৬০ বর্ষ ৩ সংখ্যা / ২৬ আগস্ট, ২০২২ / ৯ ভাদ্র, ১৪২৯
‘‘বীরের এ রক্তস্রোত, মাতার এ অশ্রুধারা’’
শান্তশ্রী চট্টোপাধ্যায়
পুলিশের পাশবিক লাঠিচার্জে মারা পড়লেন ৮০ জন মানুষ।
তারিখটা ৩১ আগস্টের এক বর্ষণসিক্ত সন্ধ্যা। সালটা ১৯৫৯। পশ্চিমবঙ্গের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল অধ্যায়।
১৯৫৭ সালে দ্বিতীয় সাধারণ নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও কমিউনিস্ট ও বামপন্থীদের সংখ্যা যথেষ্ট বাড়ল। কমরেড জ্যোতি বসু বিধানসভায় বিরোধী দলের নেতা হিসাবে স্বীকৃতি পেলেন। যদিও সুযোগ-সুবিধা কিছুই নেননি। ওই নির্বাচনে কেরালায় কমরেড ই এম এস নাম্বুদিরিপাদের নেতৃত্বে প্রথম কমিউনিস্ট সরকার গঠিত হলো। বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও সেই সরকারকে কেন্দ্রীয় সরকার অন্যায়ভাবে বরখাস্ত করে দিলো। তখন কেন্দ্রে পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর নেতৃত্বে সরকার। তাঁর ইতিবাচক যে ভূমিকাই থাকুক না কেন তিনি শ্রেণিস্বার্থেই এই সরকার ভেঙে দিলেন। অজুহাত, কেরালায় নাকি গণঅভ্যুত্থান হয়েছে (mass upsurge)। কংগ্রেস সভানেত্রী ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। এই চক্রান্তের বিরুদ্ধে কলকাতায় যে ঐতিহাসিক মিছিল হয় এই ঘটনা প্রসঙ্গে স্টেটস্ম্যান পত্রিকা লিখল, “City of processions record broken. Communists show of massive strength.”
তখন পশ্চিমবঙ্গে চলছে ভয়ংকর খাদ্য সংকট। চালের দাম বেড়েই চলেছে, তা সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। গ্রামে সরকারের রিলিফ নেই, মাঠে কাজ নেই। গরিব মানুষের দুর্গতি বেড়েই চলেছে। রেশন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। অনাহার-অর্ধাহার নিত্যসঙ্গী। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’-এ ছিয়াত্তরের মন্বন্তর সম্পর্কে বলা হয়েছিল, ‘‘শিশুও আজ সাহস করিয়া কাঁদে না।’’ এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে সস্তায় খাদ্য সরবরাহের দাবিতে, চোরাচালান ও গুদামজাত করার বিরুদ্ধে, গ্রামে সরকারি রিলিফের দাবিতে কমিউনিস্ট পার্টি ও বামপন্থী দলগুলি গ্রাম-শহর মিলিয়ে আন্দোলন শুরু করল। সংগ্রামের একটি ব্যাপক ভিত্তিক মঞ্চ গড়ে উঠল যার নাম হলো, ‘‘মূল্যবৃদ্ধি ও দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ কমিটি’’। চেয়ারম্যান হলেন প্রজা সোশ্যালিস্ট পার্টির ডঃ সুরেশ চন্দ্র ব্যানার্জি। কতকগুলি ন্যূনতম দাবি নিয়ে জেলা সদর, মহকুমা ও ব্লকে জমায়েত ও আইন অমান্য হলো। লাঠিচার্জ, গ্রেপ্তার এসব নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়াল। আন্দোলনের গতি যখন তীব্র থেকে তীব্রতর হতে লাগল তখন নেতৃবৃন্দকে পিডি অ্যাক্ট -এ গ্রেপ্তার করা হলো। কমরেড জ্যোতি বসু সহ অনেকে আত্মগোপন করে আন্দোলন চালিয়ে যেতে লাগলেন। জেলখানা বন্দিদের ভিড়ে ভরতি হতে লাগল। হুগলি জেলার উত্তরপাড়ায় ভবঘুরে আশ্রমে অস্থায়ী জেলখানা তৈরি হলো, যেখানে বন্দি ছিলেন কমিউনিস্ট নেতা রাধিকা ব্যানার্জি (পরে বামফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রী হয়েছিলেন), কমল চট্টোপাধ্যায়, হরিপদ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ।
৩১ আগস্ট আহ্বান জানানো হয় কলকাতায় বৃহৎ সমাবেশের এবং গণআইন অমান্যের। সেদিন কলকাতা শহর বৃষ্টিতে ভিজছিল। মনুমেন্ট ময়দান থেকে (এখন শহিদ মিনার) বিশাল মিছিল রাইটার্স অভিমুখে যাত্রা করল, সামনে প্রবীণ নেতা অমর বসু সহ অনেকে। মিছিল ছিল শান্তিপূর্ণ। কোনো বোমা-বন্দুক ছিল না। মমতা ব্যানার্জি যেমন ২১শে জুলাই হিংসার উদ্দেশ্যে সমাবেশ করেছিলেন - এ মিছিল তা ছিল না। গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলের সামনে থেকে পুলিশ মিছিলের গতিরোধ করল। চারপাশের গলিতে পুলিশকে পজিশন নিতে দেখা গেল। একটি বড়ো পরিকল্পনা অপেক্ষা করছিল। নেতৃবৃন্দ আইন অমান্য করার পর পরই মিছিলকে চারপাশ থেকে ঘিরে আলো নিভিয়ে শুরু হলো অমানুষিক অমানবিক আক্রমণ। লাঠির আঘাতে ৮০ জন মানুষ মারা পড়লেন, গ্রাম থেকে এসেছেন, পথঘাট চেনেন না - এক ভয়ংকর পরিস্থিতি। ‘‘স্বাধীনতা’’ পত্রিকার ফটোগ্রাফার শম্ভু ব্যানার্জি ঝুঁকি নিয়ে ফটো তুললেন, যা সরকারের নগ্ন চেহারাকে তুলে ধরল।
পরের দিন ছাত্র ধর্মঘট হলো। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় লন থেকে ছাত্রদের মিছিল যখন সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারে মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ের বাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছে সেই মিছিলও আক্রান্ত হলো, অনেক ছাত্রছাত্রী আহত হলেন। পর পর তিনদিন পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে উঠল।
এই সময়ে ভয়াবহ বন্যা এসে যাওয়ায় আন্দোলনকে আর এগিয়ে নিয়ে যাওয়া গেল না। সকলে রিলিফের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। এলাকায় এলাকায় শহিদবেদি স্থাপন করে শহিদদের স্মরণ করা হলো। সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারে হলো স্থায়ী শহিদবেদি। তাই প্রতিবছর এই দিনটি খাদ্য আন্দোলনের শহিদ দিবস হিসাবে উদ্যাপন করা হয় এবং সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাবার শপথ গ্রহণ করা হয়।
১৯৫৯-১৯৬৬ - আর একটি দীর্ঘ পথ পরিক্রমা। ১৯৬০ সালে কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের (রেলসহ) লাগাতার ধর্মঘট, ১৯৬১ সালে আসামে বাঙালি বিতাড়নের প্রতিবাদে পশ্চিমবঙ্গে ধর্মঘট, ১৯৬২-তে চীন-ভারত সীমান্ত সংঘর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে জরুরি অবস্থায় কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ও কর্মীদের বিনা বিচার এবং মিথ্যা মামলায় আটক, ১৯৬৪ সালে কমিউনিস্ট আন্দোলনে বিভাজন, সিপিআই(এম)-র প্রায় সহস্রাধিক নেতা ও কর্মীকে ভারত রক্ষা আইনে বিনা বিচারে আটক, ৬৫-৬৬ সালে বন্দিমুক্তিসহ খাদ্যের দাবি, শ্রমিক-কৃষক আন্দোলনের অগ্রগতি, ৬৬ সালে কেরোসিনের দাবিতে বসিরহাটের ছাত্র নুরুল ইসলামের পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার ঘটনা, ১০ মার্চ ডাকা হলো বাংলা বন্ধ, রক্তাক্ত প্রতিরোধ গড়ে উঠল, ৮০ জন মানুষের প্রাণ গেল, নিহত হলেন হিন্দমোটরের শ্রমিক এম পি সিন্হা, কোন্নগরের কংগ্রেস পরিবারের সন্তান রঞ্জন দত্ত, হাওড়ার আনন্দ হাইত সহ অনেকে। সেই বছরেই ২২-২৩ সেপ্টেম্বর ৪৮ ঘণ্টার বাংলা বন্ধ, শিক্ষকদের ধর্মঘটসহ গণআন্দোলন এমন একটি পর্যায়ে উঠল যার প্রতিফলন ঘটল ১৯৬৭ সালের সাধারণ নির্বাচনে প্রথম অকংগ্রেসী যুক্তফ্রন্ট সরকারের প্রতিষ্ঠায়। ১৯৬৯ সালে দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠা, ১৯৭১-র নির্বাচন, ৭২-এ প্রহসনের নির্বাচন, তারপর ১৯৭৭ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ৩৪ বছর বামফ্রন্টের সরকার। ২০১১ সাল থেকে চলছে স্বৈরাচারী তৃণমূল কংগ্রেসের শাসন। কেন্দ্রে ২০১৪ সাল থেকে চলছে সাম্প্রদায়িক বিজেপি’র শাসন।
বর্তমান আন্দোলন সংগ্রামের আঁকাবাঁকা পথে চলতে চলতে অতীতের গণ-আন্দোলনের সেইসব বীর শহিদদের আমাদের স্মরণ করতে হবে।
‘‘বীরের এ রক্তস্রোত, মাতার এ অশ্রুধারা
এর যত মূল্য সে কি ধরার ধূলায় হবে হারা।
স্বর্গ কি হবে না কেনা।... রাত্রির তপস্যা সে কি
আনিবে না দিন।’’