৫৯ বর্ষ ৩২ সংখ্যা / ২৫ মার্চ, ২০২২ / ১০ চৈত্র, ১৪২৮
সোমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯২৬ - ২০২২)
পল্লব সেনগুপ্ত
সম্ভবত, সোমেনদা - সোমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনাবসানের ফলে শান্তিনিকেতনের বনেদি ঐতিহ্যের সর্বশেষ স্তম্ভটিও সরে গেল। ৯৬ বছর বয়সে তিনি প্রয়াত হয়েছেন; অবশ্যই সুপরিণত সেই বয়স। কিন্তু এই ‘বিদ্যুৎস্পৃষ্ট’ দুঃসময়েও, শান্তিনিকেতন ও বিশ্বভারতীর ঐতিহ্যের পরম্পরা যে ক’জন ধরে রাখতে পেরেছিলেন, তিনি ছিলেন তাঁদের মধ্যে অগ্রণীতম; প্রবীণতম তো বটেই। এবং যোগ্যতমও। সদা স্মিতমুখ, সুভদ্র, বিনয়ী এক পণ্ডিত হিসেবেও তিনি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রখ্যাত। শুধু এটাই নয়। এই রাজ্যের প্রগতিশীল সংস্কৃতি আন্দোলনেরও যাঁরা অভিভাবক, সোমেনদা ছিলেন তাঁদের মধ্যে প্রবীণতম অগ্রপথিক। আর রবীন্দ্রনাথকে উপলব্ধি করার যে নতুন ধারার তিনি প্রতিষ্ঠা করে গেলেন, তার ফলশ্রুতি রবীন্দ্রচর্চার ক্ষেত্রে যে এক নতুন দিগ্বলয় উন্মোচিত হয়েছে, সেটাও তো সশ্রদ্ধায় স্বীকার্য অবশ্যই।
শান্তিনিকেতনের সঙ্গে সোমেনদার তিন প্রজন্মের সম্পর্ক। তাঁর পিতামহ রাজেন্দ্রনাথকে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই ডেকে এনেছিলেন সেখানে, আশ্রমের স্কুলে পড়ানো এবং অর্থ সচিবের দায়িত্ব দিয়ে। সোমেনদার বাবা সত্যেন্দ্রনাথ ছিলেন কলা ভবনের প্রথম ছাত্রদের একজন। তাছাড়া ওঁদের পরিবারের আরও কয়েকজন বিশ্বভারতীর বিভিন্ন কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আর পরবর্তীকালে সোমেন্দ্রনাথও বিশ্বভারতী যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হলো, ক’বছর বাদে সেখানে বাংলা সাহিত্য বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৫৭-তে। পরের তিন দশক সেটাই ছিল তাঁর কর্মক্ষেত্র। এবং বাকি জীবন, মর্মক্ষেত্র।
সোমেনদার ছাত্র হতেই পারতুম আমি। হইনি যে, তার কারণ (পারিবারিকভাবে একটা যোগসূত্র ছিল তো বটেই) প্রবীণ বয়সে পৌঁছেও নানাভাবে আমার বিশ্বভারতী ও শান্তিনিকেতনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ থাকলেও, সেখানে আমি ছাত্র হিসেবে যাইনি! তবে তাঁর পড়ানোর এবং গবেষণা পরিচালনার সুপ্রবল খ্যাতির সঙ্গে আদৌ আমি অপরিচিত নই। তাছাড়া, তাঁর বিখ্যাত বইগুলি বারবার পড়ার সূত্রে, ভাবনার নানান মাত্রা যুক্ত হয়েছে মনের মধ্যে, সে কথা তো বলবই! সেই দিক থেকে তো দাবি করতেই পারি যে, এই অভাজন কলমচিও তাঁর প্রত্যক্ষ না হলেও, পরোক্ষ ছাত্র অবশ্যই! সেই দাবি করার অধিকারী আরও বহুজনই, যাঁরা তাঁর অসামান্য বইগুলি পড়ে ঋদ্ধ হয়েছেন। তবে তাঁর সরাসরিভাবে ছাত্র না হতে পারলেও সহকর্মী হবার সুযোগ কিন্তু মিলেছে! সেটা অবশ্য গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সঙ্ঘের অনুষঙ্গে। সোমেনদা দীর্ঘদিন এই সংগঠনের বীরভূম জেলা কমিটির সভাপতি ছিলেন। রাজ্য কমিটির উপদেষ্টামণ্ডলীর অন্যতম প্রধান সদস্য হিসেবে শেষ দিন পর্যন্ত তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। সংগঠনের বহু সুখ ও দুঃখের সময়ে সোমেনদা স্থিতধী অগ্রজের মতন উপদেশ দিয়ে দিশা দেখিয়েছেন, যা সংগঠনের প্রবীণ ও পুরোধা কর্মীরা স্মরণ করতে পারবেন। সোমেনদা সুপরিণত বয়সে চলে গেছেন বটে, কিন্তু গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সঙ্ঘের পক্ষে সেই যাওয়াটা কিন্তু অপূরণীয় ক্ষতি তো অবশ্যই। গত বছর দুয়েকের মধ্যে সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের বহু সহকর্মী প্রয়াত হয়েছেন। সেই তালিকায় দীর্ঘতর হলো প্রবীণতম এই উপদেষ্টার প্রয়াণে।
।। দুই।।
গবেষক এবং লেখক হিসেবে সোমেন্দ্রনাথ যে কী বিশাল ‘অলিম্পিয়ান’ উচ্চতার মানুষ ছিলেন, সেটা যাঁরা তাঁর বিখ্যাত সব বইগুলি পড়েছেন, তাঁরাই জানেন। সোমেনদার খুব উল্লেখযোগ্য বই হলো এইগুলিঃ ‘রবীন্দ্র-চিত্রকলাঃ রবীন্দ্র সাহিত্যের পটভূমিকা’; ‘রবীন্দ্র-ভাবনাঃ পস্টারিটির পথে’; ‘My Days with Ramkinkar Baij’; ‘শিল্পী রামকিঙ্করঃ আলাপচারী’। এছাড়াও বাংলার বাউল এবং ক্ষিতিমোহন সেনের লেখা ‘Hinduism’ বইয়ের অনুবাদ হিন্দুধর্ম বিষয়ক বইগুলিও তাঁর বহুমুখী পাণ্ডিত্যের পরিচয়বাহী। এদের মধ্যে রবীন্দ্র চিত্রকলা সম্পর্কিত বইটিতে তো রবীন্দ্রচর্চার সম্পূর্ণ অভিনব একটি ধারার প্রবর্তন ঘটেছে। বস্তুতপক্ষে, রবীন্দ্র সাহিত্যের ওপর অজস্র বই থাকলেও সেখানে রবীন্দ্রনাথের ছবির পরিপ্রেক্ষায় তার বিন্যাস-বিশ্লেষণ এই বইতেই প্রথম হয়। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে উত্তরকালের মানুষ কী ভাবেন, ভাববেন, ভাবতে পারেন - তারই সুমিত অন্বেষণ করেছেন ‘রবীন্দ্রভাবনাঃ পস্টারিটির পথে’ বইতে। আর রামকিঙ্কর সম্পর্কে তাঁর বই দুটি শুধু ব্যক্তিগত স্মৃতিমন্থনই নয়, আলাপচারিতার অনুষঙ্গে সেই মহান শিল্পীর শিল্পবিচার, তাদের নান্দনিকতা এবং আধুনিক ভারতীয় ভাস্কর্যে তাঁর কী বিশাল অবদান - সেই সবই বিশ্লেষিত হয়েছে স্বচ্ছন্দ আনন্দের মাধ্যমে।
শুধু রামকিঙ্করই নন, সোমেন্দ্রনাথের বিভিন্ন আলোচনায় অবনীন্দ্রনাথ, নন্দলাল বসু, এলমহার্স্ট প্রমুখের সম্পর্কে বহুবর্ণিম আলোকসম্পাত হয়েছে, যাদের মূল্যও অপরিমিত। বস্তুতপক্ষে শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্র-ঐতিহ্যের সঙ্গে একালের সেতুস্বরূপ ছিলেন তিনি। একদিকে যেমন রবীন্দ্রনাথের ছবির মধ্যে যে প্রথাবহির্ভূত রঙ ও রেখার ছোপ আছে, তার বিচারের সূত্রে মানুষের মনের গভীর, গহীন স্তরগুলিকেও উন্মোচিত করেছেন সোমেন্দ্রনাথ তাঁর লেখায়; তেমনই সেই চিত্র নির্মিতির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যের কতটা নিবিড় সম্পর্ক, এমন কি তাঁর গানেরও কী নিবিড় যোগ ছিল - সেই বিচার করে গবেষণাটিকে একটা দার্শনিক মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছেন। আবার তারই পাশাপাশি এই যুগের সামাজিক প্রয়োজনকেও না-ভুলে তিনি এমন অনেক কিছুতে পথ দেখিয়েছেন, দায়িত্ব পালন করেছেন - যা তাঁকে পাণ্ডিত্যের গজদন্ত-মিনারের মধ্যে বন্দি করে রাখেনি। বিশ্বভারতীর কর্তৃপক্ষ অনিচ্ছুক থাকলেও, সোমেনদার নেতৃত্বে অধ্যাপক সভা তৈরি হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাঁকে সাসপেনসনও ভোগ করতে হয়েছিল সেই কারণে। কিন্তু গণতান্ত্রিক আন্দোলনের চাপে কর্তৃপক্ষ অবশেষে নতিস্বীকারও করেন। আজকে বিশ্বভারতীর বুকে যে জগদ্দল পাথর চাপিয়ে রেখেছেন জনৈক একনায়কতুল্য উপাচার্য - তাঁর বিরুদ্ধে ছাত্র-অধ্যাপক-শিক্ষাকর্মীরা যেভাবে আন্দোলন করছেন, তাঁর প্রথম বীজ বপন করা হয়েছিল বহু বছর আগের সেই আন্দোলনেই। সোমেনদা ছিলেন যার নেতৃত্বে।
আবার গঠনমূলক কাজেও তাঁর ভূমিকা কিছু কম নয়। যে নিপ্পন ভবন এ দেশে জাপানের ভাষা ও সংস্কৃতি চর্চার প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে, তারও পত্তন এবং বিকাশ ঘটে তাঁরই উদ্যোগে। এজন্য বারবারই তাঁকে জাপানে যেতে হয়েছে। ইয়োরোপের বিভিন্ন দেশেও তিনি গেছেন - আধুনিক পাশ্চাত্য চিত্রশিল্প সম্পর্কে প্রত্যক্ষ উপলব্ধি অর্জনের জন্য। আসলে রবীন্দ্র ঐতিহ্যের মর্মস্থলে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সংস্কৃতির সমন্বয় ঘটেছিল - সেটাকে অনুধাবন করেছিলেন সোমেনদা গভীরভাবেই। তাই কাকাজু ওকাকুরা রবীন্দ্রনাথের সময়ে শান্তিনিকেতনে এসে যে ‘প্রাচ্যের আদর্শ’ (তাঁর বিখ্যাত বই) উদ্ভাসিত করেছিলেন, তারই পূর্ণ রূপ পায় সোমেনদার ‘নিপ্পন ভবন’ গড়ে তোলার মধ্যে। অবনীন্দ্রনাথ, বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়, নন্দলাল বসু, কে জি সুব্রহ্মণ্যম প্রমুখ যে শিল্প আন্দোলনের একটা নতুন প্রেক্ষাপট গড়ে দেন, তারই সুযোগ্য বিশ্লেষক সোমেন্দ্রনাথ পাশ্চাত্যের শিল্পকলার মুখ্য একালীন (এবং প্রাক্তনও) ধারাগুলির সঙ্গেও সুষ্ঠুভাবে পরিচিত ছিলেন। নিজে শিল্পী ছিলেন না, কিন্তু শান্তিনিকেতনে কলা ভবনের সঙ্গেও তাঁর গভীর সম্পর্ক ছিল।
সোমেন্দ্রনাথ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রদত্ত রবীন্দ্র-পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি যে বিশাল মাত্রার বিদগ্ধ মানুষ ছিলেন তাতে তাঁর আরও সহযোগিতা প্রাপ্য ছিল - অন্তত ললিতকলা ও সাহিত্য - এই দুই শাখার কেন্দ্রীয় আকাদেমি থেকে। অবশ্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সাম্মানিক ডি লিট দেন।
তবে এইসব পাওয়া-না-পাওয়ায় তাঁর বিশালত্বের কোনও হ্রাস বৃদ্ধি হয় না। চিরকালই তিনি এসবের ঊর্ধ্বেই থেকেছেন তাঁর সুস্মিত হাসি এবং সুভদ্র বাচন নিয়ে। তবে তাঁর অনুপস্থিতিতে প্রত্যক্ষভাবে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি আন্দোলনের যতটা ক্ষতি হবে, সেটা কিন্তু অপূরণীয়ই।