৫৯ বর্ষ ২৮ সংখ্যা / ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ / ১২ ফাল্গুন, ১৪২৮
বামপন্থা প্রগতির পথ
অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
[২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে বামফ্রন্ট প্রার্থীদের সমর্থনে অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় এই লেখাটি দেশহিতৈষী’র জন্য পাঠিয়েছিলেন। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে লেখাটি পুনর্মুদ্রিত হলো।]
শ্রদ্ধেয় শ্রী সূর্যকান্ত মিশ্রের একটি অপূর্ব অভিব্যক্তিঃ ‘‘বামপন্থা বিক্রি হয় না - বিক্রি হয় গোরু ছাগল।’’ সময়ের সংকটে দাঁড়িয়ে এমন একটি সত্য-দীপ্ত অভিদ্যোতনা বামপন্থীদের জীবনে একটি দীপ্যমান দিশারি হতে পারে। কারণ ‘বামপন্থা’ শব্দটির আত্মিক বিভূতি কী? - প্রগতি। যারা বামপন্থী তারা প্রগতিপন্থী। দেশে দেশে, যুগে যুগে ইতিহাসে এই সত্য স্বীকৃত, প্রমাণিত, আদৃত। আমার ব্যাখ্যা নিয়ে আমি দলের কথা বলছি না, আমি ইতিহাসের সত্য-সাধনার কথা বলছি। চৈতন্যদেবের আবির্ভাবকে বলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘‘চৈতন্যের আবির্ভাবে বাংলাদেশে বৈষ্ণবধর্ম যে হিল্লোল তুলিয়াছিল তাহা একটা শাস্ত্র ছাড়া ব্যাপার। তাহাতে মুক্তি পাওয়া-চিত্ত ভক্তিরসের আবেগে আত্মপ্রকাশ করিতে ব্যাকুল হইল। সেই অবস্থায় মানুষ কেবল স্থাবরভাবে ভোগ করে না, সচলভাবে সৃষ্টি করে।’’ রক্ষণশীলতা, স্থবিরত্বের বিরুদ্ধে আত্মপ্রকাশের যে বিপ্লব সেটাই বামপন্থা। বামপন্থা শব্দটির ভাষিক ব্যঞ্জনা, তাৎপর্যর সবটুকু বোধই বিকাশ প্রাপ্ত হয় যে কাজে, তার নাম প্রগতি। বামপন্থা মানে প্রগতিপন্থা।
আমরা রবীন্দ্র সংগীত ভাবনার উত্তরসূরি। আমরা রবীন্দ্রনাথের অচলায়তনের দাদাঠাকুর। তাসের দেশের রাজপুত্র। প্রায়শ্চিত্তের ধনঞ্জয় বৈরাগীদের অনুসারী। আমাদের সাধনা শিব সাধনা। শিব শব্দের সমার্থ সুন্দর, কল্যাণ, মঙ্গল। আমাদের প্রতিবাদ দক্ষযজ্ঞের অন্যায়ের বিরুদ্ধে সৌন্দর্য সাধনা, মঙ্গল সাধনা। কল্যাণব্রত আমাদের বিপ্লব - কালাপাহাড়ি নয়, রক্ষণশীলতার ঘূণধরা অবস্থার বিরুদ্ধে নব সৃষ্টির সংগ্রামের জন্যে। রবীন্দ্রনাথ বিপ্লবকে সমর্থন করে তাসের দেশ উৎসর্গ করলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে, কিন্তু বিসর্জন নাটকটি কোনও অহিংস পন্থীকে উৎসর্গ করেন নি। যিনি ‘হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী’ গান লিখেছেন, তিনি রক্ত নেওয়া সমর্থন করেননি, কিন্তু বিপ্লবীকে সমর্থন করেছেন। তিনি বুঝিয়েছেন বিপ্লব মানে হিংসা, ধ্বংস নয় - বিপ্লব মানে প্রগতি - আর এটাই বামপন্থা।
আমি সৃষ্টিশীল মানুষ। আমি রবীন্দ্র বোধ নিয়ে বাঁচি, ‘‘তরঙ্গ মিলায়ে যায় তরঙ্গ ওঠে/কুসুম ঝরিয়া পড়ে-কুসুম ফোটে।’’ আমরা স্থবিরতায় বিশ্বাসী নই। তাই আমরা চলি। আর এই চলাটাই প্রগতি আর এটাই যুগে যুগে, কালে কালে, দেশে দেশে ইতিহাস রচিত করেছে। প্রগতিবিহীন হয়ে বাঁচবো? তা হয় না। বাঁচলে চলতে চলতে বাঁচবো, সৃষ্টি করতে করতে বাঁচবো - এটাই বামপন্থা অর্থাৎ গতিপন্থা, প্রগতি পন্থা। আন্তরিক শ্রদ্ধা জানাই শ্রদ্ধেয় সূর্যকান্ত মিশ্রকে। তাঁর উচ্চারণকে শ্রদ্ধা জানিয়ে বলি, ‘‘বামপন্থা বিক্রি হয় না, গোরু ছাগল বিক্রি হয়।’’
৩৪ বছরে কিছু হয়নি - এই উচ্চারণ করছেন গণ্যমান্যেরা যখন তারা মোবাইল কানে পার্ক সার্কাস ব্রিজ থেকে রেসকোর্সের সামনে গিয়ে নামছেন। মিথ্যাচারের সাধনায় এইটেই সত্য। সত্য, ইতিহাস - এদের বিকৃত করে মানুষের কল্যাণ করা যায় না। আগে যারা গ্রাম থেকে শহরে বাড়ি বাড়ি কাজ করতে আসত - ৩৪ বছরে গ্রামীণ কর্মযজ্ঞের ফলেই তাদের শহরে কাজ খুঁজতে আসা বা ভিক্ষা করতে আসা কমে গিয়েছিল। সেই ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু হয়ে কংগ্রেস শাসনকাল পর্যন্ত গ্রামে কুটির শিল্প ক্রমশ ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। ভূমিসংস্কার হয়নি। চারদিকে নিরক্ষরতার অন্ধকার। আবার কাগজে পড়েছি শ্রদ্ধেয় জ্যোতি বসুর আমলেই ভারতে কুটির শিল্পে পশ্চিমবঙ্গ প্রথম স্থানে। ভূমিসংস্কারে প্রথম স্থানে, সাক্ষরতা বিস্তারে বিরাট অগ্রগতি।
কৃষিভিত্তিক দেশে না হলো চাষিদের মানইজ্জত রক্ষা, না হলো অর্থনৈতিক নিরাপত্তা। সেচ বিভাগ বলে কিছু আছে, সেটা আমজনতা কিছুই বুঝল না।ভূমিসংস্কার হলো না। ৩৪ বছর গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বামপন্থার বিকাশ ঘটেনি - ওইসব দরিদ্র মানুষের মুখে হাসি ফুটেছিল বামপন্থী সরকারের জন্যই। গ্রামীণ অর্থনীতির রূপ বদলে দিয়েছে ৩৪ বছরের শাসন।
আমি রাজনীতির লোক নই। সংস্কৃতি জগতের মধ্যে দিয়ে সচেতনতার সাধনা করেছি। যাদের দেখে বড়ো হলাম - ভারতে, বাংলায় তারা কারা? জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, সলিল চৌধুরী, বিনয় রায়, তাপস সেন, জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়, ঋত্বিক ঘটক, শম্ভু ভট্টাচার্য, বিজন ভট্টাচার্য, উৎপল দত্ত - এরকম অজস্র মানুষ। তাদের প্রসব করলো কে? বামপন্থা। প্রগতিবাদীদের সম্মেলন। দূর থেকে কাছে দেখতে পেলাম প্রমোদ দাশগুপ্ত, জ্যোতি বসু, হরেকৃষ্ণ কোঙার, সোমনাথ লাহিড়ী, ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত আরও কতো কতো জন। কেউ বলবেন, তাতে কি গেল এলো? আমি বলব একটাই কথা, তাঁদের প্রাণের স্রোত আমার প্রাণের স্রোতকে স্পর্শ করেছে। তাঁদের পেয়ে চোখ জুড়িয়েছে বলি না, বলি প্রাণ জুড়িয়েছে। আমার গতিশীলতা বেগ পেয়েছে। সৃষ্টিশীল মনকে চলমান করেছে।
আমি দলবদ্ধ বা ইজমবদ্ধ নই। সুজন চক্রবর্তী ও নির্বেদ রায়ের বিতর্কে নির্বেদ রায়ের বক্তব্যে উদ্দীপ্ত হয়েছি, সেখানে সুজন আমার প্রিয় মানুষ বলে একপেশে ভাবনায় ভাবিত হইনি।
কথা অনেক জমেছে। ধরে ধরে বিশ্লেষণ করে প্রভূত আলোচনার সুযোগ আছে। বিস্তারিত বলার জায়গা এটা নয় - শুধু বলব বামপন্থীরা ৩৪ বছর কাজ করেছে বলেই ত্রুটিগুলো সামনে এসেছে। যে কাজ করে তারই কিছু কাজে ত্রুটি হয় - সেটা শোধরাতে হয় - যা বামপন্থা অবলম্বনকারীদের ইতিহাসে দেখা যায় কার্যকরী হতে। কিন্তু তা বলে কাজটির সমগ্রকে সেই ত্রুটির নিরিখে বিচার একটা মিথ্যাচার। ৩৪ বছর জনগণের ভীমরতি ছিল, তাই বামপন্থীরা শাসন করেছে - জনসাধারণকে এই হীনম্মন্য রঙে রাঙানো যায় কী? গণবিবাহ, গণশবদাহ, মানবিক কাজ, কিন্তু বিবাহ ও সৎকারের নিরিখে এর উৎকর্ষ উজ্জ্বল নয়। শিল্পীদের গণ-সংবর্ধনাও কতটা শিল্পী ও শিল্পের প্রতি শ্রদ্ধা আর কতটা সম্ভ্রান্তবোধকে গুলিয়ে দেওয়া অসম্মানের জায়গা - বুঝতে পারছি না।
আবার শ্রদ্ধেয় সূর্যকান্ত মিশ্রের বাণী পুনরুচ্চারণ করে বলব - ‘‘বামপন্থা বিক্রি হয় না - গোরু ছাগল বিক্রি হয়।’’ আমি একজন বিষয় নির্ভর সংগীত সৃষ্টির ঘরামি। আমার কাজে খামতি আছে, উৎকর্ষের উজ্জ্বলতাও কখনো কখনো ধূসর, তা বলে বোধকে, অনুভূতিকে ফাঁকি দিয়ে কাজ করিনি। সৃষ্টিশীলতায় বারবার অন্তরের ধ্বনি অন্তরেই প্রতিধ্বনিত করে উচ্চারণ করেছি রবীন্দ্রনাথের বাণী, ‘‘হেথা নয় হেথা নয় অন্য কোথা অন্য কোনও খানে।’’ বর্তমান সময়ে প্রাত্যহিক জীবন যাপন করছি আর মনে মনে দুটি বাণীকে আন্তরিকভাবে আঁকড়ে ধরছি - (১) ‘‘হেথা নয় হেথা নয় অন্য কোথা অন্য কোনও খানে।’’ (২) ‘বামপন্থা মানে প্রগতির পথ - পরিবর্তন ও প্রগতির পক্ষে অধোগতির বিপক্ষে - রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেবার সময় ভাবনাকে সে দিকেই স্থির রাখতে হবে।