E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ২৮ সংখ্যা / ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ / ১২ ফাল্গুন, ১৪২৮

ভারতে অরণ্যের হ্রাস বৃদ্ধিঃ সত্য অসত্য

তপন মিশ্র


জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি কেন্দ্রীয় পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রক ভারতের ১৭তম ‘ইন্ডিয়া স্টেট অফ ফরেস্ট রিপোর্ট’(আইএসএফআর) প্রকাশ করে। ফরেস্ট সার্ভে অফ ইন্ডিয়া (এফএসআই) প্রতি ২ বছর অন্তর ভারতের অরণ্য সম্পদ সম্পর্কে এই তথ্য প্রকাশ করে। এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিগত দু’বছরে (২০১৯ সালের তুলনায়) দেশের অরণ্য এবং তার সঙ্গে অরণ্যের বাইরে রোপিত বৃক্ষের পরিমাণ ২,২৬১ বর্গ কিলোমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে। পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে এর থেকে ভালো খবর আর কীই-বা হতে পারে। অধিক বনাঞ্চল মানে আরও গাছ এবং আরও গাছ মানে আরও কার্বন সিকোয়েস্ট্রেশন (কার্বন জমা রাখার প্রাকৃতিক পদ্ধতি)। আইএসএফআর’র রিপোর্ট আরও বলছে যে, এই সময়কালে বনাঞ্চলে ৭৯.৪ মিলিয়ন টন কার্বন সঞ্চয় বৃদ্ধি পেয়েছে।

যে প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়

ঘাটতি প্রযুক্তি ব্যবহারে নয়,ওই প্রযুক্তি ব্যবহার করে যে তথ্য পাওয়া গেছে তার ব্যাখ্যায় গোলমাল রয়েছে। যে প্রযুক্তি এফএসআই ব্যবহার করেছে তা হলো, কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে‘রিমোট সেন্সিং’। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভারতের অরণ্য এবং অরণ্যের বাইরে গাছের আচ্ছাদনের যে স্যাটেলাইট ইমেজ বা উপগ্রহের সাহায্যের তোলা ডিজিটাল ছবি পাওয়া যায় তাকে বিশ্লেষণ করা হয়। এই বিশেষ ধরনের কৃত্রিম উপগ্রহকে রিমোট সেন্সিং উপগ্রহ বলা হয়। এর মাধ্যমে যে ছবি তোলা হয় আসলে সে ছবি সাধারণ কোনো ছবি নয়। পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে যে সৌরশক্তি প্রতিফলিত হয় তাতে ডিজিটাল প্রযুক্তিতে ‘নরমালাইজড ডিফারেন্স ভেজিটেশন ইনডেক্স’ ব্যবহার করা হয়। এতে উদ্ভিদের আচ্ছাদন থাকলে এক ধরনের রঙ এবং না থাকলে বিভিন্ন ধরনের রঙ পাওয়া যায়। আসলে দুটি ক্ষেত্রে উপগ্রহ চিত্রগুলিতে বিভিন্ন পরিমাণে আলো প্রতিফলিত হয় এবং এর উপরে নির্ভর করে কিছু সূচক (ইনডেক্স) তৈরি করা হয়। সূচকের মানে পার্থক্যের মাধ্যমে কী ধরনের গাছপালা মাটির উপর আছে এবং তার আচ্ছাদনের ঘনত্ব কতটা তা নির্ধারণ করা হয়।

এফএসআই গবেষকরা প্রতিটি পিক্সেলের উজ্জ্বলতার উপর ভিত্তি করে অরণ্যের গাছপালা এলাকাকে বিভিন্ন ‘শ্রেণি’তে শ্রেণিবদ্ধ করেন। এগুলি হলো ‘খুব ঘন’বন, ‘মাঝারি ঘন’ বন এবং ‘উন্মুক্ত বন’। ‘খুব ঘন’ বনের আচ্ছাদনের ঘনত্ব ৭০ শতাংশের বেশি। ৭০ শতাংশ থেকে ৪০ শতাংশ ঘনত্ব হলে মাঝারি ঘন বনাঞ্চল, ৪০ থেকে ১০ শতাংশ ঘনত্ব হলে উন্মুক্ত বনাঞ্চল এবং ১০ শতাংশের নিচে ঘনত্ব হলে তা ঝোপঝাড়।

প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে এফএসআই অনেকটা এগিয়ে থাকলেও, এবারের সমীক্ষার তথ্য ব্যাখ্যার মধ্যে কতটা সততা আছে তা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। ভারত সরকার জলবায়ু পরিবর্তন রোধ করার জন্য আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি পালনের মরিয়া চেষ্টা করছে এবং তাই কিছু অবাঞ্ছিত পদ্ধতি ব্যবহার করার অভিযোগ উঠেছে। যে যে প্রশ্নগুলি সামনে এসেছে সেগুলি হলো নিম্নরূপ।

সন্দেহের অবকাশ কোথায়

প্রথম যে বড়ো সমস্যা তৈরি করা হয়েছে তা হলো, অরণ্যকে সংজ্ঞায়িত করার সমস্যা। ব্রিটিশ আমলে যে সমস্ত বনাঞ্চল সরকার অধিগ্রহণ করেছিল এখনও পর্যন্ত সেগুলিই অরণ্য। পরে গোদাভিরমন বনাম ভরত সরকারের মামলায় সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপে অরণ্যের একটি সংজ্ঞা নিরূপিত হয়। এফএসআই সেই সংজ্ঞা ব্যবহার করে। এই সংজ্ঞা অনুযায়ী যে সমস্ত গাছের আচ্ছাদনের ঘনত্ব ১০ শতাংশের বেশি এবং জমির পরিমাণ এক হেক্টরের চেয়ে বড়ো, সেগুলি মালিকানা নির্বিশেষে অরণ্য হিসাবে বিবেচিত হবে।

কেরালা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বন গবেষক শ্রীনিবাসন কোরাপথের মতে - পশ্চিমঘাট পর্বতমালার বর্ষা বন ধ্বংস করে চা, কফি এবং সুপুরি ইত্যাদির বাগান তৈরি করা হয়েছে। এগুলিও এখন অরণ্যের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তিনি আরও বলেন যে, এই যুক্তি অনুসারে, এক হেক্টরের বেশি শহরাঞ্চলে রোপিত গাছপালা,বড়ো গাছযুক্ত পার্ক, রাস্তার ধারের বৃক্ষরোপণ এই সবগুলিকে অরণ্য হিসাবে বিবেচিত করা হবে। সেগুলিকেও যদি বনাঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত করা হয় তাহলে দেশে খাতায় কলমে ৩৩ শতাংশ বনভূমি তৈরির অপচেষ্টা করা হচ্ছে মাত্র। তিনি বলেনঃ “আমরা এই তথ্যে আশ্বস্ত হতে পারি, কিন্তু, এটি একটি সম্পূর্ণ ছবি নয়। একই প্রতিবেদনের পূর্ববর্তী সংস্করণে অর্থাৎ ২০১৯ সালে এফএসআই’র বাইরে অরণ্যের রিমোট সেন্সিং বিশেষজ্ঞদের থেকে একই ধরনের সমালোচনা শোনা গিয়েছিল।”

দ্বিতীয়ত, অরণ্যের সঙ্গে রোপিত বনাঞ্চল (plantation) এবং মনোকালচার (একটি নির্দিষ্ট প্রজাতির রোপণ) যেমন কফি এবং কাঠ উৎপাদনকারী কিছু বৃক্ষ প্রজাতি সবুজায়নের ক্ষেত্রে অবদান রাখে ঠিকই কিন্তু অরণ্যের সঙ্গে এর তুলনা চলে না। এই প্রতিবেদনে তামিলনাডুর অরণ্য মানচিত্রে কন্যাকুমারী জেলার নারকেল এবং রাবার বাগানগুলিকে বনাঞ্চলের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

তৃতীয়ত, বিজ্ঞানীরা বার বার উল্লেখ করেন যে, এফএসআই ব্যবহৃত বনের আচ্ছাদন সম্পর্কিত রিমোট সেন্সিংয়ের তথ্য সর্বজনীন পরিসরে (Public domain) দেওয়া হয় না। দেশের পরিবেশ, বন এবং জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রক (MoEFCC) এই তথ্য সর্বজনীন পরিসরে দেওয়ার অনুমতি দেয় না। এর অর্থ হলো, রিমোট সেন্সিংয়ে যে সমস্ত প্রাথমিক তথ্য ব্যবহার করে ভারতের বনাঞ্চল বৃদ্ধি হয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে, অন্য গবেষকদের সেই তথ্য যাচাই করার কোনো সুযোগ নেই।

চতুর্থ যে অভিযোগ উঠছে তা হলো, আমাদের দেশে আর একটি রিমোট সেন্সিং বিশেষজ্ঞ সংস্থা রয়েছে যার নাম ন্যাশনাল রিমোট সেন্সিং সেন্টার (এনআরএসসি)। এরা দেশের আসমুদ্র হিমাচলের জলভাগ, স্থলভাগ ইত্যাদি অঞ্চলের অনবরত রিমোট সেন্সিং তথ্য সংগ্রহ করে। এম ডি মধুসূদন নামে বাঙ্গালোরের একজন বন্যপ্রাণ গবেষকের এবং রিমোট সেন্সিং বিশেষজ্ঞের মতে এফএসআই’র রিপোর্টে ২০১১ থেকে ২০১৩ যখন অরণ্য আচ্ছাদন বৃদ্ধির পরিমাণ কয়েক লক্ষ হেক্টর দেখানো হয়েছিল তখন ২০১৫ সালে এনআরএসসি বলছে যে,ওই সময়কালে লাগাতারভাবে অরণ্য আচ্ছাদন হ্রাস পেয়েছে।

কেন এই অপপ্রয়াস

প্রধানমন্ত্রী এবং তার সরকার আন্তর্জাতিক স্তরে যখন ভারতের অরণ্য সম্ভার বৃদ্ধির বড়ো বড়ো দাবি করছে, তখন একথা স্পষ্ট যে,বাস্তব অবস্থা এই দাবি থেকে অনেক দূরে। ভারতে জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বৈশ্বিক ঘটনার পরিণাম হলো, আবহাওয়ার বিরূপ পরিণতি। বিশ্ব জলবায়ু ঝুঁকি সূচকে (Global Climate Risk Index, 2020, Germanwatche.V) ভারতকে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ (Vulnerable) দেশ হিসাবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।

২০২১ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভারতের জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলিতে মোট বনভূমি ১০২০ বর্গ কিলোমিটার হ্রাস পেয়েছে। যে পাঁচটি রাজ্যে অরণ্যের আচ্ছাদন অনেকটা হ্রাসের রিপোর্ট পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলি হলো - অরুণাচল প্রদেশ, মণিপুর, নাগাল্যান্ড, মিজোরাম এবং মেঘালয়। এই প্রতিবেদনে কিন্তু বলা নেই যে, কতটা বনাঞ্চল ছেদন করে মোনোকালচার (একটি নির্দিষ্ট প্রজাতির রোপণ) করা হয়েছে। প্রাকৃতিক বনাঞ্চলে যে জৈববৈচিত্র্য এবং কার্বন জমা থাকে সৃজিত বনে তার কানাকড়িও পাওয়া যায় না।

এই প্রতিবেদনের আগে অর্থাৎ ২০১৯ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, ভারতে আট লক্ষ বর্গ কিলোমিটারেরও বেশি জমি বৃক্ষ ও বনের আচ্ছাদনে আচ্ছাদিত। এটি দেশের সমগ্র এলাকার প্রায় ২৪.৫ শতাংশ এবং ২০১৭ সালে প্রকাশিত পূর্ববর্তী প্রতিবেদনে বন হিসাবে নথিভুক্ত এলাকার চেয়ে ৫,১৮৮ বর্গ কিলোমিটারেরও বেশি।একই সময়ে, গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচ-এর মতে ২০১০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ভারতীয় বনাঞ্চল ৪ শতাংশ কমেছে। ভারতের এফএসআর লাগাতারভাবে ভুল তথ্য আমাদের সামনে পরিবেশন করছে। উল্লেখ্য, বিশ্বব্যাপী অরণ্য পর্যবেক্ষণের জন্য একটি ওপেন সোর্স ওয়েব অ্যাপ্লিকেশন পাওয়া যায়।

প্রাকৃতিক অরণ্যের বাস্তুতন্ত্রে (উভয় বন এবং সাভানা তৃণভূমি), সৃজিত বা রোপিত বনাঞ্চলের তুলনায় অনেক বেশি পরিমাণে কার্বন জমা রাখার ক্ষমতা রাখে। তাই, পুরনো বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস করে এবং বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে এর ক্ষতিপূরণ করার সরকারি প্রয়াস বিজ্ঞানসম্মত নয় ও পরিবেশগত বাস্তবতাকে উপেক্ষা করা হচ্ছে বলে বলা যেতে পারে।

তবে এমনটা নয় যে, বৃক্ষরোপণ বা শহরের পার্কের জীববৈচিত্র্যের কোনো মূল্য নেই। চা, কফি বাগান বা রোপিত বনাঞ্চল সাধারণভাবে বন্যপ্রাণী প্রজাতিগুলির আবাসস্থল হয় না; তবে কখনও কখনও আশ্রয়স্থল হতেও পারে। বন্য প্রাণীর আবাসস্থল নির্ভর করে সেখানকার উদ্ভিদ প্রজাতির গঠন এবং তার বৈচিত্র্যের উপর। কারণ খাদ্য সহ অন্যান্য জৈবিক কাজের জন্য বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিদ প্রজাতির আবশ্যকতা রয়েছে। কৃষি-বনজ বৃক্ষরোপণ (Agroforestry) গ্রামাঞ্চলের প্রাকৃতিক গঠনের এক ধরনের ক্ষণস্থায়ী আবাসস্থল হিসাবে কাজ করতে পারে। ঠিক তেমনই শহরের জৈববৈচিত্র্য কিছুটা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বনসৃজন সাহায্য করতে পারে। কিন্তু এসব কখনওই প্রাকৃতিক বনের প্রতিস্থাপন হতে পারে না।

২০১৫ সালে প্যারিস চুক্তির প্রাক্বালে ভারত সরকার এনডিসি (ন্যাশনালি ডিটারমাইন্ড কনট্রিবিউশন) নামে অন্যান্য দেশের মতো একটি স্বেচ্ছা ঘোষণাপত্র দাখিল করে। এই ঘোষণাপত্রে, ভারত সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে বন এবং গাছের আচ্ছাদন বাড়িয়ে বর্তমানের তুলনায় ২.৫-৩ বিলিয়ন টন কার্বন ডাই অক্সাইডের সমান কার্বন সিঙ্ক (কার্বন ভাণ্ডার) তৈরি করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। একদিকে এই প্রতিশ্রুতি পূরণের তাগিদ ও পরিবেশ রক্ষা এবংঅন্যদিকে অরণ্য সংরক্ষণ আইন পরিবর্তন করে কর্পোরেটদের স্বার্থে অরণ্য ধ্বংসের যে কর্মসুচি সরকার নিয়েছে তাকে ঢাকা দিতেই এই অসত্য ভাষণ।

আশঙ্কা হয় যে, কয়েক বছর ধরে প্রায়শই ‘স্টেট অফ ফরেস্ট রিপোর্ট’-এর তথ্য কিছুটা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানোর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক জলবায়ু আলোচনায় গৃহীত লক্ষ্যমাত্রার সাথে সাযুজ্য রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। এই নির্দিষ্ট মাত্রায় পৌঁছনোর জন্য অরণ্যের আচ্ছাদনকে বেশি করে দেখানোর যে পরিকল্পনা করা হয়েছে তা এফএসআই’র বাইরে বিভিন্ন গবেষকদের দেওয়া তথ্য ও গবেষণা থেকে স্পষ্ট। এই রিপোর্ট দেশের বাস্তুতন্ত্র এবং জৈববৈচিত্র্যের প্রকৃত চিত্র কখনই হতে পারে না।/p>