিছিলে শামিল হন বামপন্থী গণসংগঠন আওয়াজ’র সদস্যরা। এছাড়াও কলকাতা, যাদবপুর এবং প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারাও সংহতি জানান। বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠনও প্রতিবাদ সংগঠিত করে। পুলিশি সন্ত্রাসের প্রতিবাদে এসএফআই’র উদ্যোগে প্রেসিডেন্সি এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ সংগঠিত হয়। মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশ মন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি’র কুশপুতুল দাহ করেন এসএফআই কর্মীরা। সেই কর্মসূচিতে এসএফআই রাজ্য সম্পাদক সৃজন ভট্টাচার্য এবং সর্বভারতীয় যুগ্ম সম্পাদক দীপ্সিতা ধর উপস্থিত ছিলেন।

তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতীদের হাতে আনিস খানের খুনের অভিযোগ এবং অপরাধীদের উপযুক্ত শাস্তির দাবিতে এদিন এসএফআই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় আঞ্চলিক কমিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ধর্মঘটের ডাক দেয়। সফল ছাত্র ধর্মঘট চলতে চলতে তৃণমূল সমর্থিত কর্মচারী ইউনিয়নের নেতা ও তার সহকর্মীরা বিদ্রূপাত্মক ভেঁপু বাজায় এবং কুরুচিকর মন্তব্য করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কার্যালয় অরবিন্দ ভবনের গাড়িবারান্দায় তখন ধর্মঘটী পড়ুয়ারা প্রতিবাদ করলে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। কর্মচারীরা বিনয় সিংয়ের নেতৃত্বে ঝান্ডার লাঠি নিয়ে পড়ুয়াদের উপর চড়াও হন। এই ঘটনায় চার ছাত্রী আহত হয়। রাতে ঘটনাটি নিয়ে যাদবপুর থানাতে এফআইআর করা হয়।