৫৮ বর্ষ ৪৫ সংখ্যা / ২৫ জুন, ২০২১ / ১০ আষাঢ়, ১৪২৮
বামফ্রন্ট সরকারের সাফল্য চিরউজ্জ্বল
সুপ্রতীপ রায়
৪৪ বছর আগে ১৯৭৭ সালের পশ্চিমবাংলায় বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ৩৪ বছর ধরে নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যে দিয়ে এই সরকারের প্রতিটি সিদ্ধান্ত ছিল ঐতিহাসিক। এ ইতিহাস হাজার চেষ্টাতেও মোছা যাবে না। কিন্তু কেন? কারণ বামফ্রন্ট সরকারের কাছে অভিমুখ ছিল গরিব মানুষ, মেহনতি মানুষ। ১৯৭৭-২০২১ - এই ৩৪ বছর একটি রাজ্য সরকার মানুষের স্বার্থে যে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত ও কর্মসূচি নিয়েছিল তা চিরকাল উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।
বামফ্রন্ট সরকারের কাছে প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল পশ্চিমবাংলায় গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনা। গণতন্ত্রের সঙ্গে উন্নয়নের সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। বামফ্রন্ট শাসন ক্ষমতায় এসে সমাজের সব অংশের মানুষকে গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে দিয়েছিল। ১৯৭৮ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে পঞ্চায়েত নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। কর্পোরেশন, পৌরসভা, ছাত্র সংসদ নির্বাচন, বিদ্যালয় পরিচালন সমিতির নির্বাচন, সমবায় নির্বাচন, বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয় পরিচালন সমিতির নির্বাচন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে কোর্ট-কাউন্সিল বা সেনেট-সিন্ডিকেট নির্বাচন নিয়মিত হয়েছে বামফ্রন্ট আমলে। শ্রমিক-কর্মচারীদের গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
গ্রামীণ অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করেছিল বামফ্রন্ট সরকার। গ্রামীণ অর্থনীতি সফল হওয়ার ফলে বাংলার সার্বিক অর্থনীতি বদ্ধদশা থেকে মুক্তি পেয়েছিল। পর্বতপ্রমাণ সমস্যা নিয়েই ১৯৭৭ সালের ২১ জুন বামফ্রন্ট সরকার কাজ শুরু করেছিল। বামফ্রন্ট সরকার ভূমিসংস্কারের ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে। তখন তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে - (১) উদ্বৃত্ত জমি উদ্ধার ও ভূমিহীনদের মধ্যে বণ্টন, (২) ভূমিহীনদের মজুরির হার বৃদ্ধিতে উৎসাহ দান, (৩) বর্গাদারদের চাষের অধিকার বর্গা রেকর্ডিং-এর মাধ্যমে নিশ্চিত করা। ১৯৭৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বর্গাদার উচ্ছেদ বন্ধ করার জন্য ও তাদের অধিকারকে আইনি স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য ভূমিসংস্কার আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধন করা হয়। যদিও রাষ্ট্রপতির সম্মতি পেতে বেশ কিছু দিন সময় লেগেছিল। বর্গার নাম রেকর্ড করার উদ্দেশ্যে বামফ্রন্ট সরকার আইন করেছিল - রেকর্ড থাক বা না থাক জমিতে যে চাষ করবে প্রাথমিকভাবে তাঁকে বর্গাদার ধরে নেওয়া হবে।
বামফ্রন্ট সরকার নিয়ম করেছিল - ফসল পাবার পর জোতদারকে বর্গাদারের নাম, ফসলের পরিমাণ, জমির দাগ নম্বর, তারিখ ইত্যাদি দিয়ে একটি রসিদ দিতে হবে। রসিদ যদি কোনো কারণবশত না দেয়, তাহলে বর্গাদারদের অধিকার থাকবে সেই ফসলের ভাগ জোতদারকে না দিয়ে সরকারি অফিসের জেএলআরও’র হাতে তুলে দেওয়ার। বর্গাদারদের নাম রেকর্ড করার ব্যবস্থা করা হয়।
গ্রামাঞ্চলের ভূমিসংস্কারের সাফল্য এক কথায় ঐতিহাসিক। বামফ্রন্ট সরকারের ভূমিসংস্কার নীতির ফলে বেশিরভাগ জমি প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র চাষির হতে গিয়েছিল। ভূমিসংস্কারের সাফল্যের ফলেই কৃষি ও ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছিল। গ্রামাঞ্চলে প্রান্তিক মানুষ ও কৃষকদের ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছিল। গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙা হয়েছিল। কৃষি মজুরদের ন্যূনতম মজুরি নিশ্চিত হয়েছিল।
ভূমিসংস্কারের কাজকে কার্যকর করার জন্য ভূমিসংস্কার আইনের সংশোধনের মাধ্যমে জমি ন্যস্তকরণের কাজকে দ্রুত করা হয়েছিল। উচ্চ আদালতে মামলার কারণে যে সকল ক্ষেত্রে জমি বণ্টনের কাজ আটকে ছিল, বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মাধ্যমে সেগুলির দ্রুত নিষ্পত্তি করা হয়েছিল। স্বামী-স্ত্রীর নামে যৌথ পাট্টা বণ্টনের কাজ হয়েছিল। নারী শ্রমিকদের সমমজুরি এবং জমির উপর নারীদের সমান অধিকার প্রদান সুনিশ্চিত করা হয়েছিল। বামফ্রন্ট সরকারের ভূমিসংস্কারের ফলে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে উপকৃত পরিবারের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল প্রায় ৪৯ লক্ষ। এটি কৃষিনির্ভর পরিবারের প্রায় ৫০ শতাংশ । একথা স্বীকার করতেই হবে, বামফ্রন্ট সরকারের ভূমিসংস্কার নীতি জমির ক্ষেত্রে আধা-সামন্ততান্ত্রিক ও সামন্ততান্ত্রিক সম্পর্কের উপর আঘাত করেছিল।
ভূমিসংস্কারের কাজ করার ক্ষেত্রে বিশেষত ছিল আমলা নির্ভরতা হ্রাস করা ও জনগণকে যুক্ত করা। ১৯৭৮ সালের জুন মাসেই গৃহীত হয়েছিল প্রচলিত আইনের মাধ্যমে ‘অপারেশন বর্গা’ কার্যকর করার সিদ্ধান্ত ও কর্মপদ্ধতি। অপারেশন বর্গার সমগ্র প্রক্রিয়াটিকে কতগুলি ধাপ বা পর্যায়ে বিভক্ত করা হয়েছিল।
এগুলি হলো - (ক) বিভিন্ন কৃষক সংগঠন মারফত অগ্রাধিকার-ভিত্তিক অঞ্চল স্থির করা অর্থাৎ কৃষক সংগঠনগুলির সুপারিশে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বর্গাদার প্রধান মৌজা চিহ্নিত করা। পঞ্চায়েত ও কৃষক সংগঠনগুলিকে সংযুক্তির মূল লক্ষ্য ছিল - ভূমিসংস্কারের প্রধান প্রতিবন্ধক ঐতিহাসিকভাবে গড়ে ওঠা প্রশাসন ও সামন্ত প্রভুদের ভয়ে ভীত দরিদ্র চাষিদের প্রাতিষ্ঠানিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি; (খ) ভূবাসন ও ভূমিসংস্কার বিভাগের কর্মীদের নিয়ে স্কোয়াড গঠন করা; (গ) বর্গাদারদের নিয়ে সান্ধ্য সভা করা; (ঘ) মাঠে মাঠে সরেজমিনে তদন্ত করা; (ঙ) বর্গাদারদের নাম নথিভুক্ত করা, নথিভুক্তকরণের কাজে ভূমিসংস্কার আইনের ৫১নং ধারা অনুযায়ী পুরোপুরি প্রশাসনিক পদ্ধতি অনুসরণ করা।
বামফ্রন্ট সরকারের গ্রামীণ নীতির ফলে জমির পুনর্বণ্টনমুখী ভূমিসংস্কার তথা শ্রমনিবিড় প্রযুক্তির সাহায্যে যথাসম্ভব অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধি হয়েছিল। আমলা নির্ভরতা কাটিয়ে গ্রামীণ উন্নয়নে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও অংশগ্রহণ করেছিলেন গ্রামের গরিব মানুষ। গ্রামীণ ক্ষেত্রের সর্বাঙ্গীণ বিকাশের উদ্দেশ্যেই রাজ্য সরকার একই সঙ্গে কৃষি বিকাশ ও সংশ্লিষ্ট শ্রম-নিবিড় উদ্যোগের সাথে সাথে গ্রামীণ কুটির শিল্প, হস্তশিল্পের বৃদ্ধির উপর জোর দিয়েছিল। এই বিভিন্নমুখী প্রকল্পগুলি রূপায়িত হয়েছিল বিকেন্দ্রীকৃত পরিকল্পনার মাধ্যমে।
পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকারের সাফল্যগুলির মধ্যে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য হলো ভূমিসংস্কার আর বিকেন্দ্রীকরণ। বাম আমলে ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের ফলস্বরূপ গ্রামীণ উন্নয়নে অংশগ্রহণের সুযোগ লাভ করেছিলেন পাট্টাদার-বর্গাদাররা, যাঁরা এক সময়ে জমিদার-জোতদারদের সামনে কথা বলার সাহস পেতেন না। পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় পাট্টাদার-বর্গাদাররা ক্ষমতায়িত হয়েছিলেন, গ্রামীণ উন্নয়নে অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়েছিলেন।
কৃষি উৎপাদন, গ্রামীণ কর্মসংস্থান, মজুরি ও আয় এবং ভোগের জন্য ব্যয়ের পরিমাণ বৃদ্ধিতে যথেষ্ট ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল ভূমিসংস্কার ও বিকেন্দ্রীকরণ। বামফ্রন্ট সরকারের নীতির ফলে দীর্ঘদিনের স্থবিরত্ব কাটিয়ে বাংলার কৃষি উৎপাদন অগ্রগতির মুখ দেখেছিল। কৃষিতে স্থবিরত্ব কাটিয়ে ১৯৮৩-৮৪ সালে ৯২ লক্ষ ৯২ লক্ষ টন খাদ্যশস্য উৎপাদনের নজির গড়েছিল পশ্চিমবাংলা। ১৯৮১-৮২ থেকে ১৯৯১-৯২ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বৃদ্ধির বার্ষিক হার ছিল ৬.৫ শতাংশ, যা ভারতের ১৭টি বড়ো রাজ্যের মধ্যে সর্বাধিক।
বাম আমলে ভূমিসংস্কারের ফলে রাজ্যে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে গ্রামীণ কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পেয়েছিল। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি কৃষি শ্রমের বণ্টিত চাহিদা সৃষ্টি করেছিল যা গ্রামীণ মজুরি বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছিল। খেতমজুরের মজুরি বৃদ্ধির পাশাপাশি চাষিরা আয় বৃদ্ধিরও সহায়ক হয়েছিল কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধি।
৩৪ বছরের বামফ্রন্ট সরকারের গ্রাম উন্নয়নের নীতির ফলে গ্রামাঞ্চলে লক্ষণীয় পরিবর্তন ঘটেছিল। গ্রামীণ সমাজে ক্ষমতার ভারসাম্যের পরিবর্তন ঘটেছিল। দুর্বলতর অংশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের আত্মমর্যাদা ও আত্মবিশ্বাস প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বামফ্রন্ট সরকারের সঙ্গে পূর্ববর্তী সরকারের উন্নয়নমূলক কাজের মূল দৃষ্টিভঙ্গিগত ফারাক ছিল পরিষ্কার। শ্রেণিগত তফাত ছিল এক্ষেত্রে। ’৭৭-র বামফ্রন্ট সরকারের আগের সরকার যে টাকা খরচ করতো তার সিংহভাগই গিয়ে পৌঁছাতো গ্রামের ধনীদের কাছে। ফলে দরিদ্র মানুষ আরও দরিদ্র হয়েছিলেন। বামফ্রন্ট সরকার যাঁরা সবচাইতে গরিব তাদের জন্য বেশি অর্থ বরাদ্দ করেছিল। বামফ্রন্ট সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সাধারণ মানুষ, প্রান্তিক অংশের মানুষরা নিজের পায়ে দাঁড়াক। তাঁরা নিজেরা সম্পদ সৃষ্টি করুন ও তা ভোগ করুন। এটি সফল হলে পশ্চিমবাংলার গ্রামীণ অর্থনীতি সচল হবে। সাতটি বামফ্রন্ট সরকার একাজে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছিল।
বামফ্রন্ট আমলে গ্রামীণ উন্নয়নের দু’টি স্তম্ভ ছিল ভূমিসংস্কার ও পঞ্চায়েত ব্যবস্থা। ভূসম্পর্কের পরির্তন ও ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ একে অপরের পরিপূরক হিসাবে কাজ করেছে। নির্বাচিত পঞ্চায়েত ব্যবস্থা আসলে সামন্ততান্ত্রিক সামাজিক সম্পর্কের মূলে আঘাত হেনেছিল। পঞ্চায়েতি ব্যবস্থা ও ভূমিসংস্কার কৃষকের আর্থিক ক্ষমতাকে বাড়িয়েছিল।
বামফ্রন্ট সরকারের কর্মসূচির মধ্যে দিয়ে সার্বিক গ্রামোন্নয়ন ঘটেছিল। অনুন্নত, পিছিয়ে-পড়া আদিবাসী ও তফশিলি অংশের মানুষ উন্নয়নের সুফল পেয়েছিলেন। উন্নয়নের কাজে স্থানীয় শ্রম ও স্থানীয় সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করেছিল। গ্রামীণ উন্নয়নের মধ্য দিয়ে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও কৃষি মজুরের কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পেয়েছিল।
ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের প্রথম ধাপ হিসাবে ১৯৭৮ সালে জুন মাসে ত্রিস্তর পঞ্চায়েত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। প্রতি পাঁচ বছর অন্তর নিয়মিত পঞ্চায়েত নির্বাচন বামফ্রন্ট আমলে সম্পন্ন হয়েছিল। নির্বাচিত পঞ্চায়েতের হাতে গ্রামোন্নয়নের দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয়েছিল। বামফ্রন্ট সরকার দরিদ্র গ্রামবাসীদের সাহায্যে গ্রামীণ উন্নয়ন করেছিল। গ্রামোন্নয়নের নীতির ফলে কৃষির উৎপাদন ও শিল্প বিকাশের মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, গ্রামীণ ধনী এবং গরিবের মধ্যে অসাম্য অনেকটা দূর হয়েছিল। কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছিল। বামফ্রন্ট সরকারের উদ্যোগের ফলেই সম্পদ সংগ্রহ ও বণ্টনের মাধ্যমে সময়ের ব্যবধানে জনকল্যাণ ও উৎপাদনমূলক কাজকর্মের মধ্যে একটি সমন্বয় সাধিত হয়েছিল।
বামফ্রন্ট সরকারের গ্রামীণ উন্নয়নমূলক ব্যাপক কর্মকাণ্ড গ্রামবাংলায় পরিবর্তন সূচিত করেছিল। গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে সাধারণ গরিব চাষিদের হাতে কৃষি উপকরণ সুলভে সরবরাহ করা হয়েছিল। ১৯৭৭ সালের আগে কৃষকদের সাহায্যের যা কিছু ব্যবস্থা ছিল, তা কুক্ষিগত ছিল ধনী কৃষক, জোতদার ও প্রতিক্রিয়াশীলদের হাতে। বামফ্রন্ট সরকারের কৃষকদরদি নীতির ফলে অধিক পরিমাণে কৃষির উপকরণ কৃষকের হাতে পৌঁছানো সুনিশ্চিত হয়েছিল। দামের ক্ষেত্রে কৃষি পণ্যের উচ্চ মূল্য আদায় সম্ভব হওয়ার ফলে কৃষি উৎপাদন লাভজনক হয়েছিল।
ভূমিসংস্কারের সাফল্যকে কাজে লাগাতে বামফ্রন্ট সরকার গুরুত্ব দিয়েছিল রাজ্যের শিল্পায়নে। শিল্পে বিনিয়োগ ক্রমাগত বাড়তে থাকে। ২০০৯ সালে বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৮,৪০০ কোটি টাকারও বেশি। ২০১০ সালে বিনিয়োগের পরিমাণ ১০,০০০ কোটি টাকা অতিক্রম করে। বামফ্রন্ট সরকারের আমলে তথ্য প্রযুক্তিতে পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগ বেড়েছে বহুগুণ। বৃদ্ধি পায় কাজের সুযোগ। পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়ন প্রক্রিয়া ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির স্বীকৃতি হিসাবে রাজারহাটে দেশের দ্বিতীয় ‘ফিনান্সিয়াল হাব’র সূচনা হয়। ক্ষুদ্র শিল্পের ক্ষেত্রে সংস্থার সংখ্যা ও কর্মসংস্থান উভয় বিচারেই পশ্চিমবঙ্গ দেশের মধ্যে প্রথম স্থান অর্জন করে। হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালস পশ্চিমবঙ্গে শিল্পে পুনর্জাগরণের প্রতীক।
বামফ্রন্ট সরকারের শিক্ষানীতির অভিমুখ ছিল যাতে সমাজের একেবারে প্রান্তিক অংশের মানুষের কাছে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা পৌঁছায়। সেকাজে সাফল্য অর্জিত হয়েছে। নতুন নতুন মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে। কেবলমাত্র সপ্তম বামফ্রন্টের সময় রাজ্য সরকারের উদ্যোগে স্থাপিত হয়েছে ৫টি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় ও ৭৩টি ডিগ্রি কলেজ।
বিদ্যুৎ পরিস্থিতি অভূতপূর্ব উন্নতি ঘটেছে বামফ্রন্ট আমলে। ১৯৭৭ সালে পশ্চিমবঙ্গে বিদ্যুৎ উৎপাদন হতো মাত্র ১৭০০ মেগাওয়াট। ২০১০ সালে সেই পরিমাণ দাঁড়ায় ৬৮৩৩ মেগাওয়াট। পিছিয়ে-পড়া মানুষের পাশে বন্ধুর মতো দাঁড়িয়েছিল বামফ্রন্ট সরকার। প্রতিবন্ধী ভাতা, বার্ধক্য ভাতা, আদিবাসী বার্ধক্য ভাতা, মৎস্যজীবীদের ভাতা, কৃষক ভাতা, বিধবা ভাতার মতো প্রকল্পগুলি থেকে অসহায় মানুষ নিয়মিত সহায়তা পেয়ে এসেছেন।
সংখ্যালঘু উন্নয়নে বামফ্রন্ট সরকারের অবদান অনস্বীকার্য। ৫৩টি মুসলিম জনগোষ্ঠীকে ওবিসি হিসাবে সংরক্ষণের আওতায় আনে বামফ্রন্ট সরকার। ১৯৭৬-৭৭ সালে মাদ্রাসা শিক্ষার উন্নয়নের রাজ্য সরকার খরচ করতো মাত্র ৫ লক্ষ ৬০ হাজার টাকা। ২০০৯-১০ সালে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ১০ কোটি টাকা। ২০০৮ সালে মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশন গঠিত হয়। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে পশ্চিমবঙ্গ সংখ্যালঘু উন্নয়ন ও বিত্ত নিগম ২০০৯-১০ সালে ১১৬.৫০ কোটি টাকা মঞ্জুর করে ৩ লক্ষ ৪৫ হাজার জনকে সাহায্য করেছে।
বাম আমলে বাংলায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অটুট ছিল। বারংবার সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরির চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু রাজ্য সরকারের দৃঢ় অবস্থানের ফলে বিভাজনের শক্তি পরাস্ত হয়েছে। ইন্দিরা গান্ধী হত্যার পর গোটা দেশে যখন শিখ নিধন যজ্ঞ চলেছিল, তখন এ রাজ্যের শিখরা ছিলেন নিরাপদে। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর সারা দেশে দাঙ্গার আগুন জ্বললেও বাংলা ছিল দাঙ্গা মুক্ত। ২০১১ সালের পর এই সমস্ত ক্ষেত্রেই পশ্চিমবাংলার ঐতিহ্য ও সাফল্য বিনষ্ট হয়েছে।