E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ৪৫ সংখ্যা / ২৫ জুন, ২০২১ / ১০ আষাঢ়, ১৪২৮

মিলখা সিং প্রয়াত


নিজস্ব সংবাদদাতাঃ থেমে গেলেন ‘উড়ন্ত শিখ’। ১৮ জুন গভীর রাতে কিংবদন্তি ক্রীড়াবিদ মিলখা সিংয়ের জীবনাবসান হয়েছে। ২৪ মে করোনা আক্রান্ত হবার পর একানব্বই বছর বয়স্ক মিলখা সিংকে চণ্ডীগড়ের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভরতি করা হয়। দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই অ্যাথলিটের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী সহ অন্যান্য বিশিষ্টজনেরা। ১৯ জুন চণ্ডীগড়ে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। করোনা পরবর্তী জটিলতায় পাচঁ দিন আগেই প্রাণ হারিয়েছিলেন তাঁর স্ত্রী নির্মল কউর।

১৯২৯ সালের ২০ নভেম্বর (অধুনা পাকিস্তানের) অবিভক্ত পাঞ্জাবের মুজফ্‌ফরগঞ্জ জেলার গোবিন্দপুরায় মিলখা সিংয়ের জন্ম হয়। দেশভাগের যন্ত্রণা নিয়েই স্বজনহারা মিলখা তাঁর দিদির সঙ্গে ভারতে এসে পৌঁছান কিশোর বয়েসেই।

অ্যাথেলেটিকসে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মিলখা সিং মোট পাঁচটি সোনা জিতেছেন। প্রথম ভারতীয় হিসেবে কমনওয়েলথ গেমসে ১টি ১৯৫৮ সালে,এশিয়ান গেমসে ১৯৫৮ এবং ১৯৬২-তে ২টি করে মোট ৪টি। কিন্তু এই পাঁচটা পদক এবং দেশে জেতা ভুরি ভুরি পদক জেতার সাফল্য শুধু নয়, ভারতীয় অ্যাথেলেটিকসে মিলখা সিংয়ের অবদান তার অনেক বেশি। স্বাধীনতার দেড় দশক পরেও ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের ২০০ বছরের হীনমন্যতা আর দেশভাগের দগদগে ক্ষতের মুখে তাঁর এইসব পদক জয় ছিল গরিমা আর স্বনির্ভরতার বহুমুখী প্রলেপ। ব্রিটেনের কার্ডিফে ৪৪০ গজের দৌড়ে তাঁর সোনা জয়ের পর স্টেডিয়ামে ‘জন গণ মন’ বেজে ওঠার সময় প্রায় ‘লাখখানেক গোরা’র উঠে দাঁড়িয়ে করতালি ও সম্মান জানানোর কথা নানা সাক্ষাৎকারে বারবার বলেছেন উচ্ছসিত মিলখা।

১৯৬০ সালে এগিয়ে থেকেও রোম অলিম্পিকে ০.১ সেকেন্ডের ব্যবধানে ব্রোঞ্জ পদক হাতছাড়া হয় তাঁর। এই হার নিয়ে দোষারোপের পরিবর্তে দেশজুড়ে সহানুভূতির ঢল তাঁকে লোকগাথার বিষাদ নায়কে পরিণত করে। দেশের তরুণ প্রজন্ম তাঁর সাফল্যে অ্যাথলেটিকসের প্রতি উৎসাহী হয়। মনে রাখতে হবে ওই ৪০০ মিটার দৌড়ের চূড়ান্ত পর্বে ২৫০ মিটার পর্যন্ত এগিয়ে ছিলেন তিনি। ছিলেন অন্যতম ফেভারিটও; যেখানে এশীয় তো দূরের কথা কোনও ব্রিটিশ দৌড়বাজও সেমিফাইনালের ধাপ টপকাতে পারেনি। হকির অলিম্পিক পদকজয়ীদের দেশে তাঁর ওই চতুর্থ হওয়া দৌড় ভারতের প্রায় পরিকাঠামোহীন অ্যাথেলেটিকসকে আন্তর্জাতিক ফোকাসে এনেছিল। তাঁর সাফল্যের মাপ হলো আজ পর্যন্ত কোনও ভারতীয় পুরুষ দৌড়বিদ অলিম্পিকে স্বল্প দৈর্ঘ্যের দৌড়ের মূলপর্বে পৌছাতে পারেনি। আধুনিক ‘রানিং শু’ বা জ্যাকেট-কোনও কিছুর সঙ্গেই তাঁর পূর্ব পরিচয় ছিল না। কী ছিল তবে? তিনি বলেছেন, ‘আগ থা অন্দর!’ (আমার ভেতরে আগুন ছিল)।

স্বাধীনতার পর ভারতে আসার সময় দাঙ্গায় স্বজন হারানোর যন্ত্রণা আর ক্ষোভের আগুন সঙ্গী ছিল তাঁর। চোখের সামনে বাবা-কাকাদের খুন হতে দেখে বাড়ি ছেড়ে পালান তিনি। তারপর দিল্লিমুখী ট্রেনের মহিলা কামরায় যাত্রীদের কাছে কিশোর মিলখা রীতিমতো প্রাণভিক্ষা করে জায়গা পান। সিটের নিচে লুকিয়ে দিল্লিতে পৌঁছালে তাঁর আর তাঁর দিদির জায়গা হয় উদ্বাস্তু শিবিরে। পুরনো দিল্লির স্টেশন চত্বরে ঝাঁট দেওয়া থেকে ছোটো খাটো চুরি করে জেলযাত্রা সবই ঘটেছে তাঁর জীবনে। দিদি ইশভার নিজের গয়না বেচে তাঁর জামিন করিয়েছেন। দু’মুঠো খাবারের অনিশ্চিয়তার দোলাচলে অন্ধকার জগতের হাতছানি প্রথমে এড়াতে পারেননি তিনি। কিন্তু হারিয়ে না গিয়ে আবার সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসে তারকা দৌড়বিদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন নিজেকে, পেয়েছেন পদ্মশ্রী সম্মান (১৯৫৯)। সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে ৩ বার বিফল হবার পর ১৯৫১ সালে সফল হন তিনি। সেখানেই দৌড়বিদ হিসেবে মিলখার জীবনের মোড় ঘোরে। তাঁর রোম অলিম্পিকের রেকর্ড প্রায় ৩৮ বছর অক্ষত ছিল। ১৯৬৪’র অলিম্পিকের পর অ্যাথটলেটিকস থেকে অবসর নিলেও ১৯৬১-তে পাঞ্জাব সরকারের ক্রীড়া বিভাগের ডেপুটি ডিরেক্টরের চাকরি নেন। সেসময় তিনি রাজ্যে স্কুল পাঠক্রমে খেলাধুলা বাধ্যতামূলক করেছিলেন।

২০১৩ সালে তাঁকে অর্জুন পুরস্কার দিতে গেলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯৬১ সালে চালু হওয়া অর্জুন পুরস্কার এত পরে দিতে চাওয়া সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য, এম এ পাস কৃতি’কে এ যেন ম্যাট্রিক পাসের সার্টিফিকেট দেওয়ার মতো ব্যাপার! পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকারের আমলে তাঁকে সম্মানিত করা হয় নয়ের দশকে। তাঁর আত্মজীবনী ‘দ্য রেস অব মাই লাইফ’ অবলম্বনে বায়োপিক ‘ভাগ মিলখা ভাগ’ চলচ্চিত্র সাড়া ফেলে দেয় এই উপমহাদেশের বাইরেও। গলফ খেলোয়াড় পুত্র জীব মিলখা সিংহ ছাড়াও মিলখা রেখ গেলেন তিন মেয়ে মোনা সিংহ, আলিজা গ্রোভার এবং সোনিয়া সানওয়ালকাকে।