E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ৩ সংখ্যা / ২৬ আগস্ট, ২০২২ / ৯ ভাদ্র, ১৪২৯

বিকল্পের ছাত্রমিছিল

সৃজন ভট্টাচার্য


আজ ষষ্ঠ দিন পেরিয়ে লিখছি।

আদতে ষষ্ঠ না, তার খানিক বেশিই। দেশের ৫ প্রান্ত থেকে, ‘মার্চ ফর এডুকেশন’ নামে, যার বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘শিক্ষার জন্য পদযাত্রা’ - সর্বভারতীয় ছাত্র জাঠা পথ হাঁটছে ১ আগস্ট থেকে। আগামী ২০ সেপ্টেম্বর শেষ জাঠাটির শেষ সমাবেশটি সম্পন্ন হবে। আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করছে দুটি জাঠা। ১৯ আগস্ট কোচবিহারের বক্সিরহাটে প্রবেশ করেছে ত্রিপুরা ও আসাম হয়ে আসা উত্তর-পূর্ব ভারতের জাঠা। ২০ আগস্ট পূর্ব মেদিনীপুরের দীঘায় প্রবেশ করেছে বিহার, ঝাড়খণ্ড ও ওডিশা হয়ে আসা পূর্ব ভারতের জাঠা। পশ্চিমবঙ্গে ১৪ দিন ধরে ২২টি জেলায় ২৫০০ কিলোমিটারের উপর পথপরিক্রমা করবে দুটি ছাত্র জাঠা। আপাতত দেখা যাচ্ছে, তাদের যাত্রাপথে পশ্চিমবঙ্গে ১৩২টি ছোটোবড়ো সভা ও মিছিল অতিক্রম করবে জাঠা দুটি। এছাড়াও অগণিত কর্মসূচি চলছে এই জাঠাকে ঘিরে। আমরা স্লোগান দিয়েছি - শিক্ষা বাঁচাও, সংবিধান বাঁচাও, দেশ বাঁচাও। চ্যালেঞ্জ নিয়েছি, জাঠার খবর পৌঁছে দেব এক কোটি ছাত্রের কাছে।

জাঠাকে কেন্দ্র করে সাংগঠনিকভাবে নড়াচড়া হচ্ছে এসএফআই’র প্রতিটি স্তরে। ইতিমধ্যেই আলিপুরদুয়ারে এবং পুরুলিয়াতে তৃণমূলের সাথে টক্কর নিয়ে এগিয়েছে জাঠা। পূর্ব মেদিনীপুরে খোদ অধিকারী সাম্রাজ্যে আরএসএস’র চোখে চোখ রেখে পথ হেঁটেছে জাঠা। চা-বাগান থেকে লালমাটি - জাঠা এগোচ্ছে ছাত্রসমাজের ভালবাসা কুড়োতে কুড়োতেই। আমাদের পরিষ্কার কথা, জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০’ বাতিল করতে হবে। এই শিক্ষানীতি দরিদ্র মধ্যবিত্ত ছাত্রদের প্রতি সুবিচার করে না। এই শিক্ষানীতি লেখাপড়ার খরচ বাড়ায়, লাগামছাড়া বেসরকারিকরণের বন্দোবস্ত করে এবং অনগ্রসর প্রান্তিক ছাত্রদের শিক্ষার সুযোগ কেড়ে নেয়। এই শিক্ষানীতি ‘ভার্টিক্যাল নলেজ’ বা গভীরে গিয়ে কোনো বিষয়ে জ্ঞানার্জনের সুযোগকে সংকুচিত করে দেয়। শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য যে আগামী প্রজন্মের মনে মুক্তচিন্তার পরিসর প্রস্তুত করা, সে কথা অস্বীকার করে শারীরিক কর্মদক্ষতাকে বৌদ্ধিক বিকাশের থেকে আলাদা করে ভবিষ্যতের প্রতিনিধিদের সস্তার শ্রমিক বানাতে চায় এই শিক্ষানীতি। এমন সর্বনাশা জাতীয় শিক্ষানীতি, যাতে একটিবারের জন্যও ধর্মনিরপেক্ষতা ও বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যকে উদ্‌যাপন করার কথা বলা নেই। চোর-ডাকাত-দাঙ্গাবাজদের হাতে তৈরি শিক্ষানীতি মানব না - এই বার্তা দৃঢ়ভাবে সামনে এনেই জাঠা বলছে, খোঁজ করো বিকল্পের। একমাত্র ছাত্র সংগঠন হিসেবে, বিকল্প শিক্ষানীতি গঠনের কাজে হাত লাগিয়েছি আমরা। যে শিক্ষানীতিতে লকডাউনে ডিজিটাল ডিভাইডের শিকার হওয়া দরিদ্র ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষার মূলস্রোতে ফেরানোর উদ্দেশ্য নিয়ে গঠন হবে স্পেশ্যাল প্যাকেজ। যে শিক্ষানীতি সরকারি ব্যয়বরাদ্দ বাড়াতে বলবে শিক্ষাখাতে, মিড ডে মিল থেকে গবেষকদের স্কলারশিপ-ফেলোশিপ, প্রতিটি ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের তরফে দেখভালের পরিসর বাড়ানোর দাবি করবে যে শিক্ষানীতি। যে শিক্ষানীতি স্বচ্ছ শিক্ষক নিয়োগের বন্দোবস্ত করবে, যাতে আর কোথাও কোনো পার্থ চ্যাটার্জি আগামীর প্রজন্মকে ঠকিয়ে ফ্ল্যাটে টাকা জমাতে না পারেন। আমরা হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানের বিপ্রতীপে গিয়ে বলব বিবিধের মাঝে মহান মিলনের কথা - আমাদের বিকল্প শিক্ষানীতি, প্রতিষ্ঠিত করবে আম্বেদকরের হাতে তৈরি সংবিধানের মূল্যবোধকেই। আগামী ২ সেপ্টেম্বর - দিনের আলো দেখবে বিকল্প শিক্ষানীতির খসড়া।

আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কাজ রয়েছে এই জাঠার। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পালন করছি আমরা। দেশের সরকার বলছে, হর ঘর তিরঙ্গা। দেশের ভুখা মানুষ বলছেন, তিরঙ্গা তো হলো, কিন্তু সকলের ঘর নেই যে! মেকি জাতীয়তাবাদের জিগির তুলে দেশের মানুষের অন্ন বস্ত্র বাসস্থান শিক্ষা স্বাস্থ্য কর্মসংস্থানের সমস্যাকে পিছনে ঠেলে দিতে চাইছে মোদি সরকার। আমরা স্বাধীনতার ৭৫ বছরে আরেকবার মনে করাতে চাইছি সংবিধানের মূলমন্ত্রগুলিকে। ছাত্র জাঠা স্মরণ করতে করতে এগোচ্ছে আমাদের দেশজ মনীষীদের, স্বাধীনতা সংগ্রামীদের, প্রগতির লড়াইয়ের শহিদদের। ক্ষুদিরাম, ভগৎ সিং, সুভাষচন্দ্র বসুরা তো বটেই - জাঠা স্মরণ করছে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল, বিদ্যাসাগর, পঞ্চানন বর্মা, ভানুভক্ত, রঘুনাথ মুর্মু বা হরিচাঁদ-গুরুচাঁদ ঠাকুরের মতো বাংলার সমাজজীবনে দীর্ঘমেয়াদি ছাপ রেখে যাওয়া ব্যক্তিত্বদেরও ৷ আমাদের বোঝাপড়া পরিষ্কার - এই বিপুল বৈচিত্র্যের ঠাসবুনোটে গড়ে ওঠা মানবতার মহাসাগরকে, আমাদের মিলেমিশে বাঁচার ইতিহাসকে উদযাপন করতেই হবে আরএসএস-বিজেপি’র সাংস্কৃতিক আগ্রাসনকে প্রতিহত করতে গেলে। ওরা যত একমাত্রিক সমাজের কথা বলবে, আমরা তুলে ধরব সহিষ্ণু বহুমাত্রিক বিবিধতায় ভরা বাংলার ইতিহাসকে। ওদের সাথে সাভারকর থাকলে আমাদের সাথে আছেন চৈতন্য আর লালন ফকির। এই ইতিহাসকে খণ্ডন করা আরএসএস’র পক্ষে দুঃসাধ্য। নবজীবনের গান গেয়ে, সুকান্ত’র লাইন ধার করে বলেছি আমরা - এ দেশের বুকে আঠারো আসুক নেমে। আরএসএস স্বাধীনতা আন্দোলনে কোথাও ছিল না, একথা নতুন করে মনে করিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব তো আঠারোরই এখন।

হাজারো ছাত্রছাত্রীকে শামিল করে দুটি ছাত্রজাঠা এসে মিলবে ১৫তম দিনে - ২ সেপ্টেম্বর বেলা ১২টায় কলকাতার কলেজ স্ট্রিটে। সাম্প্রতিককালের বৃহত্তম ছাত্র সমাবেশটির মঞ্চ থেকে আমরা জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ বাতিল করার দাবির পাশেই ঘোষণা করব বিকল্প শিক্ষানীতির খসড়া। ছাত্র আন্দোলনের কর্মীদের সাথেই প্রধান বক্তা হিসাবে উপস্থিত থাকবেন আমাদের সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক, সারা দেশের বাম আন্দোলনের মাথার উপর ছায়া হয়ে থাকা বিমান বসু। ছাত্র শহিদদের স্মরণ করে, আগামীর আন্দোলনের শপথ বুকে, রাস্তার লড়াইকে ক্যাম্পাসে পৌঁছে দেওয়ার অঙ্গীকার করেই সমাপ্ত হবে ছাত্র জাঠা। দাঙ্গাবাজের হাত থেকে, চাকরিচোরের হাত থেকে-বাংলার তরুণ প্রজন্মকে রক্ষা করার সংগ্রামে গতি বাড়বে কেবল আগামীদিনে, কমবে না।

‘‘উষার দুয়ারে হানি আঘাত
আমরা আনিব রাঙা প্রভাত...’’