৬০ বর্ষ ৩ সংখ্যা / ২৬ আগস্ট, ২০২২ / ৯ ভাদ্র, ১৪২৯
ভারত ছাড়ো আন্দোলন -
বটেশ্বর ১৯৪২
শংকর মুখার্জি
লীলাধর বাজপেয়ী
উনিশশো বিয়াল্লিশ সালের সাতাশে আগস্ট। এর কয়েক দিন আগে নয়ই আগস্ট থেকেই গান্ধীজির ডাকে ভারত ছাড়ো আন্দোলনে দেশ উত্তাল। আগ্রা থেকে ষাট মাইল দূরে ছোটো গ্রাম বটেশ্বর। সেখানেও আঁচ লেগেছে এই আন্দোলনের। ২৭ আগস্ট ছিল বটেশ্বর চকে ‘ভুজারিয়া কা মেলা’। খুব জনপ্রিয় উৎসব, রাখীবন্ধনের পরে হয় এই ব্রাহ্মণ অধ্যুষিত গ্রামে। মেলার কেন্দ্রস্থলে এক লোকগায়ক গাইছিলেন আলহা পল্লীগীতি। এই পল্লীগীতির মুখ্য বৈশিষ্ট্যই ছিল প্রাচীন বীরদের শৌর্যের গাথা বর্ণনা করা। স্বাভাবিকভাবেই বেশ কয়েকশো মানুষ জড়ো হয়েছেন সেই গায়কের চারপাশে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে কয়েকজন তরুণ দিতে শুরু করলেন ব্রিটিশের বিরুদ্ধে স্লোগান। তাঁরা শ্রোতাদের উদ্দেশে বললেন, “কেন মৃতদের জয়গাথা গাইছেন। যাঁরা জীবিত, যাঁরা দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছেন তাঁদের গান গাওয়া হোক।আলহা হোক কংগ্রেসের জন্য, যে এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছে।” জনগণের সামনে পড়া হলো গান্ধীজির আবেদনও। ওই তরুণরা জনগণকে প্রণোদিত করলেন, ব্রিটিশ শাসন থেকে বটেশ্বর ফরেস্ট অফিসকে মুক্ত করতে অভিযান হোক।
ওই চক থেকে ফরেস্ট অফিস হাঁটাপথে দশ মিনিট। ওই তরুণদের নেতৃত্বে ফরেস্ট অফিসের অভিমুখে শুরু হলো মিছিল। মিছিল ফরেস্ট অফিসে পৌঁছে তুলল তেরঙ্গা ঝান্ডা। মিছিলের নেতারা ঘোষণা করলেন, তারা এখন ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত। এরপর মিছিল চলল, ফরেস্ট অফিস থেকে কিছুটা দূরে ফরেস্ট চৌকিতে, জায়গাটার নাম বিককলি। মিছিল মুখরিত স্লোগান আর দেশাত্মবোধক গানে। জঙ্গলে বেআইনিভাবে ঘোরাফেরা করার জন্য আটক গৃহপালিত পশুদের এই চৌকিতেই রাখা হতো। মক্তির আনন্দে উদ্বেলিত জনতা সেই আটক পশুদের মুক্ত করে দিল। বটেশ্বর ছিল আগ্রা জেলার মধ্যে। জেলাসদর আগ্রায় খবর পাঠানো হলো, বটেশ্বরে বিদ্রোহ হয়েছে। সেনা পাঠানো হোক।
বটেশ্বর ফরেস্ট অফিস অভিযানের পেছনেও একটা কারণ ছিল। বটেশ্বরের চারদিকের এলাকা অরণ্য ভূমি হিসেবে ঘোষণা করেছিল প্রশাসন। গ্রামবাসীরা ওই এলাকা থেকে আগুন জ্বালানোর কাঠ সংগ্রহ করলে কিংবা তাদের গৃহপালিত পশু সেখানে প্রবেশ করলে জরিমানা হতো অন্যথায় পশুদের আটকে রাখত ফরেস্ট কর্তৃপক্ষ।
ওইদিনের ফরেস্ট অফিস অভিযানে সারাক্ষণই ছিলেন অটল বিহারী এবং তাঁর দাদা প্রেম বিহারী। হ্যাঁ, ইনিই আমাদের দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী, বিজেপি নেতা অটল বিহারী বাজপেয়ী। তবে সেসময় দেশের বিভিন্ন স্থানে উত্তেজনা-হিংসা এবং আন্দোলন যে উচ্চতায় পৌঁছেছিল সেই তুলনায় বটেশ্বরের ঘটনা সামান্যই বলা যায়।
অটল বিহারীদের পৈতৃক ভিটে বটেশ্বর গ্রামে। অটল এবং প্রেম দুজনেই পড়তেন করদরাজ্য গোয়ালিয়রের ভিক্টোরিয়া কলেজে। ওই ঘটনার সময় অটল বিহারী নাবালক, তাঁর বয়স তখন ১৬ বছর। আর দাদা প্রেমের বয়স ২৩। কিন্তু ওই বয়সেই অটল বিহারী রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘে (আরএসএস)’র সক্রিয় কর্মী। তিনি আরও তিন বছর আগে আরএসএস'র সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। যে আরএসএস মতাদর্শগত ও রাজনৈতিকভাবে স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিল না। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরোধিতাও করত না তারা। অটল বিহারীর বাবা কৃষ্ণ বিহারী (তাঁর পারিবারিক নাম গৌরী শঙ্কর) স্কুল শিক্ষক, পরে স্কুল পরিদর্শক হন। স্কুল পরিদর্শক থাকার সময় তিনি কতৃপক্ষের বিরুদ্ধে কোনো আন্দোলনে ছাত্রদের যুক্ত থাকাকে অনুমোদন করতেন না।
২৮ আগস্ট পুলিশ গ্রামবাসীদের ওপর প্রচণ্ড মারধর করল। ধরপাকড় শুরু হলো ২৯ আগস্ট থেকে। পুলিশের এফআইআর-এ ৩৭ জনের নাম ছিল। যার মধ্যে ১১ জনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করতে পেরেছিল। অভিযুক্তের তালিকায় ২৯ এবং ৩০ নম্বরে নাম ছিল যথাক্রমে অটল বিহারী বাজপেয়ী এবং প্রেম বিহারী বাজপেয়ীর। তালিকায় দুনম্বরে নাম ছিল কাকুয়া ওরফে লীলাধর বাজপেয়ীর। যে কয়জন ওই মিছিলটা এবং ফরেস্ট অফিস অভিযান সংগঠিত করতে মুখ্য উদ্যোগ নিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম লীলাধর। অন্যরা হলেন, মাহুয়ান ওরফে শিব কুমার, গোধা এবং কোকিয়ান প্রমুখ। লীলাধর প্রথমে পলাতক ছিলেন। পরে তাঁকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গ্রেপ্তার হওয়া সবাইকে আগ্রা জেলে রাখা হয়েছিল।
অটল বিহারী এবং প্রেম বিহারী জেলে ছিলেন ২৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। বিচারপ্রক্রিয়া শুরুর আগেই তাঁরা মুক্ত হন। আরও তিনজন বিচারপ্রক্রিয়া শুরুর আগেই জেল থেকে ছাড়া পেয়েছিলেন। গ্রেপ্তার হওয়া ১১ জনের মধ্যে বাকি ছয়জনের বিচারপ্রক্রিয়া চলে আগ্রা স্পেশাল জজ কের্টে ১৯৪৩ সালের মার্চ মাস থেকে। বিচারক ছিলেন কে এন ওয়াংচু, যিনি স্বাধীনতার পর হয়েছিলেন রাজস্থান হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি।
অটল বিহারী বাজপেয়ী এবং প্রেম বিহারী বাজপেয়ী জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার কয়েকদিন আগে ১৯৪২ সালের ১ সেপ্টেম্বর সেকেন্ড ক্লাস ম্যাজিস্ট্রেট এস হাসানের সামনে অপরাধ-স্বীকার বিবৃতি (confessional statement)-তে স্বাক্ষর করেন। বিবৃতি দু’টি উর্দুতে লেখা ছিল। বিবৃতির শেষে ওঁরা দুজন ইংরেজিতে স্বাক্ষর করেন। অটল বিহারী যে বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছিলেন তাতে বলা হয়ঃ
“১৯৪২ সালের ২৭ আগস্ট বটেশ্বর বাজারে আলহা পল্লীগীতি গাওয়া হচ্ছিল। দুপুর দু’টো নাগাদ যেখানে গান চলছিল সেখানে কাকুয়া ওরফে লীলাধর ও মাহুয়ান আসে এবং বক্তৃতা দেয় ও অরণ্য আইন ভাঙতে জনগণকে প্রণোদিত করে। দুশো জন মানুষ ফরেস্ট অফিসে যায় এবং আমি ও আমার ভাই ওই জনতাকে অনুসরণ করে ফরেস্ট অফিসে পৌঁছাই। আমি এবং আমার ভাই নিচে ছিলাম, বাকি সবাই ওপরে উঠে যায়। কাকুয়া ও মহুয়ান ছাড়া অন্য যারা সেখানে ছিল তাদের নাম আমি জানি না।
আমার মনে হয় ইট পড়ছিল। কারা পাঁচিলটাকে মাটিতে ফেলে দিয়েছিল আমি জানিনা, কিন্তু এটা নিশ্চিত, পাঁচিলের ইটগুলিই পড়ছিল।
আমি এবং আমার ভাই মইপুরার উদ্দেশে যাওয়া শুরু করি, জনতাও আমাদের সঙ্গে ছিল। ওপরে উল্লেখিত ব্যক্তিরা গবাদিপশুর খোঁয়াড় থেকে ছাগলগুলিকে ছেড়ে দেয় এবং জনতা বিককলির দিকে অগ্রসর হয়। ফরেস্ট অফিসে দশ-বারো জন ছিলেন। আমি ১০০ গজ দূরে ছিলাম। সরকারি বাড়ি ভাঙায় আমি কোনো সাহায্য করিনি। এরপর আমরা বাড়ি ফিরে আসি।”
একই পৃষ্ঠায় এই বিবৃতির তলায় আরেকটি ইংরেজিতে নোট লেখা ছিল। যাতে স্বাক্ষর করেন ম্যাজিস্ট্রেট এস হাসান। তাতে বলা হয়, “গৌরী শঙ্করের পুত্র অটলবিহারীকে এটা আমি ব্যাখ্যা করে বলেছি যে, এই অপরাধ-স্বীকার বিবৃতি দিতে তিনি বাধ্য নন এবং তা সত্ত্বেও তিনি যদি এটা করেন, তাহলে এর যেকোনো অংশ বিচারে তার বিরুদ্ধে প্রমাণ হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। আমার বিশ্বাস, এই অপরাধ-স্বীকার বিবৃতি স্বেচ্ছামূলকভাবেই হয়েছে। আমার উপস্থিতিতে শুনানি চলাকালীন এটি গ্রহণ করা হয় এবং অটলবিহারী যিনি এটা দিয়েছেন তাকে সম্পূর্ণটা পড়ে শোনানো হয়। এটি সঠিক এবং এর বিষয়বস্তু সম্পূর্ণভাবে ও প্রকৃতঅর্থে এই বিবৃতি তারই তৈরি বলে তিনি স্বীকার করেছেন।”
সেকেন্ড ক্লাস ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে এই বিবৃতি দেওয়ার কয়েকদিন পরই অটল বিহারী বাজপেয়ী এবং প্রেম বিহারী বাজপেয়ী জেল থেকে ছাড়া পান। তাঁদের আর বিচারের আওতায় আনা হয়নি।ওই বিবৃতির সঙ্গে অটল বিহারী বাজপেয়ী এবং তাঁর দাদার ছাড়া পাওয়ার কোনো সম্পর্ক আছে কীনা তার কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ আমাদের হাতে নেই। কিন্তু আদালতে দেওয়া অটল বিহারী বাজপেয়ীর বিবৃতিতে যে লীলাধরের নাম উল্লেখ ছিল তাঁর তিন বছর জেল হয়েছিল। আরও দুজনের শাস্তি হয় এই মামলায়, তাঁরা হলেন ভবানী প্রসাদ ও শোভারাম; তাঁদের সাত বছরের জেল হয়। এছাড়াও সমগ্র গ্রামের ১০ হাজার টাকা জরিমানা হয়। লীলাধর বাজপেয়ীর বয়স ছিল তখন ১৮ বছর, তাই হয়তো বিচারক তাঁর শাস্তির মেয়াদ কিছুটা কম করেছিলেন। অটল বিহারী বাজপেয়ীর ওই বিবৃতিতে মাহুয়ান নামে আরেক জনের কথা উল্লেখ ছিল। ২৭ আগস্টের ঘটনায় সারাক্ষণ তাঁর থাকার উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে বিচারক মাহুয়ানকে বেকসুর খালাস দেন।
লীলাধরের শাস্তির জন্য অটলবিহারী বাজপেয়ীর বিবৃতিই দায়ী ছিল তা এককথায় বলা যাবে না। অটল বিহারীকেও বিচারপ্রক্রিয়ায় সাক্ষী হিসেবে হাজির করা হয়নি। তবে এটা অনস্বীকার্য যে, এই কেশে লীলাধরকে অভিযুক্ত হিসেবে প্রমাণ করার ক্ষেত্রে এই বিবৃতি যথেষ্ট সাহায্য করেছিল।
বটেশ্বরের এই বিদ্রোহ যত ক্ষুদ্র পরিসরেই হোক না কেন এটা স্বতঃস্ফূর্ত ছিল না। পুরোটাই পরিকল্পনামাফিক হয়েছিল। এক সাক্ষাৎকারে লীলাধর জানাচ্ছেনঃ “৯ আগস্টের পর সমস্ত স্কুল, কলেজ বন্ধ হয়ে গেল। বিশে আগস্ট আমি বটেশ্বরে পৌঁছলাম। তখন আরও অনেক ছাত্র গ্রামে ফিরে এসেছে। আমাদের গ্রামের দুজন স্বাধীনতা সংগ্রামী - অমরনাথ দীক্ষিত এবং বাগলা গ্রেপ্তার হয়ে গেছে। আমরা সবাই বিক্ষুব্ধ ছিলাম। আমাদেরই একটা গোষ্ঠী ঠিক করল, একটা কিছু আমাদের অবশ্যই করতে হবে। আমরা জানতাম ২৭ আগস্ট একটা বড়ো মেলা আছে। আমরা ঠিক করলাম, এই অনুষ্ঠানটাকে ব্যবহার করে আমরা মেলায় গান্ধীজির আবেদনটা পাঠ করব আর কিছু কর্মসূচি নেব।” যেহেতু বটেশ্বরের চারদিকের এলাকাকে অরণ্যভূমি ঘোষণা করায় সেখানে গ্রামবাসী এবং তাঁদের গবাদি পশুদের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ ছিল, তাই অরণ্য আইন ভাঙার ডাকটা বেশি কার্যকর হবে বলে তাঁরা ভেবেছিলেন। প্রসঙ্গত, ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় লীলাধরও অটলবিহারীর মতোই গোয়ালিয়রেই, অন্য একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মোরার হাই স্কুলে পড়তেন।
১৯৯৭ সাল থেকে বিজেপি অটল বিহারী বাজপেয়ীকে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের হিরো হিসেবে প্রোজেক্ট করে প্রচার শুরু করে। ওই বছর ১৫ আগস্ট হিন্দি ‘দৈনিক জাগরণ’ পত্রিকায় বাজপেয়ীর লেখা একটা প্রবন্ধ প্রকাশ হয়। যাতে ১৯৪২ সালের ২৭ আগস্ট বটেশ্বরে কী হয়েছিল এবং তাঁর গ্রেপ্তারের বিষয়টা বর্ণনা করেন বাজপেয়ী। কিন্তু প্রবন্ধের কোথাও তিনি নিজের নির্দোষের পক্ষে সাফাই দেওয়া বিবৃতির কথা উল্লেখ করেননি। ওই বছরের ২৫ ডিসেম্বর বাজপেয়ীর জন্মদিনে দেশের বহু দৈনিকে বিজ্ঞাপনী ক্রোড়পত্রে বাজপেয়ীর সংক্ষিপ্ত জীবনী বের হয়। তাতেও লেখা হয়, বাজপেয়ী ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে ১৯৪২ সালে গ্রেপ্তার হন, এবং স্বাধীনতার দাবিতে সোচ্চার হয়েছিলেন। দৈনিক জাগরণের লেখায় বাজপেয়ী বটেশ্বরের ঘটনায় নিজের অংশগ্রহণকে এমনভাবে উপস্থাপন করেছিলেন, যাতে মনে হয়, ব্রিটিশ শাসনকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে ওই বিদ্রোহে তিনি মূল ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। এরজন্যই তাঁকে রাষ্ট্রের নিপীড়নের মুখোমুখি হতে হয়েছিল।
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে আরএসএস কিংবা হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির কোনো মৌলিক সম্পর্ক ছিল না। যেটা তাদের ছিল তা হলো বিশ্বাসঘাতকতার সম্পর্ক কিংবা স্বাধীনতা আন্দোলনের থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখা। স্বাধীন ভারতে নির্বাচনী রাজনীতিতে এটা প্রকাশ হয়ে গেলে তো বিপদ। তাই বারবার ইতিহাস বিকৃতির আশ্রয় নিতে হয়েছে আরএসএস এবং বিজেপি-কে। ১৯৯৭ সালে বাজপেয়ী এবং বিজেপি’র ওই প্রয়াসগুলি ছিল তাদের সেই ইতিহাস বিকৃতি করার কর্মসূচিরই অঙ্গ। কিন্তু আরএসএস-বিজেপি’র এই অপচেষ্টার মুখোশ খুলে দিয়েছিল ইংরেজি পাক্ষিক ‘ফ্রন্টলাইন’। ১৯৯৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারির সংখ্যায় মানিনী চ্যাটার্জি এবং ভি কে রামচন্দ্রনের তদন্তমূলক লেখায় আরএসএস-বিজেপি’র বটেশ্বর নিয়ে ইতিহাস বিকৃতির বিষয়টা প্রকাশ হয়ে পড়ে। সারা দেশ জানতে পারে প্রকৃত ইতিহাসটা - বটেশ্বরে ১৯৪২ সালের ২৭ আগস্ট ও তার পরবর্তী সময়ে ঠিক কী হয়েছিল। এবং নিজেকে নির্দোষ হিসেবে বর্ণনা করে বাজপেয়ীর দেওয়া সাফাই বিবৃতির কথাও। ওই সংখ্যাতেই এন রামের নেওয়া অটল বিহারী বাজপেয়ীর একটা সাক্ষাৎকারও প্রকাশ হয়েছিল। যেখানে বাজপেয়ী সমস্ত বিষয়টা স্বীকার করে নেন। তবে ওই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, উর্দু তিনি পড়তে পারতেন না। তাই ওই বিবৃতিতে কী লেখা ছিল তা তাঁর পক্ষে জানা সম্ভব হয়নি। কিন্তু ওই সাফাই বিবৃতির তলায় ম্যাজিস্ট্রেট এস হাসানের স্বাক্ষর করা নোটে পরিষ্কার লেখা ছিলঃ “তাঁকে (অটল বিহারী বাজপেয়ী) সম্পূর্ণটা পড়ে শোনানো হয়েছে”।
ইতিহাস বিকৃতি করার এই সংস্কৃতি আরএসএস-বিজেপি’র রাজনৈতিক কর্মসূচির অঙ্গ। এটা তারা কোনোদিন ত্যাগ করতে পারবে না। তাহলে তাদের রাজনৈতিক অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়বে। আমরা সবাই বীর সাভারকরের ‘মারসি পিটিশনে’র কথা জানি। সম্প্রতি আরএসএস’র পক্ষ থেকে সুকৌশলে প্রচার করা হয় যে, সাভারকর এই মারসি পিটিশন দাখিল করেছিলেন গান্ধীজির নির্দেশে। যেটা সর্বেব মিথ্যা। বিভিন্ন মহল থেকে প্রতিবাদ এবং প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরার পরই আরএসএস-বিজেপি বিষয়টা নিয়ে চুপ করে যায়। মিথ্যা ইতিহাসকে আর এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা তারা করেনি।
এবছর যেমন স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্ণ হলো, একইভাবে ২০২২ সাল ভারত ছাড়ো আন্দোলনেরও ৮০ বছর। দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে নিজেদের বিশ্বাসঘাতকতার এই ইতিহাসকে চাপা দিতেই অমিত শাহ স্বাধীনতার ইতিহাস নতুনকরে লেখার ডাক দিয়েছেন। দেশের গণতান্ত্রিক শক্তির দায়িত্বই হচ্ছে, এই অপচেষ্টাকে প্রতিহত করে দেশবাসীর সামনে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রকৃত ইতিহাসকে তুলে ধরা। এটা নিশ্চিতভাবেই একটা দেশপ্রেমিক কর্তব্য।