E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ২৮ সংখ্যা / ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ / ১২ ফাল্গুন, ১৪২৮

দেউচা-পাঁচামী পদযাত্রীর ডায়েরি

একের পর এক সশস্ত্র অবরোধ ঠেলে পথ হাঁটা

ঋদ্ধি রিত


শান্তিনিকেতনে পদযাত্রীরা।

রবি ঠাকুরের পুরাতন ভৃত্য কবিতার প্রথম দুটো লাইন দিয়ে লেখাটা শুরু করার ইচ্ছে হচ্ছে। “ভূতের মতন চেহারা যেমন, নির্বোধ অতি ঘোর। যা কিছু হারায় গিন্নি বলেন, ‘কেষ্টা বেটাই চোর।’” কেন লিখলাম তা লেখার শেষে পাঠক নিশ্চই বুঝতে পারবেন।

দেউচা-পাঁচামীর খোলামুখ কয়লাখনির বিরোধিতা করে ‘‘বিদ্বেষের রাজনীতি বিরোধী জনমঞ্চ’’-এর ডাকে ১৫ ফেব্রুয়ারি কলকাতার রানুচ্ছায়া মঞ্চের সামনে থেকে হাঁটা শুরু করে ১৬ ফেব্রুয়ারি হাওড়া, ১৭ তারিখ হুগলি হয়ে আমরা পৌঁছোলাম পূর্ববর্ধমান। ১৮ফেব্রুয়ারি সকালে বর্ধমানের কার্জন গেট থেকে শুরু হয় হাঁটা। রোজই বেড়েছে মানুষের ভিড়। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থেকে মানুষ লিফলেট নিয়ে পকেটে পুরে ফেলছেন না। তাঁরা পড়ছেন, এসে কথা বলছেন আমাদের সাথে, জানতে চাইছেন। ওই দিন দুপুরে পশ্চিম বর্ধমানের পানাগড়ের মিছিলে মানুষের ভিড় ছিল দেখার মতোই। তখনও পর্যন্ত স্থায়ী পদযাত্রীর সংখ্যা ২২জন। কিন্তু আমাদের বক্তব্যের সাথে সহমত হয়ে আমাদের মিছিলে তখন প্রায় আড়াই হাজার মানুষ (বেশিও হতে পারে)। মিছিল শেষ হলো দার্জিলিং মোড়ে। সেখানে মানুষের সাথে কথা বলার জন্য একটা মঞ্চ বানিয়েছিলেন স্থানীয় এলাকার তিনটি সাংস্কৃতিক গণসংগঠন (আদিবাসী লোক শিল্পী সংঘ, পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘ এবং ভারতীয় গণনাট্য সংঘ)। মঞ্চে বসে লক্ষ করছিলাম সেই মিছিল কতদূর বিস্তৃত। মানুষ আমাদের সাথেই তখন গলা মিলিয়ে আওয়াজ তুলেছে পরিবেশের ওপর আক্রমণ নামিয়ে কোনো কয়লাখনি করা চলবে না।

১৮ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় আমরা পৌঁছোলাম শান্তিনিকেতন। বাস থেকে নামার সময় চোখ ঝলসানো ক্যামেরার ফ্ল্যাশ। পরপর ছবি উঠছে আমাদের সবার। বকুলতলা মোড়ে স্থানীয় কিছু মানুষ আমাদের সমর্থনে একটা ছোটো পথসভার আয়োজন করেছিল। সেখানকার শিল্পীরা গান গাইছিলেন। সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন বীরভূমের বামপন্থী নেতৃত্বও। কিন্তু আমরা বাস থেকে নামতেই দেখলাম কয়েকজন পুলিশ এসে মাইক ও চেয়ার বাজেয়াপ্ত করে এবং উপস্থিত হওয়া বীরভূম জেলার সিপিআই(এম)’র সম্পাদক, ডিওয়াইএফআই’র জেলা সম্পাদক সহ তিনজনকে তারা আটক করে। মাইক ছাড়াই চলে নির্ধারিত কর্মসূচি। আমাদের পক্ষে জয়রাজ ভট্টাচার্য ও শঙ্কর মৈত্র আমাদের কথা তুলে ধরেন এলাকার মানুষের কাছে। বোলপুরে পা রাখতেই বোঝা গেল, রবি ঠাকুরের শান্তিনিকেতন এখন অশান্তির মূল নিকেতন। অবশ্য তা আমাদের কাছে খানিকটা যেন প্রত্যাশিত।

আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল রতন পল্লির শান্তিনিকেতন লজে। লজে যাবার রাস্তায় চোখে পড়লো রাস্তার মোড়ে মোড়ে ভিডিয়ো করা হচ্ছে আমাদের। কয়েকজন বাইকেও আমাদের ফলো করছে ও ভিডিয়ো করছে। এটা খুবই অদ্ভুত এক ঘটনা। তবে টোটোতে করে রতন পল্লি যাবার সময় একজন বাইকে বলে গেলেন, ‘সবাই এখানে দলদাস’। মাকু হাঁসদা কলকাতায় এসে রানুচ্ছায়া মঞ্চে দাঁড়িয়ে যেভাবে বীরভূম পুলিশের নৃশংসতার কথা তুলে ধরেছেন, আমরা পৌঁছে সেই পরিস্থিতির সম্মুখীন হলাম। এতে স্পষ্ট হয়েছে তাদের দলদাসত্ব। লজে পৌঁছানোর আধ ঘণ্টার মধ্যে আমাদের থিয়েটারের আরও কিছু কমরেড আমাদের সাথে যোগদান করে বাকি রাস্তা একসাথে হাঁটবে ও মোড়ে মোড়ে পথ নাটক ‘লে ধড়াদ্ধর’ করবে বলে।

পৌঁছানোর দিন সন্ধ্যায় ও পরের দিন ভোরে চা খেতে যাবার সময়ও খেয়াল করেছি আমাদের লজের বাইরে কিছু মুখ। আমাদের ওপর যেন নজরদারি চলছে। আমরা একটা স্বাধীন দেশের নাগরিক তা বোঝা মুশকিল। পরদিন সকালে বকুলতলা মোড় থেকেই শুরু হয় আমাদের পদযাত্রা। শ্রীনিকেতন পর্যন্ত হাঁটার সময়ও একই, রাস্তার দুধারে মোবাইলে ভিডিয়ো চলছে। শ্রীনিকেতনে পদযাত্রা শেষ হলে ওখান থেকে বাস ধরি। বাসেই সিউড়ি পৌঁছানোর কথা। কিন্তু বাস ছাড়ার পাঁচ মিনিটের মধ্যে তা থেমে যায়। খবর আসে, আমাদের যাবার সমস্ত রাস্তা বন্ধ করা হয়েছে। তিনটে রাস্তায় তৃণমূলের ইন্ধনে সাতটা সশস্ত্র অবরোধ। আমাদের যেতে দেওয়া হবে না। নেতৃত্বের নির্দেশে আমাদের ফিরতে হলো আগের দিনের লজে। লজে ফেরার সময়ও আমাদের প্রায় এসকর্ট (Escort) করে পৌঁছে দেয় আমাদের ওপরে নজরদারি বাহিনী। তখন থেকেই আমাদের থেকে আলাদা জয়রাজ দা আর শঙ্কর দা।

লজে ফিরে এলে আমাদের কাছে খবর আসে তাড়াতাড়ি পোশাক বদলে, দুপুরের খাবার খেয়ে রেডি হয়ে থাকবার। কিন্তু আমাদের সবার ব্যাগ ও নাটকের মালপত্র যে গাড়িতে ছিল তা তখনও এসে পৌঁছাতে পারেনি। আরও আধ ঘণ্টা বাদে তা আসে। আমরা তখনও ভাবছি কীভাবে আমরা ওখানকার মানুষের কাছে পৌঁছাব। কীভাবে তাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই চালাব। কারণ, কলকাতা এসে দেউচার ছাত্র অশোক বলে গেছে, যদি লড়তে হয় তাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়েই যেন লড়াই করি। তাঁর মৃত্যুর পর মালা হাতে যেন তাঁর কাছে না পৌঁছানো হয়। এরমধ্যে শ্রাবন্তী, সমীরণদা আর আমার ফোনে তাড়াতাড়ি স্টেশন পৌঁছনোর ইনস্ট্রাকশন আসে। সেইমতো খেয়ে আমরা তৈরি হচ্ছি, আচমকা একদল লোক ঢুকে আসে আমাদের লজে। হঠাৎ চেঁচামেচি শুনে ঘরের বাইরে বেরোতেই দেখি প্রায় জনা তিরিশ লোক ঢুকে পড়েছে। সামনের উঠোনের পিটুনিয়া ফুলের টবগুলো আছাড় মারতে থাকে, শুরু করে ভাঙচুর । যারা ফুলের গাছ নষ্ট করে তারা কখনো মানুষ নয়। কারণ তাদের মান বা হুঁশ কোনোটাই নেই।

বাবু দাস (নাম পরে সংবাদ মাধ্যম সূত্রে জানা) নামক এক তৃণমূল নেতার নেতৃত্বে উন্মত্ত বাহিনী চড়াও হয় আমাদের ওপর। শুরু করে অকথ্য গালিগালাজ। তারা জানায় দেউচা-পাঁচামী যেতে দেবেনা, নাটক করতে দেবেনা। নাটকের প্রপ নষ্ট করে। আমাদের পদযাত্রী তোজো, রাজর্ষি, সন্দীপন, পৃথ্বীশ, রোহিতদের গায়ে হাত তোলে। তারপর সশস্ত্র এক দুষ্কৃতী এসে আমাকে অকথ্য গালিগালাজ শুরু করে। আমাদের সাথে পাঁচজন মহিলা কমরেড ছিলেন। তাঁদের রেপ থ্রেট দিতে শুরু করে। এলোপাতাড়ি লাঠি চালাতে দেখে, কী করব বুঝতে পারছিলাম না। তখন সম্বল লেনিনের ‘এক পা আগে আর দু পা পিছে’। আমার দায়িত্ব এই সমস্ত কমরেডকে এই অবস্থা থেকে বের করে স্টেশন পৌঁছানো। বেরোনোর সময়ও চলে মারধর। আমাদের সিনেমাটোগ্রাফার অমিতকে লাথি মারা হয়। কোনোরকমে লাগেজটা নিয়ে লাঠিগুলো পাশ কাটিয়ে বাইরে বেরিয়ে বাকিদের জন্য অপেক্ষা করছি, তখনও দু’একজন বেরোয়নি বলে শৌনক দেখতে গেলে আবার ধাক্কা দেয় ওকে। আমরা তবুও অপেক্ষা করি বাইরে বেরিয়ে। বাকিরা ফিরলে আমরা স্টেশনের টোটো ধরলে সেই একই নজরদারি। ফারহিনের বয়স অনেকটাই কম, লক্ষ করছিলাম ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিল সে। তবে তানিয়া তাকে সামলে নিয়ে ট্রেনে ওঠে। ট্রেনে ওঠার পর শ্রেয়সীদি আর শান্তনু খেয়াল করে দু-তিনজন লোক আমাদের ফলো করছে। সম্ভবত বর্ধমান অবধি ওদের লোক ট্রেনে ফলো করে। ঠান্ডা চোরাস্রোতের মতো একটা ভয় আমি সেদিন আমাদের অনেকের মধ্যে দেখেছি।

আর বাকি পাঠকদের বলব, ‘‘এখনো ভয় না পেলে ভয় পান। ভয় পেলে সবাই একজোট হয়ে যান, একজোট হয়ে গেলে আর ভয় পাবেন না।’’ শেষে এটাও বলে রাখি কেষ্ট মণ্ডলের পোষা গুন্ডারা আমাদের থামাতে পারবে না। আনিসকে খুন করলে আরও লাখ লাখ আনিস খান জেগে আছে, থাকবেই। সংকল্প আরও দৃঢ় হচ্ছে। তীব্র হচ্ছে দেউচা-পাঁচামীর কয়লাখনি বিরোধী স্বর। আসলে ওরাই আমাদের ভয় পায়, সত্যকে ভয় পায়, তাই আমাদের ভয় দেখাতে চায়। অনুব্রত শান্তিনিকেতনে বসে বাধা দিলে আমাদের সাথে আছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। যিনি শান্তিনিকেতনে বসেই লিখেছিলেন,
‘‘বাধা দিলে বাধবে লড়াই, মরতে হবে
    পথ জুড়ে কী করবি বড়াই, সরতে হবে॥
লুঠ-করা ধন ক’রে জড়ো    কে হতে চাস সবার বড়ো -
    এক নিমেষে পথের ধুলায় পড়তে হবে।"