৬০ বর্ষ ১৫ সংখ্যা / ২৫ নভেম্বর, ২০২২ / ৮ অগ্রহায়ণ, ১৪২৯
সংবেদনশীল সংরক্ষণ
অলকেশ দাস
সংরক্ষণের অর্থনৈতিক মাপকাঠির বৈধতা
২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগে সংবিধানের ১০৩ তম সংশোধনী হয়েছিল।যারা অর্থনৈতিকভাবে দুর্বলতর (ইকনমিক্যালি উইকার সেকশন) তাদের জন্য ১০ শতাংশ সংরক্ষণ শিক্ষায় এবং সরকারি চাকুরিতে রাখার জন্য। সেই সংশোধনী আদৌ বৈধ কিনা সেই বিষয় নিয়ে উচ্চ আদালতে চ্যালেঞ্জ হয়েছিল। পাঁচজন বিচারকের সুপ্রিম কোর্ট বেঞ্চ শেষ অবধি পুরনো রায়কেই বৈধতা দিয়েছেন। যদিও রায়ের প্রশ্নে এক বিভাজনরেখা সামনে এসেছে। তিনজন বিচারক বৈধতার পক্ষে এবং দুজন বিচারক অন্য মত দিয়েছেন। ওই বেঞ্চে থাকা বিচারকদের মধ্যে ছিলেন প্রধান বিচারপতি ইউ ইউ ললিত। বিচারক হিসেবে ওইদিনই তাঁর শেষ দিন ছিল।
রায়দানে বিচারকদের মধ্যে বিভাজন
চ্যালেঞ্জ ছিল যে, সংরক্ষণে অর্থনৈতিক মাত্রাকে সংবিধান অনুমোদিত করে কিনা। সুপ্রিম কোর্ট তার রায়ে বলে যে, ১০৩ তম সংবিধান সংশোধনী সংবিধানের মূল কাঠামোকে অক্ষুণ্ণ রেখেছে, তাকে ডিঙিয়ে যায়নি। আদালতে চ্যালেঞ্জ ছিল যে, সংবিধানের মূল কাঠামোকে আঘাত করা হয়েছে কারণ, এই অর্থনৈতিক দুর্বলতর অংশের সংরক্ষণে সামাজিক এবং শিক্ষাগত পশ্চাৎপদ অংশকে (এসসি, এসটি, ওবিসি) বিযুক্ত করা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয় যে, এটি সংবিধানের মূল বৈশিষ্ট্যকে আঘাত না করেই কোটার সর্বোচ্চ লক্ষ্যমাত্রাকে অতিক্রম করেছে ,কারণ এই লক্ষ্যমাত্রা নমনীয়। অর্থনৈতিকভাবে পশ্চাৎপদ অংশের সংরক্ষণকে কোনোভাবেই বৈষম্যমূলক বলা চলে না। সুপ্রিম কোর্ট তার রায়ে উল্লেখ করে যে, সংরক্ষণের নীতির পর্যালোচনা করা উচিত। এর একটা সুনির্দিষ্ট সময়সীমা থাকা দরকার। এটা অনন্তকাল ধরে চলতে পারেনা। যদিও কথাগুলি একজন বা দুজন বিচারকের মন্তব্যের মধ্যে এসেছে। বিচারক রবীন্দ্র ভাট সংখ্যাগুরু মতামতের বিরুদ্ধে ছিলেন। অর্থনৈতিক পশ্চাৎপদ অংশের সংরক্ষণের বৈধতার বিরুদ্ধেই মত দেন। এই অংশের সংরক্ষণের সময় যখন তফশিলি জাতি, আদিবাসী ও অন্যান্য পিছিয়েপড়া জাতিভুক্তদের বিযুক্ত করা হয় তখন তিনি বলেন যে, এই রায় বৈষম্যমূলক। প্রধান বিচারপতি ললিতও তাঁর সঙ্গে একই মত পোষণ করেন।
কেন অর্থনৈতিক দুর্বলতর অংশের জন্য সংরক্ষণে সমর্থন
১৯৯০ সালে সংসদে অন্যান্য পশ্চাৎপদ অংশের (ওবিসি) সংরক্ষণের জন্য আলোচনা চলাকালীনই সিপিআই(এম)’র পক্ষ থেকে সাধারণ শ্রেণির দরিদ্রদের জন্য কিছু পরিমাণ সংরক্ষণের দাবি উত্থাপন করা হয়েছিল। সেই সময় আরএসএস’র পক্ষ থেকে দেশজুড়ে সংরক্ষণ বিরোধী তীব্র জিগির তোলা হচ্ছিল। লক্ষ্য ছিল তথাকথিত উচ্চবর্ণীয় মানুষের মধ্যে বঞ্চনা বোধ তৈরি করে তাদের সংকীর্ণভাবে সংহত করা। সারাদেশে তথাকথিত নিম্নবর্ণীয় ও পশ্চাৎপদ অংশের যে ভাবাবেগ মণ্ডল কমিশনকে কেন্দ্র করে তৈরি হচ্ছিল তার পালটা হিসাবে সংঘ পরিবার হিন্দু ভাবাবেগ তৈরি করার কাজে নেমে পড়েছিল। সেই সময় তাকে বর্ণিত করা হয়েছিল কমণ্ডুল রাজনীতি হিসাবে। সেই সময় সিপিআই(এম) মনে করেছিল যে, এই ধরনের সংরক্ষণ ব্যবস্থা লাগু হলে সংরক্ষণবিরোধী আন্দোলনের সাথে সংঘটিত তীব্র মেরুকরণকে খানিকটা প্রশমিত করবে। এই একই সময়ে সিপিআই(এম) ওবিসি’দের জন্য ২৭ শতাংশ সংরক্ষণকে পূর্ণ সমর্থন করেছিল। কিন্তু তাদের বক্তব্য ছিল যে, এই সংরক্ষণ যেন প্রকৃত অন্যান্য পশ্চাৎপদ জাতিভুক্ত মানুষ পায়। এবং সেই শ্রেণিগত দৃষ্টিভঙ্গিগত কারণেই ওবিসি সংরক্ষণে একটি অর্থনৈতিক মানদণ্ডের দাবি সিপিআই(এম) করে। সুপ্রিম কোর্ট একেই ‘ক্রিমি লেয়ার’ হিসেবে চিহ্নিত করে এবং তাদের ওবিসি সংরক্ষণের সুবিধা থেকে বিযুক্ত করে।
অর্থনৈতিক মাপকাঠি নির্ণয়ে সকলের মতামত নেওয়া হয়নি
অর্থনৈতিকভাবে দুর্বলতর অংশের ১০ শতাংশ সংরক্ষণের বিষয়টি সংসদের দুই কক্ষেই অনুমোদিত হয়। এই বিষয়ে কোনো রাজনৈতিক দলই বিরুদ্ধাচরণ করেনি। কিন্তু প্রাপকদের অর্থনৈতিক মাপকাঠিটি পরে যুক্ত হয়। রাজনৈতিক দলগুলির মতামত নেওয়া হয় না। সমস্যা বাঁধে সেখানে। বিজেপি সরকার ঠিক করে যে, অর্থনৈতিকভাবে দুর্বলতর অংশ বলতে বোঝাবে সেই পরিবারকে, যাদের বার্ষিক আয় আট লাখ টাকার নিচে। অর্থাৎ কোনো পরিবার মাসে ৬৬,৬৬৬ টাকা আয় করলেও তাকে গরিব ধরতে হবে। এ ছাড়াও বলা হয় যে, পরিবারে পাঁচ একরের বেশি কৃষি জমি নেই বা এক হাজার বর্গফুটের বেশি এলাকার আবাসিক ফ্ল্যাট নেই বা বিজ্ঞাপিত পৌর এলাকায় একশো বর্গ গজের কম বাস্তু জমি রয়েছে এমন পরিবারকেও অর্থনৈতিকভাবে দুর্বলতর বলা যাবে। অর্থনৈতিকভাবে দুর্বলতর পরিবার সংজ্ঞায়িত করার এই প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে সিপিআই(এম) স্মারকলিপি প্রদান করে।
অর্থনৈতিকভাবে দুর্বলতর অংশের সংরক্ষণের অর্থনৈতিক মাপকাঠি বদলাতে হবে
আসলে অর্থনৈতিকভাবে দরিদ্রদের সংরক্ষণের নাম করে অবস্থাপন্নদেরও সংরক্ষণের সুযোগ করে দেওয়ার ব্যবস্থা করে বিজেপি সরকার। আসলে মোদি সরকার এটাকে তথাকথিত সামাজিক উচ্চবর্ণের সংরক্ষণ হিসেবে দেখাতে চাইছিল। এসসি, এসটি, ওবিসি সংরক্ষণের পালটা। উচ্চবর্ণকে হাতে রাখার কৌশল। ওবিসি সংরক্ষণে অর্থনৈতিক ক্রিমি লেয়ারের প্রয়োগ হয়, অথচ অর্থনৈতিক দুর্বলতর অংশের সংরক্ষণে অর্থনৈতিক মাপকাঠি খুল্লামখুল্লা হয়! সাধারণভাবে আয়কর ছাড়ের সীমা হচ্ছে, যে পরিবার বার্ষিক আড়াই লক্ষ টাকা আয় করে, তার উপরে আয় করলে সেই পরিবারকে আয়কর দিতে হয়। বার্ষিক ২.৫ থেকে ৮ লক্ষ টাকা আয়কারী পরিবার আয়কর দাতা পরিবার। অথচ তাকে দরিদ্র দেখিয়ে সংরক্ষণের সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে। আমাদের দেশের উপরের দিকে উচ্চতর আয় করা ১০ শতাংশের মাসিক পারিবারিক আয় ন্যূনতম ২৫ হাজার টাকা। মানে বছরে তিন লাখ টাকা। একই পরিবারের দু’জন যদি আয় করে তাহলে বছরে মোট আয় ছ’লাখ টাকা। বার্ষিক ৮ লাখ টাকার নিচে। এর মানে দাঁড়ায় ৯০শতাংশ ভারতীয় এই অর্থনৈতিক দুর্বলতর অংশের সংরক্ষণের কোটা গ্রহণ করতে পারবে। একইরকমভাবে ভারতে কৃষিতে যারা নিযুক্ত তাদের ৮৬ শতাংশ ছোটো, প্রান্তিক চাষি যাদের ৫ একর বা দুই হেক্টরের কম জমি আছে। এগ্রিকালচারাল সেন্সাসের রিপোর্ট তাই বলছে। সুতরাং কৃষিতে যুক্ত ৮৬ শতাংশ মানুষ অর্থনৈতিক দুর্বলতর অংশের সংরক্ষণের সুযোগ পাবে। সম্প্রতি সিএমআইই তাদের কনজিউমার পিরামিডস হাউজহোল্ড সার্ভে ডাটাতে দেখিয়েছে যে, ভারতে ২.৩ শতাংশ পরিবারের বার্ষিক আয় আট লক্ষ টাকার বেশি। ২০১৫ সালে দেখা গিয়েছিল ৯৮ শতাংশ পরিবারের বাৎসরিক আয় আট লাখ টাকার নিচে। এই হিসাবে ৯৮ শতাংশ পরিবার অর্থনৈতিক দুর্বলতর অংশের সংরক্ষণের সুযোগ পাবে। তার মানে এখানে সংরক্ষণের সুবিধা নেওয়ার প্রতিযোগিতায় গরিব মানুষ হারিয়ে যাবে। সাধারণ জাতির মধ্যে দারিদ্র্যসীমার নিচে ১৮.২ শতাংশ মানুষ থাকে। এদের জন্যই অর্থনৈতিক দুর্বলতর অংশের সংরক্ষণের কথা ভাবা হয়েছিল। এরাই এখন কোনো ভাগ পাবে না। হতদরিদ্রদের বঞ্চনা থেকেই গেল। উদ্বেগের জায়গা এখানেই। সেই উদ্বেগের কথা মাথায় রেখেই কেরালার এলডিএফ সরকার অর্থনৈতিকভাবে দুর্বলতর অংশের মানদণ্ড ও কোটার পরিমাণ নির্ধারণের জন্য কমিশন গঠন করেছে। যাদের পারিবারিক আয় চার লাখ টাকার নিচে এবং যাদের আড়াই একরের বেশি কৃষি জমি নেই, তারাই হবে অর্থনৈতিক দুর্বলতর অংশভুক্ত পরিবার। কেরালা সরকার এইভাবেই সাধারণ জাতিভুক্ত দরিদ্রদের সংরক্ষণের সুবিধা দিচ্ছে। কেন্দ্রীয় সরকারকেও অর্থনৈতিক দুর্বলতর অংশের পরিবার সংজ্ঞায়নে নতুন চিন্তা আনতে হবে।
অর্থনৈতিক দুর্বলতর অংশের সংরক্ষণে তারাই থাকবে যারা অন্য কোনো সংরক্ষণের অন্তর্গত নয়
‘সামাজিক ও শিক্ষাগতভাবে’ পশ্চাৎপদ জাতিগুলির সংরক্ষণকে সমর্থন করার সময়, তফশিলি জাতি ও আদিবাসীদের সংরক্ষণকে সমর্থনের সময়, এমনকী অর্থনৈতিক দুর্বলতর অংশের সংরক্ষণের সমর্থনের সময়ও সিপিআই(এম) সবসময় মনে রেখেছে এদেশের এক নিপীড়নমূলক জাতি ব্যবস্থাকে - যা শতাব্দীর পর শতাব্দী চলে এসেছে। মনে রেখেছে শ্রমজীবী ও সমস্ত জাতি ও সম্প্রদায়ের দরিদ্রদের একত্রিত করার বিষয়টি। কারণ একমাত্র এইভাবেই শোষণমূলক আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই করা যেতে পারে। সিপিআই(এম)’র অভিমত ছিল সংরক্ষণের এই অংশটি কোনোভাবেই তফশিলি জাতি, আদিবাসী ও অন্যান্য পিছিয়েপড়া জাতির সংরক্ষণের অংশকে প্রভাবিত করতে পারবে না। ঠিক তেমনি অর্থনৈতিকভাবে দুর্বলতর অংশের সংরক্ষণের পরিমাণেও তারাই থাকবে যারা যে ধর্মীয় গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হোক না কেন–যারা চালু সংরক্ষিত কোটার কোনো সুবিধা নিতে পারেনি।
সংরক্ষিত বনাম জেনারেল
এখন তপশিলি জাতি, আদিবাসী বা অন্যান্য পিছিয়ে পড়া জাতিভুক্ত মানুষেরা বলতে পারবে যে, তাদের সংরক্ষণ নিয়ে যারা বিদ্রূপ করত তারা হয়তো এখন আপাতত নিশ্চুপ থাকবে। ইডব্লিউএস সংরক্ষণে এখন আর মেধা নিয়ে কথা উঠবে না। যারা দীর্ঘ অধিকারহীনতার নিরাময় হিসেবে সংরক্ষণকে দেখতে শেখেনি তাদেরও এখন আর হীনম্মন্য হওয়ার সুযোগ নেই। এদেশে এখন এভরি কাস্ট ইজ এ কোটা বেনিফিশিয়ারি।একটা মত আছে যে, যদি একটি নির্দিষ্ট শতাংশ আসন কোনো বর্ণগোষ্ঠীর জন্য বরাদ্দ করা হয়, তাহলে সাধারণ বিভাগে বা জেনারেল ক্যাটাগরিতে সেই বর্ণগোষ্ঠী কেন সুযোগ পাবে? বর্ণগোষ্ঠীর প্রতিযোগীদের তাদের নিজস্ব আলাদা বন্ধনীতেই থাকা উচিত। যেমন ট্রেনের কম্পার্টমেন্ট প্রসঙ্গে কথা ওঠে কেন মহিলারা জেনারেল কম্পার্টমেন্টে উঠবেন মহিলাদের জন্য নির্দিষ্ট কম্পার্টমেন্ট থাকা সত্ত্বেও। মহিলাদের তখন পালটা বলতে হয় যে, এটা পুরুষদের জন্য নির্দিষ্ট কম্পার্টমেন্ট না, এখানে পুরুষ, মহিলা সবাই ওঠার জন্য যোগ্য। আবার সমাজে পঞ্চাশ শতাংশ মহিলা হওয়া সত্ত্বেও ট্রেনের নটি কম্পার্টমেন্টের কেবলমাত্র একটি (সামনে অর্ধেক বগি+পিছনে অর্ধেক বগি) মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত। যদি শুধুমাত্র মহিলা রেলযাত্রীদের কথা ধরা যায় তাহলেও সেই সংখ্যা অনুযায়ী একটি সংরক্ষিত বগি চাহিদা মেটাতে পারেনা। পশ্চাৎপদ বর্ণগোষ্ঠীর সামনে থাকা সামাজিক, অর্থনৈতিক, পরিপ্রেক্ষিতগত বাধাগুলিকে পিছনে ফেলে কেউ যদি সাধারণ বিভাগের যোগ্যতায় প্রবেশ করে তখন তো তাদের সাহায্য করার জন্য ইতিবাচক পদক্ষেপের প্রয়োজন নেই। যখন কেউ বর্ণ পরিচয়ের বাধা মুছে ফেলে তখনও আমরা তাদের মধ্যে জাত ছাড়া ‘মেধা’ দেখতে কেন রাজি হব না? কেন আমরা তাদের ‘উড়ে এসে জুড়ে বসা’ হিসেবে বিবেচনা করবো? ‘কোটা’ মানে মেধার অবনমন বলে যাকে কটাক্ষ করছি, সেই যখন ‘মেধা’ যুক্ত হয়ে সাধারণের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পাল্লা দিচ্ছে তখন কেনই বা তাকে আমরা ‘সংরক্ষণে’ ফিরিয়ে দেওয়ার কথা বলছি? তাহলে জাতপ্রথাকে কি রক্ষা করা হচ্ছে না?
যে কোনো সংরক্ষণের সমর্থনের উদ্দেশ্য
প্রদেশে প্রদেশে বিভিন্ন অংশের মধ্যে সংরক্ষণের দাবি উঠছে। আরএসএস প্রত্যক্ষ বা কখনো পরোক্ষভাবে সেই সংরক্ষণের দাবির পাশে দাঁড়াচ্ছে। এটা আরএসএস’র ওই অংশের প্রতি ভালোবাসার নিদর্শন নয়। বরং তাদের চিরাচরিত সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়েরই কার্যক্রম। মূল লক্ষ্য সংসদীয় ক্ষমতা। আর শেষে বিবদমান সব শক্তিকেই হিন্দুত্বে উত্তরণ ঘটানো। আসলে সাম্প্রদায়িক শক্তি অন্যায্য সংরক্ষণের দাবি তুলে ভবিষ্যতে প্রকৃত সংরক্ষণকেই তুলে দিতে চাইছে। যেটা তাদের মনুবাদী লক্ষ্য।
সমতা, মেধা
সমতা সংজ্ঞায়িত করা কখনো কখনো সহজ নয়। এমন কিছু সম্প্রদায় আছে যেগুলিকে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে শিক্ষা থেকে দূরে রাখা হয়েছে, যাদেরকে এখনও স্কুলে সাধারণ জলের পাত্র স্পর্শ করার জন্য মারধর করা হয়, যারা তাদের নিজের বিয়েতে ঘোড়ায় চড়লে গুলিতে মারা যেতে পারে, যাদের মন্দিরে প্রবেশ নিষেধ! অনেকক্ষেত্রেই উচ্চবর্ণের মানুষ তাদের জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই নিম্নবর্ণের মানুষকে সমান হিসেবে গ্রহণ করতে প্রস্তুত নয়। তাহলে তারা কেন শুধু ভরতি ও চাকরিতে তাদের সমান হিসেবে বিবেচনা করবে? ২০১১ সেনসাস অনুযায়ী দেশে তফশিলিদের সংখ্যা জনগণের ১৬.৬শতাংশ। আদিবাসী ৮.৬ শতাংশ।ওবিসি ৫২ শতাংশ। মোট ৭৭.৬ শতাংশ। এর বাইরে তথাকথিত উচ্চ বর্ণের অংশের মানুষ ২২.৪ শতাংশ। অথচ তারাই প্রায় জমি, সমস্ত অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সম্পদ দখল করে রেখেছে। এটা কি শুধু মেধার ভিত্তিতে, না এর সঙ্গে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলতে থাকা সামাজিক অবিচার রয়েছে?
মেধা বনাম সংরক্ষণ
সংবিধান প্রণয়নের দিন থেকেই মেধা বনাম সংরক্ষণের বিতর্ক চলে আসছে। একটা উন্মুক্ত প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় পিছিয়ে রাখা অংশের ছাত্র-ছাত্রীরা পিছিয়ে পড়তে পারে। যদিও আজকাল প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাগুলির প্রথমদিকের তালিকার পদবীগুলি দেখে একটু অনুমান করা যাচ্ছে যে, পিছিয়ে রাখারা খানিকটা সামনে এগিয়ে আসছে। প্রতিযোগিতাটা তখনই প্রকৃত হয় যখন অংশগ্রহণকারীদের সমান সুযোগ থাকে। কয়েক হাজার বছরের সামাজিক, অর্থনৈতিক পীড়ন, বৈষম্যর ফলে সুবিধা বঞ্চিত শ্রেণিগুলি অগ্রগামী শ্রেণিগুলির সাথে কীভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে? অবস্থাপন্ন তথাকথিত উচ্চবর্ণের পরিবারের শিক্ষার্থী তার নিজের পরিবার থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে শিক্ষা, সংস্কৃতি, পরিবেশ অর্জন করে। দরিদ্র, নিম্নবর্ণের পরিবারের ছাত্র ছাত্রীর সেই সুযোগ নেই। সংরক্ষণের বিষয়টির উত্থাপন এক ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে যেটিকে সাময়িক রিলিফ হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে, এক ঐতিহাসিক ভুলের নিরাময়ে লেভেল প্লেয়িং গ্রাউন্ড তৈরি করার জন্য। আমাদের সংবিধানে রাজনৈতিক সংরক্ষণ, শিক্ষাঙ্গনে ভরতিতে সংরক্ষণ, সরকারি নিয়োগে সংরক্ষণের ব্যবস্থা আছে। নিচের দিকের সরকারি পদগুলিতে কিছুটা সংরক্ষণ থাকলেও উপরের দিকের পদে তা ক্রমহ্রাসমান। এই সংরক্ষণ কিছুতেই কার্যকর হতে পারে না যদি না শাসকের রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকে। পশ্চাৎপদতা পশ্চাৎপদেই থেকে যাবে, মূলস্রোতে আর তার আসা হবে না। সংরক্ষণের মধ্যে দিয়ে যে মেধার অবনমনের কথা বলা হয় সেই মেধার জন্য অর্থনৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক সব ধরনের যথেষ্ট বিনিয়োগের প্রয়োজন। এক প্রজন্মের মেধার পেছনে রয়েছে বহু প্রজন্মের বিনিয়োগ। আমাদের মেধা বা আমাদের প্রতিভা শুধু নিজেদের অর্জন নয়। যা আমরা বিবেচনা করি। আমরা যেখানে বাস করি তার পরিবেশ, পারিপার্শ্বিকতার সাথে এর অবশ্যই সম্পর্ক আছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে, যারা নিজেদের জন্য সমস্ত সুযোগ সংরক্ষিত রেখেছে তারা তাদের প্রতিভাকে স্বাভাবিক হিসাবে বিবেচনা করতে শুরু করেছে। সামাজিক কাঠামোর মধ্যে লুকিয়ে থাকা অন্যায় ও অত্যাচারকে তারা উপলব্ধি করতে পারে না যা তাদের যোগ্যতার অধিকারী করে অন্যের মেধা কেড়ে নেয়। অথবা সম্ভবত তারা এটি ভাল জানেন এবং এই পরিস্থিতিকে অব্যাহত রাখতে চান।
আসল সমাধানের রাস্তা
সংরক্ষণকে সামনে রেখে তাকে দীর্ঘস্থায়ী বা চিরস্থায়ী করে দক্ষিণপন্থী দলগুলি রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে চায় পিছড়েবর্গের ভোটবাক্স অক্ষুণ্ণ রাখার স্বার্থে। সিপিআই(এম) কখনো মনে করে না যে, সংরক্ষণ পিছিয়ে রাখা অংশের মানুষের চূড়ান্ত সামাজিক মুক্তি সাধন করতে পারে। তবে যারা ঐতিহাসিক এবং সামাজিকভাবে দীর্ঘদিন ধরে বঞ্চিত তাদের কাছে এটি একটি গণতান্ত্রিক উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। এই সুবিধার জন্য তার শিক্ষার্জন, অর্থনৈতিক সক্ষমতা, প্রশাসনিক পদে যাওয়ার অভিজ্ঞতা তার মধ্যে এক সামাজিক চেতনা তৈরি করে। যে চেতনা শেষ অবধি তাকে ‘এনিহিলেশান অফ কাস্ট’-এর চেতনাতেও পৌঁছে দিতে পারে। এই অধিকারের মধ্য দিয়ে তার ব্যক্তিগত এবং সম্প্রদায়গত সামাজিক গতিও তৈরি হতে পারে। সংরক্ষণ হয়তো পশ্চাৎপদ অংশে সাময়িক রিলিফ দিতে পারে। কিন্তু জাতি ব্যবস্থার মূলে আঘাত হানতে গেলে প্রয়োজন আমূল ভূমি সংস্কার। প্রয়োজন সম্পদের কেন্দ্রীভবনের জায়গায় আঘাত করা। প্রয়োজন পশ্চাৎপদ, দরিদ্র অংশের প্রভূত নিবিড় অর্থনৈতিক উন্নয়ন। আম্বেদকর যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমতার কথা বলেছিলেন তা এভাবেই প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। ‘ড্রাফ্ট অফ এ কমিউনিস্ট কনফিউশন অফ ফেইথ’-এ ‘কমিউনিস্ট সমাজে বিভিন্ন জাতিসমূহটিকে থাকবে কি?’– এই প্রশ্নের উত্তরে এঙ্গেলস বলেছিলেন– ‘‘কমিউনিস্ট সমাজে বিভিন্ন জাতিসমূহ একত্রিত হয়। তারা পরস্পরের সঙ্গে মিশে যেতে বাধ্য হয়। আর তার ফলে তাদের মধ্যে এলাকাগত এবং শ্রেণিগত ভেদাভেদ দূর হয়ে যায়। কারণ মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ তৈরি করার মূল ভিত্তি অর্থাৎ ব্যক্তিগত সম্পত্তিই আর থাকে না।’’