৫৮ বর্ষ ৪৫ সংখ্যা / ২৫ জুন, ২০২১ / ১০ আষাঢ়, ১৪২৮
দেশের আত্মনির্ভরতার প্রতীক বেঙ্গল কেমিক্যালস বিক্রি রুখতে হবে
মৃণাল রায়চৌধুরী
অতিমারীজনিত ভয়াবহ পরিস্থিতিতে যখন দেশজুড়ে জীবনদায়ী ওষুধের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে, তখন কেন্দ্রের বিজেপি সরকার বেঙ্গল কেমিক্যালের মতো ওষুধ শিল্পের ঐতিহ্যবাহী রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাকে বেসরকারি হাতে তুলে দিতে উদ্যত হয়েছে। রাজ্যের তৃণমূল সরকার এ ব্যাপারে নীরব থেকে কেন্দ্রের চক্রান্তকেই কার্যত সমর্থন করছে।প্রখ্যাত রসায়নবিদ, ঐতিহাসিক, শিল্প উদ্যোগী, মানব মিত্র আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় পরাধীন ভারতে আত্মনির্ভরতা গড়তে ১৯০১ সালের ১২ এপ্রিল দেশের প্রথম রসায়ন ও ওষুধ শিল্প “বেঙ্গল কেমিক্যালস অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড” গড়ে তোলেন কলকাতার মানিকতলায়। তারপর একে একে পানিহাটি, কানপুর এবং মুম্বাইতে কারখানা এবং দেশের সমস্ত রাজধানী শহরে বিক্রয় কেন্দ্র গড়ে জীবনদায়ী বিভিন্ন ওষুধ, রসায়ন শিল্পে ব্যবহৃত গুরুত্বপূর্ণ সালফিউরিক অ্যাসিড ইত্যাদির উৎপাদন এবং বিক্রয়ের সুষ্ঠু ব্যবস্থা গড়ে তোলেন।
যে স্বনির্ভরতা গড়তে তিনি ১৯০১ সালে বেঙ্গল কেমিক্যালস প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তা আজ দেশের সরকার দ্বারা আক্রান্ত। যদিও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলছেন ‘আত্মনির্ভর ভারত গঠন’ তাঁর লক্ষ্য। কিন্তু আত্মনির্ভরতার বুনিয়াদ, সব ধরণের রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ক্ষেত্র দেশি-বিদেশি কর্পোরেটদের হাতে তুলে দিচ্ছেন, বেঙ্গল কেমিক্যালস তার মধ্যে অন্যতম।
কিছু পরিচালন ব্যবস্থার ত্রুটির ফলে আচার্যের জীবদ্দশায় ৫০-এর দশকের শেষে তাঁর কোম্পানি রুগ্ণ হতে শুরু করে। ১৯৭৭ সালে কেন্দ্রে জনতা পার্টির সরকার ও রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকার। ঐতিহ্যশালী জীবনদায়ী ওষুধ শিল্প রক্ষায় রাজ্যের তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী, শ্রমিকনেতা জ্যোতি বসুর প্রচেষ্টায় কেন্দ্রীয় সরকার এই শিল্প প্রতিষ্ঠান অধিগ্রহণ করে এবং ১৯৮০ সালে তা জাতীয়করণ করা হয়। তাতেও শিল্পের রুগ্ণতা না কাটায় জ্যোতি বসুর উদ্যোগে পুনরুজ্জীবন প্রকল্পে ৪৪০ কোটি টাকা অনুমোদিত হয়। আধুনিকীকরণের পর ২০১৫-২০১৬ সাল থেকে রুগ্ণতা কাটিয়ে লাভ শুরু হয়। তারপর থেকে ধারাবাহিকভাবে এই সংস্থায় লাভ হতে থাকে। এভাবে বেঙ্গল কেমিক্যাল দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ওষুধ শিল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে।
শিল্পে লাভ হওয়ার শুরুতেই ২০১৬ সালে কেন্দ্রীয় সরকার বেঙ্গল কেমিক্যালসকে কৌশলগত বিক্রির (Strategic Sale) সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এই লক্ষ্যেই পানিহাটি কারখানার ২৫ একর জমি বিক্রির উদ্যোগ কার্য্যকর করতে এসে শ্রমিক-কর্মচারীদের বাঁধার মুখে পরে সাময়িকভাবে পিছু হঠে।
২০১১ সালের পর থেকে রাজ্যে নেই শ্রমিক দরদি বামফ্রন্ট সরকার, কেন্দ্রেও নেই গণতান্ত্রিক সরকার। এখন এখন কেন্দ্রে এবং রাজ্যে রয়েছে জনবিরোধী, শ্রমিক-কৃষক স্বার্থ বিরোধী অগণতান্ত্রিক, স্বৈরাচারী, কর্পোরেট স্বার্থবাহী দুই অপশক্তি যথাক্রমে বিজেপি এবং তৃণমূল পরিচালিত সরকার। ২০১১ সালে রাজ্যে তৃণমূল সরকার গঠনের পর থেকেই যে লাগামহীন সন্ত্রাসের রাজত্ব চলেছে এই বাংলায়, তার ফলে সিআইটিইউ পরিচালিত ইউনিয়নের শক্তি একেবারেই সীমিত হয়ে পরে। তবুও আইএনটিটিইউসি সহ অন্যান্য ইউনিয়নগুলিকে একত্রিত করে এই শিল্প রক্ষার লড়াই সংগঠিত হয়। কনভেনশন, প্রকাশ্য সভা ও মিছিল, প্রচার পত্র প্রদানের মাধ্যমে সমাজের অন্যান্য অংশের মানুষের সমর্থনলাভের আবেদন জানানোর সাথে সাথে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিকট যৌথ প্রতিবাদ পত্র পাঠানো হয়।
একই সাথে কলকাতা হাইকোর্টে মামলাও করা হয়। যদিও প্রথমে আইএনটিটিইউসি মামলায় শামিল না হলেও, শ্রমিক-কর্মচারীদের চাপের মুখে পরবর্তীকালে যুক্ত হয়। শিল্প রক্ষার পক্ষে বিশিষ্ট আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য্যের যুক্তিপূর্ণ সওয়াল শেষে মাননীয় বিচারপতি রায় দানে বলেন, ‘জনস্বার্থে লাভজনক এই গুরুত্বপূর্ণ শিল্প বিক্রি করা যাবে না’।
স্বাভাবিকভাবেই কেন্দ্রীয় সরকার উক্ত রায়ের বিরুদ্ধে ডিভিশন বেঞ্চে আবেদন করেছে। মামলা বিচারাধীন, ফলে বিক্রি করতে পারছে না। তা বলে চুপ করে বসে নেই কেন্দ্রীয় সরকার। আর রাজ্য সরকার নিশ্চুপ অচল পাথরের মতো বসে আছে।
করোনাজনিত পরিস্থিতিতে যখন ওষুধের কালোবাজারি হচ্ছে,সাধারণ মানুষকে চড়া দামে ওষুধ কিনতে হচ্ছে, তখন রাজ্য সরকার যদি রাজ্যের হাসপাতাল, স্বাস্থ্য কেন্দ্র, পৌরসভা, পঞ্চায়েত ইত্যাদির জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ, ইঞ্জেকশন, জীবাণুমুক্ত করতে ‘কালো ফিনাইল’, ‘ব্লিচিং পাউডার’, ‘টয়লেট ক্লিনার’ ইত্যাদি বেঙ্গল কেমিক্যালস থেকে কিনতো, তাহলে এই শিল্প প্রতিষ্ঠান বিক্রির হাত থেকে রক্ষা পেত। ‘আত্মনির্ভর ভারত’ গড়ার নামে মোদীজির কর্পোরেট তোষণ নীতির বিরুদ্ধেও ভূমিকা পালিত হতো।
সপ্তদশ লোকসভার কেমিক্যালস এবং ফার্টিলাইজার স্ট্যান্ডিং কমিটি ফেব্রুয়ারি, ২০২১-এর রিপোর্টে জোরালো ভাবে বলেছে, ‘সকল ধরণের ওষুধ বেসরকারি ক্ষেত্রে উৎপাদন করতে দেওয়া সমুচিত হবে না। রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ওষুধ শিল্পগুলি ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে প্রয়োজনীয় জীবনদায়ী ওষুধ নিয়ে দেশব্যাপী বিভিন্ন মহামারীর সময় মানুষের পাশে থেকেছে। সুতরাং লাভজনক কর্ণাটক অ্যান্টিবায়োটিক ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড এবং বেঙ্গল কেমিক্যালস অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড বিক্রির সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা হোক’।
উক্ত সুপারিশ বিবেচনা করে আবারও নীতি আয়োগ এবং কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রক মার্চ, ২০২১- এর অভিমতে জানায়, ‘নির্ভরযোগ্য বেসরকারি ওষুধ শিল্প দেশের মানুষের চাহিদা পূরণে সক্ষম। সুতরাং রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ওষুধ শিল্পগুলি পরিচালনার কোনো প্রয়োজন নেই’।
ডিভিশন বেঞ্চে মামলা চলার ফলে বেঙ্গল কেমিক্যালস বিক্রি না করতে পারায় কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত করতে শিল্পের পরিচালকমণ্ডলী তিন দশক কোনো নিয়োগ না করে, অবসর ও স্বেচ্ছা অবসরের মাধ্যমে ক্রমাগত কর্মী সঙ্কোচন এবং উৎপাদন হ্রাস করে শিল্পকে স্বাভাবিক মৃত্যুর দিকে নিয়ে চলেছে। ১৯৮০ সালে শিল্প জাতীয়করণের সময় শ্রমিক-কর্মচারী ছিল ২৫০০ জন। বর্তমানে মাত্র ১৪০ জন স্থায়ী এবং প্রায় সম সংখ্যক চুক্তি ভিত্তিক শ্রমিক-কর্মচারী নিয়ে এই শিল্প চলছে।
দেশের বিভিন্ন সংকটে বিশেষকরে মহামারীর সময়ে বেঙ্গল কেমিক্যালস তার উৎপাদিত সামগ্রী নিয়ে মানুষের পাশে থেকেছে, ঠিক তেমনই আজ কোভিড-১৯ মোকাবিলায়ও তা সম্ভব। এছাড়া যে শিল্প প্রতিষ্ঠানের ওষুধ সাপের বিষের কবল থেকে বহু মানুষকে রক্ষা করেছে,সেই বেঙ্গল কেমিক্যালসকে কর্পোরেটদের হাতে তুলে দিতে চাইছে কেন্দ্রের সরকার। আজ দেশি-বিদেশি কর্পোরেট ওষুধ কোম্পানিকে লুটের মৃগয়া ক্ষেত্র তৈরির সু্যোগ করে দিতে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ নরেন্দ্রমোদী নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। আর এদিকে নীরব আমাদের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী।
তাই ঐক্যবদ্ধভাবেই কেন্দ্রীয় সরকারের জনস্বার্থ-বিরোধী বেসরকারিকরণের নীতি রুখে দিয়ে এই ঐতিহ্যবাহী শিল্প প্রতিষ্ঠানকে রক্ষা করতে হবে।