৫৮ বর্ষ ৪৫ সংখ্যা / ২৫ জুন, ২০২১ / ১০ আষাঢ়, ১৪২৮
সোচ্চার চিন্তা
হিন্দি কি সত্যি-সত্যিই একটাই ভাষা?
পল্লব সেনগুপ্ত
গণপরিষদে রাষ্ট্রের কার্যনির্বাহী ভাষা নিয়ে বলছেন জওহরলাল নেহরু।
বিলিতি প্রবাদ আছে, ‘‘ঝামেলায় পড়লে শয়তানও শাস্ত্রর আওড়ায়!’’ (When in trouble, the Devil also quotes Scriptures)... তো, বহুদিন পরে কথাটা ফের মনে পড়ল সাম্প্রতিক কিছু কাজকর্ম দেখে। দেশ স্বাধীন হবার পর এই প্রায় সাড়ে চুয়াত্তর বছর ধরে, মূলত হিন্দিভাষীদের চাপেই, কেন্দ্রে যখনই যে সরকার গদিয়ান হয়েছে,তারাই একটা মিথ্যে কথাকে সত্যি বলে চালাতে চেয়েছে যে, ভারতের রাষ্ট্রভাষা হলো হিন্দি এবং সেটা দেশশুদ্ধ সবাই না-হোক অধিকাংশ মানুষই (না কি) বোঝে ! এ ব্যাপারে কংগ্রেস, জনতা, বিজেপি কেউই কারুর থেকে পিছিয়ে নেই ! (যদিও, ১৯৪৬ সালে গণপরিষদে যেটা মাত্র এক ভোটে উৎরে গিয়েছিল - তা হলো: হিন্দি নয় হিন্দুস্তানি হবে ইংরেজির সঙ্গে সরকারিভাবে যোগাযোগের ভাষা। মাত্র ক’দিন আগেই এক জনের আর টি আইয়ের উত্তর দেবার সূত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকেও এমনটাই জবাব দেওয়া হয়েছে!)... দ্বিতীয়বার বিজেপি ক্ষমতায় ফেরার পরে হিন্দি নিয়ে সেই স্টিম রোলার চালানোর উৎসাহটা আরও চাগাড় দিয়েছে নাগপুরি-বাবুদের ‘হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্থান’ জিগিরটা পুনরুজ্জীবিত করার নির্দেশ জারি হবার কারণে। যে জন্যে ইংরেজিতে গোছানো বয়ান পাঠানো সত্ত্বেও সব রাজ্যের কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলিকে হুকুম দেওয়া হয়েছে যে, ওতে চলবে না, কমপক্ষে শতকরা ষাট ভাগ রিপোর্ট ‘‘রাষ্ট্রভাষামে দেনা পরেগা হরগিজ !’’ ...যদিও, হিন্দি আমাদের রাষ্ট্রভাষা নয়, সংবিধানের ৮ম সিডিউলে উল্লেখিত সমস্ত জাতীয় ভাষার অন্যতম মাত্র।
[দুই]
যে উপলক্ষ্যে এতগুলো কথা বললাম, আপাতত সেই কথাতেই আসি। হিন্দি চালানোর ব্যাপারে যতই অতি-উৎসাহ দেখাক না-কেন বিজেপি সরকার, এই কোভিড-১৯ মহামারীর রাক্ষসী বেলায়, তারা বেশ হাপ্সে গিয়ে নানা ক্ষেত্রেই হিন্দির পরিবর্তে স্থানীয় সব ছোটো-ছোটো ভাষাতে মানুষকে সচেতন করতে বাধ্য হচ্ছে। যে-হিন্দিতে ‘‘দেশকা সারে সে সারে আদমি আউর ওউরতোকো আপ্না জুবান’’ বলে ঢক্কানিনাদে কান ফাটায় নাগপুরিয়া নেতাদের চেলা চামুণ্ডারা, সেই হিন্দি কিন্তু অকেজো হয়ে যাচ্ছে দেশের নানা ক্ষেত্রেই। খাস দিল্লির একশো-দেড়শো কিলোমিটার দূরেই বিভিন্ন বিভিন্ন অঞ্চলে হিন্দির মাধ্যমে মানুষকে কোভিড সংক্রমণ ঠেকাতে কী কী করণীয় - তা যখন ভালোভাবে বোঝানো গেল না, তখন সরকারি কর্তাব্যক্তিরা ভেবেচিন্তে যে-উপায় বার করলেন, সেটা হলো, উত্তর ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের ছোটো ছোটো স্থানীয় ভাষাতে নুক্কড়-নাটক (ওরফে, পথনাটক) অভিনয়ের ব্যবস্থা করা। আঞ্চলিক লোকগীতির প্রচলিত সব বিভিন্ন সুরে-বাঁধা গানের মুশায়রা করে, ওই সব ভাষায় যাঁরা কথা বলেন, তাঁদের সঙ্গে সেই-সব ভাষাতেই ভাববিনিময় করে সচেতন করা। এই সব প্রচেষ্টার জন্য দিল্লির মেট্রোপলিটন কাউন্সিল রীতিমতো প্রশিক্ষণও দিচ্ছে, যাতে প্রচার কর্মীরা হিন্দির পরিবর্তে ওই ভাষাগুলির মাধ্যমে মানুষকে বোঝাতে পারেন। অবশ্য এই বোধোদয়টা ওঁদের আকস্মিকভাবে সদ্বুদ্ধির ঘুমভাঙার কারণে হয়েছে, না কি 'হু' (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা) দুনিয়ার সব দেশকে এমন পরামর্শ দেবার বাবদে ঘটেছে, তা জানিনে কিন্তু!
এর কিছুকাল আগেই অবশ্য আঞ্চলিকভাবে ছত্তিশগড় এবং রাজস্থানের কোনও কোনও অঞ্চলে, বিদর্ভের কিছু কিছু এলাকায় যেসব জায়গার মানুষের একেবারে ঘরোয়া, দৈনন্দিন তেল-নুন-লাকড়ি-সবজি-আটার জীবনের ব্যবহারিক ভাষায় বোঝানো হয়েছে করোনার বিপদ এবং তার থেকে রেহাই পাবার পদ্ধতির কথা। বিদর্ভের কোর্কুভাষী অঞ্চলে, রাজস্থানের ওয়াগদিভাষীদের মহলে, ছত্তিশগড়ের গোন্দ্ভাষীদের এলাকায় এই পরিক্ষাটা ভালোভাবেই উৎরে গেছে। প্রসঙ্গত বলি, ওই তিন রাজ্যে কিন্তু বিজেপি ‘হুকুমৎ’(!) বর্তমানে নেই।
[তিন]
এই বিষয়টা কিন্তু বিশেষভাবে অনুধাবনযোগ্য। স্তালিনের নামটুকু শুনলেও যাঁরা সাত ঘটি জল খেয়ে গায়ের জ্বালা মেটান, তাঁরাও কিন্তু অস্বীকার করতে পারবেন না যে, বিপ্লব-পরবর্তী সোভিয়েত রাশিয়ায় ওই মানুষটিই রুশ কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বের সকলকে সচেতন করেছিলেন এমন একটা পদ্ধতি অবলম্বনের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে। প্রাক্-বিপ্লব আমলে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এশিয়া মহাদেশের লাগোয়া (সোভিয়েত) রাশিয়ার বিস্তীর্ণ, বিশাল বিশাল এলাকাজুড়ে যেসব যাবাবরতুল্য বা দ্বৈপায়ন জীবনে অভ্যস্ত গ্রামীণ মানুষ বাস করতেন, তাঁদের একটা করে মুখের ভাষা ছিল বটে, কিন্তু না ছিল লিপি, না ছিল যথার্থভাবে স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন ধারনের মতো শিক্ষার পরিবেশ। স্তালিনই তাদের নিজস্ব ভাষাগুলিকে কীভাবে আধুনিক জীবনের উপযোগী করে তোলা যায় সে বিষয়ে প্রথম ভাবতে শুরু করেন। এবং প্রাথমিক পর্যায়ে পার্টি কর্মীদেরকে ওইসব অঞ্চলের একান্তভাবে স্থানীয় সীমানায় আবদ্ধ ভাষাগুলিতে রপ্ত হয়ে সেখানকার মানুষদের সঙ্গে মেলামেশা করতে বলেন। অল্পসময়ের মধ্যে সোভিয়েত রাশিয়ার জন্য জীবনের মূল স্রোতের সঙ্গে উজবেক, কির্ঘিজ, তুর্কমেনি, আজারবাইজানিরা মিশে গেলেন এবং কালে-দিনে তাঁদের নিজেদের নিয়ন্ত্রণে, পার্টির সহযোগিতায় গড়ে উঠলো এক-একটি স্ব-শাসিত প্রজাতন্ত্র - বৃহত্তর ইউনাইটেড স্টেটস অব সোভিয়েত রিপাবলিকসের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে। এই বিকাশের জাদুকাঠি ছিল প্রারম্ভিক পর্বে ওই রিপাবলিকগুলির নিজস্ব সব ভাষাবর্গের প্রতি মনোযোগ দেওয়াটাই। রুশ কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীবৃন্দ সেইসব ভাষা রপ্ত করেই স্থানীয়ভাবে মিশতে পেরেছিলেন, ওখানে পার্টিও গড়ে তুলতে পেরেছিলেন। এই পার্টি গড়ে তোলার ব্যাপারটা অবশ্য রবীন্দ্রনাথের ‘রাশিয়ার চিঠি’ (১৯৩০) বইতে পাবেন না; কিন্তু তাতে মাত্র তেরো বছরের মধ্যেই কীভাবে প্রায় মধ্যযুগীয় জীবনযাত্রা থেকে আধুনিক জীবনচর্চায় উন্নীত হন ওই সব প্রদেশগুলির (পরবর্তীকালে যারা ‘রিপাবলিক’ পদে স্থিত হয়) মানুষরা তার সপ্রশংস বিবরণ আছে।
ঠিক এমনটাই বিপ্লব-পূর্ব চিনের ‘লংমার্চ’-এর বেলাও ঘটেছে ! চিনা কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব মাদাম তিঙ লিঙ-কে সংস্কৃতি বিষয়ে ভাবনাচিন্তা,পরিকল্পনা ইত্যাদি করার দায়িত্ব দেন। তিনি পার্টি কর্মীদের শেখান কীভাবে বিশাল ওই দেশের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলিতে গিয়ে, সেসব জায়গার স্থানীয় ভাষায় রপ্ত হয়ে, স্থানীয় সংস্কৃতির নানা বিষয়ে ওয়াকিবহাল হয়ে, সেখানকার প্রচলিত লোকসঙ্গীত, লোকনৃত্য, লোকনাটক, লোককথা ইত্যাদির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হয়ে, সেইসব ভাষায়, সেই সমস্ত লোকসাংস্কৃতিক সৃষ্টির আদলে আধুনিককালের ভাবনা, কমিউনিজমের মূল কথা, কমিউনিস্ট পার্টির গণ-উন্নয়ন প্রকল্প ইত্যাদি বিষয়ে প্রচার করতে থাকেন। ফলে, আঞ্চলিক ভাষা এবং সংস্কৃতির মাধ্যমেই পার্টির ভাবনাগুলো মানুষের মনে গভীরভাবে ছাপ ফেলে। এরপরে যখন পার্টির নেতৃত্বে লালফৌজ সেখানে যায় এবং স্থানীয় মধ্যযুগীয় মানসিকতার ধারক (মান্দারিন) শাসকদের সরিয়ে দিয়ে বিপ্লবী সরকারের পত্তন করে, তখন তাতে বিশেষ সুবিধাই হয় কিন্তু!
[চার]
বিজেপি (এবং আরএসএস) আরও একটা ভাষাকেন্দ্রিক ব্যাপারে অতিসম্প্রতি হোঁচট খেয়ে, নিজেদের ‘হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্থান’ ক্যাম্পেন বন্ধ রেখে, অন্যসব ‘জাতীয়’ ভাষাকেও ব্যবহার্য বলে মানতে বাধ্য হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার একটি সাম্প্রতিক প্রকল্পে সরকারি আধিকারিক এবং সাংসদদের বিভিন্ন ভাষায় সড়গড় করার উদ্যোগ নিয়েছে। মান্যবর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রীমদ্ অমিত শাহবাবু কিছুকাল আগে (মনে হচ্ছে, সেপ্টেম্বর, ২০১৯-এ) একটা হুঙ্কার ছেড়েছিলেন এই মর্মে যে, তাঁদের লক্ষ্য ‘‘এক রাষ্ট্র, একই ভাষা’’। যস্যার্থ: ওই ‘একই’ ভাষা হলো (বলাইবাহুল্য!) হিন্দি। যদিও এই মহাবিদগ্ধ(!) রাষ্ট্রনেতাটি ভুলেই গেছেন যে (হয়ত জানেনই না!) বিশ্বের বহু রাষ্ট্রেই একের বেশি (এমনকি তিনটিও যথা, সুইৎজারল্যান্ডে) রাষ্ট্রীয় ভাষা প্রচলিত আছে। অমিত শাহবাবুর সেই হুংকার স্তিমিত হয়ে গিয়েছিল বহু দিক থেকেই (বিশেষত, দক্ষিণভারত) প্রবল প্রতিবাদ ওঠায়।
তা সে যাই হোক, এবারের ঘটনাটা আরও মারহাব্বা! ওই অনলাইন ভাষা তালিমের সিলেবাস প্রথমে করা হয়েছিল এইরকম: ছ'টি ভারতীয় ভাষা - বাংলা (কিমাশ্চর্যমতঃ পরম্!), গুজরাটি, মারাঠি, তামিল, তেলুগু এবং ওড়িয়া। বিদেশি ভাষা - ফরাসি, পর্তুগিজ, জাপানি, রুশি, স্পেনীয় ও জার্মান। দ্বিতীয় পর্যায়ে ছিল প্রথমবারের ভাষাগুলির সঙ্গে হিন্দি, সংস্কৃত, মালয়ালম। আর এদের সঙ্গে তৃতীয় পর্যায়ে যুক্ত হয়েছে, কাশ্মীরি, সিন্ধি, অসমিয়া, উর্দু, সাঁওতালি, নেপালি, মণিপুরি, বোড়ো, ডোগ্রি, কোংকনি, মৈথিলি ও পাঞ্জাবি। ...দেখা গেল যে, এই তালিকায় অন্যতম প্রধান ভারতীয় ভাষা কানাড়ি বাদ চলে গেছে। এনিয়ে কর্ণাটকে প্রবল বিক্ষোভ শুরু হয় এবং প্রমাদগুণে কেন্দ্রীয় সরকার ঝটিতি কানাড়িকে দ্বিতীয় পর্যায়ে ঢুকিয়ে দেয়! কেন প্রথমে এত বড়ো ভুল হলো, এই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে সরকারপক্ষ কিছু একটা সংশয় ঘটেছিল এই মর্মে সাফাই দেন এবং ওই রাজ্যের পঁচিশজন বিজেপি সাংসদ ‘‘আমি কিছু বলতে পারব না, সব জানেন প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী...’’ ইত্যাদি বলে ‘ও পিসিমা’ মার্কা দোহাই পাড়লেন!
যাই হোক, হোঁচট খেতে খেতে হলেও কেন্দ্রীয় সরকারকে ঘাট্ মানতে হচ্ছে দুই ক্ষেত্রেই ! আর সেই জন্যেই, লেখার শুরুতে ওই বিলিতি প্রবাদটার উল্লেখ করেছি ! তবে সব শেষে একটা কথা: ‘হিন্দি’ কিন্তু একটা একশৈলিক ভাষা নয় ! যাকে হিন্দি বলা হয় তার খাড়িবলি, হরিয়ানভি, রাজস্থানি, ছত্তিশগড়িয়া, বিহারি ইত্যাদি নানা রূপান্তর আছে - যার অর্থ, শুধু শব্দভাণ্ডার নয়, ব্যাকরণ, বাক্যের অন্বয়, বাগ্রীতি - বহু ক্ষেত্রেই একের সঙ্গে অন্যটি বহুলভাবে পৃথক! তাহলেও হিন্দিকে কি একটা ভাষা বলেই মানতে হবে?