৫৯ বর্ষ ২৮ সংখ্যা / ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ / ১২ ফাল্গুন, ১৪২৮
সিপিআই(এম) অসম রাজ্য সম্মেলনে বাম-গণতান্ত্রিক-ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকে সংহত এবং দৃঢ় করার আহ্বান
কমলেশ গুপ্ত
অসম রাজ্য ২৩তম সম্মেলনে বক্তব্য রাখছেন মানিক সরকার।
অসমে বিজেপি সরকারের জনবিরোধী নীতি, সাম্প্রদায়িকতা এবং স্বৈরতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে বাম-গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির ঐক্য আরও অধিক সংহত, সম্প্রসারিত এবং দৃঢ় করার সংকল্প গ্রহণ করেছে অসমের বরাক উপত্যকার শিলচর শহরে অনুষ্ঠিত সিপিআই(এম)-র অসম রাজ্য ২৩তম সম্মেলন। প্রচণ্ড উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে ১৫ ফেব্রুয়ারি শুরু হয়ে তিনদিনের সম্মেলন ১৭ ফেব্রুয়ারি সফল সমাপ্তি হয়। সম্মেলনে বিভিন্ন জেলা থেকে ৩১৩ জন নির্বাচিত প্রতিনিধি এবং দর্শক প্রতিনিধি ছাড়াও পার্র্টির কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষে তিনজন পলিট ব্যুরো সদস্য - ত্রিপুরার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার, প্রাক্তন সাংসদ বৃন্দা কারাত এবং নীলোৎপল বসু উপস্থিত ছিলেন।
১৫ ফেব্রুয়ারি নুরুল হুদা নগরে সম্মেলনের কর্মসূচি শুরু হয় পার্টির রক্তপতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে। রাজ্যের বয়োঃজ্যেষ্ঠ কমিউনিস্ট নেতা হেমেন দাস পতাকা উত্তোলন করেন। শহিদবেদিতে মাল্যদান করেন পলিট ব্যুরো সদস্য বৃন্দা কারাত, নীলোৎপল বসু সহ রাজ্যের নেতৃবৃন্দ। শহরের প্রসিদ্ধ ‘রাজীব ভবন’কে কেন্দ্র করে সুসজ্জিত সম্মেলন স্থল নুরুল হুদা নগর এবং দীপক ভট্টাচার্য মঞ্চ নামাঙ্কিত করে উপত্যকার সর্বজনশ্রদ্ধেয় দুই প্রয়াত কমিউনিস্ট নেতার প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা হয়। সম্মেলন আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন মানিক সরকার। তিনি তাঁর উদ্বোধনী ভাষণে বলেন, বিজেপি’কে ক্ষমতা থেকে হটাতে দেশে বাম ও গণতান্ত্রিক জোটকে শক্তিশালী করতে হবে। তিনি বলেন, দেশে হাওয়া বদলাচ্ছে, বিজেপি’র ওপর মানুষের মোহ ভাঙছে, তা মোদি-শাহ টের পাচ্ছেন। বিভিন্ন রাজ্যের নির্বাচনে এর প্রতিফলন ঘটছে। বিজেপি থেকে মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন, কিন্তু এর বিকল্প কী? মানুষের সামনে দ্রুত বিকল্প তুলে না ধরলে বিজেপি ছেড়ে আরও একটি জনবিরোধী শক্তি তাদের টেনে নেবে। তাই বাম-গণতান্ত্রিক বিকল্পকে মানুষের সামনে তুলে ধরতে হবে। দেশের সর্ববৃহৎ বামপন্থী দল সিপিআই(এম)-কে এই বিকল্প জোট গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, শুধু নির্বাচনের ছয় মাস আগে জোট গড়লে এই জোটের প্রতি মানুষের আস্থা অর্জন করা সম্ভব নয়। বরং জাতীয় ইস্যু থেকে শুরু করে স্থানীয় সমস্যা নিয়ে ঐক্যবদ্ধ লড়াই আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। তিনি সাম্প্রতিক কৃষক আন্দোলনের দৃষ্টান্ত তুলে ধরে বলেন, ঐক্যবদ্ধ ও জেদি কৃষক আন্দোলনের কাছে মাথা নোয়াতে বাধ্য হয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। এই ঐক্য এখন রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ঘটানো প্রয়োজন।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বৃন্দা কারাত, নীলোৎপল বসু। রাজ্যের সিপিআই(এম) বিধায়ক মনোরঞ্জন তালুকদার, পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুপ্রকাশ তালুকদার প্রমুখ নেতৃবৃন্দ ভাষণ দেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন রাজ্য কমিটির সদস্য তথা কাছাড় জেলার অন্যতম নেতা রেজামন্দ আলি বরভূঞা। উপস্থিত ছিলেন সিপিআই, সিপিআই (এম এল) এবং কংগ্রেস দলের প্রতিনিধিরা।
প্রতিনিধি সম্মেলন পরিচালনা করেন হেমেন দাস, উদ্ধব বর্মণ, পূর্ণ বড়ো, সত্যবতী ভূঞা, রেজামন্দ আলি বরভূঞা এবং অমিয় কুমার সন্দিকৈকে নিয়ে গঠিত সভাপতিমণ্ডলী। রাজ্য কমিটির সম্পাদক দেবেন ভট্টাচার্যের অসুস্থতার জন্য রাজ্য কমিটির পক্ষে রাজনৈতিক প্রস্তাব এবং সাংগঠনিক প্রতিবেদন উত্থাপন করেন সুপ্রকাশ তালুকদার। প্রতিবেদনের ওপর মোট ৬১জন প্রতিনিধি আলোচনায় অংশগ্রহণ করে একে সমৃদ্ধ করেন। রাজনৈতিক প্রস্তাব এবং সাংগঠনিক প্রতিবেদন সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। রাজনৈতিক প্রস্তাবে বলা হয়েছে, কেন্দ্রে বিজেপি’র আটবছর এবং রাজ্যে ছয় বছরের শাসনকালে সাম্প্রদায়িক-কর্পোরেটের অশুভ জোট সংহত হয়েছে। দেশের সংবিধান বিপন্ন হয়েছে, গণতন্ত্র বিরোধী স্বৈরতান্ত্রিক এবং রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত প্রতিশোধপরায়ণ বিজেপি-কে জনবিচ্ছিন্ন এবং পরাজিত করাই হচ্ছে এই সময়ের মূল কাজ। এই লক্ষ্য পূরণ করার জন্য সিপিআই (এম) এবং বামপন্থীদের স্বতন্ত্র শক্তি বৃদ্ধি করতে হবে, যাতে জনসাধারণকে শক্তিশালী জঙ্গি রূপে গণসংগ্রাম এবং শ্রেণিসংগ্রামে জড়িত করা যায়। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সকল ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকে সমবেত করতে ব্যাপক মঞ্চ গড়ে তোলা জরুরি কর্তব্য। পার্টির স্বতন্ত্র শক্তির বিকাশ এবং বাম ঐক্য শক্তিশালী করার কাজকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। অসমের বাস্তব আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে একটি বিকল্প নীতি প্রস্তুত করে তার ভিত্তিতে ধারাবাহিক গণসমাবেশ ও গণআন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
সম্মেলনে রাজ্য সরকারের স্বৈরতান্ত্রিক শাসন, সাম্প্রদায়িক কর্মকাণ্ড, রাজ্যের কৃষকের ক্রমবর্ধমান সমস্যা তথা নির্মম কৃষক উচ্ছেদ, কর্মসংস্থানহীনতা, শ্রমিক-কর্মচারী এবং মহিলাদের সমস্যা, নারী নির্যাতন, মূল্যবৃদ্ধি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বন্যা ও নদী ভাঙনের সমস্যা, শিল্পায়ন, ছয় জনগোষ্ঠীকে তফশিলিভুক্ত করা প্রভৃতি সমস্যাগুলোকে কেন্দ্র করে মোট ১৮টি প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়েছে।
এই ২৩তম রাজ্য সম্মেলনের সাফল্য কামনা করে এবং শুভেচ্ছা জানিয়ে অভিনন্দনবার্তা প্রেরণ করেন সিপিআই দলের রাজ্য পরিষদের সম্পাদক মুনিন মহন্ত, সিপিআই(এম এল) দলের রাজ্য সম্পাদক রুবুল শর্মা। এই দলগুলো কেন্দ্র এবং রাজ্যে বিজেপি শাসনকালে জনসাধারণের জীবন-জীবিকার ওপর আক্রমণ চলার সাথে স্বৈরতন্ত্র এবং সাম্প্রদায়িকতার বিপদ ভয়ঙ্কর রূপ গ্রহণ করেছে বলে মতপ্রকাশ করেছেন। রাজ্য সরকারের উদ্যোগে গণতন্ত্র নিধনযজ্ঞ এবং সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে বলে এই দলগুলো মত পোষণ করে এবং এর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে।
অভ্যর্থনা সমিতির উদ্যোগে ১৬ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত হয় এক মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে আইপিটিএ শিলচর শাখা পরিবেশিত নৃত্যগীত ছাড়াও বিশেষ আকর্ষণ ছিল গণশিল্পী শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদারের সঙ্গীত পরিবেশন। সহস্রাধিক মানুষের উপস্থিতিতে এই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এক অনন্য মাত্রা লাভ করে।
পরবর্তী তিন বছরের জন্য সম্মেলন থেকে সুপ্রকাশ তালুকদারকে সম্পাদক হিসাবে নিয়ে ৫০ জনের নতুন রাজ্য কমিটি গঠিত হয়। নির্মল গগৈকে সভাপতি হিসাবে নিয়ে তিন সদস্যের ‘কন্ট্রোল কমিশন’ সর্বসম্মতিক্রমে নির্বাচিত হয়। নব-নির্বাচিত রাজ্য কমিটি ১৪ সদস্যকে নিয়ে সম্পাদকমণ্ডলী নির্বাচিত করে। সর্বভারতীয় পার্টি কংগ্রেসের জন্য ১৬ জন প্রতিনিধি এবং দর্শক প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়।
সম্মেলন সফল করতে বরাক উপত্যকার বিশেষভাবে কাছাড় জেলা এবং শিলচরের পার্টি সভ্য-সমর্থক এবং সর্বস্তরের গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ জনসাধারণের সহযোগিতা ছিল অতি উৎসাহজনক। অভ্যর্থনা সমিতি এবং স্বেচ্ছাসেবকদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে সম্মেলন আশাতীতভাবে সফল হয়। উল্লেখ্য, ৩৩ বছর পর এবার বরাক উপত্যকায় পার্টির রাজ্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে।