E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ৩ সংখ্যা / ২৬ আগস্ট, ২০২২ / ৯ ভাদ্র, ১৪২৯

বিলকিস বানু ও আমরা

মালিনী ভট্টাচার্য


প্রথমত মনে রাখুন বিলকিস বানু আপনার দয়াভিক্ষা করে না। ২০০২ সালের ৩ মার্চ যারা তাঁর শিশুকে আছড়ে মেরে ফেলে তাঁর দেহকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলে রেখে গিয়েছিল তারা মনে করেছিল সে মরেই গেছে। তাঁর ১৪ জন পরিজন তো সেদিনের ঘটনায় নিকেশই হয়ে গিয়েছিল। তাঁর স্বামী সেসময়ে অন্যত্র থাকার ফলে বেঁচে যায়, অনেকদিন পরে পরস্পরের খোঁজ পায় তাঁরা। বিলকিস কিন্তু আবার অসম সাহসে উঠে দাঁড়িয়েছিল স্বজনহারা শ্মশানে, সেরে উঠেছিল। ঘটনার একমাত্র জীবিত সাক্ষী। যখন সে ভাষা ফিরে পেল, তাঁর একটাই জিজ্ঞাস্য ছিল আপনাদের কাছে, গুজরাট সরকারের কাছে, ভারতীয় আইনব্যবস্থার কাছেঃ আমি কি সুবিচার পাব?

এই প্রশ্নের উত্তর পেতেও প্রতি পদে বাধা। এফআইআর রিপোর্টে গরমিল, মৃতদেহগুলি পুলিশ গোর দিয়ে দিয়েছে, পোস্টমর্টেম রিপোর্ট এক ধোঁকাবাজি, অপরাধীকে মদত দিচ্ছে আদালত ও রাজ্য সরকার। অবশেষে মানবাধিকার কমিশন ও সুপ্রিম কোর্টের মধ্যস্থতায় কেসটি আবার খোলা হয়, তদন্তভার নেয় সিবিআই। তাও গুজরাটে থাকলে কেস বানচাল হয়ে যাবার ভয় আছে বিলকিসের আইনজীবীর এই যুক্তি মেনে তা সরানো হয় মুম্বই হাইকোর্টের বিশেষ সিবিআই আদালতে। অবশেষে ২০০৮ সালে সেখান থেকে ১৯ জনের মধ্যে ১১ জন নারীঘাতী শিশুঘাতী ধর্ষক যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা পায়। ধরে নেওয়া যায় তাদের অপরাধের প্রমাণ ছিল অবিসংবাদিত। আমরা মৃত্যুদণ্ডের পক্ষপাতী নই, কারণ অপরাধীর প্রাণ নিলেই অপরাধ বন্ধ হয় না। তবু মনে না হয়ে পারে না একজন নির্ভয়ার খুনী-ধর্ষকদের কিন্তু সেই চূড়ান্ত সাজাই হয়েছিল। না, বিলকিসও মৃত্যুদণ্ডের দাবি করেনি, কিন্তু যাবজ্জীবনের সাজা তাঁকে একটু স্বস্তি দিয়েছিল।

যারা মৃত্যুদণ্ডের বিরোধী তারা নিশ্চয়ই অপরাধকে লঘু করে দেখার কথা বলে না। তাদের যুক্তি এটাই যে, সবচাইতে জঘন্য অপরাধে অপরাধী যারা তাদের বুঝতে হবে তাদের অপরাধের বীভৎসতা। কারাপ্রাচীরের আড়ালে যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন তাদের একথা মনে রাখতে হবে। ‘যাবজ্জীবন’ মানে ১৪ বছর নয়, এমন অপরাধে ‘যাবজ্জীবন’ মানে ‘আমৃত্যু’। অবশ্যই ১৪ বছর কাটার পরে কোনো কোনো ক্ষেত্রে রেহাই মিলতে পারে কিছু কিছু নিয়ম মেনে। বিলকিস বানুর কেসের জনৈক অপরাধী রাধেশ্যাম শাহ্‌ ১৫ বছর জেলে কাটানোর কাঁদুনি গেয়ে সুপ্রিম কোর্টে মুক্তির জন্য আপিল করে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সুপ্রিম কোর্ট গুজরাট সরকারকে অনুমতি দেয় তাদের রেহাইনীতি অনুযায়ী একটি কমিটি গঠন করে বিষয়টির ফয়সালা করতে।

আজাদির ‘অমৃত মহোৎসবে’ মোদি যখন লালকেল্লা থেকে দেশের অত্যাচারিত মেয়েদের হয়ে সওয়াল করছেন এবং যখন সাজাপ্রাপ্ত কয়েদিদের রেহাই দেবার নতুন কেন্দ্রীয় নীতি জানাচ্ছে যে খুনি-ধর্ষকদের এমন রেহাই পাবার সম্ভাবনা নেই, তার সঙ্গেই যুগলবন্দি ঘোষণা এল গুজরাট সরকারের পক্ষ থেকে যে খুশির স্বাধীনতা দিবসে তাদের পুরনো ১৯৯২ সালের রেহাইনীতি অনুযায়ী (তাদের নতুন ২০১৪ সালের রেহাইনীতিতেও এটা ঘটতে পারত না) বিলকিস বানু মামলার ১১ জন কয়েদিকে মুক্তি দেওয়া হলো।

কমিটিতে বিজেপি’রই প্রতিনিধিরা ছিল, ছিল পঞ্চমহলের ম্যাজিস্ট্রেট, তার ঘাড়েও তো একটাই মাথা। এমনই একজন প্রতিনিধি প্রকাশ্যেই জানালেন ওরা জেলে ভালো আচরণ করেছে, ‘সংস্কারী’ ছিল, অর্থাৎ ধর্মীয় আচারে একনিষ্ঠ ছিল, তাই ওদের রেহাই দেওয়া হলো! কিন্তু এটা যে সিবিআই-এর কেস ছিল! রায় দেওয়া হয়েছিল গুজরাট থেকে তো নয়, মুম্বই থেকে! সুপ্রিম কোর্ট গুজরাট সরকারকে এ এক্তিয়ার দিয়ে কি ঠিক করলেন? আর গুজরাট সরকার সিবিআই-এর কেসে কি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারে কেন্দ্রীয় সরকারকে না জানিয়ে? না কি কেন্দ্রীয় সরকার, যার দুটি মাথাই ২০০২ সালের গুজরাট গণহত্যায় জড়িত বলে অভিযোগ, এটা জানত এবং তাদের অনুমোদন দিয়েছিল? আমরা জানি না, কারণ মোদি-শাহ্‌ কেউই তারপর থেকে মৌনভঙ্গ করেননি। এই সবই হলো আইনের কথা, অনেকেই মনে করছেন সুপ্রিম কোর্টে এবিষয়ে রিভিয়ু পিটিশন করা যেতে পারে। হয়তো তা করা হবেও।

কিন্তু কথাটা শুধু তাই নয়। বিলকিস নিজের জোরে যে মানসিক আতঙ্ক কাটিয়ে উঠে এতদিন আইনি লড়াই করে গেছেন সেই আতঙ্ক তাঁর দরজায় নতুন করে ফিরে এল। যতদিন না এই অপরাধীরা আবার জেলে ঢুকছে এ ভয়ে তাঁকে ভুগতে হবে এই কারণেও হয়তো আইনের রাস্তা নতুন করে নেওয়া দরকার। বিচারবিভাগের লোকেরাই বলেন, যার ক্ষমতা আছে সে আইনকে নিজের মতো করে ব্যবহার করতে পারে। একথাকে অপ্রমাণ করে বিলকিস সুবিচারে আস্থা ফিরে পাবেন, বিচারবিভাগ তার নিরপেক্ষতা প্রমাণ করার আরেকটি সুযোগ পাবে যদি বিলকিসের সপক্ষে মানুষের প্রতিবাদকে একটি আন্দোলনে পরিণত করা যায়।

গুজরাটে সঙ্ঘ পরিবার সাম্প্রদায়িকতার যে রক্তাক্ত গবেষণাগার তৈরি করেছিল, যার ভিত্তিতে ওই রাজ্যে এত বছর নিরঙ্কুশ ক্ষমতাভোগ করছে তারা, বিলকিস আসলে তার জলজ্যান্ত প্রমাণ। সেই প্রমাণ ওরা লোপাট করতে চায়, নিজেদের কাজকে বৈধতা দিতে চায় বলেই এই জল্লাদদের রেহাই দেওয়া ওদের দরকার। সাধারণের নীরবতা এই রেহাই দেওয়ার পাপকে ঢেকে রাখছে। আমাদের সেই পাপের অংশীদার করে ফেলছে।

কেউ বলছেন, জনমতকে সংগঠিত করতে হলে বিলকিস মুসলিম একথা সোচ্চারে না বলে বিলকিস নারী এই আওয়াজটাই তোলা দরকার। এতে সন্দেহ নেই যে, আজ যদি কোনো রেহাইনীতির বলে বিলকিসের মামলার সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীরা ছাড়া পায় তাহলে শাসকদলের অনুগ্রহধন্য সব ধর্ষক-খুনিরাই ছাড়া পেতে পারে। হাথরস-উন্নাও থেকে কামদুনি কোনো নারীই তাহলে নিরাপদ নয়, কেউ সুবিচার পাবে না। কিন্তু এখানে নারীর বিপন্নতার সঙ্গে যে জড়িয়ে গেছে ধর্মীয় সংখ্যালঘু মানুষের বিপন্নতা, বিপর্যস্ত হচ্ছে এই রাষ্ট্রে তাদের সুবিচার পাবার দাবি সেটা বলতে যদি দ্বিধা করি তাহলে সংঘ পরিবারের পাতা ফাঁদেই আমরা পা দিচ্ছি। গোধরার অগ্নিকাণ্ডের কথা বলে পঞ্চমহল বা নারোদা-পাটিয়ার কত্‌ল-এ-আমের কথা চাপা দেওয়া যায় কী? গোধরাতে আদতে ট্রেনে আগুন কারা লাগিয়েছিল তার নিষ্পত্তি কি হয়ে গেছে? আজ চারিদিকে বিজেপি’র যেসব বাহুবলী ও সাধ্বীদের প্রকাশ্যে কদর্য ভাষা ও ভঙ্গিমায় খুনদাঙ্গায় উসকানি দিতে দেখছি তাদেরই আমরা বৈধতা দিই যখন একথাটা জোরালোভাবে বলতে অস্বীকার করি যে, ভারতের সব সমস্যার কারণ মুসলিমরা, এই কথাটিকে ঢাল বানিয়ে হিন্দুত্বের ফেরিওয়ালারা জনসাধারণকে সর্ববিষয়ে ধোঁকা দিয়ে রাখছে। বিলকিসের সুবিচারের দাবি তাই আমাদের সবার দাবি হয়ে ওঠা প্রয়োজন।

পশ্চিমবঙ্গে আরএসএস-কে আমরা বামফ্রন্টের আমলে কখনো স্বমূর্তিতে দেখিনি। বিজেপি’র বিরোধিতা করেছি রাজনৈতিক স্তরেই। আর বর্তমান জমানায় যারা শাসক তাদের উপস্থিতির একটা শর্তই এই যে এরাজ্যে আরএসএস-র উত্থানকে তারা আড়াল করে রাখবে। তাই আরএসএস বা সঙ্ঘপরিবার আমাদের কাছে, এমনকী বামপন্থীদের কাছেও যেন একটু তুচ্ছতাচ্ছিল্যের বিষয়। ওরা খুব খারাপ, এর বেশি আর কী বলা যায় এমন একটা ভাব। যেন আমাদের বিপরীতে অন্য যেকোনো রাজনৈতিক শক্তির মতোই তারা। গুজরাটের গণহত্যা এবং বিলকিস দুইই আমাদের কাছে দূরের জিনিস।

বাঙালির স্বভাবসুলভ অহমিকায় আমরা এমনও ভেবে থাকি যে পশ্চিমবঙ্গে আরএসএস ভাসমান শ্যাওলামাত্র, তাদের এখানে কোনো স্বাভাবিক শিকড় নেই। আবার এর পাশাপাশিই তাদের সম্বন্ধে একটা সহনশীল মনোভাবও অনেকের মধ্যে দেখা যায়, হ্যাঁ, ওরা একটু বাড়াবাড়ি করে বটে, কিন্তু সবই তো ওরা মিথ্যে বলে না। যেখানে তাদের ভয়ংকর শক্তি আজ এদেশে গোটা রাষ্ট্রকে, প্রশাসনকে, সংস্কৃতিকে, দৈনন্দিন জীবনকে গ্রাস করতে উদ্যত সেখানে এই উদারবাদের কোনো জায়গা নেই। ভারতে বামপন্থীদের এরাই সবচেয়ে বড়ো শত্রু। হয় ওরা, নয় আমরা এই মানসিকতা নিয়েই আজ বিলকিসের লড়াই আমাদের লড়তে হবে।