৫৯ বর্ষ ৩২ সংখ্যা / ২৫ মার্চ, ২০২২ / ১০ চৈত্র, ১৪২৮
সিপিআই(এম) রাজ্য সম্মেলনে প্রতিনিধিদের আলোচনায় মূর্ত হয়েছে পরিস্থিতির উপযোগী পার্টিকে শক্তিশালী করে নিরন্তর লড়াইয়ের বার্তা
নব নির্বাচিত রাজ্য কমিটি।
নিজস্ব প্রতিনিধিঃ সিপিআই(এম) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য ২৬তম সম্মেলনে উত্থাপিত খসড়া রাজনৈতিক-সাংগঠনিক প্রতিবেদনের উপর আলোচনায় প্রতিনিধিরা লড়াই-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সমস্ত প্রতিকূলতা-প্রতিবন্ধকতাকে চূর্ণ করে এগিয়ে যাবার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। প্রতিনিধিদের আলোচনায় উঠে এসেছে, একদিকে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের সাম্প্রদায়িক-জনবিরোধী নীতি, সংবিধানকে ভূলুণ্ঠিত করা, অন্যদিকে এ রাজ্যের তৃণমূল সরকারের স্বৈরাচারী-গণতন্ত্র বিরোধী কার্যকলাপ ও সীমাহীন দুর্নীতি, অপশাসন এবং রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় শাসকদলের সন্ত্রাস ইত্যাদির ফলে নানা দিক থেকে আক্রান্ত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। বিজেপি এই রাজ্যে তাদের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিকে প্রতিষ্ঠা করতে নানা কৌশলে বিভাজনের চক্রান্ত করছে। একাজে আরএসএস-র মতো কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি নানা অংশের মানুষ বিশেষ করে তপশিলি-আদিবাসী সহ বিভিন্ন অন্ত্যজ, পিছিয়ে পড়া মানুষদের মধ্যে গোপন কার্যকলাপ চালিয়ে পরিচিতিসত্তার মনোভাবকে উসকে দিচ্ছে। ফলে বিচ্ছিন্নতাবাদ মাথাচাড়া দিচ্ছে। একাজে বিপুল অর্থ খরচ করা হচ্ছে। এরই পাশাপাশি এ রাজ্যের পরিস্থিতির পর্যালোচনায় প্রতিনিধিরা উল্লেখ করেছেন, তৃণমূল সরকারের অপশাসন, সরকার পরিচালনায় সার্বিক ব্যর্থতার পাশাপাশি সাধারণ মানুষের অধিকার হরণ, দুর্নীতি লুঠ ইত্যাদিতে জনজীবনে যে ক্ষোভের সঞ্চার হচ্ছে, তার ইতিবাচক প্রভাব বামপন্থীদের দিকে পড়ছে না। সাংগঠনিক দুর্বলতা এবং কিছুটা হলেও জনবিচ্ছিন্নতা এর অন্যতম কারণ। কিন্তু নানা অপকৌশলে এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগাচ্ছে বিজেপি, আরএসএস’র মতো সাম্প্রদায়িক শক্তি। মানুষের সঙ্গে নিবিড় সংযোগ তৈরি করে শ্রমজীবী সাধারণ মানুষের স্বার্থে শ্রেণি আন্দোলন-গণ আন্দোলনকে তীব্র করেই পরিস্থিতির চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা করা সম্ভব বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন প্রতিনিধিরা।
বিগত সময়কালে কোভিড মহামারীর ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি মোকাবিলায় এবং আক্রান্ত ও বিপন্ন মানুষদের চিকিৎসা এবং ত্রাণের কাজে রাজ্যজুড়ে বামপন্থী ছাত্র-যুব এবং রেড ভলান্টিয়াররা যে অনন্য সাধারণ ভূমিকা পালন করেছেন সে কথাও প্রায় সমস্ত জেলার প্রতিনিধির আলোচনাতেই প্রাধান্য পেয়েছে।
তাঁরা কলকাতা প্লেনামের নির্দেশ অনুযায়ী পার্টির নিজস্ব শক্তি বৃদ্ধি এবং গণলাইনসম্পন্ন বিপ্লবী পার্টি গড়ে তুলে জনজীবনের বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে যাবার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন।
হুগলি জেলার প্রতিনিধিরা বলেছেন, ৩১ আগস্ট গণ আন্দোলনের শহিদ দিবস এবং নভেম্বর বিপ্লব দিবসে জেলার প্রায় ৫ হাজার বুথে রক্তপতাকা উত্তোলন ও হাতে লেখা পোস্টার লাগানোর কর্মসূচি নেওয়া হয়েছিল। এছাড়া কর্মসংস্থান ও শিল্পের দাবিতে সিঙ্গুর থেকে নবান্ন অভিযান, সিঙ্গুরে শিলান্যাস কর্মসূচি সংগঠিত হয়েছে। এই সমস্ত কর্মসূচির প্রভাব পড়েছে জেলায়। তাঁরা বলেছেন, করোনাকালে জেলা জুড়ে প্রায় ৫ কোটি টাকার ত্রাণসামগ্রী অসহায় মানুষদের প্রদান করা হয়েছে।
নদীয়ার প্রতিনিধিরা সাম্প্রতিক পৌর নির্বাচনে তাহেরপুরে বামফ্রন্টের সাফল্য প্রসঙ্গে বলেছেন, এটা সহজ কাজ ছিলনা। বিগত পাঁচ বছরে বামফ্রন্ট পরিচালিত এই পৌরসভা রাজ্য সরকারের নানা বাধাকে অতিক্রম করে এখানে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা পূরণে সচেষ্ট থেকেছে। গত বিধানসভা নির্বাচনের তুলনায় সাম্প্রতিক পৌর নির্বাচনে ভোটের হার বেড়েছে বামফ্রন্টের। এছাড়া শান্তিপুর বিধানসভার উপনির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের নিরিখে যে বামফ্রন্টের ভোটের হার বেড়েছে, সে কথাও বলেছেন প্রতিনিধিরা। তাঁদের কথায় উঠে এসেছে তৃণমূলের দুর্বৃত্তদের হাতে গরিব খেতমজুর পার্টিকর্মী বাবুলাল বিশ্বাসের খুনের ঘটনা। করোনা আবহে জেলায় ৫,১০০ রেড ভলান্টিয়ার আর্ত মানুষের সেবায় নিয়োজিত ছিলেন। তাঁরা দক্ষিণপন্থী রাজনীতির মোকাবিলায় শ্রেণি সংগ্রামকে তীব্র করার পাশাপাশি মনোজগতে যে আঘাত নেমে আসছে, অর্থনৈতিক ও ধর্ম-জাতপাতের নামে যে আক্রমণ নেমে এসেছে, তা প্রতিহত করতে মতাদর্শগত চেতনাকে শানিত করার কথা বলেছেন।
কলকাতা জেলার প্রতিনিধিরা বলেছেন, তৃণমূল জমানায় সর্বাত্মক আক্রমণ নেমে এসেছে জনজীবনে। বস্তি উচ্ছেদ চলছে। এই সময়ে ছাত্রছাত্রীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নানাভাবে। স্কুল কলেজ খোলা ও ফি বৃদ্ধির প্রতিবাদে আন্দোলনে সাফল্য এসেছে। কর্পোরেশন নির্বাচনে গত বিধানসভা ভোটের তুলনায় বামফ্রন্টের ভোটের হার বৃদ্ধির কথা বলেন তাঁরা। ছোটো, মাঝারি শিল্প বন্ধ হচ্ছে,অসংগঠিত শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ছে। কলকাতা মহানগরীতে পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে। তাঁরা বলেছেন, বেকার বাহিনীকে শাসকদলের বাহিনী হিসেবে কাজে লাগানো হচ্ছে। সিভিক পুলিশ তৃণমূলের গেস্টাপো বাহিনীতে রূপান্তরিত হয়েছে। উদার অর্থনীতিতে মানুষের চিন্তা-চেতনা, মূল্যবোধ ধ্বংস হচ্ছে। তাই কিছু মানুষ নিজেদের অধিকারবোধের চেয়ে সরকারের অনুদানকে বড়ো করে দেখছে। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, তৃণমূল-বিজেপি’র চুরি ও অপরাধ জেনেও মানুষ নির্বাচনে আমাদের সমর্থন করছে না। তৃণমূল দল কোটি কোটি টাকা খরচ করে আইপ্যাক’র মতো সংস্থাকে তাদের হয়ে জনসংযোগের কাজে লাগাচ্ছে। তাঁরা এই অভিমতই ব্যক্ত করেছেন যে, পুলিশ নিয়ন্ত্রিত পথে আইন মেনে আইন অমান্যের কর্মসূচি করলে সুফল মিলবে না। বর্তমান পরিস্থিতির মোকাবিলায় ব্যাপক অংশের মানুষকে জোটবদ্ধ করে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলা জরুরি।
পূর্ব মেদিনীপুর জেলার প্রতিনিধিদের বক্তব্যে উঠে এসেছে নিরন্তর আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্যদিয়ে সন্ত্রাসকে মোকাবিলা করে লালঝান্ডাকে নিয়ে অগ্রসর হওয়ার বার্তা। জেলায় প্রায় ৬,০০০ পার্টি কর্মীর বিরুদ্ধে ৩,৪৩৭টি মিথ্যা মামলা করা হয়েছে, অনেককে হাজতবাস করতে হয়েছে। তবুও পার্টির অগ্রগতিকে রোখা যায়নি। তাঁরা বলেছেন, চিটফান্ড দুর্নীতি ও গরিব মানুষদের বর্গা, পাট্টা আটকে দেবার বিরুদ্ধে, নদীবাঁধ ভাঙন মেরামতি, স্থানীয় আদায়যোগ্য বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে সমাজের বিভিন্ন অংশের অসংখ্য মানুষ ভয়ভীতি ভেঙে পার্টির কাছাকাছি এসে আন্দোলনে যোগ দিচ্ছেন। কোভিড পরিস্থিতিতে এবং আমফান ঝড়ের পর এই জেলাতেও বামপন্থীরা বিশেষকরে রেড ভলান্টিয়াররা দুর্গত মানুষের স্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
মুর্শিদাবাদ জেলার প্রতিনিধিরা বলেছেন, এখানকার অন্যতম শিল্প হচ্ছে বিড়ি শিল্প। এই শিল্পের শ্রমিকদের মজুরি সহ নানা সংকট। বিড়ি শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে লালঝান্ডার লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে এখন দৈনিক মজুরি ১৭৮ টাকা হয়েছে, এই মজুরিও প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। তবু্ও শ্রমিকদের পাশে রয়েছেন একমাত্র বামপন্থীরাই। প্রতিনিধিরা বলেছেন, জেলায় কোভিড পরিস্থিতিতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রেড ভলান্টিয়াররা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তারা হেল্প লাইন তৈরি করে পরিযায়ী শ্রমিকদের সাধ্যমতো সাহায্য করেছেন।
পুরুলিয়া জেলার প্রতিনিধির কথায় উঠে এসেছে গরিব মানুষের জন্য লড়াই করে অনেক পার্টি কর্মীকে জেলে যেতে হয়েছে। জেলায় বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে পার্টির নেতৃত্বে লড়াই চলছে। সেটেলমেন্টের দুর্নীতির বিরুদ্ধে, বান্দোয়ানে দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রীকে অত্যাচার করে খুনের প্রতিবাদে আন্দোলন ছড়িয়েছে জেলার বিভিন্ন প্রান্তে। টুর্গা জল প্রকল্পের নামে ৬টি আদিবাসী গ্রামের মানুষ উচ্ছেদের মুখে। এই মানুষদের রক্ষার জন্য আন্দোলনে অবিলম্বে ঝাঁপিয়ে পড়া দরকার বলে উল্লেখ করেন প্রতিনিধিরা। অন্যথায় বিপন্ন আদিবাসী মানুষদের পরিচিতি সত্তার রাজনীতি গ্রাস করবে। প্রতিনিধিদের অভিমত, জেলায় মানুষের দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলনকে এমন অভিমুখে নিয়ে যেতে হবে যাতে পার্শ্ববর্তী জেলায়ও তার প্রভাব পড়ে।
বীরভূম জেলার প্রতিনিধিরা বলেন, তৃণমূল কংগ্রেসের খুন-সন্ত্রাসের আঁতুড়ঘর হচ্ছে বীরভূম। ২০২১ সালের ৭ নভেম্বর নানুরের বালিগুনি গ্রামে নভেম্বর বিপ্লব দিবসের পতাকা তোলার জন্য তৃণমূলের ঘাতক বাহিনী খুন করে পার্টি কর্মী বাদল শেখকে। পঞ্চায়েত নির্বাচনে পার্টির প্রার্থীর মনোনয়ন পত্র জমা দেবার জন্য খুন হতে হয় পার্টি কর্মী দিলদার শেখকে। জেলায় ৫ টি পৌর সভায় মনোনয়ন পত্র জমা দেবার সময় থেকেই সন্ত্রাস শুরু করে শাসকদল। নির্বাচনে পুলিশের সাহায্য নিয়ে ব্যাপক ছাপ্পা ভোটের কারবার চালায়, শারীরিকভাবে আক্রমণ করে বামপন্থীদের। এই অবস্থার মধ্যেও অদম্য সাহস নিয়ে পার্টির নেতৃত্বে আন্দোলন-সংগ্রাম চলছে।
দেউচা-পাঁচামিতে কয়লা খনির নামে কর্পোরেটদের কোটি কোটি টাকা লুটের বন্দোবস্ত করতে চাইছে তৃণমূল সরকার। এর ফলে আদিবাসীরা জমিহারা হবেন। প্রতিনিধিরা এই মানুষদের রক্ষা করতে এবং পরিবেশ সুরক্ষায় হাজার হাজার মানুষকে সমবেত করে লাগাতার লড়াই জারি রাখা জরুরি বলে অভিমত ব্যক্ত করেন।
বাঁকুড়া জেলার প্রতিনিধিরা বলেন, রাজ্যের সরকার ও শাসকদল বামফ্রন্ট আমলের সাফল্যগুলিকে নস্যাৎ করছে। গরিব মানুষ যারা পাট্টা পেয়েছিলেন তাদের জমি থেকে উচ্ছেদ করছে। এমনকি বনরক্ষী বাহিনীকে নিয়ে জঙ্গলের জমি থেকেও আদিবাসীদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে। কেন্দ্রের মতো পশ্চিমবঙ্গ সরকারও কৃষি আইন করে গোটা কৃষি ব্যবস্থাকে কয়েকটি সংস্থার হাতে তুলে দেবার বন্দোবস্ত করেছে। ব্যাপকতর আন্দোলন গড়ে তুলেই এই চক্রান্ত রোখা দরকার বলে তাঁরা মনে করেন। প্রতিনিধিরা উল্লেখ করেছেন, গ্রামীণ শ্রমজীবী মানুষ যারা নানাভাবে চক্রান্তের শিকার হয়ে আমাদের কাছ থেকে দূরে চলে গেছেন তাঁদের ফিরিয়ে আনতে না পারলে রাজনৈতিক ভারসাম্য পরিবর্তন করা যাবেনা। করোনাকালে রেড ভলান্টিয়াররা যে অসামান্য ভূমিকা পালন করেছেন জেলায় তার উল্লেখ করেছেন প্রতিনিধিরা। তাঁরা জানিয়েছেন, জেলার বেশ কিছু জায়গায় শাসকদলের সন্ত্রাসকে মোকাবিলা করেই পার্টির কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছেন পার্টি কর্মীরা।
পূর্ব বর্ধমান জেলার প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, বুথস্তরে কর্পোরেট হিন্দুত্বের আগ্রাসন লক্ষ করা যাচ্ছে। গ্রামাঞ্চলে মাইক্রোফিনান্সের কার্যকলাপ ক্রমশ ভয়ঙ্কর আকার নিচ্ছে। এই সংস্থাগুলি গরিব মানুষদের কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা আদায় করছে। এই টাকা আদায় করতে এই সংস্থাগুলি কোথাও কোথাও বাউন্সার পাঠাচ্ছে। তথাপি আন্দোলনের মধ্য দিয়ে কিছু জায়গায় এদের কার্যকলাপ রোখা গেছে। মাইক্রোফিনান্স কোম্পানিগুলির শোষণ রুখতে শ্রমিক, কৃষক, খেতমজুরদের ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন প্রতিনিধিরা। তাদের দৃঢ় অভিমত, দেশজুড়ে প্রচার আন্দোলনের মধ্যদিয়ে তৃণমূলের সন্ত্রাসকে তুলে ধরা প্রয়োজন। তাঁরা বলেন, শ্রেণি আন্দোলনকে তীব্র করেই রাজ্যের রাজনৈতিক ভারসাম্যের পরিবর্তন করা সম্ভব।
আলিপুরদুয়ার জেলার প্রতিনিধিরা উল্লেখ করেছেন, আদিবাসী সহ নেপালি, মেচ, রাভা, বড়ো প্রভৃতি নানা জনজাতির মানুষের বসবাস এই জেলায়। এই বিভিন্ন অংশের মানুষকে পার্টিতে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে ঘাটতি রয়ে গেছে। গ্রামাঞ্চলে আরএসএস সরস্বতী স্কুলের নামে কৌশলে হিন্দুত্ববাদী প্রচার চালাচ্ছে। গ্রামের তরুণ সম্প্রদায় প্রতিক্রিয়াশীল দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে। এসব মোকাবিলার ক্ষেত্রে আমাদের দুর্বলতা থেকে যাচ্ছে। চা বাগানগুলিতে আর্থিক ইস্যু নিয়ে দীর্ঘ আন্দোলন হলেও ভোটে তার প্রতিফলন পড়ছে না। এই সমস্ত দিক নিয়ে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে সঠিক স্লোগান ও আন্দোলনের রূপরেখা তৈরি করা প্রয়োজন বলে মতপ্রকাশ করেছেন প্রতিনিধিরা।
পশ্চিম বর্ধমান জেলার প্রতিনিধিদের কথায় উঠে এসেছে উদার অর্থনীতিতে কয়লা, ব্যাঙ্ক, বিমা ইত্যাদি রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পে মারাত্মক আঘাত নেমে এসেছে। এখানে কয়লা শিল্পে যেখানে শ্রমিক সংখ্যা ছিল ১লক্ষ ৮৭ হাজার, সেখানে এখন রয়েছে মাত্র ৫৩ হাজার। বাম আমলে গড়ে ওঠা অনেক শিল্পই ধ্বংসের মুখে। আবার অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে শিল্প ক্ষেত্রে বেশ কিছু মাফিয়া প্রায় ১৫ হাজার শ্রমিককে নিয়ন্ত্রণ করছে। অসংগঠিত ক্ষেত্র সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে আন্দোলন কর্মসূচির অগ্রাধিকার ঠিক করা এবং সামগ্রিকভাবে আন্দোলন গড়ে তুলতে নির্দিষ্ট রূপরেখা তৈরি করা প্রয়োজন বলে জানান এই জেলার প্রতিনিধিরা।
সম্মেলনে দার্জিলিং জেলার প্রতিনিধিরা বলেছেন, নানা জনসমষ্টির বসবাস এই জেলায়। আশির দশক থেকে যে জাতিসত্তার আন্দোলনের সূচনা হয়, তা চলতেই থাকে। এই আন্দোলনের আঘাত নেমে এসেছে পার্টিতে। ’৮৬-র রক্তক্ষয়ী আন্দোলনকে মোকাবিলা করে এখানে পার্টি অগ্রসর হয়েছে। জেলার বিভিন্ন জনগোষ্ঠির মানুষের নানা সমস্যাও রয়েছে। তাদের মধ্যে গোপনে কার্যকলাপ চালাচ্ছে আরএসএস। উত্তরবঙ্গে কয়েকটি জনজাতির জন্য পৃথক রাজ্যের দাবি তুলেছে বিজেপি। আবার তৃণমূল বাঙালি জাত্যভিমানকে উসকে দিয়ে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি করতে চাইছে। তাই আমাদের উচিত এই মানুষদের সমস্যাগুলি অনুধাবন করে সঠিক আন্দোলনের কর্মসূচি স্থির করা। তাঁরা উল্লেখ করেন, দার্জিলিঙের প্রধান আয়ের উৎস চা। প্রায় দেড় লক্ষাধিক শ্রমিক চা বাগানগুলিতে কাজ করছে। তাঁদের নানা সমস্যা ও সংকট রয়েছে। প্রায় সাড়ে চার লক্ষ শ্রমিক মজুরি ও অন্যান্য দাবিতে জয়েন্ট ফোরামের আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। প্রতিনিধিরা বলেছেন, বিগত সময়ে রাজ্য সরকারের নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা সত্ত্বেও সাফল্যের সঙ্গে শিলিগুড়ি কর্পোরেশন চালিয়েও কেন এবারে পরাজিত হতে হলো তার উপযুক্ত বিশ্লেষণ করে কারণ অনুসন্ধান করা প্রয়োজন।
উত্তর ২৪ পরগনা জেলার প্রতিনিধিরা বলেছেন, বর্তমানে কর্পোরেট মিডিয়ার তীব্র বামবিরোধী প্রচারের বিরুদ্ধে আমাদের বক্তব্যকে জনমানসে তুলে ধরতে চাই একটি নিজস্ব বৈদ্যুতিন চ্যানেল। আজকে রাস্তার লড়াইয়ে জয় ছিনিয়ে আনতে না পারলে মানুষের আস্থা অর্জন করা যাবেনা। সারদা-নারদা-টেট-পিএসসি ইত্যাদি নানা দুর্নীতি-কেলেঙ্কারির ইস্যু আমাদের সামনে থেকে চলে গেল, কিন্তু এসবের বিরুদ্ধে সেভাবে জোরালো আন্দোলন গড়ে তোলা গেল না। আমাদের কেবল কর্মসূচি করলে চলবে না, মানুষকে নিয়ে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। তাঁরা বলেছেন, জেলায় আমফান-বিধ্বস্ত মানুষদের প্রায় ৫ কোটি টাকা সাহায্য করা হয়েছে। ছাত্র-যুব সহ রেড ভলান্টিয়াররা জীবনকে বাজি রেখে কোভিড মোকাবিলায় নানা কাজে অংশ নিয়েছেন। আমাদের গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা দরকার কেন আমরা একের পর এক নির্বাচনে পরাজিত হচ্ছি। সময়ের চাহিদা মেনে পরিস্থিতি অনুযায়ী আমাদের নিরন্তর সংগ্রাম করে যাওয়া ছাড়া বিকল্প কিছু নেই।
পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার প্রতিনিধিরা দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে আন্দোলন-সংগ্রামের স্ফুলিঙ্গ তৈরি করতে হবে। বর্তমানের এই প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবিলা কেন করতে পারছি না তা আমাদের গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে দেখা দরকার। আদিবাসীরা আজ নানাভাবে বিভাজনের শিকার হচ্ছেন। তাদের পার্টিতে যুক্ত করার ক্ষেত্রে দুর্বলতা থেকে যাচ্ছে। স্বল্পশিক্ষিত, গরিব শ্রমজীবী মানুষ যাতে পার্টির বাইরে না থাকে সেদিকে আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে। তাঁরা প্রশ্ন তোলেন, খুনের অভিযোগে লুক আউট নোটিশ জারি থাকা বিমল গুরুঙকে নবান্নে ডেকে মুখ্যমন্ত্রী বৈঠক করেন, জ্ঞানেশ্বরীকাণ্ডে অন্যতম অভিযুক্ত ছত্রধর মাহাতোকে শাসকদলের সম্পাদক করা হলো, অথচ এসব নিয়ে প্রতিবাদ-আন্দোলন হলো না কেন?
কোচবিহারের প্রতিনিধির আলোচনায় উঠে এসেছে রাজ্য সরকারের উদাসীনতায় চাষিরা হিমঘরে আলু রাখতে গিয়ে অসুবিধার মুখে পড়ছেন। দালাল-ফড়েরা মাঝখান থেকে কাটমানি খাচ্ছে। শীতলকুচিতে কাঁটাতারের বেড়ার ওপারে ফসল কাটতে গিয়ে বাঁধার মুখে পড়েছিল কৃষকরা, কৃষক সভার আন্দোলনের চাপে সেই বাঁধা দূর হয়েছে। সীমান্তবর্তী জেলা হওয়ায় চোরাচালানকারীদের দৌরাত্ম্য বাড়ছে। শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপি উভয়েই বিচ্ছিন্নবাদীদের মদত দিচ্ছে, পৃথক রাজ্যের দাবি মাথাচাড়া দিচ্ছে। অন্যান্য জেলার মতো এই জেলাতেও কোভিড পরিস্থিতিতে রেড ভলান্টিয়াররা যে অসামান্য ভূমিকা পালন করেছেন, তা আলোচনায় উঠে এসেছে।
মালদহ জেলার প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, গঙ্গার ভাঙন, ভাঙন প্রতিরোধ, পুনর্বাসন, আর্থিক সাহায্য এবং জমিহারাদের জন্য চাকরির দাবিতে লাগাতার আন্দোলন গড়ে তোলা প্রয়োজন । তাঁদের কথায় উঠে এসেছে, জেলায় বিড়ি শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৫ লক্ষ। তাদের ঠিকমতো মজুরি মেলে না। ধারাবাহিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এখন দৈনিক ১৭৮ টাকা মজুরি স্থির হয়েছে। কিন্তু এক হাজার বিড়ি পিছু এই মজুরি নিতান্তই স্বল্প। এই শ্রমিকদের জীবন জীবিকার স্বার্থে প্রয়োজন আরও শক্তিশালী আন্দোলন। তাঁরা জানান, জেলায় পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা ৬ লক্ষের বেশি। লকডাউনের সময়ে সাধ্যমতো তাদের পাশে ছিলেন বামপন্থীরা। ২১ জন পরিযায়ী শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছেন। তাদের সাহায্যের দাবিতে ডিএম-এর কাছে স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে। প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, তৃণমূলের সন্ত্রাস, বুথ দখল সত্ত্বেও পৌর নির্বাচনে প্রায় ৩৫ শতাংশ ভোট পেয়েছে বামফ্রন্ট।
দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার প্রতিনিধিরা বলেছেন, গণ লাইনসম্পন্ন বিপ্লবী পার্টি গড়ে তুলতে হলে শ্রেণি আন্দোলন-গণআন্দোলনকে শক্তিশালী করা প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে গণ সংগঠনেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তাঁরা বলেছেন, পঞ্চায়েত এলাকায় সন্ত্রাস সত্ত্বেও আমফান-দুর্নীতির বিরুদ্ধে মানুষকে যুক্ত করে আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে। বিভিন্ন থানায় ডেপুটেশন দেওয়ার মধ্য দিয়ে লুটের অর্থ, ত্রাণ সামগ্রী ফেরত দিতে বাধ্য করা গেছে। সুন্দরবন এলাকায় নদী ভাঙনে বিপর্যস্ত মানুষদের স্বার্থে আন্দোলন করতে গিয়ে পার্টি কর্মীদের জেলে যেতে হয়েছে। কুলতলিতে ৪৮ ঘণ্টা ধরে কৃষকদের অবস্থান-বিক্ষোভের জেরে বিডিও-কে কৃষকদের ধান কিনতে বাধ্য করা সম্ভব হয়েছে। এই জেলার অনেক জায়গাতেই তৃণমূলের সন্ত্রাস রয়েছে, তা সত্ত্বেও পার্টির লড়াই-আন্দোলন চলছে। লকডাউনের সময়ে মহিলাদের দ্বারা পরিচালিত শ্রমজীবী ক্যান্টিন সহ জেলাজুড়ে রেড ভলান্টিয়াররা দৃষ্টান্তমূলক ভূমিকা পালন করেছেন।
হাওড়া জেলার প্রতিনিধিরা উল্লেখ করেছেন,জেলায় ৫টি রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানাকে পুনরুজ্জীবিত করা, রূপনারায়ণ বাঁচাতে এবং আদায়যোগ্য নানা দাবিতে আন্দোলন গড়ে উঠেছে। আমফান দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গরিব মানুষের টাকা ফেরত দেওয়া সম্ভব হয়েছে।
বিভিন্ন জনজাতি ও আদিবাসী অধ্যুষিত জেলা জলপাইগুড়িতে পরিচিতিসত্তার রাজনীতি মাথাচাড়া দিচ্ছে। বিজেপি তাদের মধ্যে গোপন তৎপরতা চালাচ্ছে। চা শ্রমিকদের যৌথ আন্দোলন হয়েছে। সব অংশের মানুষের সঙ্গে নিবিড় সংযোগ গড়ে তুলে আন্দোলন গড়ার কথা বলেন প্রতিনিধিরা।
ঝাড়গ্রামের প্রতিনিধির বক্তব্যে উঠে এসেছে গ্রামের নব্য ধনীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে গরিব মানুষদের সংগঠিত করার গুরুত্বের কথা। তিনি বলেছেন, কৃষি নির্ভর এই জেলায় সাঁওতাল, মুন্ডা, কুরমি, দেশওয়ালি প্রভৃতি জন অংশের মানুষ তাদের নির্দিষ্ট কিছু দাবির ভিত্তিতে সামাজিক সংগঠন গড়ে তুলছেন। এই মানুষদের বিভক্ত করার চক্রান্ত করছে আরএসএস সহ হিন্দুত্ববাদী শক্তি। এই মানুষদের সাথে নিবিড় সংযোগ গড়ে গণ আন্দোলন- শ্রেণি আন্দোলনের প্রবাহে নিয়ে আসা জরুরি।
কৃষক ফ্রন্টের প্রতিনিধি বলেছেন, গ্রামের কৃষক, খেত মজুর, অসংগঠিত শ্রমিকদের নিয়ে নব্য ধনী যারা শাসকদলকে মদত দিচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে জোট তৈরি করতে হবে। এরাই করপোরেট ও মাইক্রোফিনান্স কোম্পানির মাধ্যমে গরিবদের শোষণ করছে। তাঁরা বলেছেন, গ্রামে সমবায় গড়ে তুলতে হবে। তাহলেই মাইক্রোফিনান্স কোম্পানির দৌরাত্ম্য বন্ধ হবে। এছাড়া পঞ্চায়েতে নানা দুর্নীতির বিরুদ্ধে, পাট্টাদারদের উচ্ছেদের বিরুদ্ধে, একশো দিনের কাজের দাবিতে আন্দোলনকে দুর্বার করতে হবে।
খেত মজুর ফ্রন্টের প্রতিনিধি বলেছেন, গ্রামের গরিব মানুষদের লাল ঝান্ডার দিকে ফিরিয়ে আনতে এবং গ্রামের অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে খেত মজুরদের সংগঠিত করতে হবে।
শ্রমিক ফ্রন্টের প্রতিনিধি বলেছেন,এই সময়ের স্লোগান হলো - যার কাছে পৌঁছাতে পেরেছো তাকে সংগঠিত করো, আর যার কাছে পৌঁছাতে পারনি তার কাছে পৌঁছাও। তাঁরা বলেছেন,অসংগঠিত শ্রমিকদের সংখ্যা বাড়ছে। তাদের পাশাপাশি চা, কয়লা ও ইস্পাত শ্রমিক, আশা, মিড ডে মিল শ্রমিকদের বিভিন্ন দাবি নিয়ে সময়ের চাহিদা মেনে লড়াইয়ের উদ্যোগ নিতে হবে। বিজেপি’র শাসনে রাষ্ট্রায়ত্ত সমস্ত শিল্পের উপর যে আঘাত নেমে এসেছে,তার উল্লেখ করে দেশ ও দেশের শ্রমজীবী সাধারণ মানুষের স্বার্থে ২৮-২৯ মার্চ দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘটকে সর্বাত্মক সফল করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন তাঁরা।