৫৯ বর্ষ ২৮ সংখ্যা / ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ / ১২ ফাল্গুন, ১৪২৮
ছাত্রনেতা আনিস খানের নৃশংস হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত পুলিশ
নিরাপত্তাহীনতা রাজ্যজুড়ে
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ ১৯ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে পরিবারের সদস্যদের সামনে বাড়িতে ঢুকে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা আনিস খানকে খুন করার পর প্রায় এক সপ্তাহ কেটে গেলেও ধরা পড়ল না ঘটনায় যুক্ত সব দুষ্কৃতী। অভিযোগ, আমতা থানার থেকে আসা উর্দি পরা পুলিশ কর্মীরাই যুক্ত ঘটনার সঙ্গে। আমতা থানা এলাকার গ্রাম সারদার দক্ষিণ খানপাড়ার বাসিন্দা ছিলেন অনিস খান। এদিন মারধর করে তিন তলা থেকে নিচে রাস্তায় ফেলে দেওয়া হয় আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ছাত্র নেতাকে। খুনের ঘটনায় এখনও পর্যন্ত গ্রেপ্তার ২ জন পুলিশ। তারা দুজনেই আমতা থানায় কর্মরত। ধৃতদের মধ্যে একজন প্রীতম ভট্টাচার্য, তিনি সিভিক ভলেন্টিয়ার। দ্বিতীয়জন কাশীনাথ বেরা, হোমগার্ড। ঘটনার প্রতিবাদে রাজ্যজুড়ে প্রবল ছাত্র-যুব বিক্ষোভ এবং প্রকৃত দোষীদের গ্রেপ্তারের দাবিতে উত্তাল আন্দোলনের মুখে দিশেহারা প্রশাসন আমতা থানার দু’জন পুলিশ কর্মীকে আপাতত গ্রেপ্তার করে অবস্থা সামাল দিতে চাইলেও সিবিআই বা উচ্চতর তদন্তের দাবি ক্রমশ জোরালো হচ্ছে। সিবিআই তদন্ত আরও যুক্তিসঙ্গত হয়ে উঠছে এই কারণে যে, ধৃতরা দাবি করেছে থানার ওসি’র নির্দেশেই তারা আনিসের বাড়ি গিয়েছিল। ঘটনার কিনারা করার জন্য রাজ্য সরকারের বিশেষ তদন্তকারী দল গঠনের পর ৭২ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও উন্মোচিত হলো না রহস্য। পুলিশের পোশাক পরে আসা ওই দুষ্কৃতীদের নৃশংস প্রাণঘাতী আক্রমণের ঘটনার অন্যতম সাক্ষী আনিসের বাবা সালেম খান সিবিআই তদন্তের দাবিতে অনড়। তিনি বলেছেন, শুধু গ্রেপ্তার নয়, বিচার শুরু হওয়ার পর অপরাধীরা যেদিন শাস্তি পাবে, আমি সেদিন খুব খুশি হবো। উল্লেখ্য, গত বছর মে মাসেই আলিয়ার এই ছাত্রনেতা আনিস খান আমতা থানায় লিখিতভাবেই তৃণমূলের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়ে বলেছিলেন, আমি ও আমার সমগ্র পরিবার ভীষণ নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে আছি এবং আশংকা প্রকাশ করছি, যে কোনদিন এরা আমাকে ও পরিবারকে প্রাণে মেরে ফেলতে পারে। তাঁর সেই আশঙ্কাই সত্যি হলো। এই ঘটনার পরেও মৃতের দাদা সাবিরকে টেলিফোনে পরিবারের সদস্যদের মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়েছে।
এই ঘটনার প্রেক্ষিতে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে সিপিআই(এম) সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি বলেন, একটা জঘন্য হত্যাকাণ্ডে মুখ্যমন্ত্রী কেন এত সাফাই গাইছেন? ...খুনিরা পুলিশকর্মী কিনা বলতে এত দেরি কেন? মুখ্যমন্ত্রী বলুন দোষীদের চিহ্নিত করে শাস্তি নিশ্চিত করতে তিনি কী কী করছেন?
ঘটনার প্রেক্ষিতে সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক সূর্য মিশ্র বলেছেন, রাজ্য সরকারের প্রধান দায়িত্ব অবিলম্বে খুঁজে বার করতে হবে হত্যাকারীদের। তারা তৃণমূল নাকি পুলিশ তা পরিষ্কার করে বলার দায়িত্ব সরকারের। আমাদের সন্দেহ আনিস গণ আন্দোলনে শামিল ছিলেন, আইএসএফ কর্মী ছিলেন, বিজেপি’র কালা আইনের প্রতিবাদ করেছিলেন বলে তাকে প্রাণ দিতে হলো এভাবে।
সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিম বলেছেন, প্রতিবাদের কণ্ঠস্বর স্তব্ধ করতে খুন করা হলো আনিস খানকে। পুলিশের উর্দি পড়ে যারা এসেছিল তারা তৃণমূলের গুন্ডা না পুলিশ বোঝা যাচ্ছে না। স্বাধীনতার পর ছাত্র আন্দোলনের কর্মী নেতার ওপর এরকম নৃশংস হত্যাকাণ্ড আর ঘটেনি।
এসএফআই রাজ্য সম্পাদক সৃজন ভট্টাচার্য বলেছেন, অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি চাই। আমরা আনিসের পরিবারের পাশে আছি।
যদিও মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি নিহত আনিস খানকে তার ‘ফেভারিট’ এবং তৃণমূল কর্মী বলে উল্লেখ করেছেন, নিহত ছাত্র নেতার পরিবারের সবাই মুখ্যমন্ত্রীর এই মিথ্যাচারের মুখোশ খুলে দিয়েছেন। পরিবারের বক্তব্য আনিস খান কলেজে পড়ার সময় যোগ দেন এসএফআই-তে। শাসকদলের হাতে একাধিকবার আক্রান্ত হয়েছেন তিনি। এসএফআই কুশবেড়িয়া ইউনিটের সদস্য হিসেবেও কাজ করতেন তিনি। ছাত্র-যুবদের নবান্ন অভিযান বা কৃষকদের রাজভবন অভিযানের মতো কর্মসূচিতে আনিস বরাবর ছিলেন সামনের সারিতে। মৃত ছাত্রের বাবা সালিম খান জানিয়েছেন, আনিস খান আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরত ছিলেন ইন্টিগ্রেটেড এমবিএ কোর্স-এ। বাগনান কলেজে পড়ার সময় এসএফআই’র সদস্য ও কর্মী ছিলেন তিনি। ছাত্র আন্দোলনে তখন থেকেই সক্রিয় আনিস আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আলিয়া বাঁচাও আন্দোলনের প্রথম সারির সংগঠকের ভূমিকা পালন করছিলেন। রাজ্য সরকারের শিক্ষানীতি মোতাবেক আলিয়া নিয়ে অবস্থানের বিরুদ্ধে সক্রিয় প্রতিবাদে তিনি ছিলেন অন্যতম মুখ। তিনি প্রতিষ্ঠানে অরাজকতা, বিশ্ববিদ্যালয়ের বরাদ্দ নয়ছয় সহ পরিকাঠামো উন্নয়নের দাবিতে আন্দোলনের অগ্রণী কর্মী ছিলেন। মোদি সরকারের সিএএ-এনআরসি বিরোধী আন্দোলনে ২০২০ সাল থেকে সক্রিয় আনিস থাকতেন কলকাতায়। পার্ক সার্কাসে সিএএ-এনআরসি বিরোধী জমায়েতের অন্যতম ছাত্র সংগঠক হিসেবে তিনি অত্যন্ত সক্রিয় ছিলেন।
কী হয়েছিল সেই রাতে? আনিস খানের পরিবার সহ গ্রামবাসীদের দেওয়া ঘটনার বিবরণে প্রকাশ, ১৯ ফেব্রুয়ারি রাত দেড়টা নাগাদ একজন পুলিশের পোশাক পরে এবং বাকি তিনজন সাধারণ পোশাক পরে আনিসের খোঁজে তাদের বাড়িতে আসে। বাইরে থেকে তারা জানায় আনিসের নামে অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট আছে। দরজা খুলে দিলে তারা কোনো ওয়ারেন্ট অবশ্য দেখাতে পারেনি। এরপর বাড়ির অন্যান্য সদস্যদের প্রশ্ন অগ্রাহ্য করে উপরতলায় গিয়ে ওই তিন জন আনিসের ওপর চড়াও হয়। তাকে মারধর করতে থাকে। এরপর তিন তলার ছাদে নিয়ে গিয়ে সেখান থেকে তারা তাকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দেয়। এরপরই ওই চারজন দ্রুত এলাকা ছেড়ে চলে যায়। বাড়ির সামনে প্রবল আওয়াজ হতেই আনিসের বাবা ও তার পরিবারের সদস্যরা বেরিয়ে দেখতে পান রক্তাক্ত অবস্থায় ২৮ বছরের আনিস রাস্তায় পড়ে আছে। অভিযোগ, পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও প্রশাসন সেদিন রাতে গ্রামে আসেনি। আসে পরেরদিন সকালে। দুপুরে মৃত আনিস খানকে নিয়ে হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে নিজেদের দায়িত্ব সারে আমতা থানার পুলিশ। গ্রামের মানুষজন তখন ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন যখন তারা শোনেন পুলিশ বলছে, আমতা থানা থেকে আগের দিন রাতে কেউ আসেনি আনিসের বাড়িতে। পুলিশ তার দেহ নিয়ে যেতে এলেও পুলিশকে ঘিরে ধরে বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন গ্রামবাসীরা। উত্তেজিত জনতাকে কোনোমতে সামলে আনিস খান-এর মৃতদেহ হাসপাতালে নিয়ে যায় পুলিশ। তাঁর বাবার অভিযোগ, থানায় পৌঁছালে তাঁরা জানতে পারেন আনিসের মৃতদেহ ময়নাতদন্তের জন্য উলুবেড়িয়ায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। ময়নাতদন্তের পর তার দেহ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে এলে কান্নায় ভেঙে পড়ে গোটা গ্রাম। তার পরিবারের সদস্যদের সমবেদনা জানান সিপিআই(এম) নেতা পরেশ পাল, সন্তোষ অধিকারীসহ নেতৃত্ব। ভাঙড়ের বিধায়ক আইএসএফ নেতা নৌশাদ সিদ্দিকী বলেন, পুলিশকে প্রশ্ন করলেও আমতা থানার বড়োবাবু জানিয়েছেন পুলিশের কেউ যায়নি। তাহলে প্রশ্ন, কারা গেছিল। এরপর পুলিশ রাতে বাড়ি চড়াও হলে কেউ তো ঢুকতে দেবেনা। আমরা এই ঘটনায় আদালতের দ্বারস্থ হব। শেষ দেখে ছাড়ব।
আনিস খানের হত্যার ঘটনার নিন্দা করে লোকসভার বিরোধী দলনেতা অধীর চৌধুরী এক বিবৃতিতে বলেছেন, ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করতে হবে। যে জঘন্য অপরাধ হয়েছে সেই অপরাধীদের চিহ্নিত করা হোক। তাদের খুঁজে বের করে উদাহরণযোগ্য শাস্তি দিতে হবে। অন্যদিকে আনিস খানের নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানিয়েছে সিপিআই(এম এল) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি।
দফায় দফায় প্রকৃত তদন্তের দাবিতে আমতা থানা ঘেরাও সহ কলকাতার রাজপথ জুড়ে চলছে ছাত্র-যুব-বুদ্ধিজীবী সহ সাধারণ মানুষের প্রতিবাদ মিছিল, বিক্ষোভ অবস্থান। আর রাতের অন্ধকারে রাজ্যের যে পুলিশ নিরীহ ছাত্র নেতার বাড়িতে চড়াও হয়ে তাঁকে খুন করেছে, তাঁরাই দিনের আলোয় গণতান্ত্রিক ছাত্র আন্দোলন ও বিক্ষোভ অবস্থানের অধিকার কেড়ে নিতে তৎপর হয়ে নিপীড়ন নামিয়ে আনছে আন্দোলনের অধিকারকে স্তব্ধ করতে।
বাংলার বুকে রাজনৈতিক হত্যার ইতিহাসে আনিস খানের হত্যার নৃশংস ও বর্বর এই ঘটনা কার্যত মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বে তৃণমূলী জমানার রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের অন্যতম নজির। আমতার ঘটনাকে শুধু শাসকদল বা প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি নিয়ন্ত্রিত পেশাদার খুনির কাজ বলে চালিয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। তাকে ছাড়িয়ে এখন পুলিশ কর্তৃক রাষ্ট্রীয় হত্যার গুরুতর অভিযোগ সামনে এসে গেছে। বিভিন্ন স্তর থেকে সিবিআই তদন্তের দাবি করা হলেও তাতেও কতটা কাজের কাজ হবে তা নিয়ে সন্দেহ আছে, উঠছে এ প্রশ্নও। ওয়াকিবহাল মহলের মতে, এ রাজ্যে একাধিক সিবিআই তদন্তের অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। তাই উত্তাল গণ আন্দোলনের পথেই থাকতে হবে। কারণ, পর্দার আড়ালে মোদির সঙ্গে কোনও বোঝাপড়ায় সব ধামাচাপা পড়ে যাবে কিনা কেউ জানে না। আবার বিচার বিভাগীয় তদন্তও দীর্ঘ সময়সাপেক্ষ।