৫৮ বর্ষ ৭ম সংখ্যা / ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০ / ৮ আশ্বিন ১৪২৭
সর্বনাশা কৃষি বিলের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে প্রতিবাদ বিক্ষোভ
কৃষি বিলের বিরুদ্ধে চেন্নাইতে বামপন্থীদের বিক্ষোভ।
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ সংখ্যার আধিক্যে গায়ের জোরে সংসদে কৃষি ও কৃষক বিরোধী তিনটি বিল পাশ করিয়ে নিতে সক্ষম হলেও দেশজুড়ে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে গর্জে উঠেছেন কৃষক সমাজ। ২০ সেপ্টেম্বর পাঞ্জাব ও হরিয়ানার হাজার হাজার কৃষক দলমত নির্বিশেষে জাতীয় সড়ক এবং রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে অবরোধ করেন। তাঁরা দাবি করেন, অবিলম্বে কৃষক বিরোধী তিনটি বিল বাতিল করতে হবে। বিক্ষোভ হয়েছে দেশের অন্যান্য প্রান্তেও।
সংসদে গায়ের জোরে কৃষক বিরোধী বিল পাশ করিয়ে নেবার পরিপ্রেক্ষিতে সারা ভারত কৃষক সভা জানিয়ে দিয়েছে, আরএসএস-বিজেপি নেতৃত্বাধীন মোদী সরকারের পরামর্শে কর্পোরেট স্বার্থে এই স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট আচরণ মেনে নেওয়া হবে না। ২৫ সেপ্টেম্বর প্রতিবাদ কর্মসূচির মাধ্যমে দেশজুড়ে এর প্রতিবাদ জানানো হবে।
সারা ভারত কৃষকসভার সভাপতি অশোক ধাওয়ালে এবং সাধারণ সম্পাদক হান্নান মোল্লা এক বিবৃতিতে বলেছেন, আরএসএস-বিজেপি সরকারের নেতৃত্বাধীন মোদী সরকারের পরামর্শে কর্পোরেট স্বার্থে এই স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ত আচরণ মেনে নেওয়া হবে না। ২৫ সেপ্টেম্বর প্রতিবাদ কর্মসূচির মাধ্যমে দেশজুড়ে এর জবাব দেওয়া হবে।
সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক হান্নান মোল্লা সংসদে কৃষি বিল পাশ করানোর প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, ভারতীয় কৃষকের মৃত্যু পরোয়ানা পাশ করিয়ে নেওয়া হলো। আজকের দিনটি ভারতীয় সংসদের ইতিহাসে কালো দিন হিসাবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। ভারতীয় কৃষক সমাজের শেষকৃত্যের পুরোহিত হিসাবে দায়িত্ব পালন করলেন মোদী। এবার সমস্ত গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ জনগণের ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ে এই দেশবিরোধী এবং কৃষক বিরোধী দানবদের ষড়যন্ত্র পর্যুদস্ত করতে হবে।
বিক্ষোভ মিছিল বেঙ্গালুরুতে।
কেন্দ্রের কৃষক বিরোধী পদক্ষেপের বিরুদ্ধে আগামী ২৫ সেপ্টেম্বর কৃষক এবং খেতমজুরদের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ আন্দোলনের প্রতি পূর্ণ সংহতি ঘোষণা করেছে সিআইটিইউ। ওই প্রতিবাদ কর্মসূচিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে দেশের সমস্ত শ্রমিক এবং দলমত নির্বিশেষে সমস্ত ট্রেড ইউনিয়নের উদ্দেশে আহ্বান জানিয়েছেন সিআইটিইউ-র সাধারণ সম্পাদক তপন সেন।
১৯ সেপ্টেম্বর এক বিবৃতিতে তপন সেন বলেছেন, একেবারে স্বৈরাচারী কায়দায় কৃষক বিরোধী এবং জনবিরোধী তিনটি অর্ডিন্যান্স আইনে পরিণত করতে চাইছে কেন্দ্রের মোদী সরকার। কর্পোরেটমুখী এই আইনের জেরে দেশের গ্রামীণ অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে যাবে, কৃষি ও কৃষক পুরোপুরি সর্বস্বান্ত হবে। পক্ষান্তরে মুনাফা বাড়বে আদানি, উইলমার, রিলায়েন্স, ওয়ালমার্ট, বিড়লা, আইটিসি’র মতো বৃহদাকার সংস্থাগুলির। এই তিন বিধ্বংসী কৃষি বিল এবং সর্বনাশা বিদ্যুৎ সংশোধনী বিল প্রতিরোধে আগামী ২৫ সেপ্টেম্বর জোরালো বিক্ষোভ, রেল রোকো, রাস্তা রোকো ইত্যাদির মাধ্যমে তুমুল প্রতিবাদের ডাক দিয়েছে অল ইন্ডিয়া কিষান সংঘর্ষ কো-অর্ডিনেশন কমিটি (এআইকেএসসিসি)। এই জোটবদ্ধ কৃষক আন্দোলনের প্রতি পূর্ণ সংহতি ও সমর্থন জানানোর জন্য এবং দেশের সব এলাকায় প্রতিবাদী কর্মসূচিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নেবার জন্য শ্রমজীবী জনগণ এবং তাদের ইউনিয়নগুলির প্রতি আবেদন জানিয়েছে সিআইটিইউ।
২৫ সেপ্টেম্বর সারা দেশে কৃষকদের প্রতিবাদ কর্মসূচিকে সমর্থন জানিয়েছে আইএনটিইউসি, এআইটিইউসি, এআইইউটিইউসি, টিইউসিসি সহ ১০টি শ্রমিক সংগঠন। এছাড়া এসএফআই, এআইএসএফ, এআইএসএ, পিএসইউ এবং এআইএফবি প্রভৃতি ছাত্রসংগঠন কৃষকদের প্রতিবাদ কর্মসূচির প্রতি সংহতি জানিয়ে এই আন্দোলনে শামিল হবার কথা ঘোষণা করেছে।
এদিকে মোদী সরকারের কৃষক বিরোধী বিলের প্রতিবাদে পাঞ্জাব ও হরিয়ানার কৃষকরা তীব্র আন্দোলন শুরু করেছেন। হরিয়ানার যমুনা নগরে ভারতীয় কিষান ইউনিয়নের ডাকে বিক্ষোভ ও পথ অবরোধ করা হয়েছে। সংগঠনের সভাপতি গুরনাম সিং চারুনি বলেছেন, যতদিন না পর্যন্ত এই কৃষি বিল প্রত্যাহার করা না হবে, ততদিন পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। সরকার কিছুতেই কৃষকদের প্রতিবাদ-আন্দোলনকে দমন করতে পারবে না। হরিয়ানায় রাজ্যসরকার কৃষকদের মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর চেষ্টা করছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।
সারা ভারত কৃষক সভার কর্মীরাও সংগঠনের ঝান্ডা নিয়ে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ কর্মসূচিতে শামিল হন। তারা অন্যান্য কৃষক সংগঠনের কর্মীদের সঙ্গে এক সঙ্গে পথ অবরোধে শামিল হন।
কৃষি বিলের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ অমৃতসরে।
হিসারে পুড়ছে কৃষি বিল।
রাজ্যসভায় কে কে রাগেশ আরও বলেছেন, এই বিল প্রত্যাহার না করে যে সর্বনাশ আপনারা করেছেন, তার মূল্য দিতে হবে আপনাদের। দেশের মানুষই সরকার থেকে আপনাদের প্রত্যাহার করে নেবে।
হরিয়ানার জোট সরকারের শরিক বিজেপি। তাই রাজ্য সরকার এই আন্দোলন দমন করতে উঠেপড়ে লেগেছে। কাইথালের টিটাম মোড়ে আম্বালা-হিসার জাতীয় সড়কে অবরোধ করেন কৃষকরা। কুরুক্ষেত্র জেলায় কৃষকেরা জাতীয় ও রাজ্য সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখান। কুরুক্ষেত্র সহ লাদওয়া, কারনাল, শাহবাদে পথ অবরোধ হয়। এই অবরোধে শামিল হন কমিশন এজেন্টরাও। পুলিশ তাদের বাধা দেবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। রাজ্য সরকার কৃষকদের আন্দোলনের বিরোধিতা করলেও জোট সরকারের অন্যতম শরিক জননায়ক জনতা পার্টির দুই বিধায়ক যোগীরাম সিহাগ এবং রামকরণ কালা শামিল হন বিক্ষোভে। লোকসভায় এই বিল পেশের সময় সরকারের শরিক শিরোমণি আকালি দল প্রতিবাদ জানায়। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভায় দলের একমাত্র সদস্য হরসিমরাত কাউর বাদল প্রতিবাদে ইস্তফা দেন।
পাঞ্জাবেও বিভিন্ন জায়গায় কৃষকেরা কৃষি বিলের প্রতিলিপি ও কুশপুতুল পুড়িয়ে প্রতিবাদ জানান। পাঞ্জাবের কংগ্রেস সরকার এই কৃষি বিলের বিরোধী। রাজ্যে কংগ্রেস দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এই নয়া বিল আইনে পরিণত হলে দেশের ৮০ কোটি কৃষক বিপদে পড়বেন। এদিকে পাঞ্জাবের শিল্প মহলও কৃষি বিলের বিরুদ্ধে সরব হন। এই বিলের বিরোধিতা করে কৃষকদের পাশে দাঁড়িয়েছেন গায়ক-অভিনেতা দিলজিৎ দোসাঞ্জ। তাঁকে সমর্থন জানিয়েছেন হরভজন মান, জিপ্পি গ্রেওয়াল, নিমরত খাইরা প্রমুখ শিল্পী।
এদিকে মোদী সরকার স্বৈরাচারী কায়দায় সংসদে কৃষি বিল পাশ করানোর উদ্যোগ নেওয়ার বিরুদ্ধে ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া আন্দোলনে অনেকের সাথে মুক্তসর জেলার বাদল গ্রামে শামিল ছিলেন প্রীতম সিং নামের এক কৃষক। ১৮সেপ্টেম্বর সেই আন্দোলনস্থলেই বিষ খেয়ে তিনি আত্মহত্যা করেন। আন্দোলনের উদ্যোক্তা ভারতীয় কিষান ইউনিয়নের নেতারা জানিয়েছেন, সরকারের কৃষিবিরোধী নীতির জেরে টানা লোকসানে প্রীতম সিংও ঋণে জর্জরিত হয়ে পড়েছিলেন। আত্মঘাতী কৃষকের পরিবারকে সরকারি ক্ষতিপূরণের দাবিতে সোচ্চার হয়েছে এই কৃষক সংগঠন।
পাঞ্জাব, হরিয়ানার পাশাপাশি দিল্লি, চেন্নাই, বেঙ্গালুরু, উত্তর প্রদেশ, রাজস্থান প্রভৃতি দেশের বিভিন্ন প্রান্তের কৃষকরা প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছেন। তাঁরা আগামী ২৫ সেপ্টেম্বর দেশব্যাপী প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অংশ নেবার পাশাপাশি কালা দিবস পালন করবে।
২১ সেপ্টেম্বর চেন্নাইয়ে কৃষক বিরোধী বিলের সোচ্চার প্রতিবাদ জানায় সিপিআই(এম)। এই দানবীয় বিলকে এডিএমকে সমর্থন জানানোয় তামিলনাডুর মুখ্যমন্ত্রী পালানিস্বামীর পদত্যাগের দাবি জানিয়েছে সিপিআই(এম)। পার্টিকর্মী-সমর্থকেরা এদিন প্যারি কর্ণার থেকে রাজ্য সচিবালয় অভিমুখে প্রতিবাদ মিছিল করতে চাইলে পথ আটকায় পুলিশ। সেখানে পুলিশের সাথে ধস্তাধস্তি হয় এবং দীর্ঘক্ষণ ধরে পথ অবরোধ করেন পার্টিকর্মীরা।
তামিলনাডু কিষান সভার সাধারণ সম্পাদক পি সম্মুগম মুখ্যমন্ত্রীর ইস্তফার দাবির পাশাপাশি এই বিলকে সমর্থনের জন্য মুখ্যমন্ত্রীর ক্ষমা চাওয়া উচিত বলে দাবি করেন। তিনি জানিয়ে দেন, ২৫ সেপ্টেম্বর রাজ্যের ৫০০টি জায়গায় জাতীয় ও রাজ্য সড়ক অবরোধ করা হবে।
বেঙ্গালুরুতে এদিন রাজ্যের বিজেপি সরকারের জারি করা ভূমি সংস্কারের আড়ালে জমি দখলের বিলের বিরোধিতা করে প্রতিবাদ জানায় কৃষক, শ্রমিক ও দলিত সংগঠনগুলি। বেঙ্গালুরুর ফ্রিডম পার্ক এলাকায় প্রতিবাদ সভা হয়। এই সভায় বক্তব্য রাখেন স্বরাজ ইন্ডিয়া সংগঠনের সভাপতি যোগেন্দ্র যাদব। তিনি বলেন, আগামীদিনে সারা দেশেই প্রতিবাদে সোচ্চার হবেন কৃষকেরা।
এদিন দিল্লিতে কেন্দ্রীয় সরকারের জনবিরোধী নীতির পাশাপাশি সদ্য সংসদে অনুমোদন প্রাপ্ত কৃষি বিলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায় সিপিআই(এম) দিল্লি রাজ্য কমিটি। বিক্ষোভ সমাবেশ হয় সোনিয়া বিহার, মঙ্গলপুরী, জাহাঙ্গীরপুরী, নারেলা, মেট্রো বিহার, শাহবাদ ডেয়ারি, ইন্দ্রপুরী, মিঠাপুরী চক, দক্ষিণপুরীতে। এছাড়াও বিশাল সমাবেশ হয়েছে গাজিয়াবাদ জেলাশাসকের দপ্তরের সামনে।
সংসদ ভবনের সামনে বিক্ষোভ বিরোধীদের।
এদিন দিল্লিতে কংগ্রেস দলের পক্ষেও সংসদ ভবনের দিকে মিছিল করে প্রতিবাদ জানানো হয়।
এদিন সারা ভারত কিষান সংঘর্ষ সমন্বয় কমিটি এক বিবৃতিতে কেন্দ্রের সরকারের প্রতি এক হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছে, ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য গ্যারান্টি, ফসলের দাম ও সংগ্রহের নিরাপত্তার ব্যবস্থা না করা হলে এবং গরিবের খাদ্য নিরাপত্তার দিকটি কর্পোরেট ও বহুজাতিকদের হাতে তুলে দিলে দেশজুড়ে প্রতিবাদ আন্দোলন আরও জোরদার হবে। দিল্লিতে ‘কর্পোরেট ভাগাও’,‘কিষানি বাঁচাও’ স্লোগান তুলে ঘেরাও চলবে। এই কমিটির পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতিকে কৃষি বিলে স্বাক্ষর না করার আরজি জানানো হয়েছে।
একইভাবে রাষ্ট্রপতিকে কৃষি বিলে স্বাক্ষর না করার আবেদন জানিয়েছে সিপিআই(এম), সিপিআই, কংগ্রেস, এনসিপি, ডিএমকে, এসপি, আরজেডি এবং তৃণমূল কংগ্রেস। এই দলগুলি এ বিষয়ে রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের হস্তক্ষেপ দাবি করেছে। সিপিআই(এম) সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি কৃষি বিল প্রত্যাহারের দাবি জানানোর পাশাপাশি ২৫ সেপ্টেম্বর কৃষকদের প্রতিবাদ কর্মসূচিকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন।