E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ২৮ সংখ্যা / ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ / ১২ ফাল্গুন, ১৪২৮

পার্টির স্বাধীন শক্তির বিকাশ ঘটিয়ে বাম ঐক্যকে শক্তিশালী করতে হবে, প্রসারিত করতে হবে বাম গণতান্ত্রিক শক্তিকে

সিপিআই(এম) পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা সম্মেলনের আহ্বান

সন্দীপ দে


বর্ণময় অনুষ্ঠানে পশ্চিম মেদিনীপুরের সম্মেলনে পতাকা উত্তোলন।

নীতি আদর্শের ‍‌ভিত্তিতে পার্টিকে শক্তিশালী করতে হবে। পার্টির স্বাধীন শক্তির বিকাশ ঘটিয়ে বাম ঐক্যকে আরও শক্তিশালী করে বাম গণতান্ত্রিক শক্তিকে প্রসারিত করতে হবে। সিপিআই(এম) পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা ২৪তম সম্মেলন থেকে এই আহ্বান জানানো হয়েছে। ১৬ ও ১৭ ফেব্রুয়ারি ডেবরায় এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলন উপলক্ষে ডেবরার নামকরণ করা হয় কমরেড সেখ ইসরাইল নগর। এছাড়া সম্মেলন মঞ্চ সুকান্ত স্মৃতি সদন নামাঙ্কিত হয় কমরেড অনিল পাত্র, কমরেড শোভানাথ বসু, কমরেড হরেকৃষ্ণ জানা এবং কমরেড তুষারকান্তি পঞ্চানন প্রমুখ প্রয়াত নেতৃবৃন্দের স্মৃতিতে।

এই সম্মেলন আগামীদিনের আন্দোলন-সংগ্রামের লক্ষ্যে উদারনীতি এবং কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের জনস্বার্থ বিরোধী আর্থিক নীতির বিরুদ্ধে; কৃষি সহ রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পদ, শিক্ষা-স্বাস্থ্য পরিষেবা ইত্যাদি দেশি-বিদেশি বৃহৎ পুঁজির হাতে তুলে দেওয়ার বিরুদ্ধে জনগণকে সংগঠিত করে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলার ডাক দিয়েছে। এছাড়াও সম্মেলন আহ্বান জানিয়েছে, কেন্দ্রের বিজেপি সরকার যেভাবে দেশের সংবিধান, ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও প্রতিষ্ঠানগুলির উপর আক্রমণ করছে এবং এরাজ্যের তৃণমূল কংগ্রেস সরকার গণতন্ত্রের উপর আক্রমণের পাশাপাশি হিংসা-সন্ত্রাস চালাচ্ছে এবং এই সরকার ও শাসকদলের ব্যাপক দুর্নীতি ও স্বজনপোষণের বিরুদ্ধে আন্দোলনকে তীব্র করতে হবে। একই সঙ্গে আশু ও আদায়যোগ্য দাবিতে আন্দোলন সংগঠিত করার পাশাপাশি সিপিআই(এম) এবং বামপন্থীদের বিকল্প নীতিগুলি তুলে ধরার ডাক দিয়েছে এ‍‌ই সম্মেলন।

নতুন নেতৃত্ব

সিপিআই(এম) পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা ২৪তম সম্মেলন থেকে জেলায় আগামীদিনে মানুষের স্বার্থে আন্দোলন-সংগ্রাম পরিচালনা এবং পার্টিকে ঐক্যবদ্ধ ও প্রসারিত করার লক্ষে ৬৫ জনের নতুন জেলা কমিটি সর্বসম্মতিক্রমে নির্বাচিত হয়েছে। নবনির্বাচিত জেলা কমিটির প্রথম বৈঠকে জেলা কমিটির নতুন সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন সুশান্ত ঘোষ। জেলা কমিটিতে ৪ জন বি‍‌শেষ আমন্ত্রিত সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন বিদায়ী জেলা কমিটির সম্পাদক তরুণ রায়, সুভাষ দে, গুরুপদ দত্ত এবং অমলেশ বোস।

সম্মেলনের প্রতিনিধি

এই সম্মেলনে ৩৪৭ জন প্রতিনিধি এবং ৩০ জন দর্শক উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন ১৯ জন শ্রমিক, ৩৮ জন খেতমজুর, ১৪৫ জন গরিব কৃষক, ৬৪ জন মাঝারি কৃষক। এছাড়া সম্প্রদায় ও বিভিন্ন জন অংশের প্রতিনিধিত্বকারী ৩৭ জন মুসলিম, তফশিলি জাতি ৪৯, তফশিলি উপজাতি ২১ এবং অন্যান্য পিছিয়ে পড়া অংশের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ৩৪ জন। সবচেয়ে প্রবীণ প্রতিনিধি হিসে‍বে উপস্থিত ছিলেন কালীদাস নায়েক, তাঁর বয়স ৮৫। তিনি ২৪টির মধ্যে ২৩টি সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। সম্মেলনে সবচেয়ে কম বয়সের প্রতিনিধি ছিলেন সৌভিক পাঁজা এবং সোমেন চক্রবর্তী। তাদের বয়স ২৩ বছর।

উপস্থিত প্রতিনিধিদের মধ্যে ১৩৪ জনের নামে মামলা রয়েছে। সবচেয়ে বেশি মামলা রয়েছে বিদ্যুৎ রায়ের বিরুদ্ধে, ৩৩টি। সবচেয়ে বেশি জেল জীবন তপন ঘোষের, ২ বছর ১ মাস। সবচেয়ে বেশি ৪ বার জেল খেটেছেন নি‌য়ামত হোসেন। এছাড়া সবচেয়ে বেশি ৭ বার আত্মগোপনে থেকেছেন রতন হাজরা।

সম্মেলন মঞ্চ থেকে পার্টির আসন্ন রাজ্য সম্মেলন (১৫-১৭ মার্চ, ২০২২)-এর জন্য ২০ জন প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন।

গৃহীত প্রস্তাব

পার্টির পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা ২৪তম সম্মেলন থেকে মোট ১৬টি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। এই প্রস্তাবগুলি হলো - সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলন তীব্র করো; নয়া উদারনীতির বিরুদ্ধে জীবন-জীবিকা রক্ষার সংগ্রাম গড়ে তোলো; আসন্ন পৌরসভা নির্বাচনে তৃণমূল-বিজেপি’র বিরুদ্ধে বাম ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক প্রার্থীদের জয়ী করো; ২৮-২৯ মার্চ দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট সফল করো - জনগণকে বাঁচাও-দেশ বাঁচাও; নারী অধিকার রক্ষা ও নারী নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করো; গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে ধারাবাহিক আন্দোলন গড়ে তোলো; অস্বাভাবিক ট্রেন ভাড়া বৃদ্ধির বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলো; রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পদ বিক্রির বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলন গড়ে তোলো; কেন্দ্র-রাজ্য সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যাপক জনমত গড়ে তোলো; সামাজিক বৈষম্য ও নিপীড়ন বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলো; কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের কৃষি ও কৃষক বিরোধী নীতি গ্রহণের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলো; বর্তমান সময়ে শ্রমিক শ্রেণির অধিকার সমূহের উপর আক্রমণের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক তীব্র আক্রমণ গড়ে তোলো; সামাজিক বৈষম্য ও নিপীড়ন বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলো; আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলো। এছাড়াও ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান (সেচ নিকাশি ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ) প্রকল্প ও ঘাটাল মহকুমায় রেল লাইন দ্রুত রূপায়ণের (পাঁশকুড়া থেকে চন্দ্রকোণা রোড ভায়া ঘাটাল রেল লাইন স্থাপন) দাবিতে এবং নতুন জাতীয় শিক্ষা নীতি ২০২০ বাতিলের দাবিতে প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে।

বর্ণাঢ্য উদ্বোধন

সিপিআই(এম) পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা সম্মেলনের সূচনা হয় বর্ণময় কর্মসূচির মধ্য দিয়ে। ১৬ ফেব্রুয়ারি সম্মেলন শুরুর আগে ডেবরা হরিমতি হাই স্কুলের মাঠ থেকে সম্মেলন স্থল সুকান্ত স্মৃতি সদন পর্যন্ত লাল পতাকা, ব্যানার সহ সুসজ্জিত মিছিল আসে। মিছিলে ব্যাপক অংশের সুসজ্জিত আদিবাসী মহিলা ও পুরুষের অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো। এই মিছিলে অংশ নেন পার্টির রাজ্য সম্পাদক সূর্য মিশ্র, পলিট ব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিম, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য রবীন দেব সহ অনাদি সাহু, দীপক দাশগুপ্ত, তরুণ রায়, কনীনিকা ঘোষ, মধুজা সেনরায়, পুলিনবিহারী বাস্কে, তাপস সিনহা, প্রতিকুর রহমান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

দীর্ঘ তিন কিলোমিটার এই বর্ণাঢ্য মিছিল সম্মেলন স্থলে আসার পর সংলগ্ন মাঠে সম্মেলনের রক্ত পতাকা উত্তোলন করেন প্রবীণ পার্টিনেতা দীপক সরকার। এখানে শহিদবেদিতে মাল্যদানের পর প্রতিনিধি সম্মেলনের কাজ শুরু হয়।

সম্মেলন পরিচালনা করেন সুভাষ দে, রামেশ্বর দলুই, সুশান্ত ঘোষ, গীতা হাঁসদা ও ভাস্কর দত্তকে নিয়ে গঠিত সভাপতিমণ্ডলী।

সম্মেলন উদ্বোধন

পার্টির পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা সম্মেলন উদ্বোধন করে মহম্মদ সেলিম দে‍‌শের স্বাধীনতা আন্দোলনে অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, দেশের স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তি হচ্ছে। কেন্দ্রের বিজেপি সরকার বলছে ৫ আগস্ট নাকি প্রকৃত স্বাধীনতা দিবস। এই দিনে ওরা কাশ্মীরের জন্য সংবিধান প্রদত্ত ৩৭০ ধারার যে বিশেষ অধিকার ছিল তা হরণ করেছে। স্বাধীনতা আন্দোলনে ওদের কোনো অবদানই ছিল না। ওরা স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে। এখন ‘পরাক্রম দিবস’ নামে প্রজাতন্ত্র দিবসকে অস্বীকার করছে। সংবিধান যে মানুষের মৌলিক অধিকার দিয়েছে তা হরণ করে নিচ্ছে। তিনি বলেন, আমরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনের দিকে এগোতে চাই আর মৌলবাদীরা চায় পুরনো ইতিহাসের যুগে ফিরিয়ে দিতে। প্রতিক্রিয়ারশক্তি সব সময় চায় অতীতের দিকে নিয়ে যেতে। আমরা কমিউনিস্টরা চাই সামনের দিকে চলতে। তাই আমাদের দৃষ্টিকে আরও প্রসারিত করতে হবে। আমরা গণতান্ত্রিক বিপ্লবের শপথ নিয়েছি। তাই রাজনীতি, সমাজনীতি, ইতিহাস, বিজ্ঞান সমস্ত কিছু থেকে জ্ঞান অর্জন করতে চাই। আমাদের একদিকে পঠনপাঠন অন্যদিকে আন্দোলন-সংগ্রাম থেকে শিক্ষা নিয়ে এগনোর পথ তৈরি করতে হয়।

তিনি পার্টির কলকাতা প্লেনামের আহ্বানের কথা তুলে ধরে বলেন, পার্টি বলছে, গণলাইন সম্পন্ন বিপ্লবী পার্টি গড়ে তুলতে হবে। তাই মানুষের কাছে আমাদের যেতে হবে। তাঁদের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু নীতি-আদর্শের প্রশ্নে আমাদের এতটুকু আপস করলে চলবে না। সামন্তবাদী ভাবনা আমাদের মজ্জার মধ্যে থাকলে তা ত্যাগ করতে হবে। সমালোচনা-আত্মসমালোচনার মধ্য দিয়ে আমাদের সম্মিলিত ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়ে পার্টিকে ত্রুটিমুক্ত ও শক্তিশালী করতে হবে।

তিনি বর্তমান জটিল পরিস্থিতি ও কেন্দ্রের জনবিরোধী কার্যকলাপের উদাহরণ দিয়ে বলেন, এরা জনকল্যাণের সমস্ত উদ্যোগকে স্তব্ধ করে দিচ্ছে। মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা-অধিকার-দাবিকে নস্যাৎ করছে। আরএসএস সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের মোড়কে ধর্মের নামে দেশ পরিচালনা করতে চাইছে। মানুষে মানুষে বিভেদ তৈরি করছে। আমরা বলি বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য, মিশ্র সংস্কৃতি, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো, ধর্মনিরপেক্ষতা - বিজেপি সরকার এ‍‌ই সমস্ত কিছুর ওপর আঘাত করছে। ‘হিজাব’ নিয়ে নতুন করে বিতর্ক তৈরি করতে চাইছে। কিন্তু শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বেকারি, খাদ্য সংকট ইত্যাদি নিয়ে এদের কোনো বক্তব্য নেই। অথচ দেশের মানুষ দেখেছেন কৃষি ও কৃষি বিরোধী বিল, বিদ্যুৎ বিল, শ্রম কোড আনা হয়েছে। গঙ্গা দিয়ে লাশের মিছিল যেতে দেখেছেন দে‍‌শের মানুষ। তাই আজকের দিনের চাহিদা অনুযায়ী আমাদের আন্দোলনের অভিমুখ স্থির করতে হবে।

পরিশেষে তিনি বলেন, আজকের দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় পাটিকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি বাম শক্তিকেও সংহত করতে হবে। এবং আমাদের পরিবৃত্তের বাইরে বৃহত্তর অংশের মানুষকে এক জায়গায় সমবেত করতে হবে। বিজেপি-তৃণমূলকে পরাস্ত করতে পারে - সেই সমস্ত শক্তিকে একজোট করা জরুরি। এই ঐক্যের জন্য সংগ্রাম ও সংগ্রামের জন্য ঐক্য প্রয়োজন। আমাদের সমস্ত শ্রেণিমিত্রের কাছে যেতে হবে। তাদের সংগঠিত করতে হবে। এই কাজটা কঠিন, কিন্তু এই কঠিন কাজটাই কমিউনিস্টদের করে যেতে হবে।

প্রতিবেদন উত্থাপন

সম্মেলনে রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক খসড়া প্রতিবেদন উত্থাপন করেন বিদায়ী জেলা সম্পাদক তরুণ রায়। তিনি বিগত সময়কালে জেলার রাজনৈতিক পরিস্থিতি, সাংগঠনিক অবস্থা, বিভিন্ন নির্বাচনী সংগ্রাম, মানুষের দাবি-দাওয়া ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় লড়াই-আন্দোলন এবং আগামী দিনের দায়িত্ব কর্তব্য ইত্যাদি বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। তিনি বলেন, সমস্ত প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে বঞ্চিত-শোষিত মানুষের পাশে থেকে আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী ও তীব্র করতে হবে। আরও বেশি বেশি মানুষকে আমাদের লড়াই-আন্দোলনে শামিল করতে হবে। নীতি-আদর্শের ভিত্তিতে পার্টিকে ত্রুটিমুক্ত ও শক্তিশালী করে লড়াই-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জেলায় কমিউনিস্ট আন্দোলনের ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার করতে হবে। পার্টি প্লেনামের নির্দেশ অনুযায়ী গণ-লাইনকে কার্যকর করতে কাজের ধারার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। পার্টির শক্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি বাম ঐক্যকে প্রসারিত করে গণ-আন্দোলনের বিকাশে সর্বতোভাবে উদ্যোগ নেবার আহ্বান জানান তিনি।

প্রতিনিধিদের আলোচনা

খসড়া প্রতিবেদনের ওপর ৫৪টি এরিয়া কমিটি ও বিভিন্ন ফ্রন্টের মোট ৬৯ জন প্রতিনিধি আলোচনায় অংশ নেন। সমস্ত প্রতিনিধির আলোচনায় বর্তমানের উদ্ভূত সমস্যা, প্রতিবন্ধকতা ও প্রতিক্রিয়ার শক্তির আক্রমণের মোকাবিলা করে এগিয়ে যাবার প্রত্যয় ব্যক্ত হয়েছে। এই লক্ষ্যে পার্টিকে নীতি-আদর্শে দৃঢ় শক্তিশালী করার অঙ্গীকার করেছেন তাঁরা। প্রতিনিধিদের কথায় উঠে এসেছে ২০১১ সালে তৃণমূল রাজ্যের ক্ষমতায় আসার পর থেকে কীভাবে সন্ত্রাস-আক্রমণ নেমে এসেছে পার্টির ওপর এবং বিগত ২০০৮-০৯ সাল থেকেই তৃণমূল-মাওবাদীদের আক্রমণে শহিদ হয়েছেন পার্টিকর্মীরা। অসংখ্য পার্টিকর্মী-সমর্থকের নামে মিথ্যা মামলা এবং পার্টির অনেক নেতা-কর্মীকে হাজতবাস করতে হয়েছে। তবুও পার্টির তৎপরতাকে স্তব্ধ করা যায়নি। প্রতিনিধিদের অনেকেই উল্লেখ করেছেন, তৃণমূলের অত্যাচার-সন্ত্রাস এবং সীমাহীন দুর্নীতি ইত্যাদি নানা কারণে ক্ষুব্ধ মানুষ কিছুটা বিভ্রান্ত হয়েই বিজেপি’র দিকে ঝুঁকেছিল। তাঁদের অনেকেই আজ বাস্তব পরিস্থিতি উপলব্ধি করে পার্টিতে ফিরে আসছেন।

প্রায় সমস্ত এরিয়া কমিটি এবং গণফ্রন্টের প্রতিনিধির আলোচনায় গুরুত্বের সাথে উঠে এসেছে শাসকদলের সন্ত্রাস এবং নির্বাচনী বিপর্যয় হয়েছে, তবুও কোভিড মহামারীর ভয়াবহ সংক্রমণের মধ্যে পার্টি ও গণ-সংগঠনের কর্মীরা নিজের জীবন বিপন্ন করে দুর্গত ও আক্রান্ত মানুষদের পাশে সাধ্যমতো দাঁড়িয়েছেন। জেলায় বিভিন্ন স্থানে রেড ভলান্টিয়ার তৈরি করে অসংখ্য তরুণ কর্মী অসহায়, অসুস্থ, আক্রান্ত মানুষদের জন্য দিনরাত পরিশ্রম করেছেন। দুঃস্থ, অসহায় মানুষ, বিশেষ করে ভিনরাজ্য থেকে আসা পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করেছেন। এই লক্ষ্যে বিভিন্ন জায়গায় শ্রমজীবী ক্যান্টিন, শ্রমজীবী বাজার, ভ্রাম্যমান মেডিকেল চেক-আপ ভ্যান, রক্তদান শিবির, এলাকায় এলাকায় স্যানিটাইজেশনের উদ্যোগ নিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

প্রতিনিধিরা বলেছেন, এই সময়কালের মধ্যে খাদ্য ও কাজের দাবিতে, খেতমজুরদের মজুরির দাবিতে, কৃষকদের ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের দাবিতে এবং কেন্দ্রের কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে মিছিল, সমাবেশ, অবস্থান-বিক্ষোভ সংগঠিত হয়েছে। পঞ্চায়েতে দুর্নীতি, মহিলাদের ওপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে, রেগার মজুরি সহ স্থানীয় নানা দাবিতে পঞ্চায়েত ও ব্লক স্তরে অবস্থান-বিক্ষোভ ও ডেপুটেশনের কর্মসূচি সংগঠিত হয়েছে। তাঁরা বলেছেন, এসবের মধ্য দিয়ে অনেক নতুন নতুন কর্মী পার্টির কাছাকাছি এসেছেন। বেশকিছু জায়গায় পরিযায়ী শ্রমিকদের সংগঠিত করা সম্ভব হয়েছে।

প্রতিনিধিরা আলোচনায় দাবি তুলেছেন, অবিলম্বে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান ও রূপনারায়ণ নদ সংস্কার, পাঁশকুড়া থেকে চন্দ্রকোণা রোড ভায়া ঘাটাল রেলপথ স্থাপন সহ জেলায় শিল্প ও পরিকাঠামো উন্নয়ন করতে হবে। এই দাবিগুলি নিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলার কথা বলেন তাঁরা। জেলায় বিরাট অংশের অসংগঠিত শ্রমিকদের সংগঠিত করা এবং আদিবাসী ও তফশিলি মানুষ, যাঁরা দূরে সরে গেছেন, তাঁদের কাছে যাওয়া জরুরি। এই সমস্ত অংশের মানুষকে সংগঠিত করে জেলায় শ্রেণি আন্দোলন, গণ-আন্দোলনের ঐতিহ্যকে পুনঃস্থাপনের কথা গুরুত্বের সাথে তুলে ধরেন প্রতিনিধিরা।

জবাবি ভাষণ

প্রতিনিধিদের আলোচনা শেষে জবাবি ভাষণে বিদায়ী জেলা সম্পাদক তরুণ রায় বলেছেন, অনেক ত্যাগ, আত্মদান ও লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে প্রতিকূল অবস্থাকে অতিক্রম করে পার্টিকে অগ্রসর হতে হয়েছে। আমাদের সামনে নানা প্রতিবন্ধকতা, সন্ত্রাসের পাশাপাশি কোভিড পরিস্থিতির ভয়ঙ্কর অবস্থার মধ্যে রাস্তা বার করে আমাদের চলতে হয়েছে। আমাদের চলার পথে অনেক সময়ই শত্রুর আক্রমণের বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হয়েছে। এই প্রতিরোধ-আন্দোলনে অনেক জায়গাতেই মহিলারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছেন। তাঁদের আরও বেশি সংখ্যায় পার্টিতে নিয়ে আসতে হবে। তিনি আসন্ন পৌর নির্বাচনী সংগ্রামে পার্টিকর্মীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, পার্টিকে ত্রুটিমুক্ত, শক্তিশালী এবং আরও ঐক্যবদ্ধ করে সাধারণ মানুষের অধিকার ও দাবি আদায়ের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বর্তমান প্রতিকূল অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে হবে।

নেতৃবৃন্দের বক্তব্য

সন্মেলনে পার্টির রাজ্য সম্পাদক সূর্য মিশ্র তাঁর অভিনন্দনসূচক বক্তব্যে বলেন, আমাদের পার্টির স্বাধীন শক্তিকে বাড়াতে হবে এবং বাম ঐক্যকে সংহত করতে হবে। আমাদের শত্রুরা চাইছে সর্ববৃহৎ কমিউনিস্ট পার্টি হিসাবে সিপিআই(এম)-কে একঘরে করে দিতে। তাই আমাদের রাজনীতি, মতাদর্শ, সংগঠন ও সংগ্রামের ভিত্তিতে পার্টিকে সুদৃঢ় ও বিকশিত করতে হবে। আমাদের মতাদর্শ মার্কসবাদ। লেনিন বলেছেন, এটা বৈজ্ঞানিক ও বৈপ্লবিক। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের এই মতাদর্শ নির্দিষ্ট দেশে সুনির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে প্রয়োগ করতে হয়। একটা বিকাশমান বিজ্ঞান হিসেবে মার্কসবাদকে বিচার করতে হবে।

তি‍নি বলেন, আমাদের উপর বহুমাত্রিক আক্রমণ সংগঠিত হচ্ছে। তাই বিরাট চ্যালেঞ্জ আমাদের সামনে। এই চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবিলার জন্য আমাদের কর্তব্যগুলি সঠিকভাবে সম্পাদন করতে হবে। তৃণমূল এবং বিজেপি - এই দুই বৃহৎ শক্তির বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই করতে হচ্ছে। পাশাপাশি বাম বিকল্পের জন্য সংগ্রাম চালাতে হচ্ছে। এজন্য কয়েকটি প্রস্তাব পাশ করলেই চলবে না। আশু ও আদায়যোগ্য দাবিতে ধারাবাহিকভাবে আন্দোলন সংগঠিত করতে হবে। জনশিক্ষা, জনস্বাস্থ্য অথবা স্বসহায়ক গোষ্ঠীগুলোর কী হবে? মাইক্রোফিনান্স কোম্পানিগুলো কীভাবে গ্রামে গ্রামে সর্বনাশ করছে - এসব নিয়ে স্থানীয় স্তরে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। তিনি দিল্লির কৃষক আন্দোলনের উদাহরণ দিয়ে বলেন, এক বছর ধরে লাগাতার অবস্থানের মধ্য দিয়ে যদি কৃষকরা সরকারকে কৃষি বিরোধী বিল প্রত্যাহারে বাধ্য করাতে পারে তবে এখানে কেন পঞ্চায়েত বা ব্লক স্তরে লাগাতার অবস্থান করে দাবি আদায় করা যাবে না?

সূর্য মিশ্র আসন্ন পৌর নির্বাচনী সংগ্রামে পার্টি কর্মীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের আহ্বান জানিয়ে বলেন, আমাদের বিকল্পের জন্য লড়াই এবং তৃণমূল-বিজেপি বিরোধী লড়াইকে একসূত্রে গ্রথিত করতে হবে। মানুষই ইতিহাস তৈরি করে। তাই মানুষের উপর আমাদের নির্ভর করতে হবে। মানুষের কাছ থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। পার্টির কলকাতা প্লেনামের অবস্থান অনুযায়ী গণবিপ্লবী পার্টি গড়ার উদ্যোগে সচেষ্ট থাকতে হবে।

পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য রবীন দেব তাঁর বক্তব্যে স্বাধীনতা আন্দোলনে অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার গৌরবোজ্জল ভূমিকার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, এখানেই তাম্রলিপ্ত সরকার প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। আন্দামান সেলুলার জেলে যারা দ্বীপান্তরী ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম কমরেড সুকুমার সেনগুপ্ত, কমরেড ভূপাল পান্ডা। তখন সেলুলার জেলে যে ৩৬৭ জন বন্দি ছিলেন তাঁদের মধ্যে ৩৩০ জনই ছিলেন বাংলার। আন্দামান জেল থেকে মুক্ত হয়ে সুকুমার সেনগুপ্ত, কামাক্ষা ঘোষ, গণেশ ঘোষ, সুধাংশু দাশগুপ্ত, সুবোধ রায় প্রমুখ কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। এই ধারাই আমরা বহন করে চলেছি। এখন উত্তর-সত্যের নামে ইতিহাসের বিকৃতি ঘটানো হচ্ছে।

তিনি বলেন, ৩৪ বছর বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে ২,৮০৬ জন কমরেড শহিদ হয়েছেন। আর ২০১১ সালে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর শহিদ হয়েছেন ২২৯ জন। ২০০৮ সাল থেকে ২০১১ সালের মধ্যে শুধু কেশপুরেই ৮৬ জন কমরেড খুন হয়েছেন। এই প্রেতিকৃলতাকে অতিক্রম করেই আপনারা এই সন্মেলনে উপস্থিত হয়েছেন। তিনি বিভিন্ন তথ্য-পরিসংখ্যান দি‍য়ে বলেন, বর্তমানের এই সমস্ত প্রতিকূলতার মধ্যেও আমাদের কিছুটা সফল্য এসেছে। আমাদের ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত মিলছে। এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণের জন্য আমাদের সাহস নিয়ে এগোতে হবে। আমাদের পার্টির নিজস্ব শক্তির বিকাশ ঘটাতে হবে। সেই সঙ্গে ফ্যাসিস্টধর্মী বিজেপি’র বিরুদ্ধে এবং গণতন্ত্রবিরোধী তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বাম ও গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকেও সমবেত করতে হবে। শান্তিপুর বিধান সভার উপনির্বাচন থেকে সাম্প্রতিক কর্পোরেশন নির্বাচনে আমাদের প্রতি মানুষের যে সমর্থন বৃদ্ধি পেয়েছে, আগামী পৌর নির্বাচনেও সেই সাফল্যকে বৃদ্ধির জন্য পার্টি কর্মীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের আহ্বান জানান তিনি।

পরিশেষে তিনি ব‍‌লেন, আগামী ২৮ ও ২৯ মার্চ সর্বভারতীয় ধর্মঘটকে সফল করতে সর্বতোভাবে উদ্যোগী ভূমিকা নিতে হবে। আমাদের বিকল্প প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যে বিকল্প দেখিয়েছে কেরালা। যে প্রতিকূলতাই আসুক না কেন লালঝান্ডা উড্ডীন রেখেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।

সম্মেলনের সমাপ্তি লগ্নে পার্টির নবনির্বাচিত সম্পাদক সুশান্ত ঘোষ বলেছেন, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় শত্রুর বুকে কাঁপন ধরানো আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমাদের ঘুরে দাঁড়াতেই হবে। জেলায় আগামী পৌর নির্বাচনের লড়াইয়ে আমাদের সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। আগামী ২৮-২৯ মার্চ সাধারণ ধর্মঘটকে সফল করতে সর্বতোভাবে প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হবে আমাদের।