E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ১৫ সংখ্যা / ২৫ নভেম্বর, ২০২২ / ৮ অগ্রহায়ণ, ১৪২৯

সেলুলয়েডের বুকে নভেম্বর বিপ্লবের গাথা

সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়


সের্গেই আইজেনস্টাইন

“The cinema is for us the most important of the arts.” - Lenin

বিপ্লবোত্তর যুগে রাশিয়া তথা সোভিয়েত ইউনিয়নে চলচ্চিত্র শিল্পে এক বিশাল কর্মকাণ্ডের সূচনা হয়। বিপ্লব সফল হওয়ার দু’দিনের মধ্যে ৯ই নভেম্বর, ১৯১৭ একটি ডিক্রি জারির মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্র শিল্প উপবিভাগ গঠন করা হয়। ভ্লাদিমির লেনিনের স্ত্রী নাদেজদা ক্রুপস্কায়া এই বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন। সোভিয়েত সরকার সিনেমাকে শিক্ষাবিস্তার ও রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রচারের বাহক হিসাবে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। সেই সময় বিপ্লবী সাংস্কৃতিক প্রচার আন্দোলন প্রলেটকাল্ট শিল্প-সংস্কৃতির অন্যান্য শাখার মতো চলচ্চিত্র নিয়ে নানারকম উদ্যোগ গ্রহণ করতে থাকে। রাশিয়ার মস্কোতে বিশ্বের প্রথম ফিল্মস্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। সোভিয়েত রাষ্ট্রের প্রথমপর্বে তীব্র অর্থনৈতিক সংকট, পরিকাঠামোর অভাব, কলাকুশলীর অভাব সত্ত্বেও নজিরবিহীন মানসিক দৃঢ়তায় চলচ্চিত্র শিল্পীরা এই মাধ্যমের ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান এবং এই শিল্পের এক সম্পূর্ণ নতুন প্রয়োগ রীতির উদ্ভাবন করেন। সোভিয়েত রাষ্ট্র সর্বতোভাবে এই শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতা করে। নভেম্বর বিপ্লবের কথা ইতিহাসে, নানা মাধ্যমের আখ্যানে যেমন ঠাঁই করে নিচ্ছিল তেমনই সোভিয়েত সিনেমাতেও বলশেভিক বিপ্লবের ঘটনা ও বিশ্লেষণ চিরস্থায়ী হলো দুটি চলচ্চিত্রের সুত্রে। ১৯২৭ সালে নভেম্বর বিপ্লবের দশম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বানে সের্গেই আইজেনস্টাইন নভেম্বর বিপ্লবের কথা পর্দায় তুলে ধরতে উদ্যোগী হলেন। বিপ্লববার্ষিকী উদযাপনের কমিটি হলো এই চলচ্চিত্রের প্রযোজক। তৈরি হলো 'অক্টোবর' (১৯২৭)। একইভাবে কেন্দ্রীয় কমিটির ডাকে মস্কো ফিল্ম স্কুলের প্রাক্তনী ভি. আই. পুদভকিন ওই বছরেই নভেম্বর বিপ্লবের ইতিহাস চিত্রায়িত করেন ‘দ্য এন্ড অফ সেন্ট পিটার্সবার্গ’(১৯২৭) ছবিতে। উভয় ছবিই নির্বাক ও সাদা-কালো।

‘অক্টোবর’ (১৯২৭) ছবির একটি দৃশ্য। ছবিতে লেনিনের ভূমিকায় অভিনয় করেন ভ্যাসিল নিদান্দ্রভ।

‘অক্টোবর’ ছবিতে এই ঐতিহাসিক ঘটনার বস্তুনিষ্ঠ পুনঃনির্মাণের জন্য আইজেনস্টাইন বিশেষভাবে নির্ভর করলেন তাঁর নিজের অভিজ্ঞতার উপর, কারণ এই তরুণ ইঞ্জিনিয়ার নিজে ছিলেন রুশ বিপ্লবের একজন অংশগ্রহণকারী এবং বিপ্লবোত্তর গৃহযুদ্ধের যুগের একজন সক্রিয় সাংস্কৃতিক কর্মী। এছাড়াও তিনি বহু সাক্ষাৎকার, নিউজ-রিল, স্মৃতিকথা এবং আমেরিকান সাংবাদিক জন রীডের ‘দুনিয়া কাঁপানো দশদিন’ বইটির উপর ভিত্তি করে চলচ্চিত্রের বিস্তৃত চিত্রনাট্য প্রস্তুত করলেন। এই কাজে তাঁকে সাহায্য করেন গ্রিগরী আলেকজান্দ্রভ। তবে বিপ্লবের ঘটনাক্রমের অনুপুঙ্খ বিবরণের বদলে তিনি ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে নভেম্বর পেত্রোগ্রাদ (ছবি নির্মাণের সময় এই শহরের নাম ছিল লেনিনগ্রাদ, বর্তমানে সেন্ট পিটার্সবার্গ) শহরে ঘটা কয়েকটি ঘটনার চিত্রায়ণ করলেন। ছবিতে মোটামুটিভাবে ফেব্রুয়ারি মাসে কেরেনস্কি সরকারের গঠন থেকে বিপ্লব সফল হওয়া পর্যন্ত ঘটনা প্রবাহ ধরা আছে। শ্যুটিং-এর জন্য তিনি সোভিয়েত স্থল ও নৌ-সেনা বাহিনীকে অবাধে ব্যবহার করলেন, শীত-প্রাসাদ দখলের দৃশ্যে এক হাজার জনের মতো শিল্পী অংশ নিয়েছিল। শ্যুটিং-এর জন্য প্রায় ছয় মাস ধরে শহরের রাস্তা বিপর্যস্ত হলো। ওই বছর নভেম্বর মাসে সম্পাদনার শেষে ছবিটির দৈর্ঘ্য দাঁড়ায় তেরো হাজার ফিট (প্রায় তিন ঘণ্টা)। অবশ্য পরে প্রায় হাজার ফিট বাদ দেওয়া হয়। ছবির জন্য সংগীত রচনা করেন এডমন্ড মেইসেল। আইজেনস্টাইনের অন্য ছবির মতো এই ছবিতে চিত্রগ্রহণের দায়িত্ব সামলান এডওয়ার্ড তিসে আর লেনিনের ভূমিকায় অভিনয় করেন ভ্যাসিল নিদান্দ্রভ। নভেম্বর বিপ্লবে অংশগ্রহণকারী অনেক বিপ্লবী, লাল ফৌজের সদস্য এই ছবিতে অভিনয় করেছিলেন।

পর্দায় গল্প বলার যে শৈলীর সঙ্গে আমরা পরিচিত তা মূলত ডি. ডব্লিউ. গ্রিফিথের অবদান, যা হলিউডের স্টুডিয়ো প্রথার হাত ধরে সারা পৃথিবীতে কাহিনিচিত্র নির্মাণের ব্যাকরণে পরিণত হয়। স্বয়ং লেনিন গ্রিফিথের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন, আইজেনস্টাইন, পুদভকিন, কুলেশভের মতো সোভিয়েত সিনেমার দিকপালেরা গ্রিফিথের গুণমুগ্ধ ছিলেন, কিন্তু সোভিয়েত চলচ্চিত্রবেত্তারা বুর্জোয়া সিনেমার পরিবর্তে নতুন সিনেমার জন্ম দিলেন যা কেবল বিষয়ে নয় আঙ্গিকেও আলাদা। তাই আইজেনস্টাইন চলচ্চিত্র ভাষার একজন স্বীকৃত পথিকৃৎ। মসৃণভাবে শটের পর শট জুড়ে কাহিনি বর্ণনার রীতিতে আইজেনস্টাইন আস্থাশীল ছিলেন না। তিনি মনে করতেন চলচ্চিত্র তার দর্শককে বাস্তবতা ভুলিয়ে ছবির চরিত্রদের সঙ্গে একাত্ম করে, ফলে এর মধ্যে দিয়ে চলচ্চিত্র দর্শকের চেতনাও নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে। দর্শকের বিশ্লেষণাত্মক মনকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়। তাই তিনি চান তাঁর ছবি দেখে দর্শক যেন কল্পজগতের কাছে আত্মসমর্পন না করেন। তিনি চলচ্চিত্রের উপকরণগুলি এমনভাবে প্রয়োগ করতে চান যাতে তাঁর ছবি দেখে দর্শক যেন ভাবতে বাধ্য হন। আইজেনস্টাইন তাঁর সকল ছবিতেই মন্তাজ রীতির মাধ্যমে নিজস্ব ন্যারেটিভ প্রস্তত করেন। বিপরীতধর্মী দুটি শট পরপর যুক্ত করে নতুন অর্থ প্রকাশের রীতি হলো মন্তাজ। আইজেনস্টাইন তাঁর মন্তাজের ধারণা যা 'মন্তাজ অফ অ্যাট্রাকশন' নামে পরিচিত, গড়ে তোলেন কার্ল মার্কসের দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের ধারণার ভিত্তিতে। মার্কসের সূত্রের সমীকরণ 'থিসিস+অ্যান্টিথিসিস = সিন্থিসিস' তিনি প্রয়োগ করেন তাঁর মন্তাজে। তিনি চলচ্চিত্রের গঠনগত, মানসিক ও বৌদ্ধিক স্তরে তাঁর মন্তাজ ভাবনা প্রয়োগ করেন। এইভাবে আইজেনস্টাইন তাঁর নিজস্ব চিত্রভাষার সৃষ্টি করেন। তার অন্যান্য ছবির মতো ‘অক্টোবর’ও 'মন্তাজ অফ অ্যাট্রাকশন'-এর ধারণা অনুসরণ করেছে। আইজেনস্টাইন বিভিন্ন প্রকার মন্তাজ চিহ্নিত করেন, তাদের অন্যতম হলো বৌদ্ধিক মন্তাজ (Intellectual Montage)। এই মন্তাজে শটের পর শট যুক্ত হয়ে দৃশ্যমান রূপকের সৃষ্টি করে। ‘অক্টোবর’-এর পরিচালক এই বৌদ্ধিক মন্তাজ ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেন। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানের তুলনা টানা হয় যান্ত্রিক ময়ূরের সাথে, তার অনুগত সেনাবাহিনীর সাথে টিনের তৈরি পুতুল যোদ্ধার, মেনশেভিকদের যুক্তির সাথে বীণাবাদনরত নারীর আঙুলের। ছবির আখ্যানে নেভস্কি স্কোয়ারে প্রতিবাদী জনতাকে প্রতিহত করতে পুলিশ যান্ত্রিকভাবে একটি সেতুর দুই প্রান্ত আলাদা করে ফেলে। সেতুটি বিভক্ত হয়ে যাওয়ার দৃশ্যটি আইজেনস্টাইন কাব্যিক রূপালংকারে পরিণত করেন দৃশ্যটি বাস্তবে ঘটতে যত সময়1 লাগবে তার চেয়ে বেশি সময় ধরে দেখিয়ে। পর্দায় ক্রমশ দূরে সরে যায় সেতুর একপ্রান্তের খোলামুখে মৃত্যুমুখি সাদা ঘোড়া আর অন্যপ্রান্তে মৃত বালিকার উড়ন্ত মাথার চুল। এই দীর্ঘায়িত দৃশ্যে পরিচালক একটি ঘটনার মনস্তাত্ত্বিক কালপর্বকে ঘটনাক্রমের কালপর্বের বিপরীতে উপস্থাপন করেছেন। ছবির শুরুতে জার তৃতীয় আলেকজান্ডারের মূর্তি ভাঙার দৃশ্য দর্শক দেখে, সেই দৃশ্য পিছন দিকে চালিয়ে (Rewind) সামন্তপ্রভুদের ক্ষমতায় ফেরার খোয়াব বোঝানো হয়। পুরো ছবিতেই এই ধরনের বহু চিত্রকল্প ব্যবহার করা হয়েছে।

ভেসেভোলোদ ইল্লারিওনোভিচ পুদভকিন

বিশ্ববন্দিত সোভিয়েত চিত্রপরিচালক পুদভকিনের পরিবেশনরীতি সম্পূর্ণ পৃথক। ‘দ্য এন্ড অফ সেন্ট পিটার্সবার্গ’ বিপ্লবের ঘটনাক্রমের সরাসরি বর্ণনা নয় বা বিশ্লেষণও নয়, যেমনটা আইজেনস্টাইনের ‘অক্টোবর’ ছবিতে দেখা যায়। পুদভকিন তার ছবিতে বিপ্লবের পটভূমিকায় ব্যক্তি জীবনের ঘটনাবলিকে হাজির করেন। তিনি এই ঐতিহাসিক ঘটনাকে দেখান এক অতি সাধারণ মানুষের ব্যক্তিজীবনের প্রেক্ষিতে। এই ছবির কালপর্ব ১৯১৫ থেকে ১৯১৭ সালের মধ্যে বিস্তৃত। ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র এক গ্রাম্য তরুণ জারশাসিত রাশিয়ার রাজধানী সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরে কাজের সন্ধানে আসে। বেকারত্ব তাকে সহজেই মিল মালিকের ভাড়াটে গুন্ডাদলের সদস্য করে ফেলে। নিজের অভিজ্ঞতায় সে যখন মালিকের স্বরূপ বুঝতে পেরে প্রতিবাদ করে তখন তার ঠাঁই হয় জেলে, যেখান থেকে তাকে বাধ্য করা হয় সৈন্য দলে যোগ দিয়ে যুদ্ধে যেতে। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে সে বিপ্লবের শরিক হয়। এই ছবির চিত্রগ্রাহক ছিলেন আন্তোলি গ্লোভসিয়া।

‘দ্য এন্ড অফ্ সেন্ট পিটার্সবার্গ’ (১৯২৭) ছবির পোস্টার (রুশ ভাষায়)।

পুদভকিনও তাঁর ছবিতে মন্তাজের ব্যবহার করেন কিন্তু তাঁর মন্তাজ আইজেনস্টাইনের থেকে একেবারেই আলাদা। আইজেনস্টাইন পর্দায় মহাকাব্য নির্মাণ করে থাকলে পুদভকিন অনেক বেশি ব্যক্তি মানুষের জীবন নির্ভর। পুদভকিন গ্রিফিথের থেকে গণ-অভ্যুত্থানের দৃশ্যগুলি চিত্রায়িত করার রসদ সংগ্রহ করেছিলেন। গ্রিফিথের মতোই তিনি অর্থবোধক শট ব্যবহারে পটু। আখ্যানের নায়ক যখন প্রথম পিটার্সবার্গ শহরে আসে তখন তাকে হাই-অ্যাঙ্গেল শটে দেখান হয়। বিশাল প্রাসাদগুলির তুলনায় সে যেন অতি ক্ষুদ্র, আবার সে যখন মুক্তি-বাহিনীর সদস্যরূপে শীত প্রাসাদ আক্রমণে অংশ নেয় তখন তাকে লো-অ্যাঙ্গেল-এ দেখান হয়, নায়ক হয়ে ওঠে বাস্তবের চেয়েও বিশালকায়। একই সঙ্গে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের ঘটনাবলির নাটকীয় উপাদান তাকে আকর্ষণ করত। পুদভকিনের মন্তাজ প্রতীকীভাবে ছবির কাহিনি বর্ণনার রীতিকে পুষ্ট করে। প্রায় কখনই তিনি আইজেনস্টাইনের মতো বৌদ্ধিক বিমূর্ততা (abstract) বিমূঢ়তার প্রকাশ করতেন না। তিনি বিশ্বাস করতেন মন্তাজের লক্ষ্য সংঘাত নয় সংযোগ স্থাপন। তিনি স্থাপত্য শিল্পের ঢঙে তাঁর ছবির কাঠামোটি নির্মাণ করতেন যেখানে আইজেনস্টাইনের পদ্ধতি ছিল দ্বান্দ্বিকতার ওপর নির্ভরশীল। তাই আইজেনস্টাইন ও পুদভকিনের তুলনামূলক আলোচনা ছবির গঠনের চেয়ে দর্শক মনে ছবির অভিঘাতের ওপর বেশি নির্ভরশীল। আইজেনস্টাইন যেখানে তাঁর শটগুলির মধ্যে সংঘাত সৃষ্টি করে চলচ্চিত্রের অর্থ প্রকাশ করতে চাইতেন সেখানে পুদভকিন দর্শকের আবেগের কাছে তাঁর বক্তব্য উপস্থিত করাকে শ্রেয় মনে করতেন। ‘দ্য এন্ড অফ্ সেন্ট পিটার্সবার্গ’ সেভাবেই এগিয়েছে।

‘দ্য এন্ড অফ্ সেন্ট পিটার্সবার্গ’ (১৯২৭) ছবির একটি দৃশ্যে অভিনেতা ইভান চুভেলেভ।

এই দুটি ছবিই বিশ্ব-চলচ্চিত্রের অমুল্য সম্পদ। ছবি দুটি নির্মিত হয় বিপ্লবের এক দশকের মধ্যে, সোভিয়েত রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায়, ফলে বস্তুনিষ্ঠতার অভাবের প্রশ্ন নেই। শ্রমিকশ্রেণির নতুন রাষ্ট্র নতুন সিনেমারও জন্ম দিল, এই ছবি দুটি সেই নতুন সিনেমার উজ্জ্বলতম উদাহরণগুলির প্রথম সারিতে রয়েছে।