৫৯ বর্ষ ৩২ সংখ্যা / ২৫ মার্চ, ২০২২ / ১০ চৈত্র, ১৪২৮
অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় - যুগান্তরের পথিক
শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার
অনেকেই বলছেন, একটা মৃত্যু মিছিল চলছে। যেভাবে ভারতীয় সঙ্গীতের দিকপালেরা একের পর এক বিদায় নিচ্ছেন তাতে এই কথাটা বলা হয়ত অস্বাভাবিক নয়। লতা মঙ্গেশকর, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় এবং সর্বশেষ অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। এটা ঠিক প্রত্যেকেরই মৃত্যু এসেছে জীবনের স্বাভাবিক নিয়মে, এক দীর্ঘ কর্মময় জীবনের শেষে। সেদিক থেকে এই মৃত্যুগুলিকে অপ্রত্যাশিত বা অসময়োচিত বলতে হয়ত পারি না। কিন্তু যে সমস্ত মানুষের উজ্জ্বল কর্মকাণ্ড আমাদের ব্যক্তি ও সমাজ সত্তার গভীর তন্ত্রীর সাথে আবেগমথিত হয়ে গেঁথে রয়েছে, তাঁদের মৃত্যু এলে এক ধরনের সর্বগ্রাসী শূন্যতার বোধ হয়। যে শূন্যতা আমাদের শোককে আরো গভীর করে তোলে।
গত ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে চলে গেলেন সুরকার ও গীতিকার অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। গায়ক হিসেবেও তিনি অত্যন্ত সুকণ্ঠের অধিকারী হলেও তাঁর কর্মধারায় তিনি নিজের গলায় গানের চেয়ে অপরের কণ্ঠে নিজের সুর ও বাণীকে বাঙ্ময় করার সাধনাতেই বেশি মনোযোগী থেকেছেন সারা জীবন। অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় এমন একটি সময়পর্বে তাঁর সঙ্গীত সৃষ্টি করেছেন যে সময়কে সাধারণভাবে বলা হয়, বাংলা আধুনিক গানের স্বর্ণযুগ। যে স্বর্ণালী গানের সূত্রে এই সময়পর্বকে স্বর্ণযুগ বলে অভিহিত করেন সঙ্গীতপিপাসু মানুষেরা তার একটি বড়ো অংশ হচ্ছে অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৃষ্টি। সাধারণভাবে বাংলা আধুনিক গানের ক্ষেত্রে গানগুলি সাধারণ্যে পরিচিতি পায় কণ্ঠশিল্পীর নামের সাথে। ফলেই সাধারণ মানুষ সুবোধ পুরকায়স্থের গান বা হিমাংশু দত্তের গান, কিংবা সুধীন দাশগুপ্তের গান বা অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গান না বলে গানগুলিকে চেনে শচীন দেববর্মনের গান বা কে এল সায়গলের গান বা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, সুবীর সেন বা সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গান হিসেবে। একটা বড়ো সময় ধরে প্রকাশিত রেকর্ডের গায়ে গীতিকার-সুরকারের নাম না লিখে শুধু গায়ক-গায়িকার নাম লেখা থাকত। অনেক লড়াই সংগ্রামের পর গীতিকার-সুরকাররা এই মর্যাদার অধিকার অর্জন করতে পেরেছেন।
বাণিজ্যিক সঙ্গীত জগতের জনপ্রিয় সঙ্গীতের অবিস্মরণীয় স্রষ্টা অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিচয় তিনি ছিলেন গণনাট্যের সঙ্গীতধারার এক উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব। সঙ্গীতস্রষ্টা হিসেবে তিনি গুরু হিসেবে যাকে মান্য করেন সেই সলিল চৌধুরীর তিন সবচেয়ে অগ্রগণ্য তিন সাঙ্গীতিক সহকারীর অন্যতম হচ্ছেন অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। অন্য দু’জন অনল চট্টোপাধ্যায় ও প্রবীর মজুমদার। বলা বাহুল্য, এই সকলেরও সঙ্গীত সৃষ্টিতেই তাঁদের গণনাট্য পরিচিতির স্বাক্ষর স্পষ্ট। বাণিজ্যিক ধারার আধুনিক গানের বাণীতেও হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকের মতো মূর্ত হয়ে ওঠে গভীর সমাজবোধ ও প্রান্তিকায়িত মানুষের প্রতি সহমর্মিতার চিহ্ন। শুধু গানের বাণী নয়, সুরের চলনেও গণনাট্যের উত্তরাধিকার ঠিকই চিনতে পারা যায়।
অনেকেই বলেন সলিল চৌধুরীর এই তিন সহকারীর সৃষ্টিতে তাঁদের গুরুর প্রভাব অত্যন্ত বেশি। কথাটি আংশিক সত্য। তাঁদের সঙ্গীতের যে বৈশিষ্ট্যগুলিকে সলিল চৌধুরীর প্রভাব বলে চিহ্নিত করা হয় তা আসলে শুধু প্রভাব নয়। প্রথমত, শিক্ষকের উত্তরাধিকার ছাত্রের মধ্যে দেখতে পাওয়াটা কোনো অস্বাভাবিক বিষয় নয়। বরং না-থাকাটিই একট ব্যতিক্রমী ঘটনা হতো। তাছাড়া সঙ্গীত এমন একটি শিল্প যা বায়ুভূত নয়, একটি বহমানতার মধ্যেই সঙ্গীতের জন্ম। সেখানে পূর্বসূরি ও সমকালীন স্রষ্টা থেকে স্বাধীন সম্পর্কহীন থাকা সম্ভব নয়। সঙ্গীতের যে বৈশিষ্ট্যকে সলিলীয় ঘরাণা বলা হয়, তা আসলে শুধু ব্যক্তিকেন্দ্রিক বিষয় নয়। এর একটি রাজনৈতিক ও নন্দনতাত্ত্বিক মাত্রা আছে। যে জায়গায় এই স্রষ্টাদের মিল দেখতে পাওয়া যায়, আসলে সেটা হচ্ছে তাঁদের সঙ্গীতের রাজনৈতিক নন্দনতত্ত্বের অভিন্নতা। নান্দনিকতার ওই বৈশিষ্ট্যটুকু বাদ দিলে প্রত্যেকের সৃষ্টিতে রয়েছে নিজস্বতার সুস্পষ্ট স্বাক্ষর। ফলে সলিল চৌধুরীর প্রভাব বলে সবাইকে দেগে দেওয়াটা একটা অগভীর বিবেচনা।
অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাঙ্গীতিক ভিতটা ছিল পারিবারিক কারণেই ব্রহ্মসঙ্গীত ও রাবীন্দ্রিকতা কেন্দ্রিক। এই সঙ্গীতধারা ছিল তাঁর স্নায়ুতে। চেতনার গভীরে থাকা এই সঙ্গীত তাঁর আধুনিক গানের কথায় ও সুরে একটি অনুপ্রেরণার ছায়া রেখে গেছে সারা জীবন। সঙ্গীতের ভারতীয়ত্ব তাঁর এতটাই গভীরে প্রোথিত ছিল যে সলিল চৌধুরীর সঙ্গীতধারায় স্নাত হয়ে পাশ্চাত্যের চলন যুক্ত হয়েছে সুরে ও ছন্দে সেটাও শেষ পর্যন্ত এক অনন্য রূপ পায় যাকে ভারতীয় সঙ্গীত না-বলা অসম্ভব। সঙ্গীতের এই আত্মীকরণ একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়াও। যেভাবে একটি মতাদর্শ ভিন্ন ভিন্ন দেশ ও জলবায়ুতে নতুন নতুন রূপ পরিগ্রহ করে রাজনীতিতে মূর্ত হয়, তেমনি সঙ্গীতেরও একটি বিশ্বযাত্রা ও স্থানীকরণ রয়েছে। অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সচেতন চর্চার গভীরে নিশ্চিতভাবেই শিল্প আঙ্গিকের এই রাজনৈতিক মাত্রাটির একটি জোরালো উপস্থিতি ছিল, যার জন্য তাঁর স্বাভাবিক সৃষ্টির পরতে পরতে ছিল এই দেশীয়তার বিশ্বযাত্রা ও বিশ্বসঙ্গীতের স্থানীকরণ। সমকালীন তাঁর অগ্রজ ও সতীর্থ স্রষ্টাদের সাথে তুলনামূলক আলোচনার কোনো অবকাশ না রেখেও বলা যায় অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৃষ্টির এটা একটা অনুপম বৈশিষ্ট্য।
অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় সুরস্রষ্টা হিসেবে কতটা সহজাত প্রতিভার অধিকারী ছিলেন তার প্রমাণ সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতা ‘ছিপখান তিন দাঁড় তিনজন মাল্লা’য় করা তাঁর সুর। ভাবলে অবাক হতে হয় তখন তাঁর কোমল ও শুদ্ধ গান্ধারভিত্তিক পাশ্চাত্যের মেজর মাইনর কর্ড সম্পর্কে কোনো ধারণাই গড়ে ওঠে নি। শুধুমাত্র কানে ছিল সলিল চৌধুরীর ‘রাণার’ ও ‘গাঁয়ের বধু’। শ্রবণকে কতটা তীব্রতার স্তরে উন্নীত করলে অন্তর্নিহিত ব্যাকরণটি না জেনেও এমন নিজস্বতায় শোনা গানের একটি অনুপ্রেরণার উত্তর-স্বাক্ষর এই উচ্চতায় রাখা যায়। বয়সের দিক থেকে অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় তখন নিতান্তই তরুণ। জানা যায়, অগ্রজ অরিন্দম অভিজিৎকে একটি গানের বাণী লিখে দিয়ে তাতে সুর আরোপ করতে বলেছিলেন। সুর করার পর দেখা গেল গানটি সুরের ধরন রবীন্দ্র সঙ্গীতের মতো। আগেই বলেছি রবীন্দ্র সঙ্গীত ও ব্রহ্মসঙ্গীত ছিল অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মজ্জাগত। সঙ্গীতের নানা শাখার সাথে গভীর পরিচয়ের পরও তিনি বিশ্বাস করতেন আধুনিক বাংলা গানের শিক্ষা বা দীক্ষার প্রথম পাঠ অবশ্যই হওয়া উচিত রবীন্দ্র সঙ্গীত। আমাদের পরম্পরাগত সঙ্গীতের সুর কাঠামো থেকে রবীন্দ্র সঙ্গীত হয়ে সলিলীয় বিশ্ব অভিজ্ঞতাকে তিনি ব্যাখ্যা করতেন দ্বন্দ্বমূলক পদ্ধতিতে। কী করে নানা সুরের থিসিস, অ্যান্টি থিসিসের দ্বন্দ্ব সমন্বয়ে সিন্থেসিস হিসেবে নতুন তৃতীয় সঙ্গীতের জন্ম হয় তার ব্যাখ্যা করতেন প্রাঞ্জল ভাষায়।
ব্যক্তিগতভাবে অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে পরিচিত ও মতবিনিময়ের তিনটি সুযোগ এসেছিল। রবীন্দ্র জন্মের সার্ধ শতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষ্যে আকাশবাণীর বেতার নাটক ‘রক্তকরবী’-তে আমি ছিলাম বিশুর ভূমিকায়। রাজা ও নন্দিনীর ভূমিকায় ছিলেন দেবরাজ রায় ও রত্না মিত্র। ওই নাটকের সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্ব ছিল অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওপর। সঙ্গীতগ্রহণের দিন বিমুগ্ধ বিস্ময়ে লক্ষ করেছিলাম, নাটকের রাবীন্দ্রিক সাঙ্গীতিকতাকে গ্রহণ ও আত্মস্থ করার পরও সঙ্গীতসজ্জায় কতটা অবলীলায় পাশ্চাত্য চলনরীতি ও সাঙ্গীতিক প্রয়োগ করছিলেন তিনি। প্রতিটি সঙ্গীত অংশের নন্দনতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা তিনি অংশগ্রহণকারী যন্ত্রীদের পাশাপাশি নাটকের পরিচালক ও গায়কদের বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন। সঙ্গীতের কোনো কোনো অংশে তিনি প্রয়োগ করেছিলেন লোকায়ত রীতি। ওইদিন তাঁর সাথে কাজ করতে পারার সুবাদেই সামান্য ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে আমার। আমার একটি রবীন্দ্রসঙ্গীতের অ্যালবামের সঙ্গীতসজ্জা করেছিলেন এই সময়ে ময়ূখ ও মৈনাক। সাম্প্রতিক সময়ের আধুনিক গান ও সঙ্গীতের স্রষ্টা হওয়ায় তাঁদের রবীন্দ্র সঙ্গীতের সঙ্গীতসজ্জায়ও ছিল সময়ের সাক্ষ্য এবং নিজস্বতার স্বাক্ষর। ওই অ্যালবামটির সঙ্গীত প্রয়োগ ও ভাবনায় মুগ্ধ হয়ে একটা সারাটা দিন সকাল থেকে রাত অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় আমাকে অসংখ্যবার ফোন করেছিলেন। একেকটি গান শুনছেন, আর ফোন করে প্রায় আধ ঘন্টা ধরে তাঁর মুগ্ধতা, সমর্থন ও উৎসাহের কথা বলছেন। সময়ের সাথে সতত সম্পর্কিত থাকার এ এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত যেখানে এক উত্তরসূরির সৃষ্টিশীলতাকে অকুণ্ঠ চিত্তে স্বীকৃতি জানাতে পারেন একজন অগ্রজ। দেবব্রত বিশ্বাস-এর জন্মশতবর্ষে একটি আলোচনা সভায় অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন প্রধান আলোচক, আমি ছিলাম সঞ্চালনায়। সেদিন উদাহরণ সহযোগে তাঁর চিত্তাকর্ষক বক্তব্যে বুঝেছিলাম রবীন্দ্রনাথের গানের বাণী, সুর ও নন্দনকে তিনি কতটা গভীর থেকে অবলোকন করেন। তাঁর এই বোধে তাঁর বিশেষ আধ্যাত্মিক বিশ্বাসের যতটা ভূমিকা ছিল ততটাই ভূমিকা ছিল তাঁর গণনাট্য চেতনার। শুনলে বিষয়টিকে পরস্পর বিরোধী মনে হবে। কিন্তু তাঁর রবীন্দ্র সঙ্গীত বিষয়ক আলোচনা যারাই শুনেছে তারাই বুঝবে তাঁর এই রাবীন্দ্রিক অনুধ্যান কোথাও একটা সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের রবীন্দ্র সঙ্গীত বিশ্লেষণের সাথে মিল খুঁজে পাওয়া যায়। রবীন্দ্রসঙ্গীত ও রবীন্দ্র দর্শন নিয়ে নিজের বক্তব্য সংবলিত একটি সিডি’র সিরিজ তিনি উপহার দিয়েছিলেন, যা একইসাথে অসাধারণ ও অভিনব।
একটাই আক্ষেপ, বাংলা আধুনিক গানের যে স্বর্ণযুগে অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অধিষ্ঠান তা ছিল মূলত সুরের স্বর্ণময়তার সময়। সেই যুগে সঙ্গীত যতটা পরীক্ষা নিরীক্ষা বা অভিনবত্বের পথ ধরে হেঁটেছে, তুলনায় গানের বাণী রয়ে গেছে স্থির বদ্ধ জলাশয়ে আবদ্ধ। ফলে নয়ের দশকে বাংলা আধুনিক গানের কথায় ও সুরে যে বন্ধনমুক্তির কাল এসেছে সেই সময়টা অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়দের ছিল না। ছিল তাঁদের উত্তরসূরির। অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় গণনাট্যের সঙ্গীতের যে উত্তরাধিকার বাংলা আধুনিক গানে নিয়ে এসেছিলেন তা গণনাট্যের সঙ্গীতের বাণীতে বহন করতে পারে নি। পাশপাশিভাবে, যে সময়পর্বে অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাঙ্গীতিক উত্থান হচ্ছে সেই সময়পর্ব ছিল গণনাট্যের ভাঙাগড়ার পর্ব। চারের দশকে সঙ্গীতে যে যুগান্তর এনেছিল গণনাট্য, তখন তাকে বহন করে নিয়ে যাওয়ার মতো সাংগঠনিক বাস্তবতা ছিল না। ফলেই অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো এক আধেয় তাঁর সহজাত আধারকে তার মেলে ধরার দিনে পাশে না পেয়ে সঙ্গীতের সামগ্রিকতার পরিবর্তে শুধু সুরের পথেই তাঁর জীবনকে নিবেদিত করেছেন। অবশ্য সেখানেও তিনি নিঃসন্দেহে যুগান্তরের পথিক।