৫৯ বর্ষ ২৮ সংখ্যা / ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ / ১২ ফাল্গুন, ১৪২৮
উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনে স্পষ্ট হচ্ছে মানুষের মনোভাব
যোগী অপশাসন থেকে মুক্তি চাইছেন মানুষ
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ মেহঙ্গাই, বিজলি, পানি, দাওয়াই ইত্যাদি বিষয়গুলি যেমন উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনে আমজনতার অন্যতম দাবি হয়ে উঠেছে, তেমনি সাংবিধানিক অধিকার, গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নেওয়া থেকে শুরু করে সিএএ বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের উপর যোগী পুলিশের বর্বরোচিত হামলা, নির্বিচারে জরিমানা আদায় এবং বিরোধী কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করতে জেলে ঢোকানো ইত্যাদির বিরুদ্ধেও প্রতিবাদের স্বর তীব্র হয়ে উঠেছে। এছাড়াও কট্টর হিন্দুত্ববাদীদের জোর জুলুমে বিভিন্ন কাবাবের দোকান-রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দেওয়া, অ্যান্টি রোমিও বাহিনীর হামলা ও চোখ রাঙানি, লাভ-জিহাদের নামে পারস্পরিক সম্মতিতে বিয়ে করা ভিন ধর্মের প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে-মেয়েদের ওপর শারীরিক আক্রমণ-খুন এবং একের পর এক গণধর্ষণের ঘটনাগুলি উত্তরপ্রদেশের জনজীবনে তীব্র অভিঘাত তৈরি করেছে। এছাড়া এনকাউন্টারের নামে পুলিশের জঘন্য হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও রাজ্যের সাধারণ মানুষকে আতঙ্কিত করেছে। এবারের নির্বাচনের মাধ্যমে উত্তরপ্রদেশের মানুষ চাইছেন যোগী আদিত্যনাথ পরিচালিত বিজেপি সরকারের এই সমস্ত অপকীর্তি ও অপশাসন থেকে মুক্তি পেতে।
যোগী প্রশাসনের সমস্ত ক্ষেত্রে ব্যর্থতার সঙ্গে এই সমস্ত অপকীর্তি ও অপশাসনের ফলে বিজেপি’র জনসমর্থন যে ক্রমশ কমেছে এবং রাজ্যের প্রায় সর্বত্রই সাধারণ মানুষ তাদের অবস্থান পরিবর্তন করে অখিলেশ যাদবের নেতৃত্বাধীন সমাজবাদী পার্টি সহ বিরোধী দলগুলোর প্রতি সমর্থন জানাচ্ছেন তাতে শঙ্কিত বিজেপি। তাই তাঁরা উগ্র সাম্প্রদায়িকতা ও বিভাজনের পথকেই আঁকড়ে ধরে পরিত্রাণের পথ খুঁজছে। প্রধানমন্ত্রী মোদি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ থেকে শুরু করে মুখ্যমন্ত্রী যোগী এবং তাঁর সহচররা নির্বাচনের প্রচারে কট্টর হিন্দুত্ববাদী প্রচারকেই অবলম্বন করে বিজেপি’র ভরাডুবি সামাল দিতে তৎপর হয়ে উঠেছেন।
এই হিন্দুত্ববাদী প্রচার ছাড়া যোগী সরকারের প্রচারের মূল বিষয় হয়ে উঠেছিল ‘অপরাধী’দের নিকেশ করা। আইন-শৃঙ্খলার দোহাই দিয়ে ক্রমাগত এই কাজ করে গেছে যোগী সরকার। যোগী সরকার ক্ষমতায় আসার পর কয়েক মাসের মধ্যেই রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলার পরিস্থিতির গুরুতর অবনতি হয়। প্রবল সমালোচনার মুখে এনকাউন্টারকেই সমাধান হিসেবে নির্দিষ্ট করে নেয় যোগী প্রশাসন। এখন নির্বাচনের মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রায় প্রতিটি সভাতেই উত্তরপ্রদেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির গুণকীর্তন করে ঘুরিয়ে যোগীর এই হিংস্র অসাংবিধানিক কাজকেই অনুমোদন দিয়েছেন।
প্রসঙ্গত, সরকারে আসার পর এক বৈদ্যুতিন চ্যানেলে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে যোগী আদিত্যনাথ উদ্ধত ভঙ্গিতে বলেছিলেন, কেউ অপরাধ করলে তাকে ‘ঠোক দিয়ে জায়েঙ্গে’ (অর্থাৎ এনকাউন্টারে খতম করে দেওয়া হবে)। বিচারের কোনো প্রশ্ন নেই। এর এক বছরের মধ্যেই যোগীর পুলিশ ৪৩২টি এনকাউন্টার করে। সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী উত্তরপ্রদেশ পুলিশের গুলি চালনার ৮,৪৭২টি ঘটনা ঘটেছে। এই ঘটনায় ১৪৬জন ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে এবং ৩,৩০২জন বুলেটবিদ্ধ হয়েছে।
পরবর্তীতে যোগী আরও একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, উত্তরপ্রদেশের পুলিশ এবার থেকে বুলেটের জবাব বুলেটেই দেবে। আগের সরকারের মতো নয়। আমি পুলিশবাহিনীকে সম্পূর্ণ অধিকার দিয়ে দিয়েছি অপরাধীদের মোকাবিলার জন্য সব থেকে যথাযথ পথ নিতে। এরপর বিধানসভাতেও এনকাউন্টার চালিয়ে যাবার পক্ষে সওয়াল করেছিলেন তিনি। অথচ ঘটনা হলো ২০১৭ সাল থেকে অন্তত চারবার মানবাধিকার কমিশন বিচার বর্হিভূত হত্যা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে উত্তরপ্রদেশের পুলিশের বিরুদ্ধে ভুয়ো সংঘর্ষের হত্যার অভিযোগগুলি সম্পর্কে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন স্বতঃপ্রণোদিত মামলা গ্রহণ করে।
বিজেপি’র উগ্র সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের প্রচারে রাজ্যজুড়ে তৈরি হয়েছে ভয়ের পরিবেশ। যোগী-অমিত শাহ’রা নির্বাচনী প্রচারে অপরাধ দমনের কথা তুলে ধরে অপরাধীদের নাম নেবার সময় সংখ্যালঘু অংশের কারো না কারো নাম উল্লেখ করে বুঝিয়ে দিচ্ছেন তাঁরা ঠিক কী বলতে চাইছেন। মোদি-অমিত-যোগীর উগ্র সাম্প্রদায়িক প্রচারের পর হিন্দু যুব বাহিনীর নেতা ও প্রাক্তন বিজেপি বিধায়ক রাঘবেন্দ্র যাদব মুসলিম বিদ্বেষী প্রচারকে তীব্র করে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, ‘আমি যদি ফের নির্বাচিত হই মুসলিমদের ফেজ টুপি খুলিয়ে তিলক কাটাতে বাধ্য করব।’ এই রাঘবেন্দ্র সিং মুখ্যমন্ত্রী যোগীর ঘনিষ্ঠ নেতা বলে পরিচিত।
মৈনপুরীর জনসভায় যোগী আদিত্যনাথও প্রচ্ছন্ন হুমকির সুরে বলেছেন, ‘বুলডোজার এখন বিশ্রাম নিচ্ছে। যন্ত্রেরও মাঝে মাঝে বিশ্রামের দরকার হয়। নির্বাচন শেষ হলেই আবার বুলডোজার বেরোবে। সাড়ে চার বছর ধরে তারা লুকিয়ে ছিল, তারা এখন হামাগুড়ি দিয়ে বেরুচ্ছে। তারা চিহ্নিত হয়েছে। আবার বুলডোজারের মুখে পড়বে তারা।’ এছাড়াও যোগীর কণ্ঠে শোনা গেছে ‘গর্মি’র কথা। ভোটের পর ‘গর্মি’ কমিয়ে দেওয়া হবে। লক্ষ্য বিরোধীরা।
সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ, হুমকি-শাসানির পাশাপাশি ভোটবৈতরণী পার হতে যোগীবাহিনী তুলে আনছেন রামমন্দিরের প্রসঙ্গ। ৭ দফার নির্বাচন যত এগিয়েছে রাম মন্দিরের ইস্যু ততো জোরালো করা হচ্ছে। সম্প্রতি একটি নির্বাচনী জনসভায় যোগী বলেছেন, ২০২৩ সালে অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণ শেষ হবে। ওই মন্দির হবে ‘ভারতের রাষ্ট্র মন্দির’। আর আইন শৃঙ্খলার পরিস্থিতি কত ভালো তা বোঝাতে গিয়ে কুম্ভমেলার প্রসঙ্গ তুলে ধরে বলেছেন, কুম্ভে বিশাল মেলা হয়েছে, অযোধ্যায় দোল উৎসব হয়েছে, মথুরায় রঙ্গোৎসব হয়েছে। অথচ অতি সম্প্রতি রাজ্যের চারটি প্রান্তে চাঞ্চল্যকর খুন, ধর্ষণের পর খুন এবং শবদেহ মেলার খবর সংবাদ শিরোনামে উঠে এসেছে।
এবারের এই নির্বাচনী পর্বে আরও একটি চাঞ্চল্যকর দিক হলো, লখিমপুর খেরিতে হত্যাকাণ্ডে অন্যতম অভিযুক্ত কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী অজয় মিশ্র টেনির পুত্র আশিস মিশ্র টেনিকে জামিন দিয়েছে এলাহাবাদ হাইকোর্ট। জামিন পাবার পরই আশিস মিশ্রকে নির্বাচনী প্রচারে নামিয়ে দিয়েছে বিজেপি। প্রসঙ্গত, গত বছরের ৩ অক্টোবর রাজ্যের লখিমপুর খেরিতে চার কৃষক এবং এক সাংবাদিককে পিষে দেয় মন্ত্রীপুত্রের গাড়ি। এই ঘটনায় সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে গঠিত বিশেষ তদন্তকারী দল চার্জশিটে বলেছে, কোনো দুর্ঘটনার কারণে কৃষকদের প্রাণ যায়নি। কৃষি আইনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখিয়ে ঘরে ফিরতে থাকা কৃষকদের জেনে বুঝে পিষে দেওয়া হয়। এই জামিনের বিরোধিতা করে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানিয়েছেন নিহত কৃষকদের পরিবারের সদস্যরা।
এই লখিমপুর খেরির সীমান্তে এক প্রচার সভায় এসে নরেন্দ্র মোদি সমাজবাদী পার্টির বিরুদ্ধে গুন্ডাগিরির অভিযোগ এনেছেন, কিন্তু মুখে লখিমপুর খেরির উচ্চারণ করেননি। প্রধানমন্ত্রী লখিমপুর খেরির প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেলেও অখিলেশ যাদব অওয়াইয়ায় এক সমাবেশ থেকে তীব্র হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, সমাজবাদী পার্টির সরকার আসছে রাজ্যে, তারপর যারা লখিমপুরে কৃষক হত্যার ঘটনায় জড়িত তারা জেলে থাকবে, শুধু তারাই নয়, তাদের মদতদাতাদেরও জেলে পাঠানো হবে।
এদিকে, রাজ্যে চতুর্থ দফার (২৩ ফেব্রুয়ারি) ভোটের আগে সংযুক্ত কিষান মোর্চা কৃষকদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতাকারী যোগী সরকারকে সম্পূর্ণভাবে পরাস্ত করার আহ্বান জানিয়েছে। সংযুক্ত মোর্চা দাবি তুলেছে, কৃষকদের হাতে শুধু পাঁচ কেজি আনাজ ধরিয়ে দিলেই চলবে না, সেই সঙ্গে কৃষকদের রোজগারও বাড়াতে হবে। এই কারণে ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য সুনিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছে সংযুক্ত কিষান মোর্চা।
উত্তরপ্রদেশে যোগী সরকারের সার্বিক ব্যর্থতা এবং আইন শৃঙ্খলার ব্যাপক অবনতি, চরম দারিদ্র্য, বেকারি, অপ্রতুল স্বাস্থ্য পরিষেবা, নারী নির্যাতন যেমন মানুষের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সঞ্চার করেছে, তেমনি কেন্দ্রের কৃষি ও কৃষি বিরোধী বিলের বিরুদ্ধে লাগাতার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিজেপি বিরোধী মনোভাব গ্রামাঞ্চলে তীব্র হয়েছে। এই সমস্ত কিছুর প্রভাব নিশ্চিতভাবেই পড়তে চলেছে এই বিধানসভা নির্বাচনে। রাজ্যে এ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত চারদফার নির্বাচনে জনমানুষের এই মনোভাবেরই প্রকাশ লক্ষ করা গেছে।