E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ৩ সংখ্যা / ২৬ আগস্ট, ২০২২ / ৯ ভাদ্র, ১৪২৯

‘তুমি ওই দিকে চেয়ে থেকো না,

দেখো না! দেখো না!’


নিজস্ব সংবাদদাতাঃ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্নেহের কেষ্ট, অনুব্রত মণ্ডলের নানা মাপের অপকীর্তির জেরে অক্সিজেন কমছে তৃণমূল কংগ্রেসের। আর তাই মুখ্যমন্ত্রী স্বৈরশাসকের মতো বলছেন দূর্নীতির দিকে তাকাবেন না। তৃণমূলের বীরভূম জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের দুর্নীতি গোরু পাচার কাণ্ড সহ নানা কেলেঙ্কারিতে যুক্ত থাকার একের পর এক অভিযোগ যতই ভেসে উঠছে ততই রাজ্যে রাজনৈতিক এবং সামাজিকভাবে জবাবদিহির চাপ বাড়ছে তৃণমূলের ওপর। অনুব্রত মণ্ডলের মেয়ে সুকন্যা মণ্ডলের বিরুদ্ধেও অভিযোগ উঠে এসেছে। তিনি নাকি টেট পাশ না করেই শিক্ষকের চাকরি পেয়েছেন। অনুব্রত মণ্ডলের কন্যা হবার সুবাদে তিনি স্কুলে যেতেন না। তিনি নাকি বাড়ি বসেই বেতন পেতেন! তাঁর নামে লক্ষ কোটি টাকার নানা ধরনের আমানত ব্যাঙ্কে। একই সঙ্গে দুয়ারে চাকরি পৌঁছে গিয়েছিল এই মণ্ডল পরিবারের আরও পাঁচ জনের হাতে। আরও অভিযোগ উঠেছে, অনুব্রত মণ্ডল তাঁর মালিকানার চালকলগুলির মাধ্যমে খাদ্য দপ্তরের সঙ্গে যোগসাজশে চাল কেলেঙ্কারিতেও যুক্ত। সেই চালকলগুলোতে আবার লাখ লাখ টাকা দামের আধুনিক গাড়ি রাখা। যে গাড়িগুলো মালিকদের থেকে জোর করে নিয়ে আসার অভিযোগ রয়েছে অনুব্রত মণ্ডলের বিরুদ্ধে। একের পর এক কেলেঙ্কারিতে ছয়লাপ অবস্থায় রাজ্যজুড়ে এই পরিস্থিতিতে ছিছিক্কারের আবহে একটি অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে তৃণমূল বিজেপি’র বোঝাপড়ার প্রায় দশক পুরনো তত্ত্বকে সিলমোহর দিয়ে ফেললেন বিজেপি’র সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি দিলীপ ঘোষ।

একটু বিশদে আসা যাক। শোনা যাচ্ছে, ২১ আগস্ট কেন্দ্রীয় তথ্য সম্প্রচার মন্ত্রকের এক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে দিলীপ ঘোষ বলেছেন, এ রাজ্যে বহুদিন ধরে সিবিআই তদন্ত চলছে। কিন্তু কোনও ফল হচ্ছে না। সর্ষের মধ্যেই ভূত আছে। সেটিং করে নিয়েছে। তিনি আরও মন্তব্য করেছেন, সবাইকে পেট চালাতে হয় তাই কেউ লাখে বিক্রি হয়, কেউ কোটিতে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক বুঝতে পেরে কিছু অফিসারকে সরিয়ে দিয়েছে।... কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর চেষ্টায় এখন ইডি এসেছে কিন্তু যতটা অসুখ এখনো ততটা ওষুধ পড়ছে না। প্রসঙ্গত, সিবিআই প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের অধীনস্থ।

এ প্রসঙ্গে সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম বলেছেন, কালীঘাট কোন্‌ ঘাটের সঙ্গে খুঁটি বাঁধছে সেটা তো ওদের জানতে হবে। দিলীপ ঘোষের যদি সাহস থাকে দিল্লিতে গিয়ে বলা উচিত। যদি সাহস থাকে চিঠি লিখুন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে। এ প্রসঙ্গে কংগ্রেসের আব্দুল মান্নান বলেছেন, এইভাবে চলতে থাকলে বাংলায় বিজেপি তৃণমূলের ‘বি’ টিম হয়ে থাকবে।

প্রায় সোয়া দশক আগেই তৃণমূলেশ্বরী আরএসএস’র রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি দলকে তাঁর দলের ‘ন্যাচারাল অ্যালি’ অর্থাৎ ‘স্বাভাবিক মিত্র’ বলে কবুল করেছিলেন। তারপর এই ২০২২ সালে সেটিংয়ের তত্ত্ব সম্পর্কে দিলীপ ঘোষের এহেন বক্তব্য! দুটো মিলে একেবারে ঘেঁটে ঘ হয়ে গেছে তৃণমূল-বিজেপি’র কুস্তির হুঙ্কারের আড়ালে দোস্তির কিসসা। মানে ঝুলি থেকে বেড়াল কার্যত হাটের মাঝে ধপাস্‌ করে লাফিয়ে বেরিয়ে পড়ে ডেকে ওঠার মতো অবস্থা। ভাদ্র মাসের প্রথম সপ্তাহেই তাই মুখ্যমন্ত্রীকেই মুখ খুলতে হলো। তৃণমূল সুপ্রিমো ভাদ্র মাসের প্রথম সপ্তাহেই সোৎসাহে দুর্গাপুজোর ছুটির খতিয়ান আমজনতার সামনে মেলে ধরলেন নজর ঘোরাতে। শারদ উৎসব শুরু হতে প্রায় দিন চল্লিশেক বাকি থাকতেই তাঁর এই পদক্ষেপ। ওয়াকিবহাল মহল সহ রাজ্যের বড়ো অংশের মানুষের কাছে তাঁর এই ঘোষণা রীতিমতো ঠাট্টা এবং ক্ষোভের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঠাট্টার কারণ হলো, ‘ওয়ান টু থ্রি ফোর/ তৃণমূলের সবাই চোর’- রাজ্যজুড়ে এই স্লোগানে তিনি এবং তাঁর দল নাজেহাল। একথা শুনে তাই রাজ্যের মানুষকে ‘ঐদিকে’ অর্থাৎ দুর্নীতির দিকে তাকাতে বারণ করে বাংলার প্রাচীন জনপ্রিয় ‘ঠাকুর ঘরে কে’ সংক্রান্ত প্রবাদ মনে করিয়ে দিয়েছেন বলে মনে করছেন বহু রসিক সমালোচক। আর ওই বক্তব্যে ব্যাপক ক্ষোভ চেপে রাখছেন না ৫০০ দিন অতিক্রান্ত ধরনায় বসা চাকরিপ্রার্থীরা, ফসলের সঠিক দাম না পাওয়া কৃষক, মন রেগায় ১০০ দিনের কাজের টাকা বকেয়া থাকা কয়েক হাজার দিনমজুর, কোর্টের নির্দেশ সত্ত্বেও ন্যায্য ডিএ বঞ্চিত রাজ্য সরকারি কর্মী, মিড ডে মিলে বরাদ্দ কমিয়ে অপুষ্টির দিকে ঠেলে দেওয়া ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবক।

কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, নিয়োগ কেলেঙ্কারির দুই অভিযুক্ত তৃণমূল ঘনিষ্ঠ প্রাক্তন এসএসসি’র দুই কর্তা শান্তিপ্রসাদ সিংহ এবং অশোক সাহা তদন্তে সহায়তা করছেন না। সংবাদ অনুযায়ী, ওদিকে তৃণমূলের মন্ত্রীসভার প্রাক্তন ‘নাম্বার টু’ প্রভাবশালী পার্থ চট্টোপাধ্যায় জেল হাজতেই আলুর চপ খেতে খেতে চোরচোট্টা স্লোগান শুনে ক্রমশ মিয়োনো মুড়ির মতো ম্রিয়মান হয়ে পড়ছেন। সাংবাদিকদের বলেছেন, কেউ ছাড়া পাবেনা। তিনি যে তদন্তকারী সংস্থার কাছে মুখ খুলেছেন, তা তৃণমূল নেতৃত্ব বিলক্ষণ জানেন। তাই তাদের আশঙ্কা, পার্থ চ্যাটার্জির বয়ানে, কেঁচো খুঁড়তে না অ্যানাকোন্ডা বেরিয়ে পড়ে।

ওদিকে সিপিআই(এম) নেতাদের সম্পত্তি সংক্রান্ত মামলায় জুড়ে দেবার খবর অনুপ্রাণিত দিদি মিডিয়াও প্রথম পাতা বা শিরোনামে আর কপচাচ্ছে না। তার ওপর রাজ্যের সাংসদ দিলীপ ঘোষ হাটে সশব্দে ভেঙেছেন হাঁড়ি। সেই পর্দা ফাঁসের হাঁড়ির টুকরো ছিটকে তৃণমূলের শীর্ষস্তরের দাদা দিদিদের গায়ে ‘বড্ড লেগেছে’! প্রশ্ন উঠেছে সিবিআই’র নিরপেক্ষতা নিয়েও।

এদিকে গত ২০ অগস্ট বিশেষ সিবিআই আদালতের বিচারক রাজেশ চক্রবর্তী একটি হুমকি চিঠি পান। তাতে লেখা ছিল, ‘গরু পাচার মামলায় অনুব্রত মণ্ডলকে জামিন দিন, নয়তো সপরিবার মাদক মামলায় ফাঁসানো হবে।’ ২৪ আগস্ট এ প্রসঙ্গে আসানসোলে সিবিআইয়ের বিশেষ আদালতের ওই অনুব্রত মন্ডল শুনানির সময় চিঠির বিষয়ে বিচারককে তদন্ত করতে বললে তার প্রেক্ষিতেই বিচারক বলেন, তাঁরা অবাধ এবং নিরপেক্ষ ভাবে কাজ করতে জানেন। আর ওই চিঠির সঙ্গে এই মামলার কোনও সম্পর্ক নেই। সংবাদে প্রকাশ, এরপর বিচারক দু’পক্ষকে বলেন, ‘ ...শুনানির সময় এই বিষয়ে কথা বলবেন না। না হলে আমি মামলার পক্ষ হয়ে যাব। বিচারবিভাগীয় তদন্ত বসে যাবে।’ এদিন জামিনের আবেদন খারিজ করে বিচারক রাজেশ চক্রবর্তী অনুব্রত মণ্ডলকে আগামী ৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৪ দিন জেল হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেন।

গত লোকসভা ভোটের পর কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ব‍‌লেছিলেন কয়েকমাসের মধ্যেই‍‌ বিভিন্ন কেলেঙ্কারিতে যুক্ত তৃণমূল নেতাদের ধরা হবে। হয়নি কিছুই। তাই রাজনৈতিক মহলের একাংশের মত, সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলবে। আর দশ বছর মুখে লিউকোপ্লাস্ট লাগিয়ে মুখবন্ধ রাখার নিদানের পর মমতা ব্যানার্জি সেই পরম্পরা বজায় রেখেই বলবেন ওইদিকে না তাকানোর কথা।