৬০ বর্ষ ১৫ সংখ্যা / ২৫ নভেম্বর, ২০২২ / ৮ অগ্রহায়ণ, ১৪২৯
শীতল যুদ্ধের হৃদয় ও মস্তিষ্ক
তপারতি গঙ্গোপাধ্যায়
বিজ্ঞান গবেষণা এবং বিজ্ঞানমনস্কতা, ব্যক্তি এবং সমষ্টির চেতনা, সমাজনীতি, শাসন ব্যবস্থা, তার স্থায়িত্ব ইত্যাদি ঘিরে আবর্তিত হয়। যেমন রেনেসাঁ মধ্যযুগীয় অন্ধকার পেরিয়ে সাহিত্য, শিল্প, বিজ্ঞানচেতনার উজ্জ্বল প্রকাশ। অন্যদিকে শিল্পবিপ্লব হলো নিরন্তর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণার ফসল। রেনেসাঁ আমাদের চেতনার স্থায়ী উপাদান। কিন্তু স্টিম ইঞ্জিনের আবিষ্কার, শিল্পবিপ্লব পরবর্তী যোগাযোগের উন্নতি, প্রযুক্তির উদ্ভাবনী ক্ষমতা, বিজ্ঞানের ব্যবহার, সর্বোপরি সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থাকে টপকে পুঁজিবাদ এবং বুর্জোয়া উত্থান বিজ্ঞানচেতনাকে ছাড়িয়ে প্রাকৃতিক এবং মানবসম্পদের ব্যক্তিগত মালিকানার দিকে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে পৌঁছে গেছে। শ্রম এবং শ্রমলব্ধ সম্পদের উপর শ্রমিকের অধিকার খর্ব করা, মানুষের উৎসের মেরুকরণ থেকেই সাম্রাজ্যবাদের উত্থান। রেনেসাঁ সাহিত্য, শিল্প এবং বিজ্ঞানের যে মেলবন্ধন ঘটিয়েছিল, সেই চেতনার প্রভাবই পরবর্তীতে সমাজতান্ত্রিক পৃথিবীর লক্ষ্যে লড়াইয়ের ভিত তৈরি করেছিল। সভ্যতার মস্তিষ্ক যদি বিজ্ঞান গবেষণা হয়, তবে হৃদয় হলো বিজ্ঞানচেতনা। আর এই পার্থক্য সবথেকে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছিল পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের শীতল যুদ্ধ জুড়ে।
ক্ষমতার যাত্রাপথ
শীতল যুদ্ধের প্রায় দেড়শ’ বছর আগে ১৭৮৯ সালে জার্মান রসায়নবিদ মার্টিন হাইনরিখ ক্লাপরথ পিচব্লেন্ড থেকে তাঁর আবিষ্কৃত মৌলের নাম রাখেন ইউরেনিয়াম। মার্টিন ক্লাপরথ-এর প্রায় ১১৫ বছর পরে ১৯০৫ সালে আইনস্টাইন বস্তুর জাড্য এবং শক্তির সম্পর্ক বিষয়ক তাঁর বিখ্যাত ভর ও শক্তির নিত্যতা সূত্র e=mc2 আবিষ্কার করেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আবহেই ১৯৩৮ সালে জার্মানির রসায়নবিদ ওটো হান এবং অস্ট্রিয়ার পদার্থবিদ লিজ মাইটনার নিউক্লিয়ার ফিশন প্রক্রিয়া আবিষ্কার করেন যা পরমাণু শক্তি উৎপাদনের মূলমন্ত্র। তেজস্ক্রিয় প্রক্রিয়ায় একটি মৌলের পরমাণুর নিউক্লিয়াস ভেঙে দুই বা ততোধিক অন্য মৌলের পরমাণু তৈরি হয় এবং উচ্চশক্তি উৎপন্ন হয়।
১৯৪১-এর ৭ ডিসেম্বর সকালে আমেরিকার নৌসেনা ঘাঁটি পার্ল হারবার-এ বিমান আক্রমণ করে জাপান। বোমাবর্ষণের জেরে, ২৪০০ আমেরিকান সেনা এবং সাধারণ মানুষ মারা যান। ঠিক আট মাস পরে ১৯৪২’র আগস্টে ফিসাইল মেটিরিয়াল বা সহজে বিদারণীয় পদার্থ উৎপাদন সংক্রান্ত 'ম্যানহাটান প্রজেক্ট' শুরু হয়। ক্লাপরথ, আইনস্টাইন এবং হান-মাইটনারকে এক বিন্দুতে নিয়ে আসেন ভানিভার বুশ, জে রবার্ট ওপেনহাইমার, হ্যান্স বিটা, এনরিকো ফের্মি প্রমুখের নেতৃত্বে শতাধিক বিজ্ঞানী এবং প্রযুক্তিবিদ। বুশ’র অনুরোধে রাষ্ট্রপতি রুজভেল্ট বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগ তৈরি করেন। মাত্র ২৭ মাসে তৈরি হয় পরমাণু বোমা। যুদ্ধের খরচ, মানবসম্পদ এবং কাঁচামালের চরম অভাবের মধ্যেও ম্যানহাটান প্রজেক্টে খরচ হয়েছিল ২২০ কোটি মার্কিন ডলার।
পার্ল হারবার-এর উত্তর ছিল হিরোশিমার ১ লক্ষ ৪০ হাজার এবং নাগাসাকির ৮০ হাজার সাধারণ মানুষের প্রাণ। কোনো যুদ্ধবন্দর, মিলিটারি ঘাঁটি না, দুটি নিরীহ শহর। বিজ্ঞানের ক্ষমতা, সভ্যতার হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করেছিল। ম্যানহাটান প্রজেক্ট’র এই উদ্দেশ্য সম্পর্কে আইনস্টাইনের কোনো ধারণা ছিল না। তিনি বামমনস্ক ছিলেন বলে ম্যানহাটান প্রজেক্ট-এর বিজ্ঞানীরা বহু তথ্য তাঁর থেকে গোপন রেখেছিলেন। তবু পরবর্তীতে আইনস্টাইনকে বহু ক্ষুব্ধ প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছিল। ফিশন-এর আবিষ্কারের পর থেকেই আমেরিকা এবং ব্রিটেন’র ধারণা ছিল হিটলার পরমাণু অস্ত্রের দিকে এগোচ্ছে। আইনস্টাইন রুজভেল্টকে লেখা তাঁর চিঠিতে জানান জার্মানি পরমাণু অস্ত্র তৈরি করার আগেই আমেরিকা যেন এই গবেষণা শুরু করে। তার ফলাফল লিটল বয় এবং ফ্যাট ম্যান হতে পারে, তিনি কোনোদিনও ভাবেননি। হিরোশিমা ও নাগাসাকি পৃথিবীর রাজনৈতিক ইতিহাসের পয়েন্ট অফ নো রিটার্ন।
১৯৪১ সালে জার্মানি যখন সোভিয়েত আক্রমণ করে, সোভিয়েত পরমাণু বিজ্ঞানীদের সমস্ত গবেষণা বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিছু সংখ্যক বিজ্ঞানী গোপনে এই গবেষণা চালিয়ে যেতে থাকেন। ইউরেনিয়াম-এর খোঁজ তখন পুরোদমে চলছে। কিন্তু তার একচেটিয়া সংরক্ষণ তখন আমেরিকার হাতে। ১৯৪৫ সালে ট্রুম্যান ঘোষণা করেন আমেরিকার হাতে এক নতুন অস্ত্র আছে। স্তালিন-এর সাথে তাঁর ব্যক্তিগত কথোপকথনে সেকথা উঠে এলেও স্তালিন তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেননি। ওদিকে সোভিয়েত স্পাই-রা অত্যন্ত দক্ষতার সাথে আমেরিকার মিলিটারি প্রক্রিয়া এবং অস্ত্রের খবর পৌঁছে দিতেন। এঁদের মধ্যে অন্যতম জুলিয়াস ও এথেল রোজেনবার্গ এবং ক্লাউস ফুকস্। ফুকস্ একজন পদার্থবিদ এবং ম্যানহাটান প্রজেক্ট বিজ্ঞানী। তিনি পরমাণু এবং হাইড্রোজেন বোমার সমস্ত তথ্য সোভিয়েতের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন। ১৯৪৯ সালে রাশিয়া তার প্রথম ইউরেনিয়াম পরমাণু অস্ত্র পরীক্ষা করে। আমেরিকার একাধিপত্য শেষ হয়।
সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি
বিজ্ঞানের সামাজিক ভূমিকাকে অসংখ্য কঠিন প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। নীলস্ বোর সহ বহু বিজ্ঞানী এর সুদূরপ্রসারী ফলাফল এবং সমাধান আলোচনা শুরু করেন। পরমাণু বিজ্ঞানীদের পরামর্শ ছিল একটি আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি কাঠামো তৈরি করা হোক, যা যুদ্ধপরবর্তী পরমাণু অস্ত্রের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করবে। ঠিক এই সময়, ১৫ আগস্ট, ১৯৪৫ জাপানের আত্মসমর্পণের সপ্তাহেই তড়িঘড়ি মে জনসন বিল প্রস্তাব করা হলো যা পরমাণু অস্ত্রকে মিলিটারি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এলো (৩ অক্টোবর, ১৯৪৫) । বুশ, কন্যান্ট এবং ওপেনহাইমার এই বিল সমর্থন করেন। কিন্তু ম্যানহাটান প্রজেক্ট’র অধিকাংশ বিজ্ঞানী এতে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হন। বিজ্ঞানীরা রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত হয়ে পড়েন। ক্ষমতার রাজনীতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল, বিজ্ঞানীরা এর ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরলেই চাকরি খোয়াচ্ছিলেন। তবুও সর্বস্তরে প্রতিবাদ শুরু হয়। ১৯৪৬ সালে ফেডারেশন অফ্ অ্যাটমিক সাইন্টিস্টস (FAS) গড়ে ওঠে সরকারি গোপনীয়তা বজায় রেখেও পারমাণবিক এবং তেজষ্ক্রিয় সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে এবং পরিবেশ নিরাপত্তার প্রশ্নে।
ম্যানহাটান প্রজেক্ট চলাকালীনই ফিউশন প্রক্রিয়ায় হাইড্রোজেন বোমা তৈরির কাজ শুরু করেছিলেন বিজ্ঞানী এডওয়ার্ড টেলার। ১৯৫১ সালের মধ্যে তিনি নিশ্চিত হন এটা সম্ভব। নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং-এ তাঁর উদ্যোগ ছিল 'প্রজেক্ট প্লাওশেয়ার'। ১৯৫৭ থেকে ১৯৭৫ অবধি খনি, তেল উত্তোলন, ক্যানাল তৈরি ইত্যাদি বিবিধ ইতিবাচক ক্ষেত্রে পারমাণবিক শক্তি ব্যবহার করার উদ্যোগ নেওয়া হয় প্রজেক্ট প্লাওশেয়ার-এর মাধ্যমে। কিন্তু ম্যানহাটান প্রজেক্ট সাইটগুলি আজও তেজষ্ক্রিয় এবং মানুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ। অর্থাৎ পরিবেশের কথা আসলে চিন্তাই করেননি তারা।
সোভিয়েত সমাজতন্ত্র
১৯১৭ সালে অক্টোবর বিপ্লবের পরে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম লক্ষ্য ছিল ভাববাদ ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রচার এবং সাধারণ মানুষকে বিজ্ঞানমনস্ক করে তোলা। ১৯২২ থেকে এই অভিযান আরও শক্তিশালী হয়। সেন্ট্রাল কমিটির অ্যাজিটেশনাল প্রোপাগান্ডা বিভাগ (Agitprop) চার্চের কাছে প্রতিটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও ছুটির বিজ্ঞানসম্মত বিশ্লেষণ দাবি করে, প্রতিটি প্রভিন্সে বিজ্ঞান শিক্ষা চালু করে। কিন্তু দেখা যায়, এত প্রচার সত্ত্বেও গ্রামের বেশ কিছু অঞ্চলে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গজিয়ে উঠছে। গ্রামের মানুষ তাঁদের লোকসংস্কৃতির ধারা বিসর্জন দিতে রাজি নন এবং ধর্মের বিরুদ্ধে প্রচারে সেখানে হিতে বিপরীত হচ্ছে। মানুষ অ্যাজিটপ্রপদের একঘরে করে দিচ্ছেন। কিন্তু শহরে বিভিন্ন বিজ্ঞানপত্র এবং ম্যাগাজিন তুমুল প্রচার পাচ্ছে। ১৯২২-এ মিখাইল গোরেভ 'সায়েন্স অ্যান্ড রিলিজিয়ন', ১৯২৩ সালে ইরোস্লাভস্কি 'দ্যা গডলেস' নামে দুটি সংবাদপত্র চালু করেন। ১৯২৫-এ শুরু হয় লিগ অফ্ দ্য গডলেস। স্তালিনের সময়কালে ১৯২৯ থেকে এই উদ্যোগ চরম পর্যায়ে পৌঁছায়। বিভিন্ন কমিউনিস্ট ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানের অধ্যাপকরা মানুষের জন্ম থেকে প্রাকৃতিক সমস্ত প্রক্রিয়ার ধর্মীয় ব্যাখ্যাকে সরাসরি আক্রমণ করা শুরু করেন। কয়েকশো অর্থোডক্স চার্চ বন্ধ করে দেওয়া হয়। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ধর্মকে বিদ্রূপ করা শুরু হয়। ১৯৩৭-এর সেন্সাস-এর ফর্মে চমকপ্রদভাবে ধর্মের একটি কলাম রাখা হয়। দেখা যায় তখনও দেশের ৬০ শতাংশ মানুষ ধার্মিক এবং ৪০ শতাংশ অবিশ্বাসী। অর্থাৎ বোঝা যায়, এই লড়াই সময়সাপেক্ষ। ১৯৪১ সালে হিটলারের সোভিয়েত আক্রমণের সময় বেশ আশ্চর্যজনকভাবে ধর্মযাজকরা স্তালিনকে যুদ্ধে অর্থ সাহায্য করেন, ট্যাংক তৈরিতে সাহায্য করেন। যদিও স্তালিন একে চার্চের নাগরিক দায়বদ্ধতা হিসেবেই দেখেছিলেন।
নতুন সময়
১৯৪৫ থেকে বিজ্ঞানী সের্গেই ভাভিলভ-এর নেতৃত্বে নতুন করে বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের কাজ শুরু হয়। স্তালিনের মৃত্যুর পরে নিকিতা ক্রুশ্চেভ-এর সময়ে প্রযুক্তির ব্যাপক উন্নতি হয়। যার ফলাফল ১৯৫৭ সালে স্পুটনিক-এর সফল উৎক্ষেপণ। স্পুটনিক-এর সাফল্য সোভিয়েতের মানুষকে অত্যন্ত গর্বিত করেছিল। মহাকাশ যুগের সূচনা রাশিয়ার সাইন্টিফিক স্পিরিট অনেকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল। আরও শক্তিশালী হয়েছিল দীর্ঘস্থায়ী সমাজতন্ত্রের পথ। পরের বছরই পাভেল চেরেনকোভ তাঁর গবেষণার জন্য নোবেল পান। এরপর ইউরি গ্যাগারিন-এর মহাকাশ অভিযানের পরে সোভিয়েত সংস্কৃতির মধ্যেও বিজ্ঞানের জয়গান মিশে যায়। ক্রুশ্চেভ এবং পরবর্তীতে ব্রেজনেভ আমেরিকার সাথে যোগাযোগের রাস্তা খোলেন। যদিও তাতে জটিলতা কিছুটা বেড়েই যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী পুঁজিবাদ এবং সমাজতন্ত্রের লড়াইয়ের অংশ হিসেবেই ১৯৫০ থেকে ১৯৯০ অবধি বিভিন্ন দেশের মধ্যে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অবনতি ঘটতে থাকে। এই সমস্ত প্রতিকূলতার মধ্যেও সোভিয়েত প্রযুক্তির যাত্রা অব্যাহত ছিল। ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে পৃথিবীর প্রথম ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন সালিউট-১ কক্ষপথে স্থাপিত হয়। ১৯৭৪ সালে নিউক্লিয়ার পাওয়ার মিসাইল সাবমেরিন ‘টাইফুন ক্লাস’ তৈরি হয়। ১৯৮৬ সালে প্রথম লো-অরবিট মডিউল স্পেস স্টেশন মির-এর সফল যাত্রা শুরু হয়। রেডিও রিসিভার, স্টেম সেল এবং ভিটামিন আবিষ্কারের পথিকৃৎ সোভিয়েত ইউনিয়ন। সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং চীনের প্রোপাগান্ডার লক্ষ্য ছিল দেশের মানুষের কাছে সমাজতন্ত্রের ইতিবাচক দিক তুলে ধরা। উল্টোদিকে আমেরিকা এবং ব্রিটেনের প্রোপাগান্ডার লক্ষ্য ছিল কমিউনিজম সম্পর্কে ঘৃণা এবং ভীতি তৈরি করা।
শীতল যুদ্ধে আমেরিকার বিজ্ঞানচর্চার ধরনই বদলে গিয়েছিল। সম্পূর্ণ বিজ্ঞানচর্চার উদ্দেশ্য ছিল মিলিটারি এবং যুদ্ধের জোগান। স্কুল কলেজের বিজ্ঞানশিক্ষা থেকে শুরু করে অ্যাটমিক এনার্জি কমিশন সবটাই মিলিটারি নিয়ন্ত্রণে চলে। গবেষণায় টাকার জোগান বিস্ময়কর ভাবে বেড়ে চলে। ১৯৫০ থেকে ১৯৬০ ছিল প্রোপাগান্ডার যুগ। ১৯৫৯ সালে নিক্সন সোভিয়েত ইউনিয়ন যান। ক্রুশ্চেভের সাথে তাঁর বিখ্যাত কিচেন ডিবেটে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং আমেরিকার কনস্ট্রাকশন পদ্ধতি এবং সমাজতন্ত্র ও পুঁজিবাদের পার্থক্য বেশ স্পষ্ট হয়। ক্রুশ্চেভ-এর মত ছিল মানুষের মৌলিক চাহিদার জায়গা সবসময় সুরক্ষিত রাখা উচিত। আমেরিকার বিল্ডিং রাশিয়ার মত টেঁকসই না। সোভিয়েত বিল্ডিং টেকসই হয়, কারণ তারা পরবর্তী অনেক প্রজন্মের জন্য বাসস্থানের ব্যবস্থা করেন। অর্থাৎ বিজ্ঞানের সামাজিক প্রয়োগ। নিক্সনের মত ছিল মানুষ কিছুদিন পরে আবার নতুন বাড়ি বানাতে চাইবে, কারণ তারা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির সুবিধা নিতে চাইবে। আমেরিকা তার বিজ্ঞাপন, আর্ট এবং সিনেমায় প্রমাণ করার চেষ্টা করত তারা সোভিয়েত স্বৈরাচারের পদতলে আছে। সেই সময়ে ন্যাটো এবং সিআইএ-র ভূমিকা অত্যন্ত উগ্র ছিল। যেমন কোরিয়ার যুদ্ধ, বার্লিনের অবরোধ, কিউবায় ফিদেল কাস্ত্রোকে উৎখাত করার চেষ্টা, ভিয়েতনাম-এর যুদ্ধের সময় দক্ষিণ ভিয়েতনাম-এর মাইল এর পর মাইল ফসল নষ্ট করে দেওয়া, এমন অনেক কিছু। সেই প্রেক্ষিতে সোভিয়েতের লক্ষ্য ছিল দেশের অভ্যন্তরীণ শান্তি বজায় রাখা, যেমন ১৯৫৫ সালের ওয়ারশ চুক্তি।
তৃতীয় বিশ্ব
বিজ্ঞানকে হাতিয়ার করে রাজনৈতিক আধিপত্যের অভিযান চলেছিল দুই ভিন্ন দর্শন থেকে। আইজেনহাওয়ার-এর আমেরিকা ধর্ম এবং রাষ্ট্রের মধ্যে একটা ভারসাম্য তৈরি করার চেষ্টা করে। অনেকটা স্পুটনিক-এর ফলাফল হিসেবেই ১৯৫৮ সালে নাসা গড়ে ওঠে। পরবর্তীতে জন এফ কেনেডি সারা পৃথিবীর ক্ষুধা এবং স্বাস্থ্য সমস্যার সমাধানে ১৯৬১ সালে ‘পিস কর্পস’ তৈরি করেন। ১৯৬২-তে কিউবার মিসাইল ক্রাইসিস সমাধানের চেষ্টা হয় কেনেডি এবং ক্রুশ্চেভ-এর আলোচনার মাধ্যমে। আমেরিকা তার বিদেশ নীতির অন্যতম অ্যাজেন্ডা হিসেবে ইয়োরোপ, দক্ষিণ কোরিয়া, এশিয়ায় বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে সাহায্য করে। ১৯৫৪ সালে নিউক্লিয়ার গবেষণা প্রতিষ্ঠান সার্ন (CERN)-এর জন্ম হয় জেনিভায়। ১৯৪৯ থেকে ১৯৬১’র মধ্যে জওহরলাল নেহরু তিন বার আমেরিকা ভ্রমণ করেন। আমেরিকার কৃষি, শিল্প এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যবেক্ষণ করেন। এমআইটি’র আদলে ১৯৫১ সালে গড়ে ওঠে আইআইটি খড়্গপুর। উল্টোদিকে ভারতসহ পৃথিবীর বহু অকমিউনিস্ট দেশের ভারী শিল্পসহ সমাজমুখী নির্মাণ, আর্থিক সাহায্য, কম সুদে বা নামমাত্র সুদে ঋণ সহ বিভিন্ন ধরনের সহায়তার সুবিকল্প নিয়ে এগিয়ে এসেছিল সোভিয়েত।
তিন লক্ষ বছরের আধুনিক মানুষের ইতিহাসে, ডারউইনবাদ থেকে ডায়ালেক্টিক্যাল মেটেরিয়ালিজম অবধি মানুষের সভ্যতার সমীকরণ সমষ্টির চেতনাপ্রবাহের উপর নির্ভরশীল। এককের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার জন্যও সমষ্টির উদ্যোগ জরুরি। সেখানেই কৃষক, শ্রমিক, উৎপাদন ব্যবস্থার ভারসাম্য। শীতল যুদ্ধ মূলত নীতিগত সংঘর্ষ। পুঁজিবাদ এবং মার্কসবাদের মুখোমুখি লড়াই। পৃথিবীর ভৌগোলিক মেরুর মতই দুই রাজনৈতিক মেরু। যুদ্ধনীতি, বিজ্ঞানকে সমরাস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা, সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক স্বাধীনতা এবং সুরক্ষার ক্ষেত্রে ভারসাম্যের বদল এই জিওপলিটিক্যাল ম্যাপিং-এর মূল প্রতিপাদ্য। শীতল যুদ্ধ বিজ্ঞানের রাজনৈতিক ব্যবহার শিখিয়েছে। শীতল যুদ্ধের সংকট বুঝিয়েছে এই আধিপত্য এবং শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই পেরিয়ে যেতে হবে প্রকৃতি ও মানুষের সহাবস্থানে। বিজ্ঞানের সচেতন প্রয়োগই তার একমাত্র পথ।