৫৯ বর্ষ ২৮ সংখ্যা / ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ / ১২ ফাল্গুন, ১৪২৮
অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়-এর জীবনাবসান
২১ ফেব্রুয়ারি, সোমবার প্রয়াত হলেন সুরকার-গীতিকার অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। বেশ কিছুদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন তিনি। হাসপাতালেও ভরতি করা হয়েছিল তাঁকে। খানিক সুস্থতার পর দিন কয়েক আগেই তিনি বাড়ি ফেরেন। কিন্তু সোমবার সকালেই হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে ১১টা নাগাদ তাঁর জীবনাবসান হয়। তাঁর বয়স হয়েছিল ৯২। প্রবীণ এই সঙ্গীত ব্যক্তিত্বের মৃত্যুতে শোকস্তব্ধ হয়ে পড়ে সঙ্গীত মহল।
সলিল চৌধুরী ‘ঘরানা’র সার্থক উত্তরসূরি অথচ নিজস্ব স্বকীয়তায় উজ্জ্বল ছিলেন অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। সঙ্গীত জগতে অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৃষ্টিতে, বিশেষত সুরারোপে স্বাতন্ত্র্যের ছাপ অনস্বীকার্য। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ‘এমন একটা ঝড় উঠুক’, আর ‘সবাই চলে গেছে’-র মতো গানের স্রষ্টা তিনি। ‘জীবন রহস্য’ ছবিতে মান্না দে’র গাওয়া ‘কে তুমি পৃথিবী তাকিয়ে দেখো’, আশা ভোঁসলের ‘ও পাখি উড়ে আয়’ তাঁরই উজ্জ্বল সৃষ্টি। এখানেই শেষ নয়, ‘হারায়ে খুঁজি’ ছবির আরতি মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠের বিখ্যাত গান ‘টুংটাং পিয়ানোয় সারাটি দুপুর’-এর স্রষ্টাও তিনি।
লোকসংগীত, শাস্ত্রীয় সঙ্গীত এবং পাশ্চাত্য সংগীতের শিক্ষায় পুষ্ট একজন সঙ্গীতকার হিসেবেই তাঁর উত্থান। বিশ্বাস করতেন ঐতিহ্যের সঙ্গে প্রগতির কোনো বিরোধ নেই। তার স্বশিক্ষিত সঙ্গীতের দর্শনে যুক্ত হয় সাম্যবাদী জীবনদর্শন। তীব্র জীবন সংগ্রামের নির্যাস আত্মস্থ করেই এগিয়েছেন তিনি। যা কিছু বিরোধ মতাদর্শগত দর্শনের ক্ষেত্রে - সেখানেও তিনি সুরস্রষ্টা হিসেবে অবিচল ছিলেন।
অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৩০ সালে উত্তর কলকাতায়। বাল্যকাল কেটেছে ঢাকুরিয়াতে। পড়াশোনা ঢাকুরিয়া রামচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়। বাবা নিরাময় বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মা লাবণ্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গীত যোগ ছিল পারিবারিক সূত্রে। তার মা অর্গান এর মত করে হারমোনিয়াম বাজাতে পারতেন। মেজ জ্যাঠা নিরুপম বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন ধ্রুপদ শিল্পী। তার বড়দা তাকে ছোটো থেকেই শুরু সৃষ্টিতে উৎসাহ দিতেন। একটু বড়ো হতেই দাদা অরিন্দম অভিজিৎকে সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের খান্নার কবিতাটি সুর করতে দেন। জীবনের দ্বিতীয় গানটিতে সুর করে তিনি জনপ্রিয়তা পান যা আজও বহমান। সলিল চৌধুরী এই গান গ্রামোফোন রেকর্ড থেকে রেকর্ড করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় গণনাট্য সংঘের যোগ দেন ৪৬সালের পরবর্তী সময়ে। ৪৮ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। এই সময় থেকেই বামপন্থায় লালিত হতে থাকেন তিনি । রাজনৈতিক সভাতে এই সময় থেকেই তার সংগীত পরিবেশন শুরু।
এই পর্বে মিছিল চলে মিছিল চলে, ঘুমাস না খোকা আমার বর্গী এলো দেশে ইত্যাদি গান গেয়ে পরিচিতি পেতে থাকেন গণনাট্য পরিমণ্ডলে। তিনি ছিলেন গণনাট্যের ওয়েলিংটন স্কোয়ার্ডের সমবেত গানের অন্যতম শিল্পী। সহশিল্পী ছিলেন সলিল চৌধুরী। অনল চট্টোপাধ্যায়-এর কথায় এবং অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়-এর সুরে ‘সোনার ধান’ রেকর্ড আকারে প্রকাশিত হলে জনমানুসে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করে। এরপরে অনেক পথ ‘অনেক মত অনেক ষড়যন্ত্র’ সহ গ্রাম নগর মাঠ পাথার বন্দরে তৈরি হও অংশে তাঁর সুরারোপ মানুষকে উদ্বেল করে। পেশাদারি মঞ্চে না, মল্লিকা, অঘটন প্রভৃতি নাটকেও সুরকার ছিলেন তিনি।
অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের তালিম নিয়েছিলেন ঊষারঞ্জন মুখোপাধ্যায়-এর কাছে - তাঁর কাছে শিখেছেন রাগরাগিণীর প্রণোদনার কথা যার সার্থক প্রকাশ ঘটেছে হংস পাখা দিয়ে ক্লান্ত, ও পাখি উড়ে আয়, ফুলে ফুলে বঁধু, এখনো সারেঙ্গীটা বাজছে ইত্যাদি গানে। আধুনিক মৌলিক বাংলা গান - সেখানেও তাঁর স্বতন্ত্র উপস্থিতি বিদ্যমান এমন একটা ঝড় উঠুক, যদি কানে কানে কিছু বলে বঁধুয়া, কে তুমি কে তুমি, এ পৃথিবী তাকিয়ে দেখো কপালে, সিঁদুর সিঁদুর টিপ পড়েছ, সবাই চলে গেছে তাঁকে জনপ্রিয়তার অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দেয় যেগুলি চিরকালীন হয়ে যায়। আর নিজের লেখা ‘কিছু ভাবনা কিছু কথা’ বইটিতে রয়েছে তার সঙ্গীত ভাবনার কথা. তাঁর একমাত্র ‘ঝড়ের রাতের পাখি’ কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতায় রয়েছে জীবন যাপনের প্রতিটি মুহূর্ত আর সংগ্রামী মানুষের ছবি। এই কাব্যগ্রন্থের অন্যতম কবিতা ‘ভালোবাসা’- যেখানে তিনি লিখেছেন, ‘গুজরাটের যন্ত্রণা যদি আমার বুকে যন্ত্রণা না হয় তবে জেনো তোমায় আমি ভালোবাসিনি।’
অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মরদেহ তাঁর বাসভবন থেকে প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয় দেশপ্রিয় পার্কের বাণীচক্র সঙ্গীত শিক্ষায়তনে ও পরে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সঙ্গীত আকাদেমিতে। সন্ধ্যায় কেওড়াতলা শ্মশানে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়।
সুরস্রষ্টা অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রয়াণ সংবাদ পেয়ে বাড়িতে গিয়ে শ্রদ্ধা জানান সিপিআই(এম) নেতা রবীন দেব, সুজন চক্রবর্তী, পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সঙ্ঘের রাজ্য সম্পাদক রজত বন্দ্যোপাধ্যায়, ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘ, পশ্চিমবঙ্গর রাজ্য সম্পাদক দিব্যেন্দু চট্টোপাধ্যায়, শ্রীকান্ত আচার্য, চয়ন ভট্টাচার্য প্রমুখ। শিল্পীর জীবনাবসানে শোক জ্ঞাপন করেছেন বিমান বসু, সূর্য মিশ্র। শিল্পীর প্রয়াণে গভীর শোক জানিয়েছেন গণনাট্য সঙ্ঘ ও পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সঙ্ঘ, পশ্চিমবঙ্গ আদিবাসী ও লোকশিল্পী সঙ্ঘ।
অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় রেখে গেলেন তাঁর স্ত্রী এবং দুই পুত্র ও এক কন্যাকে। দুই পুত্র অমিত ও অভিষেক এবং কন্যা মহাশ্বেতা সঙ্গীতের সঙ্গেই যুক্ত। সঙ্গীত শিল্পী অগ্নিভ বন্দ্যোপাধ্যায়ের তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র।