৫৮ বর্ষ ৭ম সংখ্যা / ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০ / ৮ আশ্বিন ১৪২৭
মোদীর ‘আত্মনির্ভর ভারত’ গঠনের স্লোগান কাঁঠালের আমসত্ত্ব
সুপ্রতীপ রায়
কাজ হোক আর না হোক নতুন নতুন স্লোগান তুলতে জুড়ি নেই আমাদের প্রধানমন্ত্রীর। অতিমারীর সময় তিনি স্লোগান তুললেন ‘আত্মনির্ভর ভারত’ গড়ে তুলতে চান। তাহলে কি আমরা এতদিন আত্মনির্ভর ছিলাম না? সে আলোচনায় আমরা আসব। ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর নানা ধরনের স্লোগান তুলেছেন মোদী। কিন্তু সেই স্লোগানগুলির বাস্তবায়ন কতটা হয়েছে? ১৯৪২ সালে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ৭৫ বছর পূর্তিতে ২০১৭ সালে প্রধানমন্ত্রী স্লোগান দিয়েছিলেন নয়া ভারত গড়ার। নয়া ভারত গড়ার লক্ষ্যে তিনি বলেছিলেন - সমৃদ্ধশালী ও বলিষ্ঠতর ভারত গড়ে তুলতে হবে। তিনি ২০১৭-র আগস্টে আর একটি স্লোগান দিয়েছিলেন ‘দারিদ্র্য ভারত ছাড়ো’।
কিন্তু ২০১৭-র স্লোগান কতটা বাস্তবায়িত হয়েছে? সরকারি মূল্যায়ন কি? ওসবের ধার ধারেন না নরেন্দ্র মোদী। ‘আত্মনির্ভর ভারত’ যদি সত্যিই গড়ে তুলতে হয় তা হলে দেশের বেশিরভাগ মানুষকে আর্থিকদিক থেকে স্বনির্ভর করে তুলতে হবে। কিন্তু সেটা এই মুহূর্তে যাঁরা দেশ চালাচ্ছেন তাঁদের দ্বারা সম্ভব নয়।
আসলে আত্মনির্ভর ভারত গড়ে ওঠার পিছনে প্রধান বাধা রাষ্ট্রের শ্রেণি চরিত্রে। বর্তমান ভারত রাষ্ট্র কি সবার স্বার্থ রক্ষা করে? না, করে না। বর্তমান ভারত রাষ্ট্র বৃহৎবুর্জোয়া শ্রেণির নেতৃত্বে বুর্জোয়া ও জমিদারদের শ্রেণি শোষণের যন্ত্র এবং এরা ক্রমান্বয়ে আন্তর্জাতিক লগ্নিপুঁজির সঙ্গে সহযোগিতায় লিপ্ত হচ্ছে। স্বাধীনতার পর দেশের অর্থনৈতিক বিকাশে সবচেয়ে বেশি লাভ হয়েছে বড়ো পুঁজির মালিকদের - সবার নয়। ১৯৯০-এর দশক থেকে আমাদের দেশে নয়া-উদারবাদী আর্থিক নীতি প্রচলিত হয়।
তখন থেকে পুঁজির মালিকদের আরও সাহায্য করতে থাকল রাষ্ট্র। ঢালাও বেসরকারিকরণের অভিযান হতে থাকল। মোদীর আমলে তা আরও তীব্রতা লাভ করল। রাষ্ট্রের সম্পদ হস্তান্তর হতে থাকল। নয়া-উদারবাদের হাত ধরে বড়ো পুঁজির মালিকদের কর ছাড়, ব্যাঙ্কের নিয়ম ভেঙে ঋণ দেওয়া হতে থাকল। অর্থাৎ উদারবাদের আমলে বড়ো পুঁজির মালিক আরও শক্তিশালী হয়েছে।
আমরা জানি আমাদের দেশে পুরাতন সামন্তবাদী ব্যবস্থাকে না ভেঙে পুঁজিবাদ বিকশিত হয়েছে। দেশের অধিকাংশ এলাকায় ভূমিসংস্কার হয়নি। বহু জমি নামে-বেনামে ভূস্বামীদের দখলে।
রাষ্ট্র কর্পোরেটদের জমি লুঠের ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। ভারতের অর্থনৈতিক কাজকর্ম অনেক ক্ষেত্রেই বিদেশি পুঁজির নির্দেশে চলছে। চলছে অবাধ বিদেশি বিনিয়োগ। বিজেপি’র জমানায় আত্মনির্ভরতার বদলে সাম্রাজ্যবাদের কাছে আত্মসমর্পণ চলছে।
এক কথায় ভারত রাষ্ট্র বৃহৎ পুঁজির মালিক, সাধারণভাবে বুর্জোয়া বড়ো অংশ, গ্রামের শাসকদের শ্রেণি স্বার্থে পরিচালিত হচ্ছে। বড়ো পুঁজির মালিকদের নেতৃত্বেই যে রাষ্ট্র পরিচালিত হচ্ছে তা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। অর্থাৎ ভারত রাষ্ট্র সকলের নয়। সে কারণে ৯৯ শতাংশ মানুষের স্বার্থবাহী রাষ্ট্রযন্ত্র হলে ‘আত্মনির্ভর ভারত’র স্লোগান কখনই বাস্তবায়িত হতে পারে না। আত্মনির্ভর মানে কর্পোরেটদের সবল হওয়া নয়। আত্মনির্ভর মানে সব মানুষের আত্মনির্ভরতা।
কৃষি ও কৃষককে বাদ দিয়ে আত্মনির্ভর ভারত-এর স্লোগান সোনার পাথর বাটি। কারণ এদেশের কৃষক জনগণই সংখ্যাগরিষ্ঠ। সেই কৃষকদের অবস্থার ধারাবাহিকভাবে অবনতি ঘটছে। গরিব ও প্রান্তিক কৃষকদের হাতে জমি নেই বললেই চলে। বড়ো জমির মালিকদের শোষণ চলছে। উদারনীতিতে কৃষিতে আরও সঙ্কট নেমে এসেছে। ধারাবাহিকভাবে কৃষি সঙ্কট বাড়ছে। পরিণতিতে কৃষক জমিচ্যুত হচ্ছেন, কৃষি অলাভজনক হচ্ছে। কৃষক চাষ ছেড়ে দিচ্ছেন, কৃষক খেতমজুরে পরিণত হচ্ছেন, কৃষিতে ভরতুকি তুলে দেওয়া হচ্ছে, কৃষি ঋণ বাড়ছে, কৃষকের আত্মহত্যা বাড়ছে, বাড়ছে গ্রামীণ সর্বহারা।
আসলে আত্মনির্ভর ভারত গড়ে তুলতে চাই আমূল ভূমিসংস্কার। আসলে ভূমিসংস্কার একটি অর্থনৈতিক কর্মসূচি। এই কর্মসূচির মধ্যে দিয়ে জমিদার-জোতদার-পুঁজিপতিদের হাত থেকে নির্দিষ্ট সীমার অতিরিক্ত জমি অধিগ্রহণ করে বিনামূল্যে তা ভূমিহীনদের মধ্যে বিলি করা সম্ভব।
অর্থাৎ জমির বিকেন্দ্রীকরণ ঘটে। স্বাধীনতার পর থেকে গ্রামাঞ্চলে প্রান্তিক, ক্ষুদ্র, মাঝারি কৃষকের জমি হাত ছাড়া হয়েছে। জমি কেন্দ্রীভূত হচ্ছে মুষ্টিমেয় জমিদার-জোতদার ও কর্পোরেটদের হাতে। অসাম্য বাড়ছে। প্রান্তিক মানুষের ক্রয়ক্ষমতা তলানিতে। এর ফলে উৎপাদিত পণ্যের জন্য প্রয়োজনীয় অভ্যন্তরীণ বাজার তৈরি হচ্ছে না। এতে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে।
ভূমিসংস্কার কর্মসূচি রূপায়িত হলে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে, গ্রামীণ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের বিকাশ হবে, গ্রামের ব্যাপক মানুষের আয় বাড়বে, শিল্প বিকশিত হবে, গ্রামাঞ্চলে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিষেবায় উন্নতি হবে, গ্রাম ও শহরের মধ্যে অসাম্যের হ্রাস ঘটবে। গড়ে উঠবে প্রকৃত আত্মনির্ভর ভারত। একাজ মোদীর পক্ষে অসম্ভব।
আমাদের দেশে বেকারবাহিনীর সংখ্যা বাড়ছে। বিপুল বেকার বাহিনী নিয়ে আত্মনির্ভর ভারত সম্ভব নয়। দেশের জনসংখ্যার এক বিরাট অংশ তরুণ-তরুণী। ২০২২ সাল নাগাদ কর্মপ্রার্থীর সংখ্যা দাঁড়াবে ১০০ কোটি। কোভিডের পর এই সংখ্যা আরও বাড়বে। কিন্তু কর্মসংস্থানের সুযোগ কোথায়? বিপুল বেকারবাহিনী নিয়ে আত্মনির্ভর ভারত সম্ভব নয়। গত কয়েক বছরে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’, ‘স্ট্যান্ড আপ ইন্ডিয়া’, ‘অটলউদ্ভাবনী মিশন’, ‘স্কিল ইন্ডিয়া’ ইত্যাদি চটকদারি প্রকল্পের ঘোষণা করলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
এখনও পর্যন্ত গ্রামীণ ভারতই প্রধান। সেই গ্রামীণ ভারতের অর্থনীতি সঙ্কটাপন্ন। সঙ্কট বাড়ছে। দশ লাখেরও বেশি জনপদ ও গ্রামের অসংখ্য পরিবারের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে গ্রামীণ ভারত। গ্রামীণ ভারতের ব্যাপক উন্নয়ন ছাড়া আত্মনির্ভর ভারত সম্ভব নয়। গত কয়েক বছরে গ্রামীণ উন্নয়নের ক্ষেত্রে সরকারি বরাদ্দ কমেছে।
আমাদের দেশের সব অংশের মানুষ কি সমান মর্যাদা পান! জাতপাতের ভিত্তিতে সামাজিক শোষণের অবসান ছাড়া আত্মনির্ভর ভারত গঠন সম্ভব নয়। কিন্তু বিজেপি শাসনে ভারতে জাতপাত প্রথার ভিত্তিতে সামাজিক শোষণ বাড়ছে। আমাদের সংবিধান রচয়িতারা অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলেন সমানাধিকার, সমতা, সমদর্শী ও নীতিনিষ্ঠ সমাজ গঠনে। জাতপাত নিয়ে বৈষম্য, অস্পৃশ্যতাকে রদ করার জন্য ১৯৫০ সালে সংবিধানে জাতপাত প্রথা উঠিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু স্বাধীনতার সাত দশককালে সমাজ ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে জাতপাতের দাপট কমছেনা। বরং বাড়ছে। বাড়ছে জাতপাতের ভিত্তিতে মেরুকরণ, হিংসা। এটি “সবকা সাথ সবকা বিকাশের” স্লোগানের বিরোধী।
আমাদের দেশের সব মানুষ কি দু’বেলা খেতে পান? অবশ্যই না। যদিও সংবিধানের ৪৭নং ধারায় খাদ্যের অধিকারের কথা বলা আছে। কিন্তু সেই অধিকার রক্ষিত না হওয়ার কারণেই ‘খাদ্য নিরাপত্তা আইন’ চালু করতে হয়। কিন্তু তারপরেও কি ক্ষুধামুক্ত ভারত গড়ে তোলা গিয়েছে? সারা বিশ্বের খাদ্য নিরাপত্তা বিহীন অর্ধেক মানুষ ভারতে বাস করেন। খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার জন্য অপুষ্টি বাড়ছে। ফলে দৈহিক ও মানসিক স্বাস্থ্য বিপন্ন হচ্ছে। আত্মনির্ভরতার সঙ্গে সুস্বাস্থ্যের সম্পর্ক আছে।
কোভিড-১৯ সঙ্কট আরও বাড়িয়ে তুলেছে। কোভিড-১৯ মোকাবিলার নামে এক বৈষম্যমূলক লকডাউন চাপিয়ে দেওয়া হয়। লকডাউন আসলে পুঁজিবাদী বৈষম্য ও ভারতে পুঁজিবাদের অবশ্যম্ভাবী রূপটিকে তুলে ধরেছে। লক ডাউনের সময় রাষ্ট্রের থেকে নাগরিকদের যে সহায়তা পাবার কথা ছিল তা পাননি। বেঁচে থাকার অত্যাবশ্যক সামগ্রী মানুষের কাছে পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করেনি। লকডাউন পর্বে সরকারি ঘোষণাগুলি পুঁজিবাদীদের পক্ষে গিয়েছে। বৃহৎ ব্যবসায়ীদের ঋণ মকুব করা হয়েছে, ঋণ দেওয়া হয়েছে। সাধারণ মানুষের জন্য কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এগুলি আত্মনির্ভরতার স্লোগানের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ নয়।
আসলে করোনা আমাদের সামনে চরম দারিদ্র্যের আসল রূপটিকে তুলে ধরেছে। দলে দলে অসহায় মানুষ তীব্র গরমের মধ্যে রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়েছেন। কোভিড আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক দিক থেকে আমরা কতটা খারাপ অবস্থায় আছি। অতিমারীর সময় কর্মহীনদের কর্ম নিশ্চিত করার দায়িত্ব পালন করার পরিবর্তে মুকেশ আম্বানি, গৌতম আদানি, অনিল আম্বানিদের সম্পদ বৃদ্ধিতে সহায়তা দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার।
আত্মনির্ভর প্যাকেজের নামে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে। ১২মে লকডাউনে বিধ্বস্ত দেশের অর্থনীতির পুনরুজ্জীবনে ‘আত্মনির্ভর’ ভারত গঠনের জন্য তথাকথিত আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করেন মোদী। এটা যে ধাপ্পা তা ধরা পড়ে গিয়েছে। কারণ দফাওয়ারি বরাদ্দের ক্ষতিপূরণে দেখা গেল বাজেটে ঘোষিত বরাদ্দের তুলনায় নতুন বরাদ্দ মাত্র ২ লক্ষ কোটি টাকা। শিল্পে গতি আনার নাম করে শ্রম আইনগুলির সংশোধন করে শ্রমিকদের পথে বসানোর ব্যবস্থা পাকা করা হয়েছে। আত্মনির্ভরতা অর্জনের নামে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির বিলোপ সাধন করা হলো। নিয়ন্ত্রিত বাজার ব্যবস্থাকে কর্পোরেট ও দেশীয় ব্যবসাদারদের হাতে তুলে দেওয়ার মধ্য দিয়ে কৃষকের উপর আক্রমণ নামিয়ে আনা হয়েছে।
আত্মনির্ভর প্যাকেজে গরিব মানুষকে টাকা দেওয়ার বদলে ঢালাও ঋণের কথা বলা হয়েছে। বাজারে চাহিদা কম হওয়ার কারণে উদ্যোগপতিরা ঋণ নেবেন না। কেন্দ্রীয় সরকারের প্যাকেজে চাহিদা বাড়বে না, ঋণের চাহিদাও বাড়বে না। প্যাকেজে শ্রমজীবী মানুষের ক্ষতিপূরণের কথাও বলা হয়নি।
লকডাউনের ফলে কর্মচ্যুত শ্রমিকদের কি হবে? ভয়ঙ্কর সঙ্কটের দিকে দেশ চলেছে। বাজার চাঙ্গা করার জন্য ক্রেতাদের অর্থ সরবরাহের বদলে বিক্রেতাদের জন্য অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে। মোদীর নীতির ফলে বিপুল পরিমাণ মানুষ প্রান্তিক অবস্থানে চলে যাচ্ছেন। শ্রমআইনগুলিকে নমনীয় বা সংশোধন করার মধ্যে দিয়ে শ্রমিকদের মজুরি কমানোর পথকে প্রশস্ত করা হয়েছে। মোদী সরকার করোনার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে শ্রমজীবীদের ওপর আক্রমণ নামিয়ে এনেছে। রাষ্ট্র শোষক পুঁজির পক্ষে। মোদীর নীতি এদেশের চলমান মন্দাকে মহামন্দায় রূপায়িত করবে।
কোভিডের আগেও আর্থিক অবস্থা ভাল ছিল না। খারাপ ছিল। কোভিডের হাত ধরে মোদী সরকারের জনবিরোধী অর্থনীতি সেই সঙ্কটকে আরও বাড়িয়েছে। নিয়োগহীনতার ফলে বেসরকারি ভোগব্যয় কমছে। বাজারে বিক্রি কম হওয়ার কারণে উৎপাদকেরা আর নতুন বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত হচ্ছেন না। ব্যাঙ্কে আমানতের টাকা উদ্যোগপতিদের কাছে বিনিয়োগ করা খুব কঠিন হচ্ছে। সাধারণ মানুষের হাতে টাকা নেই। ফলে বাজার ঝিমিয়ে পড়ছে। এই সময়কালের মধ্যে ভারত সরকার দেশি, বিদেশি কর্পোরেট সংস্থাগুলির সর্বোচ্চ মুনাফা লাভ নিশ্চিত করেছে।
লক ডাউনের ফলে প্রচুর মানুষ কাজ হারিয়েছেন। আবার লক ডাউনের সুযোগে কর্ম সংকোচনও ঘটানো হয়েছে। লক ডাউনে যাঁরা কর্মচ্যুত হয়েছেন তাঁদের বিপুল অংশ কাজ পাবেন না। বর্তমান পরিস্থিতিতে অনেক শ্রমিকের আয়ের উৎস কেড়ে নেওয়া হয়েছে। পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য এখন পর্যন্ত কোনো ক্ষতিপূরণ ঘোষিত হয়নি।
দেশের সর্বোচ্চ আদালতও গরিবদের অধিকারকে স্বীকৃতি দিতে রাজি নয়। লক ডাউনের দিনগুলিতে শ্রমিকদের মজুরি মিটিয়ে দেওয়ায় সরকারি আদেশকে খারিজ করে সুপ্রিম কোর্ট বলেছে - যখন উৎপাদন বা পরিষেবা বন্ধ তখন প্রতিষ্ঠানগুলিকে মজুরি দিতে বাধ্য করা যায় কিভাবে? পরোক্ষভাবে লকডাউনের দায় চাপিয়ে দেওয়া হলো মানুষের উপর। যে সব শ্রমিক হঠাৎ করে কাজ হারালেন, আশ্রয় হারালেন তাদের বাঁচতে হচ্ছে অন্যের করুণার উপর। লকডাউনের সুযোগে শ্রমিকদের অর্জিত অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। শ্রমআইনগুলি বাতিল করার মধ্যে দিয়ে কার্যত শ্রমিকদের দাসে পরিণত করা হচ্ছে। শ্রমিক স্বার্থ বহুজাতিকদের কাছে বন্ধক দেওয়া হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় সরকার শ্রমআইন সংশোধন করে নিয়োগ কর্তাদের বলছে নিয়োগের ক্ষেত্রে শ্রমদপ্তরের কোনো হস্তক্ষেপ বা নজরদারি থাকবে না। অর্থাৎ যেমন খুশি নিয়োগ, যেমন খুশি ছাঁটাই করা যাবে। শ্রমিকরা ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে দরকষাকষি করতে পারবেন না। নিয়োগকর্তাদের কারখানা আইন ও চুক্তিভিত্তিক কর্মী আইন থেকে রেহাই দেওয়া হয়েছে। বিপুল সংখ্যক কর্মী বাহিনীকে পেশাগত নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও কল্যাণ প্রকল্পের আওতা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
করোনা সঙ্কটের সময়ও মোদী সরকার নয়া-উদারবাদী সংস্কারগুলিকে আগ্রাসীভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে। যার ফলে আত্মনির্ভরতা বিপন্ন হচ্ছে। কৃষি ব্যবস্থাকে কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। পিএম কিষান সম্মান যোজনার নামে কৃষকদের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে। কৃষি পণ্যের বাজার কমিটির (এমপিএমসি) আইন লঘু করার জন্য অর্ডিন্যান্স আনা হয়েছে। কর্পোরেট যাতে বিনা বাধায় কৃষি জমি দখল করতে পারে তার জন্য সব আয়োজন সম্পূর্ণ। কৃষি বাজারকে বৃহৎ ব্যবসায়ীদের কাছে, কর্পোরেটদের কাছে তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। চালু করা হয়েছে ই-বাজার, যা ক্ষুদ্র ও মধ্য চাষীদের কাছে অধরা। কালোবাজারি, মজুতদারি রমরমিয়ে বাড়ছে। ফলে রকেটের গতিতে জিনিসের দাম বেড়ে চলেছে।
কোভিড আবার দেখিয়ে দিল স্বাস্থ্য পরিষেবা সব মানুষের জন্য নয়। করোনা আক্রান্ত সাধারণ মানুষ সরকারি চিকিৎসার অভাবে মারা গেলেও মোদী-শাহ নির্বিকার, নির্দয়। চিকিৎসার অধিকার থেকে বঞ্চিত সাধারণ মানুষ। ঔষধের দাম আমজনতার নাগালের বাইরে। মনরেগাকে কবরে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে।
আসলে যতটুকু আত্মনির্ভরতা আছে তাও বিপন্ন করতে চাইছে মোদী। ‘আত্মনির্ভর ভারত’ গড়ে তুলতে গেলে যা দরকার তা হলো - আমূল ভূমিসংষ্কার, গরিব মানুষের সমস্ত ঋণ মকুব, গরিব মানুষকে নিখরচায় খাদ্য সরবরাহ করা, আয়কর সীমার নিচে বসবাসকারী পরিবারগুলিকে মাসে ৭,৫০০ টাকা প্রদান, গরিব মানুষকে ঋণ নয় - অর্থ দিতে হবে, পরিকাঠামো নির্মাণে সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি করতে হবে - এতে কর্মসংস্থান বাড়বে, জনস্বাস্থ্য খাতে অর্থ বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে, সর্বজনীন স্বাস্থ্য পরিষেবা দিতে হবে, সমস্ত শূন্যপদে লোক নিয়োগ করতে হবে, মনরেগা’তে কাজ পাওয়ার অধিকার ২০০ দিন করতে হবে ও মজুরি ৬০০ টাকা করতে হবে, শহরাঞ্চলের জন্য কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা আইন চালু করতে হবে, কর্মহীন মানুষদের জন্য বেকারভাতা চালু করতে হবে, শিক্ষায় ডিজিটাল বৈষম্য করা যাবে না, স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ মেনে চাষের উৎপাদন মূল্য +৫০ শতাংশ যোগ করে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ঘোষণা করতে হবে, গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা করতে হবে।
বিকল্প অর্থনীতির পক্ষে লড়াই এবং বিকল্প অর্থনীতির পথেই প্রকৃত আত্মনির্ভর ভারত গড়ে উঠতে পারে। আর মোদীর আত্মনির্ভর ভারত গঠনের স্লোগান আসলে কাঁঠালের আমসত্ত্ব ছাড়া কিছুই নয়।