৫৮ বর্ষ ৭ম সংখ্যা / ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০ / ৮ আশ্বিন ১৪২৭
অগণতান্ত্রিক উপায়ে গায়ের জোরে সংসদে পাশ করানো হলো কৃষিবিল
বিরোধীদের কথা বলার অধিকার কেড়ে নেওয়া হলো
কৃষি বিলের প্রতিবাদে পাঞ্জাবের পাতিয়ালায় কৃষক বিক্ষোভ।
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ বিরোধীদের তীব্র প্রতিবাদকে উপেক্ষা করে অগণতান্ত্রিক উপায়ে গায়ের জোরে কৃষি সংক্রান্ত তিনটি অর্ডিন্যান্সকে বিল আকারে এনে সংসদে অনুমোদন করিয়ে নিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। এর বিরুদ্ধে সংসদের ভিতরে ও বাইরে প্রবল প্রতিবাদ-বিক্ষোভ ধ্বনিত হয়েছে। এর মধ্যে কৃষি সংক্রান্ত দু’টি বিল কার্যত গায়ের জোরে যেভাবে পাশ করানো হয়েছে, তা নজিরবিহীন। বিশেষভাবে উল্লেখ্য, দেশে করোনা আবহে লকডাউনের মধ্যেই কেন্দ্রের বিজেপি সরকার কৃষিপণ্যের বাণিজ্য, ফসলের দাম ও চুক্তি চাষ এবং অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন ও কৃষিবাজার তুলে দেবার তিনটি অর্ডিন্যান্স জারি করেছিল। সংসদের চলতি অধিবেশনে কেন্দ্রের মোদী সরকার বৃহৎ কর্পোরেটসংস্থা ও বহুজাতিকদের স্বার্থে এই তিনটি অর্ডিন্যান্সকে বিল আকারে এনে তা পাশ করিয়ে কৃষকদের চরম সর্বনাশ করতে উদ্যত হয়েছে। ‘ফার্মার্স প্রডিউস ট্রেড অ্যান্ড কমার্স (প্রোমোশন অ্যান্ড ফেলিসিটেশন) বিল, ২০২০’ ‘ফার্মার্স (এমপাওয়ারমেন্ট অ্যান্ড প্রোটেকশন) এগ্রিমেন্ট অব প্রাইস অ্যাসুরেন্স অ্যান্ড ফার্ম সার্ভিসেস বিল ২০২০’ এবং ‘দ্য এসেনশিয়েল কমোডিটিস (অ্যামেন্ডমেন্ট) বিল ২০২০’ - এই তিনটি বিল সংসদে যে কায়দায় পাশ করানো হয়েছে, তার বিরুদ্ধে গোটা দেশ প্রতিবাদে মুখর হয়েছে। এর আগে ‘ইলেকট্রিসিটি (অ্যামেন্ডমেন্ট) বিল ২০২০’ সংসদে পাশ করানো হয়েছে।
কৃষকদের স্বার্থবিরোধী এই তিনটি বিল লোকসভায় আগেই পাশ করিয়ে নেওয়া হয়েছিল। এরপর গত ২০ সেপ্টেম্বর কৃষিপণ্য বাণিজ্য এবং কৃষি ফসলের মূল্য সুরক্ষা সংক্রান্ত দু’টি বিল ধ্বনি ভোটে পাশ করিয়ে নেওয়া হয়। এই দু’টি বিল সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানোর জন্য বিরোধীদের আনা সংশোধনীতেও মাথা গুণে ভোট নেওয়া হয়নি। উলটে প্রায় ৩০ জন মার্শাল এবং ওয়াচ অ্যান্ড ওয়ার্ড রক্ষী এনে বিরোধীদের আসন ঘিরে রাখা হয়। বিরোধী সদস্যদের ধাক্কাধাক্কিও করে মার্শালরা। এর ফলে জখম হন তিনজন বিরোধী সদস্য। বিরোধীদের গুরুতর অভিযোগ, রাজ্যসভায় সরকারপক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না বলেই ধ্বনি ভোটে পাশ করানো হয়েছে এই বিল দু’টি। এমনকি রাজ্যসভার অভ্যন্তরে বিরোধীদের বক্তব্য এবং কী ঘটনা ঘটছে, তা যাতে কেউ দেখতে না পান, সেইজন্য রাজ্যসভার টিভি বন্ধ করে দেওয়া হয়। বিরোধীরা এই ঘটনাকে ‘গণতন্ত্র হত্যা’ বলে অভিহিত করেছেন।
এদিন অধিবেশনের শুরুতেই সিপিআই(এম)-র কে কে রাগেশ, ডিএমকে-র ত্রিচিসিভা, কংগ্রেসের কে কে ভেনুগোপাল সহ বিরোধী সাংসদরা বিল দু’টিকে সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানোর প্রস্তাব পেশ করেন। ডেপুটি চেয়ারপার্সন হরিবংশ বিল নিয়ে তখনই আলোচনা করতে চাইলে বিরোধীরা আপত্তি করেন। তাঁরা দাবি জানান, এই গুরুত্বপূর্ণ বিল নিয়ে এত স্বল্প সময়ে আলোচনা না করে তা পরদিন করা হোক। এ নিয়েই গণ্ডগোলের সূত্রপাত। সিপিআই(এম) সদস্য কে কে রাগেশ জোরালোভাবেই ‘ডিভিসন’ চান। বিরোধীরা বিধিবদ্ধ যে প্রস্তাব করেছেন, তা নিয়ে মাথা গুণে ভোট করানোর দাবি জানান। কিন্তু তা সত্ত্বেও ডেপুটি চেয়ারপার্সন ধ্বনিভোটে বিল দু’টি পাশ করান। বিরোধীরা অভিযোগ করেন, বিরোধীদের তুলনায় সরকারপক্ষের সংখ্যা কম থাকায় ভয় পেয়ে ধ্বনিভোটে বিল দু’টি পাশ করায় সরকারপক্ষ। এজন্য কোনো নিয়মকানুন মানা হয়নি। এদিন রাজ্যসভায় বিরোধীদের বিক্ষোভ ঠেকাতে কিছুক্ষণের জন্য রাজ্যসভা মুলতবি ঘোষণা করা হয়। কিন্তু বিরোধী সদস্যরা কক্ষেই দীর্ঘক্ষণ বসে থাকেন।
এদিন বিল নিয়ে আলোচনার সময় সিপিআই(এম) সদস্য কে কে রাগেশ বলেন, কৃষকদের প্রতি দায়িত্ব এড়িয়ে সরকার তাঁদের কর্পোরেটের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। কর্পোরেটরা কৃষককে ন্যায্যমূল্য দেবে, এমন আশা কেউ করেন না। এই বিলে ন্যূনতম সহায়কমূল্য দেবার বাধ্যতামূলক ঘোষণাও নেই। মান্ডি ব্যবস্থার গলদ থাকতে পারে, কিন্তু তা তুলে দিয়ে কৃষককে আরও সর্বনাশের পথে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। সিপিআই(এম)-র পক্ষ থেকে এদিন ১১টি সংশোধনী পেশ করা হয়েছিল। কিন্তু কোনোটাতেই ভোটাভুটি করতে পেশ করা হয়নি।
রাজ্যসভায় কে কে রাগেশ আরও বলেছেন, এই বিল প্রত্যাহার না করে যে সর্বনাশ আপনারা করেছেন, তার মূল্য দিতে হবে আপনাদের। দেশের মানুষই সরকার থেকে আপনাদের প্রত্যাহার করে নেবে।
তিনি বলেন, কৃষকের আয় দ্বিগুণ করে দেওয়া হবে বলে গত ছ’বছর ধরেই বাগাড়ম্বর করে চলেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং অন্যান্য মন্ত্রীরা। কিন্তু বাস্তবে কী হয়েছে, এবার জানান প্রধানমন্ত্রী। কৃষকের আয় দ্বিগুণ হয়নি, শুধু আত্মঘাতী কৃষকের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। আমরা দেখলাম কৃষক আত্মহত্যা আটকাতে একটা শর্টকার্ট পথ খুঁজে বের করেছে মোদী সরকার। কি সেই পথ? ২০১৬ সাল থেকে কৃষক আত্মহত্যার পরিসংখ্যান প্রকাশই বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। কৃষক আত্মহত্যা রুখতে এটাই ‘মোদী মডেল’।
কেন্দ্রের নীতির ফলে কৃষকের চরম দুর্দশার বিবরণ দিয়ে রাগেশ বলেন, ভারতীয় কৃষকদের দুর্দশার আসল কারণটা কি? সরকার তা দেখেও যেন দেখছে না! চাষের খরচ মারাত্মকভাবে বেড়ে গেছে। কারণ, চাষের উপাদানে সরকার ভরতুকি তুলে নিয়েছে। তাই চাষের খরচ আকাশচুম্বী হয়েছে। উলটোদিকে এভাবে চাষের পর ফসলের লাভজনক দামটুকুও পাচ্ছেন না কৃষক। টানা লোকসান সইতে সইতে শেষ পর্যন্ত দলে দলে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হচ্ছেন তাঁরা। সরকারি হস্তক্ষেপের মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান হতে পারে। সরকারকে দু’টি পদক্ষেপ নিতে হবে - প্রথমত, চাষের উপকরণে ভরতুকি দিতে হবে; দ্বিতীয়ত, কৃষক যাতে ফসলের ন্যূনতম সহায়কমূল্য পান, তা নিশ্চিত করতে হবে। ফসলের সরকারি সংগ্রহ ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে।
এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, এই দু’টি জরুরি পদক্ষেপ নেবার বদলে সরকার যে কৃষি-বিলগুলো সংসদে পাশ করাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে, সেগুলি একেবারেই উলটো। ভারতের বিপন্ন কৃষি ও কৃষকের স্বার্থ নয়, নয়া-উদারনীতির ফলে কেবলমাত্র কর্পোরেট মুনাফা নিশ্চিত করতেই এই আইন করতে চাইছে সরকার। এতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, কৃষিক্ষেত্রে দায়িত্ব নিজের ঘাড় থেকে ছুঁড়ে ফেলতে চাইছে সরকার। দেশের কৃষককে কর্পোরেটের দয়া ও অনুকম্পার ওপর ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি চলতি মান্ডি ব্যবস্থার মাধ্যমেই আমাদের কৃষক সামান্য হলেও, কিছু ন্যূনতম সহায়কমূল্য পেয়ে থাকেন। এটা সত্যি যে, এই মান্ডি ব্যবস্থায় কিছু ত্রুটি আছে। কিন্তু সেই ত্রুটি সংশোধন করার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু সেই পদক্ষেপ না নিয়ে এসব কৃষি-বিলের মাধ্যমে সরকার আমাদের মান্ডি ব্যবস্থায় স্লো-পয়জনিং করতে চাইছে। মোদী সরকারের নয়া আইন শেষ পর্যন্ত মান্ডি ব্যবস্থাটাকেই পুরোপুরি ধ্বংস করে দেবে।
কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্দেশে এদিন সিপিআই(এম)-র সাংসদ বলেন, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর কাছে আমার দাবি, কৃষক-বিরোধী এই দু’টি বিল প্রত্যাহার করে নিন। পরিবর্তে কৃষি ফসলের নিশ্চিত লাভজনক দাম ঘোষণা করে নতুন বিল আনুন সভায়। কর্পোরেট সংস্থা কৃষককে ঠকালে তাঁদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি ও আইনি ব্যবস্থার সুস্পষ্ট সংস্থান রাখতে হবে।
তিনি সরকারকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, সারাদেশে কৃষক অসন্তোষের তীব্রতা কি আপনারা বুঝতে পারছেন না? প্রবল ক্ষোভে রাস্তায় নেমে জোরালো আন্দোলন চালাচ্ছেন দেশের কৃষকরা। ২০০টির বেশি কৃষক সংগঠন নিয়ে তৈরি অল ইন্ডিয়া কিষান সংঘর্ষ কো-অর্ডিনেশন কমিটি (এআইকেএসসিসি)-র ডাকে আগামী ২৫ সেপ্টেম্বর দেশজোড়া প্রতিবাদের আগুনে পুড়তে হবে আপনাদের। এখনও বলছি, এসব কালা বিল প্রত্যাহার করে নিন। নাহলে দেশের মানুষই সরকার থেকে আপনাদের প্রত্যাহার করে নেবে।
এদিন কংগ্রেস সদস্য প্রতাপ সিং বাজওয়া, সমাজবাদী পার্র্টির রামগোপাল যাদব, ডিএমকে-র ত্রিচিসিভা প্রমুখ সরকার উত্থাপিত তিনটি বিলের তীব্র সমালোচনা করেন। এদিকে রাজ্যসভায় বিল পাশের পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী একে ‘ঐতিহাসিক মুহূর্ত’ বলে বর্ণনা করেছেন। ভারতীয় কৃষির উন্নতির দরজা খুলে যাবে বলে তিনি দাবি করেছেন। প্রধানমন্ত্রী যখন এই দাবি করছেন, তখন পাঞ্জাব, হরিয়ানা সহ দেশজুড়ে কৃষক বিক্ষোভ উত্তাল হয়ে উঠেছে।
২০ সেপ্টেম্বর সংসদীয় রীতিনীতি লঙ্ঘন করে গায়ের জোরে কৃষি সংক্রান্তে দু’টি বিল পাশ করানোর পর পরদিন ২১ সেপ্টেম্বর আরেক দফা আগ্রাসী ভূমিকা নেয় কেন্দ্রের সরকার। এদিন কৃষি বিলের প্রতিবাদ করার ‘অপরাধে’ রাজ্যসভার ৮ সংসদকে চলতি অধিবেশন থেকে সাসপেন্ড করা হয়। এই সাংসদরা হলেন, সিপিআই(এম)’র কে কে রাগেশ সহ সঞ্জয় সিং (আপ); রাজীব সাতভ, সৈয়দ নাজির হুসেইন, রিপুন বোরা (কংগ্রেস); ডেরেক ও ব্রায়েন, দোলা সেন (তৃণমূল কংগ্রেস)।
সাসপেন্ড হওয়া সাংসদরা সাসপেন্ড হবার পরও রাজ্যসভার কক্ষ ছেড়ে যেতে অস্বীকার করেন এবং দিনভর কক্ষেই বসে থাকেন। পরে এই সাংসদরা অন্যান্য বিরোধী সাংসদদের সঙ্গে সংসদ প্রাঙ্গণে ধরনায় বসেন। এই ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ করেছে সিপিআই(এম), সিপিআই, সিপিআই(এমএল) লিবারেশন, আরএসপি এবং ফরওয়ার্ড ব্লক। এই পাঁচটি বামপন্থী দল এক যৌথ বিবৃতিতে ঘোষণা করেছে, সাংসদদের সাসপেন্ড করে বিরোধীদের চুপ করানো যাবে না। ভারতীয় সংবিধান, সংসদ এবং ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্রের কাঠামো রক্ষায় অঙ্গীকারবদ্ধ বামপন্থীরা। সাধারণতন্ত্রের ওপর এই আঘাত রুখতে সব অংশের মানুষের বিক্ষোভে শামিল হওয়া জরুরি।
এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো বলেছে, সংসদে ভোট চাওয়ার অধিকার রয়েছে প্রত্যেক সদস্যের। সেই অধিকার কেড়ে নেওয়ার ঘটনা আগে কখনও হয়নি। রাজ্যসভায় যে ৮ সাংসদ ডিভিসনের ভিত্তিতে ভোট চেয়েছিলেন তাঁদের সাসপেন্ড করা হয়েছে। বিজেপি’র নেতৃত্বাধীন জোট এনডিএ-র যে গরিষ্ঠতা রাজ্যসভায় নেই, তা প্রমাণ করছে ঘটনাক্রম। ফলে আইন বিধিবদ্ধ হলে তা হবে বেআইনি, অযৌক্তিক। বামপন্থীদের দাবি, সংবিধানের ১১১ধারা অনুযায়ী পুনর্বিবেচনার জন্য রাষ্ট্রপতি বিল ফেরতপাঠান রাজ্যসভায়।
সিপিআই(এম)’র সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি এই ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ করে বলেন, সংবিধানে যে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর কথা বলা হয়েছে, ফের তার উপর আঘাত নামানো হলো। তীব্র প্রতিবাদ জানান কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী, অধীর চৌধুরী প্রমুখ।