৫৮ বর্ষ ৪৫ সংখ্যা / ২৫ জুন, ২০২১ / ১০ আষাঢ়, ১৪২৮
অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, পেট্রোল-ডিজেলের দাম আকাশছোঁয়া - সরকার নীরব
ঈশিতা মুখার্জি
এই দুই মাসের মধ্যে পেট্রোল ডিজেলের দাম কেন্দ্রের মোদী সরকার ২৯ বার বাড়িয়েছে। এমনিতেই দেশজোড়া রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধি, তার মধ্যে এই দাম বাড়া দেশের মানুষে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম একেবারে নাগালের বাইরে নিয়ে গেল। দেশের তেল কোম্পানিগুলি ক্রমাগত এই দাম বাড়িয়ে চলেছে। এর ফলে স্বাভাবিকভাবেই জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। বিশেষকরে বাড়ছে খাদ্যপণ্যের দাম। পেট্রোল ডিজেলের দাম কতবার কিভাবে বেড়েছে? এটা কী আমাদের দেশ এড়িয়ে যেতে পারত না? এই তীব্র আর্থিক সঙ্কটের মধ্যে এই মারাত্মকহারে তেলের দাম, রান্নার গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়া - এ কী করে লাগামছাড়া হলো এর সহজ একটিই উত্তর হয় লাগাম পড়ানোর কোনো চেষ্টা সরকার করেনি, যেমন অন্যান্য ক্ষেত্রেও সরকার করছেনা। পেট্রোল ডিজেলের দামকে খোলাবাজারে শুধুমাত্র ওঠানামাই করতে দেয় নি সরকার, এর উপর কোনো পণ্য পরিষেবা কর বা জিএসটি বসানো হয়, বরং পরোক্ষ কর বসানোর এক ক্ষেত্র বলে এটিকে সরকারের অর্থাৎ কেন্দ্র এবং রাজ্য উভয় সরকারেরই এক কর সংগ্রহ বা রাজস্ব আয়ের ক্ষেত্র বলে একে গণ্য করা হয়। সুতরাং এই পেট্রোল-ডিজেলকে সরকার এক ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখে। আর এর ফলেই বাড়ছে দেশবাসীর বিপদ।
পেট্রোল-ডিজেলের দাম বিদেশের বাজারে বেড়ে যাওয়া বা কমে যাওয়ার সাথে এটা ভাবার কোনো কারণ নেই যে, সেই একইভাবে এদেশে দাম বারবে এবং কমবে। নিচের সারণি বুঝিয়ে দিচ্ছে কিভাবে পেট্রোল-ডিজেল বিদেশের বাজারে দামের তারতম্যের সাথে আমাদের দেশে দামের ফারাক তৈরি হচ্ছে শুধুমাত্র দেশের অভ্যন্তরে কর এবং কেন্দ্র-রাজ্য এই দুই সরকারের কর বসানোর ক্ষেত্র হিসেবে এটিকে দেখার জন্য।
সারণি ১ - পেট্রোল-ডিজেলের দাম নির্ধারণ
সারণী থেকেই বোঝা যাচ্ছে, দামের দুই তৃতীয়ংশই কর বাবদ হয়ে আসছে। ২০১৫ সালে যখন আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমে গিয়েছিল, তখন এই করের অংশ বাড়িয়ে দেওয়া হলো। অর্থাৎ দেশবাসী কোনো দিনই এই বিষয়ে সুখের মুখ দেখেনি। আজ যখন দেশের পেট্রোপণ্য বিষয়ক মন্ত্রী বলেন যে, এই মূল্যবৃদ্ধি না হলে সরকারের রাজস্ব আয় হবে না; আর তা না হলে সরকার জনকল্যাণে ব্যায় করতে পারবে না, তখন তা দেশবাসীর প্রতি কার্যত উপহাস ছাড়া আর কিছুই নয়। অতিমারীর বিপর্যয়, বুভুক্ষু দেশবাসী, আর্থিক মহামন্দা-এই সময়কেই বেছে নিয়েছে সরকার তেল থেকে কর আদায় করে রাজস্ব সংগ্রহ করার জন্য। এর চেয়ে দেশের স্বার্থবিরোধী পদক্ষেপ আর কিছু হতে পারে? কলকাতায় পেট্রোল ডিজেলের দামের মাত্র কয়েক দিনের ওঠাপড়া নীচের সারণি ২-তে দেওয়া হলো।
সারণি ২ - কলকাতায় গত কয়েকদিনে দামের ওঠাপড়া
প্রতিদিন এইভাবেই অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে পেট্রোল-ডিজেলের দাম। একেবারে লাগামছাড়া এই ওঠাপড়া। এই দাম বৃদ্ধির ফল পড়ল পণ্যের মূল্যসূচকের উপর। পাইকারি পণ্যের মূল্যসূচকের রেকর্ড বৃদ্ধি হলো এই জুন মাসেই ১২.৯৪%। এর সাথেই ভোগ্যপণ্যের মূল্যসুচক বাড়ল ৬.৩০%। এটিও রেকর্ড। জিনিষপত্রের দাম প্রায় ঘোষিতভাবেই রেকর্ড বৃদ্ধি হলো, কিন্তু সরকার-বিশেষকরে কেন্দ্রের সরকার এ বিষয়ে নির্বিকার। রাজ্য সরকারও পেট্টল, ডিজেলে তার করের অংশে ছাড় দিল না মানুষের কষ্ট লাঘব করার জন্য। গত পাঁচ মাস ধরেই মুদ্রাস্ফীতির হার ঊর্ধ্বগামী। এবারে তা রেকর্ড ছাড়াল। এই দাম বৃদ্ধির মধ্যে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে সবচেয়ে বেশি হারে। ভোগ্যপণ্যের মূল্যসুচকের মধ্যে খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির হার মে মাসে ছিল ৫.০১% যা জুন মাসে আরও বেড়ে গেল। ভোজ্য তেলে মুল্যবৃদ্ধির হার ৩০.৮% এবং ডালের মুল্যবৃদ্ধির হার ৯.৩%। দেশের মানুষ কী খাবেন? সরকার এবারো নিরুত্তর। এটি পরিসংখ্যানের শুধু কথা তো নয়, এটি মানুষের বেঁচে থাকার মৌলিক প্রশ্ন। সব কিছুর কারণ হিসেবে অতিমারীকে দেখিয়ে দিলে কী সরকার তার দায় এড়াতে পারে? অতিমারী মোকাবিলা করা তো সরকারের কাজ ছিল। তা ছাড়া অতিমারী আসার বহু আগে থেকেই, কার্যত অতিমারীর আগের বছরেই মুল্যবৃদ্ধির এই গতি প্রকৃতি বোঝা গিয়েছিল। অতিমারী সেই প্রবণতাকে খুব তাড়াতাড়ি আরও বড়ো আকারে সামনে নিয়ে এসেছে। সঙ্কট ঘনীভুত হয়েছে অতিমারীতে, কিন্তু সঙ্কট তো ছিলই আর এই সঙ্কটের জন্য সরকার ছাড়া আর কেউ দায়ী ছিল না। কেন মুল্যবৃদ্ধি রুখতে কোনো নীতি গৃহীত হয়নি? কেন পেট্রোল, ডিজেলের দামের উপর লাগাম পড়ানো হলো না? কেন তাকে একটি পণ্য পরিষেবা করের আওতায় আনা হলো না? তা হলে এই প্রতিদিন অনিশ্চিতভাবে তেলের দাম ওঠানামা করত না কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের উভয়ের কর বাবদ। দেশের মানুষের কোন্ নীতি নিলে প্রাণ বাঁচবে, তা না নিয়ে কোন্ নীতি নিলে সরকার বাঁচবে সেই নীতি নেওয়া হলো। এর ফলে যা হওয়ার ছিল তাই হয়েছে - মোদী সরকারের পৌষমাস, দেশবাসীর সর্বনাশ। পেট্রোল, ডিজেলের এই দাম বৃদ্ধি পেট্রোলের দামকে লিটার পিছু যখন ১০০ টাকায় নিয়ে চলেছে, তখনই জানা যাচ্ছে যে দেশের আর্থিক মন্দা থেকে বেড়িয়ে আসা আরও কঠিন হয়ে উঠছে। কাজ হারানো শ্রমিকের কাজ পাওয়া আরও কঠিন হয়ে উঠছে। নিরন্ন মানুষের মুখে অন্ন জোটানো আরও কঠিন হয়ে উঠছে। এ সবের জন্য বৃহৎ গণআন্দোলন ছাড়া বাঁচবার আর কোনো রাস্তা এই মুহূর্তে খোলা নেই।