৬০ বর্ষ ৩ সংখ্যা / ২৬ আগস্ট, ২০২২ / ৯ ভাদ্র, ১৪২৯
৩১ আগস্ট পশ্চিমবাংলায় গণআন্দোলনের শহিদ দিবস
সঞ্জয় পূততুণ্ড
১ সেপ্টেম্বর ছাত্র মিছিল।
স্বাধীনতার পরে একটি দশক পার হলো। তীব্র খাদ্য সংকট চলছিল সমগ্র রাজ্যে। তার ওপর নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির দাপট। সরকার যেন নীরব দর্শক। ১৯৫৯ সালের জুন মাসেই সংযুক্ত বামপন্থী ফ্রন্টের ডাকে রাজ্যব্যাপী ধর্মঘট পালিত হয়। পরিস্থিতির আরও অবনতি দেখা দেয় বর্ষার শেষে। শুরু হয় তিনটি পর্যায়ে আইন অমান্যের কর্মসূচি। জেলায় জেলায় আইন অমান্যের কর্মসূচি রাজ্যব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে। ২০ আগস্ট দ্বিতীয় পর্যায়ের আন্দোলন শুরু হয়। এই পর্যায়ের কর্মসূচি শুরু হবার আগেই সারারাজ্যে নেতৃত্ব গ্রেপ্তার হন। ১৮ আগস্ট বসুমতির সংবাদ - ১৫ জন বামপন্থী বিধায়ক গ্রেপ্তার। নিরঞ্জন সেন, বিনয় চৌধুরী, ভবানী সেন, গণেশ ঘোষ, মনোরঞ্জন রায়, সমর মুখার্জি, বিশ্বনাথ মুখার্জি, রবীন মুখার্জি, গোপাল বসু, যতীন চক্রবর্তী, নীরেন ঘোষ, প্রশান্ত শূর প্রমুখ নেতৃবৃন্দ গ্রেপ্তার হলেন। ১৯ আগস্ট রাত ২টায় কমিউনিস্ট পার্টির রাজ্য দপ্তরে পুলিশ তল্লাশি চালায়। জ্যোতি বসু এবং চিত্ত বসুকে বাড়িতে গ্রেপ্তার করতে গিয়ে পুলিশ তাঁদের পায়নি। জ্যোতি বসু তখন আসাম-মণিপুরে সভা করতে গিয়েছিলেন। ২৫ আগস্ট তিনি সেখান থেকে বিবৃতি দেন - ‘‘বিনা বিচারে আটক করার জন্য গ্রেপ্তারী পরোয়ানা জারি করা হইয়াছে। অবশ্য আমি বারবার সরকারি নির্দেশ অমান্যকারী খাদ্য চোরদিগকে এবং উহাদের পৃষ্ঠপোষক মন্ত্রী শ্রী প্রফুল্ল সেনকে গ্রেপ্তার করার আবেদন জানাইয়া বিফল হইয়াছি।’’ ২৭ আগস্ট আনন্দবাজারের সংবাদ - সারা রাজ্যে গ্রেপ্তার ৬,৪০৮ জন। বলাবাহুল্য সমস্ত নেতারাই গ্রেপ্তার হয়েছেন নিবর্তনমূলক আটক আইনে। অর্থাৎ বিনা বিচারে, বিপুল সংখ্যক নেতা আত্মগোপনে থেকেই আন্দোলন সংগঠিত করেছেন।
৩১ আগস্ট
মনুমেন্ট ময়দানে সংগঠিত হয় বিশাল সমাবেশ। আইন অমান্যের জন্য মিছিল শুরু হয়। এসপ্ল্যানেড ইস্টে মিছিলের গতিরোধ করে প্রথম দফায় গ্রেপ্তার করা হয়। দ্বিতীয় দফায় গ্রেপ্তার হতে গেলেই শুরু হয় বেপরোয়া হামলা। স্টেটসম্যান পত্রিকা লিখেছে, ‘‘পুলিশ ইচ্ছা করিয়াই তাহাদের বেষ্ঠনীর মধ্যে ফাঁক রাখিয়াছিল।’’ এরপর ধর্মতলা এলাকায় চললো পুলিশি নির্মম তাণ্ডব। পিটিয়ে মারা হলো ৮০ জনকে, আহত হাজার হাজার।
পরের দিন ১ সেপ্টেম্বর ছাত্র মিছিল। যুগান্তর লিখছে - ‘‘মিছিলের সম্মুখভাগ ডাঃ রায়ের বাড়ি (মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়) ছাড়াইয়া গেলে একদল পুলিশ প্রিন্সেপ স্ট্রিট হইতে বাহির হইয়া আসিয়া মিছিল তাড়া করে।’’ দু’দিনই বিনা প্ররোচনায় হামলা।
সেদিনের সংকট-পরবর্তী পরিবর্তন
ব্রিটিশ আশ্রিত জোতদারদের অত্যাচার ছিল কৃষকের ওপর। স্বাধীন ভারতে তারাই শাসকদলের নেতা। চলছিল মজুতদারি-কালোবাজারি। স্বাধীনতার একযুগ পরে কৃষকের মোহমুক্তি, তারই প্রকাশ ’৫৯-র আন্দোলনে। যুক্তফ্রন্ট সরকার ও গরিবের জাগরণ, আধা-ফ্যাসিস্ত সন্ত্রাস পার হয়ে দীর্ঘ সময়ের বামফ্রন্ট সরকার ও পঞ্চায়েত ব্যবস্থা রাজ্যে চলেছে। আবার প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি গেড়ে বসেছে রাজ্য সরকারে। সম্প্রতি তার অতীব কুৎসিত চেহারা প্রকাশিত।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, এমনকী ভোটাধিকারের উপর চলছে আক্রমণ। গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে নির্মম পীড়ন। সমস্ত প্রকার উন্নয়ন স্তব্ধ। সারা দেশের সাথে রাজ্যে কৃষি ও কৃষক গভীর সংকটে। সারা দেশে কৃষক ফসলের দাম পায় না। কিন্তু খাদ্যের দাম, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে দ্রুতগতিতে। সেদিনের মতো আজও খাদ্য সংকট এবং মূল্যবৃদ্ধি সরকারি নীতির ফলে। মজুতদারি-মুনাফা শিকারি আজ আইনসম্মত করা হয়েছে। সরকারি গুদামে মজুত খাদ্যশস্য মদ তৈরির জন্য অত্যন্ত কম দামে করপোরেটদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। আজ দেশে বামপন্থীদের বিরোধিতা অগ্রাহ্য করে আগাম বাণিজ্য চালু করা হয়েছে। চলেছে চুক্তি-চাষও। সারা পৃথিবীতে খাদ্য উৎপাদনের জমিতে বায়ো-ডিজেল তৈরির উপকরণ চাষের প্রবণতা আছে। ফলে খাদ্য সংকট গভীরতর হওয়ায় বিপদ দেখা দিচ্ছে। আবহাওয়ার অনিশ্চয়তার কারণেও বর্তমানে কৃষিকাজে সংকট দেখা দিচ্ছে নিয়মিত। ফলে খাদ্যের সমস্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ধনীদের ওপর ট্যাক্স বৃদ্ধি না করে বরং কমানো হচ্ছে। বাড়তি অর্থ আদায় হচ্ছে গরিব এবং মধ্যবিত্তদের কাছ থেকে। এই অর্থ আবশ্যিকভাবেই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের উপর চাপে এবং তা বইতে হয় সাধারণ মানুষকে। নয়া উদারনীতির যুগে এ সমস্যা গভীরতর। ফলে আজও মূল্যবৃদ্ধি মানুষের জীবনে সমস্যা। সমস্যা বৃদ্ধিই পেয়ে চলেছে।
আমেরিকার আর্থিক সংকট ফেটে পড়ার পর বৃহৎ কোম্পানিগুলি তেলের ফাটকাবাজিতে যুক্ত হয়েছে। বিপুল মুনাফা লুট করার ফলে তেলের বাজারে বাড়তি বোঝা চাপছে। সেই বোঝা সমস্ত ক্ষেত্রেই মূল্যবৃদ্ধি ঘটায় অনিবার্যভাবেই। কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের ভাণ্ডার পূরণের জন্য বিপুল ট্যাক্স চাপানো হয় পেট্রোল-ডিজেলের ওপর। এ বাড়তি বোঝা মানুষকেই বইতে হয়।
আজ পুঁজির লুট অতীতের সমস্ত সীমা অতিক্রম করেছে। তাই মূল্যবৃদ্ধির সমস্যা তীব্রতর - বইতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। জীবনের প্রথম প্রয়োজন খাদ্য। পুঁজির লুট খাদ্যকে কেন্দ্র করেও তীব্রতর হচ্ছে। সমস্যা তৈরির মূলে সরকারি ক্ষতিকর নীতি। সে নীতির বিরুদ্ধে লড়াই তীব্রতর করেই মানুষকে বেঁচে থাকতে হবে। পশ্চিমবাংলার জনগণের ক্ষেত্রেও এই পরিস্থিতি সমান প্রাসঙ্গিক।