৫৮ বর্ষ ৭ম সংখ্যা / ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০ / ৮ আশ্বিন ১৪২৭
বিধাননগরের অতিথিশালায় ধর্মপরিচয় ঘিরে ন্যক্কারজনক ঘটনা
পিয়াল রায়
সল্টলেকের ডিএল ব্লকে একটি বেসরকারি অতিথিশালায় মালদহ জেলার কয়েকজন মাদ্রাসা শিক্ষক থাকার জন্যে বুকিং করেছিলেন। ২১ সেপ্টেম্বর সকালে তাঁরা অতিথিশালায় ওঠেন। মাদ্রাসা পর্ষদে তাঁদের কিছু কাজ ছিল। কিন্তু তাঁদের পোশাক, অর্থাৎ; দাড়ি, ফেজটুপি ইত্যাদি ঘিরে অতিথিশালার কর্মীরা বিদ্বেষমূলক কথা বলে, যেহেতু তাঁরা মুসলমান, তাই তাঁদের সেই অতিথিশালায় থাকা যাবে না বলে জানায়। সেখান থেকে অতিথিশালার কর্মীদের পরামর্শে তাঁরা অন্য একটি অতিথিশালায় যান। কিন্তু সেখানেও তাঁদের থাকতে দেওয়া হয় না। স্বাধীনতার পর এইরকম ধর্মের ভিত্তিতে মানুষের পরিচয় দেখে, সেই মানুষ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ঘটনা কখনো ঘটে নি। ব্রিটিশ অতীতে নিজেদের স্বার্থে রেল স্টেশনে হিন্দু চা, মুসলমান চা, হিন্দু জল (বলা হতো পানি পাঁড়ে), মুসলমান জলের রেওয়াজ করেছিল। ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ হলেও ভারতের মানুষই রেল স্টেশন থেকে শুরু করে সর্বত্র এই প্রকাশ্য ধর্মীয় বিভাজন তুলে দিয়েছিল। তবু কখনো কখনো হিন্দু অধ্যুষিত পাড়াতে মুসলমান বাড়ি ভাড়া পাচ্ছেন না, এমন দুর্ভাগ্যজনক খবর আমাদের কানে আসতো। তবে পেশাদার কোনো হোটেল, অতিথিশালা, রেস্টুরেন্টে ধর্মের ভিত্তিতে, পোশাক দেখে মানুষের প্রতি আচরণ ’৪৬-এর দাঙ্গার পর আর পশ্চিমবঙ্গ দেখে নি। মীজানুর রহমান তাঁর ‘কৃষ্ণ ষোলোই’-তে কলেজ স্ট্রিটের ‘দিলখুশা কেবিনে’র রাতারাতি ‘হিন্দু’ শব্দ সংযোজনের কথা লিখেছেন। তেমনটা কিন্তু পরবর্তীকালের বাংলাতে শত বিপত্তির ভিতরেও কখনো ঘটেনি।
শেখ আখলাক, উত্তরপ্রদেশের দাদরির এক নিম্ন আয়ের মানুষ। তাঁর বাড়ির ফ্রিজে গোরুর মাংস আছে কি না, তা দেখা, যাঁরা দেখলেন, তাঁদের রুচি অনুযায়ী মাংসের জাত নির্ধারণ, পরিণতিতে আখলাকের রক্তে দাদরির মাটি ভিজে যাওয়ার ঘটনাপ্রবাহের চরিত্রের সঙ্গে কিন্তু সল্টলেকের অতিথিশালাতে কেবলমাত্র মুসলমান হওয়ার ‘অপরাধে’ সহনাগরিক শিক্ষকদের উপর যে ঘটনা ঘটলো, তার চরিত্রের মৌলিকতায় এতটুকু ফারাক নেই।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হিজাব’ পরিহিত, মোনাজাতের ভঙ্গিমার ফটোশ্যুট যে মুসলমান সমাজকেই কতখানি সামাজিক হেনস্তার শিকার করেছে, তা ভাবার বা বোঝার মতো কোনো রাজনৈতিক, সামাজিক প্রজ্ঞার পরিচয় কখনো মমতা রাখেন নি। ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের কিছু প্রচলিত লব্জ (ইনশাল্লা মাশাল্লা, দোয়া ইত্যাদি) রাজনৈতিক স্বার্থে মমতা ধারাবাহিকভাবে ব্যবহার করে চলেছেন। এর ফলে হিন্দু সাম্প্রদায়িকেরা, যেসব মানুষ ধর্মপ্রাণ অথচ সাম্প্রদায়িক নন, তাঁদের মুসলিম বিদ্বেষের কোটরে সহজেই বন্দি করতে সমর্থ হয়েছে। এই বিদ্বেষের জেরে, যা আমাদের রাজ্যে কখনো ছিল না, সেই জাতি-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গজনিত হেনস্তা এখন নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে উঠছে। আদিবাসী সম্প্রদায়ভুক্ত হওয়ার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকাকে সামাজিক হেনস্তার শিকার হতে হচ্ছে। পোশাক, দাড়ি, টুপি, খৎনা-জনিত বিষয় উল্লেখ করে, মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষের উপর ভয়ঙ্কর মানসিক নির্যাতন এখন হিন্দি বলয়ের মতো, এই রাজ্যের নিত্যদিনের ঘটনা। গত লোকসভা ভোটের পর, নিজের দলের গোষ্ঠী সংঘাতকে সামাল দিতে প্রকাশ্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভাষা বিদ্বেষকে উসকানি যখন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী দেন, তখন ধর্মকে কেন্দ্র করে সল্টলেকের অতিথিশালার ঘটনার মতো অমানবিক বিষয় ঘিরে হয়তো আশ্চর্য হওয়ার মতো কিছু আর থাকে না।
সল্টলেকের অতিথিশালাতে অমানবিক আচরণের সঙ্গে যুক্ত তিনজন কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কিন্তু মালিককে এখনও ছোঁয়া হয়নি।
ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছেন সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক সূর্য মিশ্র এবং পার্টি নেতা মহম্মদ সেলিম। সূর্য মিশ্র বলেছেন, গত দশ বছরে রাজ্যে তৃণমূল সরকারের আমলে পশ্চিমবঙ্গে সঙ্ঘ পরিবারের শাখা প্রশাখা কতদূর বিস্তৃত হয়েছে এই ঘটনা তার একটা প্রমাণ। মহম্মদ সেলিম ওই অতিথি শালার ট্রেড লাইসেন্স, সরকারি অনুমতি বাতিল করার দাবি জানিয়েছেন। সিপিআই(এম)-র নেতৃত্বে বামপন্থী বিভিন্ন দল ও সংগঠন ওই ঘটনার প্রতিবাদে মঙ্গলবার বিধাননগর থানায় ডেপুটেশন দেওয়া সহ প্রতিবাদ সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল করেছে।এবিটিএ’র পক্ষ থেকেও বিবৃতিতে নিন্দা জানানো হয়েছে।