৬০ বর্ষ ৩ সংখ্যা / ২৬ আগস্ট, ২০২২ / ৯ ভাদ্র, ১৪২৯
দূষিত কলকাতা এখন বিশ্বের দ্বিতীয় স্থানেঃ দায় কার?
তপন মিশ্র
আবর্জনার দহন বায়ুদূষণের অন্যতম প্রধান কারন।
অতি সম্প্রতি প্রকাশিত পিটিআই’র খবর বলছে যে, বায়ুদূষণে আমাদের রাজ্যের প্রিয় রাজধানী শহর কলকাতা এখন বিশ্বের অন্যান্য অনেক শহরকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। আমেরিকার হেলথ এফেক্ট ইনস্টিটিউট (এইচইআই) বায়ুদূষণ সম্পর্কিত একটি সমীক্ষা প্রকাশ করে। ১৮ পাতার মূল প্রতিবেদনটি ইন্টারনেটে পাওয়া যায়। সমীক্ষাতে বলা হয় যে, পৃথিবীর ১০৩টি জনবহুল শহরের মধ্যে বায়ুদূষণের দিক দিয়ে কলকাতা দ্বিতীয় স্থানে। বায়ুদূষণের দু’টি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান যেমন পিএম-২.৫ এবং NO2 নিয়ে এই সংস্থা বিশ্বের প্রায় ৭,২৩৯ শহরে উপগ্রহ নির্ভর তথ্য এবং তারসাথে সরাসরি বায়ুমণ্ডল থেকে সংগৃহীত তথ্যের সমন্বয় ঘটিয়েছেন। প্রথম রিপোর্টটি প্রকাশিত হয় কেবল সারা বিশ্বের ১০৩টি জনবহুল শহরগুলির প্রাপ্ত তথ্য থেকে। এই শহরগুলির মধ্যে প্রথম স্থানে রয়েছে আমাদেরই দেশের রাজধানী দিল্লি। কেবল পিএম-২.৫-এর বিচারে বিশ্বের প্রথম ২০ শহরের মধ্যে আমাদের দেশের ১৮টি শহর রয়েছে।
এইচইআই-র তথ্যে বিব্রত রাজ্যের পরিবেশ মন্ত্রী রাজ্য পরিবেশ দপ্তর এবং দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের সঙ্গে সভা করে জানান যে, কলকাতা শহরের দূষণের জন্যে উত্তর ভারত এবং ঝাড়খণ্ড থেকে ভাসমান ধূলিকণা দায়ী। তাঁর দাবি কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের তথ্য অনুযায়ী, বাতাসে পিএম ২.৫-এর গড় মাত্রা প্রতি ঘনমিটারে ৪০ মাইক্রোগ্রাম। এই তথ্যও যদি ধরেনিই তা হলেও ক্ষতিকরমাত্রা থেকে এই পরিমাণ প্রায় ৮ গুণ বেশি।
বাতাসে ঘাতক দুই বিষের কথা
পিএম-২.৫ বলতে বোঝায় বাতাসে ভাসমান একটি দূষণকারী কণা যার ব্যাস ২.৫ মাইক্রন বা মাইক্রোমিটার (এক মিটারের দশ লক্ষ ভাগের এক ভাগ)। মানুষের চুলের গড় ব্যাস ৫০ মাইক্রন। বায়ুতে ভাসমান কণার আকার অনুসারে কণা পদার্থকে বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। এর অন্যতম একটি কারণ হলো, বিভিন্ন আকারের কণার মানব স্বাস্থ্যের উপর ভিন্ন ভিন্ন প্রভাব ফেলে। উদাহরণস্বরূপ, পিএম-১০ কণা (আকারে ১০ মাইক্রন) মানুষের নাক এবং চোখে জ্বলন ঘটায়, কিন্তু এই কণাগুলির মধ্যে খুব কমই ফুসফুসের গভীরে প্রবেশ করতে পারে। কারণ প্রবেশের আগেই এগুলি নাকের লোম, শ্লেষ্মা এবং অন্যান্য প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাগুলির দ্বারা আটকে যায়। কিন্তু অত্যন্ত ছোটো কণাগুলি (পিএম-২.৫) প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাগুলিকে ফাঁকি দিয়ে আমাদের ফুসফুসের গভীরে অর্থাৎ অ্যালভিওলিতে পৌঁছে যায় এবং রক্তপ্রবাহে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়। তাই এগুলি অনেক ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করে।
নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড (NO2) শহরাঞ্চলে একটি সাধারণ বায়ুদূষণকারী গ্যাস যার প্রধান উৎস হলো পরিবহণ শিল্প, বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং অন্যান্য উৎপাদন শিল্প। এটি নাইট্রোজেন অক্সাইড (NOx) গ্রুপের অন্তর্গত এবং অত্যন্ত ক্ষতিকর গ্যাসগুলির মধ্যে একটি। এই গ্রুপের গ্যাসগুলি বায়ুদূষণের একটি সূচক হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
পিএম-২.৫ এবং অন্যান্য বায়ুদূষকদের তুলনায় NO2-এর জীবনকাল কম কারণ এই গ্যাস অন্যান্য গ্যাসীয় উপাদানগুলির সঙ্গে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে। শিশুদের মধ্যে হাঁপানি রোগের মূল কারণ হলো এই গ্যাস।
যেন মৃত্যুর দূত
এইচইআই-এর গ্লোবাল হেলথ প্রোগ্রাম স্বাস্থ্যের ওপর বায়ুদূষণের প্রভাব সম্পর্কে ভালোভাবে বোঝার জন্য বিশ্বজুড়ে গবেষণার সঙ্গে যুক্ত। এই সংস্থা ভারতের অল ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ মেডিক্যাল সায়েন্স এবং দিল্লির আইআইটি-র সঙ্গে বায়ুদূষণ এবং তার প্রতিকার সম্পর্কিত বিভিন্ন গবেষণা করছে।
বায়ুদূষণ, বিশেষকরে বায়ুমণ্ডলের পিএম-২.৫-এর আধিক্য, বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ বয়স্ক মানুষ এবং শিশুদের স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। প্রতিবছর, বায়ুদূষণের সংস্পর্শে মৃত্যু এবং অক্ষমতার পাশাপাশি শ্বাসযন্ত্র এবং কার্ডিওভাসকুলার (হৃদযন্ত্র সংক্রান্ত) রোগ, ডায়াবেটিস এবং নবজাতকের ত্বক এবং শ্বাস সম্পর্কিত ব্যাধি সহ বিভিন্ন রোগের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। মানুষের স্বাস্থ্যের উপর বয়ুদূষণের এই প্রভাব কোনো এক দেশের মোট উৎপাদনশীলতা হ্রাস করতে পারে। আমেরিকার হেলথ এফেক্ট ইনস্টিটিউটের একটি হিসাবে বলছে যে, কলকাতায় ২০১১ সাল থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে কেবল পিএম-২.৫-এর জন্য ১,৮৫,৩৯০ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। দিল্লিতে এই সময়কালে মৃত্যুর সংখ্যা ২,৪১,৩১০। চীনের বেজিং শহরে একারণে মৃত্যুর সংখ্যা ২,১০,১৭০। অর্থাৎ প্রথমে দিল্লি তারপর বেজিং এবং তৃতীয় স্থানে রয়েছে কলকাতা। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ভারতের পরে, ইন্দোনেশিয়ায় পিএম-২.৫ দূষণ সবচেয়ে মারাত্মক বৃদ্ধি পেয়েছে। পরবর্তীকালে চীনে বায়ুমণ্ডলের গুণমানের অনেকটা উন্নতি ঘটে। ফলে সম্প্রতি পাওয়া পৃথিবীতে যে ২০টি শহরে পিএম-২.৫ দূষণ সবচেয়ে বেশি কমেছে সেগুলি সবগুলোই চীনের। ইতিমধ্যে চীন বিভিন্ন পরিকল্পনার মধ্যদিয়ে দূষণের পরিমাণ হ্রাস করার পরিকল্পনা নিয়েছে। আমাদের দেশের শহরগুলিতেও কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। ২০১৩ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত বায়ুদূষণের কারণে মৃত্যুর হার বৃদ্ধি পেয়েছে ১৩.৭ শতাংশ।
২০১৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি টাইমস অফ ইন্ডিয়া’তে একটি খবর প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, চীন এবং ভারতের ক্রমবর্ধমান বায়ুদূষণের কারণ পিএম-২.৫। কিন্তু ভারতে এই ক্ষুদ্রকণার কারণে মৃত্যুহারের বৃদ্ধি চীনের তুলনায় অনেক বেশি। কুয়াশা দৃশ্যমানতা হ্রাস করে এবং সড়ক দুর্ঘটনার সম্ভাবনা বাড়ায়। পারটিকুলেট ম্যাটার (পিএম) একটি দাগ ফেলে যা বস্তুবাদী পরিবেশকে প্রভাবিত করে যেমন ভবন, মূর্তি, স্মৃতিস্তম্ভ ইত্যাদি।
উৎস কোথায়
যানবাহন থেকে নির্গমন, নির্মাণ শিল্প, কয়লা দহন, পাতা ও কাঠ পোড়ানো, খড় পোড়ানো, ধাপায় এবং অন্যান্য স্থানে ঢিপি করা ময়লা পোড়ানো এবং জৈব জ্বালানি ব্যবহারের ফলে বায়ুমণ্ডলে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণার ঘনত্ব বৃদ্ধি পায়। তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বা ডিজেলচালিত জেনারেটর থেকে গ্যাসীয় নির্গমন বায়ুমণ্ডলে বিক্রিয়া করে এবং কণা পদার্থ তৈরি করে। এছাড়াও পিএম-২.৫ তামাক ধূমপান, মোমবাতি জ্বালানো, বদ্ধ স্থানে রান্নার করার সময় ইত্যাদি থেকেও উৎপন্ন হয়ে বাতাসে চলে আসে। কলকাতা শহরে সাধারণ নিয়ম না মেনে ঘরবাড়ি তৈরির কাজ এই ক্ষুদ্র কণা নির্গমনের একটি প্রধান কারণ। এগুলির উপর নিয়ন্ত্রণের কথা সরকার মুখে বললেও কার্যত বাস্তবে কাজের কিছু হয়না। যেমন ধরা যাক, যানবাহনের ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণের যে ব্যবস্থা ২০০৯ সালে বামফ্রন্ট সরকারের আমলে কলকাতা এবং পরে সারা বাংলায় করা হয়েছিল, ২০১১ সালের পর তার উপর নজরদারিই করা হয়নি। ১৫ বছরের বেশি বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহৃত হয় এমন গাড়িগুলির চলাচলের উপর নিয়ন্ত্রণ করা হয়নি। ধাপা এবং অন্যান্য স্থানে ময়লা পোড়ানোর উপর নিয়ন্ত্রণে কোনো ব্যবস্থা সরকার বা কলকাতা করপোরেশন কেউই নেইনি। ফলে দূষণ ক্রমবর্ধমান।
এইচইআই’র রিপোর্টে দেখা যায় যে, ২০১৯ সালে কলকাতার বার্ষিক গড় পিএম-২.৫ মাত্রা ছিল প্রতি ঘনমিটারে ৮৩.৯৫ মাইক্রোগ্রাম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দ্বারা নির্দিষ্ট করা হয়েছে যে, ৫ মাইক্রোগ্রাম হলো নিরাপদ সীমা। ভাবতে কষ্ট লাগে যে, কলকাতার দূষণ এই নিরাপদ সীমা থেকে প্রায় ১৭ গুণ বেশি। দিল্লিতে কখনও কখনও পিএম-২.৫-এর পরিমাণ ১১০ মাইক্রোগ্রামে পৌঁছে যায়।
দূষণ কমাতে হলে
প্রথমেই বুঝে নেওয়া দরকার যে, কোনো ব্যক্তি উদ্যোগ বা সদিচ্ছা আমাদের এই বিপদ থেকে বাঁচাতে পারবে না। কেবল আইন করেও আমরা রেহাই পাবো না। দরকার হলো আইন প্রয়োগ করার ক্ষমতা। আমাদের সরকার করপোরেটদের পদলেহন করার কারণে সেই ক্ষমতা হারিয়েছে। বায়ুদূষণ সর্বব্যাপী, তাই কেন্দ্রীয়, রাজ্য এবং আঞ্চলিক সরকারগুলির যৌথ কর্মকাণ্ড ব্যতিরেকে দূষণ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। অত্যন্ত দুষিত বায়ুমণ্ডলের মধ্যে আমাদের বেঁচে থাকার দায় কে নেবে? কেন্দ্রীয় সরকার, রাজ্য সরকার বা কলকাতা করপোরেশন কেউই এব্যাপারে ভাবিত নয়। বার বার মাননীয় হাইকোর্টের রায় সরকারকে উদ্যোগী হওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। খোদ দেশের রাজধানীর অবস্থা যদি সরকারের নিয়ন্ত্রণে না থাকে তবে দেশের অন্যান্য শহর কোথায় যাবে। বিশেষজ্ঞদের মত অনুযায়ী ন্যূনতম কয়েকটি বিষয়ের উপর জোর দিলে কলকাতার মানুষকে অনেকটাই স্বস্তি দেওয়া যেত।
প্রথমত, অনিয়ন্ত্রিত আবর্জনা পোড়ানো থেকে বিরত থাকতে হবে। মাঝে মাঝে ধাপায় এবং অন্যান্য আবর্জনার স্তূপে প্লাস্টিক সহ অন্যান্য আবর্জনা পোড়ানো হলে বিষাক্ত গ্যাস নির্গত হয় যার মধ্যে পিএম-২.৫ এবং NO2 উভয়ই থাকে। এই কাজ কলকাতা করপোরেশন বা দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের পক্ষে রোধ করা অসম্ভব নয়।
দ্বিতীয়ত, কলকাতায় গণপরিবহণ ব্যবস্থায় বিদ্যুৎচালিত গাড়ির সাথে সিএনজি-চালিত গাড়ি বাধ্যতামূলক করা গেলে দূষণের পরিমাণ হ্রাস হতে পারে। ২০০৯ সালে কাটাতেল-চালিত অটোকে প্রশাসনিক ব্যবস্থা এবং সরকারি সহায়তায় গ্যাসচালিত অটোতে রূপান্তরিত করার সময় রাজনৈতিক বিরোধিতা হলেও তৎকালীন সরকার এই পরিবর্তন করতে সচেষ্ট ছিল। তাই সেই সময়ে শহরের বায়ুদূষণের পরিমাণ কিছুটা হ্রাস পায়। এখন শহরে কিছু বিদ্যুৎচালিত গাড়ি চলছে যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সামান্য।
তৃতীয়ত, বাড়ি বা রাস্তার নির্মাণ কাজ করার সময় বায়ুতে মাটি, সিমেন্ট, ডিজেলচালিত ইঞ্জিনের দূষণ রোধের জন্য যে আইনগুলি রয়েছে তা কলকাতা করপোরেশন এবং রাজ্য সরকার সহজেই প্রয়োগ করতে পারে।
অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলির সঙ্গে উচ্চআয়ের দেশগুলিতে দূষণের প্রবণতার মধ্যে একটি ব্যবধান লক্ষ করা যায়। এইচইআই-র প্রতিবেদন অনুসারে, নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলিতে অবস্থিত শহরগুলিতে পিএম-২.৫ দূষণের প্রবণতা বেশি থাকে। কিন্তু NO2-র দূষণ সব ধরনের দেশের শহরগুলিতে পাওয়া যায়। এখানে জরুরি সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছার এবং একটু মানবিক হওয়ার।