৫৮ বর্ষ ৭ম সংখ্যা / ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০ / ৮ আশ্বিন ১৪২৭
কমিউনিস্ট বিপ্লবী ধন্বন্তরি ও পাঞ্জাব দাঙ্গার রিপোর্ট
সিদ্ধার্থ সেনগুপ্ত
স্বাধীনতা সংগ্রামে বিপ্লবী ধন্বন্তরির আত্মত্যাগের কথা বিস্মৃত হওয়ার নয়। শহিদ-এ আজম ভগৎ সিং-এর সহযোগী এবং কমিউনিস্ট বিপ্লবী ধন্বন্তরির বিপ্লবী জীবনের কথা আজও জম্মুর মানুষ বিস্মৃত হননি। জম্মুর এই কৃতি সন্তানের জন্মদিবস মর্যাদার সাথে এখনও প্রতিবছর পালন করে জম্মু ও কাশ্মীর ফ্রিডম ফাইটার অ্যাসোসিয়েশন এবং বামপন্থী ছাত্র যুবরা। জম্মুতে তাঁর মূর্তিও প্রতিষ্ঠা হয়েছে।
ধন্বন্তরির আসল বাড়ি জম্মুর কালি জান্নিতে। তাঁর পিতা (ডাঃ) দুর্গা দত্ত মাহে ছিলেন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট কর্নেল। ধনন্তরির জন্ম ১৯০২ সালের ৭ মার্চ। জম্মুর এস আর হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করার পর ১৯১৭ সালে লাহোরের ডিএভি কলেজে ভর্তি হন। লাহোরে আয়ুর্বেদ অধ্যয়নের সময়েই তিনি দেশের বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। পরাধীন ভারতকে মুক্ত করার শপথে তিনি নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। আয়ুর্বেদ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর লাহোরের সুতামন্ডীতে চেম্বার করে তিনি আয়ুর্বেদ চিকিৎসা শুরু করেন। তাঁর মধ্যে বিপ্লবী গুণাবলী থাকার জন্য কিছুদিনের মধ্যে শহিদ ভগৎ সিং-এর সাথে তাঁর পরিচয় ঘটে এবং তাঁর বিশ্বাসভাজন হয়ে ওঠেন। তাঁর চেম্বার আসলে ছিল শহিদ ভগৎ সিং, সুখদেব, রাজগুরু, শিব বর্মা প্রমুখ বিপ্লবীদের গোপন আলোচনার কেন্দ্রস্থল। ধন্বন্তরি ভারত নওজোয়ান সভা এবং হিন্দুস্থান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশনের সহ প্রতিষ্ঠাতা। ধন্বন্তরি ছিলেন ভগৎ সিং এবং চন্দ্রশেখর আজাদের নেতৃত্বে গঠিত বিপ্লবী গোষ্ঠীর আদর্শবাদী কর্মী, যিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী দাসত্ব থেকে ভারতকে মুক্ত করার এবং ভারতকে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তোলার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন।
১৯২৮ সালের ১৭ ডিসেম্বর লাহোরে ভগৎ সিং এবং রাজগুরু ব্রিটিশ পুলিশ অফিসার স্যান্ডার্সকে গুলি করেন। এই ঘটনায় ধন্বন্তরিকে পুলিশ আটক করে। একমাস ধরে পুলিশ হেফাজতে অমানুষিক অত্যাচারের পর তিনি প্রমাণাভাবে ছাড়া পান। দিল্লিতে যে পুলিশ সুপারিনটেন্ডেন্ট ভগৎ সিং-এর বিরুদ্ধে তদন্ত করছিলেন, দিল্লির চাঁদনি চকে ধন্বন্তরিরা তাঁকে গুলি করেন, পুলিশ অফিসার আহত হন। দিল্লি ষড়যন্ত্র মামলা আড়াই বছর চলার পর তাঁকে ৭ বছর কালাপানি আন্দামানের কুখ্যাত সেলুলার জেলে পাঠানো হয়। আন্দামানের জেলে কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের সাথে তাঁর পরিচয় হয়।
১৯৩৩ সালের মে মাসে আন্দামানের সেলুলার জেলে বিভিন্ন দাবিতে আমরণ অনশন শুরু করেন বিপ্লবীরা। জেলের অভ্যন্তরে ব্রিটিশদের অত্যাচার, খাদ্যাভাব, শিক্ষা, স্বাস্থ্যাভাব, সংবাদের অভাব ইত্যাদির বিরুদ্ধে সেখানকার বন্দী বিপ্লবীরা অনশন শুরু করেছিলেন। অনেক চেষ্টা করেও সেখানকার ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ এই অনশন ভাঙতে ব্যর্থ হন। এই অনশনে তিনজন বিপ্লবী মারা গিয়েছিলেন। অবশেষে ব্রিটিশরা সেলুলার জেলে পাঠান লেফটেন্যান্ট কর্নেল বার্কারকে। দু’মাস অনশন চলার পর বার্কার সাহেবের প্রতিশ্রুতিতে অনশন তুলে নেওয়া হয়। কিছুদিনের মধ্যে বিপ্লবীদের দাবি মেনে নেয় ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ। এই ঘটনা লিপিবদ্ধ আছে অগ্নিযুগের বীর বিপ্লবী সতীশ পাকড়াশীর ‘অগ্নিযুগের কথা’ পুস্তকে। বিপ্লবী সতীশ পাকড়াশীর নিজের কথায়ঃ “তিনটি অমূল্য জীবনের বিনিময়ে রাজবন্দীর মহার্ঘ দাবি আদায় করা সম্ভব হয়। এরপর স্বাস্থ্যরক্ষার ও জ্ঞান-বিদ্যা-বুদ্ধির প্রসারের পথ উন্মুক্ত হলো সুদূর দ্বীপান্তরের কারাগারে। শাস্তির আগার নবচেতনার শিক্ষাগারে পরিণত হলো - আঁধার ঘরে আলো জ্বললো। নিরঞ্জন সেন, ডাক্তার নারায়ণ রায়,লাহোরের ধন্বন্তরি, শিউ বর্মা প্রমুখ কয়েকজন মার্কসিস্ট সাহিত্য অধ্যয়ন ও অধ্যাপনার দ্বারা আন্দামান বন্দী জীবনে এক নতুন প্রেরণা সঞ্চার করেন। মার্কসবাদী শিক্ষায় ছোটো ছেলে হলেও হরেকৃষ্ণ কোঙারের উৎসাহ ছিল অপূর্ব। ডাঃ নারায়ণ রায়ের সুন্দর শিক্ষাপ্রণালী, জটিল ব্যাপারকে সরল করে বোঝাবার অপূর্ব ক্ষমতা এবং জীববিদ্যার ও শরীর বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা যুবকদের মার্কসবাদের প্রতি আকৃষ্ট করে। তাদেরই অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে শেষ অবধি আন্দামান জেলের শতকরা নব্বই জন রাজবন্দী কমিউনিজম মতবাদ গ্রহণ করে। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন মামলার প্রায় সকলেই ক্রমে ক্রমে এই মতে বিশ্বাসী হয়ে পড়ে। এখানে কমিউনিস্ট কনসোলিডেশন (জেলের মধ্যে কমিউনিস্ট পার্টির সংগঠন) গঠিত হয়। (পৃঃ ১৪৮-১৪৯, চতুর্থ প্রকাশ) এইভাবে আন্দামান সেলুলার জেলে ধন্বন্তরি মার্কসবাদে দীক্ষিত হয়ে কমিউনিস্ট হয়ে ওঠেন।
১৯৩৯ সালে জেল থেকে মুক্ত হয়ে লাহোরে ফিরে এলে কংগ্রেসীরা তাঁকে লাহোর জেলা কংগ্রেস কমিটির সভাপতি নির্বাচিত করেন। কিন্তু ব্রিটিশরা এই কমিউনিস্ট বিপ্লবীকে বেশিদিন মুক্ত রাখতে সাহস করেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে ১৯৪০ সালে তাঁকে আবার গ্রেপ্তার করা হয়। বিনা বিচারে ধন্বন্তরিকে আরও ছয় বছর কারান্তরালে কাটাতে হয়েছিল। ১৯৪৬ সালে পাঞ্জাবে কংগ্রেস-খিজার মন্ত্রীসভা গঠনের পর তাঁকে জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। জেল থেকে মুক্ত হয়ে তিনি লাহোরে ফিরে আসেন। সেখানে তিনি ট্রেড ইউনিয়ন এবং কিষান সভার আন্দোলনে নিজেকে নিয়োজিত করেন। দেশ বিভাগের পরিপ্রক্ষিতে পাঞ্জাবে এ যাবৎকালের বৃহত্তম দাঙ্গার সময় তিনি দাঙ্গার ভয়াবহ ও নারকীয় ঘটনাবলীর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন। এই সময়ে তিনি পাঞ্জাবের দাঙ্গার ওপর এক মূল্যবান রিপোর্ট ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদকের কাছে পেশ করেছিলেন। এই রিপোর্টের সংক্ষিপ্তসার এই নিবন্ধের শেষদিকে দেওয়া আছে।
জম্মুতে ফিরে আসার পর জম্মু ও কাশ্মীরে ভুমিসংস্কারের ক্ষেত্রেও তিনি উজ্জ্বল অবদান রেখে গিয়েছেন। তাঁর ৩৪ বছর পূর্ণ বয়স্ক জীবনে তিনি ১৭ বছর ছিলেন কারান্তরালে। ১৯৫৩ সালের ১৩ জুলাই মাত্র ৫১ বছর বয়সে এই স্বাধীনতা যোদ্ধার জীবনাবসান ঘটে। জম্মু ও কাশ্মীরের জনগণ এই বীর বিপ্লবীকে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের কিংবদন্তী হিসাবে আজও সম্মান জানিয়ে থাকে। ২০১৩ সালের জুলাই মাসে জম্মুর ত্রিকুটনগরে বিপ্লবী ধন্বন্তরির মুর্তি প্রতিষ্ঠা করে জম্মু ও কাশ্মীর ফ্রিডম ফাইটার অ্যাসোসিয়েশন। এই মূর্তি উদ্বোধনে জম্মু ও কাশ্মীরের দু’জন তৎকালীন মন্ত্রীও উপস্থিত ছিলেন।
বিপ্লবী ধন্বন্তরির রিপোর্টের সংক্ষিপ্তসার
দেশভাগের সময় পাঞ্জাবের ভয়াবহ ও নারকীয় দাঙ্গার ওপর ধন্বন্তরি “রক্তাক্ত পাঞ্জাবের সতর্কতা” শীর্ষক একটি মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্ট ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির তৎকালীন সম্পাদক পিসি যোশীর কাছে পেশ করেছিলেন। ওই রিপোর্টের গুরুত্ব অনুধাবন করে পিসি যোশী নিজের একটি নোট সহ ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পিপলস পাবলিশিং হাউজ লিমিটেড থেকে ঐ রিপোর্টটি প্রকাশ করেছিলেন।
পাঞ্জাবে যা ঘটেছিল তাকে দাঙ্গা বলা যায় না। এটা ছিল সংখ্যালঘু নির্মূলীকরণের যুদ্ধ - শিখ ও হিন্দুদের পশ্চিম পাঞ্জাবে এবং মুসলিমদের পূর্ব পাঞ্জাবে। পাঞ্জাবের দাঙ্গাকে কলকাতা, নোয়াখালি, বিহারের দাঙ্গার সাথেও তুলনা করা যায় না। ওই সব জায়গায় একটা নির্দিষ্ট অঞ্চলে বর্বরতা ও উন্মত্ততার সাথে একদল দাঙ্গাকারী সেই অঞ্চলের সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি লুট,অগ্নিসংযোগ ও হত্যা সংগঠিত করেছিল। এইসব জায়গার দাঙ্গা ভারতবর্ষের অন্যত্র প্রভাব ফেললেও ১৯৪৬ সালে পাঞ্জাবে দাঙ্গার আঁচ লাগেনি, পাঞ্জাব শান্তই ছিল।
১৯৪৭ সালে পাঞ্জাবের মতো এত ব্যাপক হত্যা ইতিপূর্বে আর দেখা যায়নি। পাঞ্জাবে এই দাঙ্গা চালিয়েছিল বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রশিক্ষিত বাহিনী। আধুনিক অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে এরাই লুট, হত্যা, ধর্ষণে মত্ত হয়ে উঠেছিল। এরা কারা? পশ্চিম পাঞ্জাবে মুসলিম লিগের ন্যাশনাল গার্ড, পূর্ব পাঞ্জাবে আকালিদের শহিদি দল এবং হিন্দু মহাসভার রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ। এরা পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর সাহায্যে সর্বত্র নৃসংশতা চালিয়েছিল। আবার কোথাও কোথাও এই বাহিনী নিজেরাই লুটপাঠ ও হত্যাভিযান চালিয়েছিল। পাঞ্জাবের যে ১৪টি জেলায় দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছিল, সেখানকার পুলিশ, প্রশাসন ও মিলিটারি দাঙ্গা বন্ধ না করে ছড়ানোর ব্যাপারে উৎসাহ জুগিয়েছিল। পাঞ্জাবের দাঙ্গার আগুন ছড়িয়ে দেওয়ার ব্যাপারে ব্রিটিশ প্রশাসকরা তাদের শয়তানি দক্ষতাকে পুরোদমে কাজে লাগিয়েছিল।
মুসলিম ন্যাশনাল গার্ডকে নিষিদ্ধ করার প্রতিবাদে মুসলিম লিগ পাঞ্জাবে আইন অমান্য শুরু করে। সাতদিনের মধ্যে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যহারের পরও পাঞ্জাবে ক্ষমতাসীন খিজার-কংগ্রেস মন্ত্রীসভার ওপর চাপ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে মুসলিম লিগ আন্দোলন চালু রাখে। সেই সময় কোর্ট ও জেলখানা আক্রান্ত হলেও হিন্দু ও শিখদের জীবন ও সম্পত্তি নিরাপদ ছিল। মুসলিম লিগ পাকিস্তান দাবির সপক্ষে স্লোগান দিলেও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী - যেমন ‘হিন্দু মুসলিম ভাই ভাই, সব কি দুশমন নোকরশাহী’ স্লোগানও দিয়েছিল। এই স্লোগানে আকৃষ্ট হয়ে অনেক হিন্দু শিখ সম্প্রদায়ের মানুষও এই সভাগুলিতে উপস্থিত থাকতেন। হিন্দু-মুসলিম-শিখ সম্প্রদায়ের এই ঐক্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তির মনঃপূত ছিল না।
১৯৪৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি অ্যাটলির ভারত বিভাগের ঘোষণার সাথে সাথে পরিস্থিতির পরিবর্তন শুরু হতে থাকে। গভর্ণর জেনকিন খিজার হায়াতকে পদত্যাগের নির্দেশ দেন। ব্রিটিশের পরিকল্পনা ছিল খিজার-কংগ্রেস মন্ত্রীসভাকে সরিয়ে মুসলিম লিগকে মন্ত্রীসভা গঠন করতে দিলে শিখ ও হিন্দুরা ক্ষিপ্ত হবে এবং রাতারাতি সাম্প্রদায়িক বিভাজন সফল হবে। ব্রিটিশদের উদ্দেশ্য ছিল এক সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আর এক সম্প্রদায়কে লড়িয়ে দিয়ে এবং জনপ্রিয় দলগুলিকে ক্ষমতা থেকে দূরে রেখে দাঙ্গা বাঁধাতে প্ররোচিত করা। ওইদিনই লাহোরে দাঙ্গা শুরু হয়। দ্রুত দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে লাহোর, মূলতান, রাওয়ালপিণ্ডি, অমৃতসর ও জলন্ধরে।
রাওয়ালপিণ্ডিতে দাঙ্গা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়লে কংগ্রেসের নেতারা ডেপুটি কমিশনারের সাথে দেখা করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষার আবেদন জানান। ডেপুটি কমিশনার ঔদ্ধত্যের সাথে বলেছিলেন, ‘আপনারা সর্দার প্যাটেল ও নেহরুর কাছে যান, তাঁরাই এখন সরকারে আছে। আপনারা ব্রিটিশকে চলে যেতে বলেছেন। তাহলে তাদের কাছে এসেছেন কেন?’ কয়েকজন হিন্দু ও শিখ নেতা ব্রিটিশ সিভিলিয়ান পাঞ্জাবের মুখ্যসচিব কুখ্যাত ম্যাকডোনাল্ডকে দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের দুর্দশার কথা উল্লেখ করে পুনর্বাসনের অনুরোধ করলে ম্যাকডোনাল্ড উত্তর দিয়েছিলেন, ‘রাওয়ালপিণ্ডির প্রতিশোধ মধ্য ও পূর্ব পাঞ্জাবে শুরু হলে দুর্দশার কথা তাঁরা ভুলে যাবে’। পাঞ্জাবে প্রতিশোধ ও পালটা প্রতিশোধে দাঙ্গা ছড়াবে এই সম্পর্কে তিনি ওয়াকিবহাল ছিলেন। ম্যাকডোনাল্ডের হিসাব মতো মধ্য ও পূর্ব পাঞ্জাবে দাঙ্গা শুরু হলো আরএসএস এবং আকালিদের দ্বারা। আকালিরা শিখ অধ্যুষিত এলাকায় শহিদি দল সংগঠিত করতে থাকে। প্রতিটি দলে ১৬ জন, তার মধ্যে ৬ জন রাইফেলধারী বাকিরা তরোয়াল ও অন্যান্য অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত থাকত। তারা ঘোড়সওয়ার বাহিনীও তৈরি করে। পরে জিপ ও ট্রাকও আনা হয় এই বাহিনীর জন্য। এই কাজে দেশীয় রাজ্যগুলির রাজারা এবং অমৃতসর জেলার জমিদাররা সক্রিয়ভাবে সাহায্য করেছিল।
পাঞ্জাবে কংগ্রেস বরাবরই দুর্বল ছিল। তাদের সমর্থনের ভিত্তি ছিল ব্যবসায়ী এবং অন্য পেশার কিছু মানুষজন। ফলে শহরগুলিতে দ্রুত আরএসএস শক্তি বৃদ্ধি করে নিয়ামক শক্তিতে পরিণত হয়। তাদের পৃষ্ঠপোষক ছিল কালোবাজারি ও বৃহৎ ব্যবসায়ীরা। প্রথমে তারা ভোজালি ও তরোয়াল নিয়ে আক্রমণে নেমেছিল; পরে রিভলভার,অন্যান্য আগ্নেয়াস্ত্র ও বোমা নিয়ে মুসলিম অধ্যুষিত মহল্লাগুলিতে আক্রমণ চালিয়েছিল। অন্যদিকে লাহোরে (পশ্চিম পাঞ্জাব) ন্যাশনাল গার্ডরাও একইভাবে ভাওয়ালপুর ও সীমান্ত প্রদেশের প্রতিক্রিয়াশীলদের সহায়তায় অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত হতে থাকে। পাকিস্তানের ভুস্বামীরা অর্থ ও অস্ত্র-শস্ত্র দিয়ে তাদের সাহায্য করেছিল।
পূর্ব ও পশ্চিম পাঞ্জাবের পাতিয়ালা, ঝিন্দ, নাভা, ফরিদকোট, মালকোটিয়া, ভাওয়ালপুর, কাপুরথালা প্রভৃতি দেশীয় রাজ্যের রাজারা উভয়দিকের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকারীদের সাহায্য করে। কাপুরথালায় আরএসএস বাহিনীর ট্রেনিং ক্যাম্প, ফরিদকোট আকালিদের জিপ দিয়ে এবং ভাওয়ালপুর মুসলিম ন্যাশনাল গার্ডকে অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করে। ব্রিটিশের ক্রীড়নক এইসব দেশীয় রাজারা নিজেদের রাজ্যের ক্রমবর্ধমান গণতান্ত্রিক সংগ্রামকে ভেঙে দিতে সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের সাহায্য করে, পূর্ব পাঞ্জাবের সরকারের ওপর নিজেদের আধিপত্য কায়েম করার লক্ষ্য নিয়ে।
মাউন্টব্যাটেনের পাঠানো বাউন্ডারি ফোর্স দাঙ্গা থামানোর কোনো চেষ্টাই করেনি। ন্যাশনাল গার্ড, শহিদি দল বা আরএসএস-এর একজন দাঙ্গাকারীকেও তারা গ্রেপ্তার করেনি। সেই সময় পাঞ্জাবে একটি কথা প্রচলিত ছিল, ব্রিটিশ অফিসারের নেতৃত্বে পরিচালিত মুসলিম রেজিমেন্ট লিগের দিকে, শিখ রেজিমেন্ট আকালিদের দিকে এবং হিন্দু রেজিমেন্ট আরএসএস-এর দিকে।
প্রথম থেকেই কমিউনিস্ট পার্টি, ট্রেড ইউনিয়ন ও কিষান সভা লাল ঝান্ডার পতাকাতলে এই ক্রমবর্ধমান বিপদের মধ্যেও মানুষকে রক্ষা করার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। শহরাঞ্চলে হিন্দু, মুসলিম এবং শিখ শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ করা হয়। যার জন্য প্রথমদিকে সাম্প্রদায়িক শক্তি শ্রমিকে শ্রমিকে লড়িয়ে দিতে পারেনি। কিন্তু পরেরদিকে হিন্দু ও শিখ মালিকরা মুসলিম শ্রমিকদের এবং মুসলিম মালিকরা হিন্দু ও শিখ শ্রমিকদের কাজ থেকে ছাঁটাই শুরু করে। পাকিস্তান ও ভারত রাষ্ট্র গঠন হলে অনেকে চলে যান। এই পরিস্থিতিতে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন ক্রমশ স্তিমিত হয়ে পড়ে। এই নারকীয় দাঙ্গার মধ্যেও শ্রমিক ঐক্যের এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলোঃ শিয়ালকোটে সমস্ত ক্রীড়া সরঞ্জাম কারখানাগুলির মালিক ছিল অমুসলিম। এখানকার সব কারখানা পুড়িয়ে দিয়েছিল মুসলিম দাঙ্গাবাজরা। সবচেয়ে বড়ো কারখানা, অমুসলিম মালিক ওবেরয়ের কারখানাটি বেঁচে যায়, কারণ ঐ ফ্যাক্টরির শ্রমিকরা ঐক্যবদ্ধভাবে পাহাড়া দিয়ে দাঙ্গাকারীদের নিরস্ত করতে পেরেছিল।
কমিউনিস্টদের সাহসিকতার অনেক উদাহরণ এই রিপোর্টে আছে। শিরিচাঁদ, যিনি পশ্চিম উত্তর রেলওয়ের একজন কর্মী এবং বিশিষ্ঠ ট্রেড ইউনিয়ন নেতাও ছিলেন, লাহোরে দাঙ্গার সময় তিনি শান্তি বজায় রাখার কাজ করে গিয়েছেন নিরলসভাবে। তাঁর বাসস্থানে তিনি দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত বহু মানুষকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। পুলিশ দাঙ্গাকারীদের নিরস্ত না করে শিরিচাঁদ-সহ তাঁর পরিবারের সাত জনকে এবং তাঁর বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া মানুষদের গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে যায়। ১৪ আগস্ট পুলিশ শিরিচাঁদ ও তাঁর পরিবারের সাত জনকে মুক্তি দিয়ে দু’জন কনেস্টবল দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। থানার বাইরে এসে দুই কনেস্টবল গুলি চালিয়ে হত্যা করে শিরিচাঁদ সহ তাঁর পরিবারের পাঁচ জনকে। শিরিচাঁদের মা ও স্ত্রী গুরুতরভাবে আহত হন। দাঙ্গাবিরোধী কমিউনিস্টদের ওপর এইভাবে আক্রমণ নামিয়ে এনেছিল রাষ্ট্রশক্তি ও দাঙ্গাবাজরা।
গ্রামে যেসব জায়গায় কমিউনিস্ট ও কিষান সভার লোকজন ছিলেন, সেখানে শান্তি কমিটি গঠন করে দাঙ্গা প্রতিরোধে মুসলিমদের রক্ষা করার বলিষ্ঠ ভূমিকা গ্রহণ করা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু সশস্ত্র দাঙ্গাকারীরা পুলিশের সহায়তায় গ্রাম আক্রমণ করলে আর কোনো উপায় নেই দেখে তাদের রিফিউজি ক্যাম্প বা রেলওয়ে স্টেশনে বা কাছাকাছি কোনো নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল। খাসা রেলওয়ে স্টেশনের নিকটবর্তী হোশিয়ারনগরে রেডফ্লাগের অন্তর্ভুক্ত শিখ ও হিন্দু কিষানরা তিনশ’জন মুসলিমকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। এখানে মুসলিমদের হত্যার জন্য দু’বার আক্রমণ হেনেছে দাঙ্গাকারীরা। দু’বারই তারা ব্যর্থ হয়েছে। নেহরুর প্রথম পাঞ্জাব সফরের পর ১৮ আগস্ট শিখ মিলিটারির সহায়তায় আকালিদের সশস্ত্র বাহিনী এই গ্রামে এসে মুসলিমদের হত্যা করে।
কমিউনিস্ট ও লালঝান্ডাধারীরা এইভাবে বহু জায়গায় দাঙ্গার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল। ভবিষ্যতে যদি কোনোদিন পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস লেখা হয়, তবে দেখা যাবে পূর্ব বা পশ্চিম পাঞ্জাব যেখানেই হোক না কেন, কমিউনিস্ট ও লালঝান্ডাধারীরা মুসলিম, শিখ এবং হিন্দুদের রক্ষায় এগিয়ে এসেছিল। আগস্ট মাসে ধন্বন্তরি দিল্লি যান পাঞ্জাবের নারকীয় দাঙ্গার বিবরণ প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুকে জানাবার জন্য। তাঁর সাথে ছিলেন প্রবীণ বিপ্লবী গুরুমুখ সিং, যিনি দেশের স্বাধীনতার জন্য সাতাশ বছর ব্রিটিশের কারাগারে বন্দী ছিলেন। পাকিস্তানে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত শ্রী প্রকাশ জানিয়েছিলেন, দেড় লাখ লোক এই দাঙ্গায় নিহত হয়েছিলেন। মহাত্মা গান্ধী ও জওহরলাল নেহরু, যাঁরা সাম্প্রদায়িক ঐক্য ও সম্প্রীতি রক্ষায় তৎপর ছিলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে আরএসএস এবং আকালিরা জঘন্য ভাষায় প্রচার সংগঠিত করেছিল।
পাঞ্জাবের এই দুঃখজনক ও বেদনাদায়ক ঘটনা সারা দেশের সঙ্কট। এটি আমাদের অস্তিত্ব এবং ভবিষ্যৎ গণতন্ত্রের ওপর মারাত্মক হুমকি। পাঞ্জাবের এই ধ্বংস ও রক্তপাতের বার্তাটি হলোঃ এর ছায়া যেন ভারতের অন্যত্র না পড়ে। পাঞ্জাবের এই ঘটনার নায়ক প্রতিক্রিয়ার কালো শক্তি যাতে ভারতের অন্যত্র মাথা তুলতে না পারে তার জন্য সর্বত্র সতর্কতা জরুরি। এইভাবেই পাঞ্জাব ও ভারতবর্ষকে রক্ষা করা যাবে।
সবশেষে এই কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, এই রিপোর্টে ধন্বন্তরি পাঞ্জাবের নারকীয় দাঙ্গায় সংগঠিত সাম্প্রদায়িক শক্তির কথা বারবার উল্লেখ করেছেন। ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গা থেকে সাম্প্রতিক দিল্লির দাঙ্গায় মানুষ দেখেছেন কিভাবে সঙ্ঘ পরিবারের সাম্প্রদায়িক শক্তি সংগঠিতভাবে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ শানিয়েছে। ২০১৪ সালে আরএসএস প্রচারক নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে ভারত সংগঠিত সাম্প্রদায়িক বিভাজনের শিকার। সেইদিক থেকে ধন্বন্তরির রিপোর্টের সারবস্তু আজকের পরিস্থিতিতেও খুবই প্রাসঙ্গিক।